top of page
Search

অক্ষয় সংখ্যা ।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। অয়ন ঘোষ


ধুলোমুঠির গান


অয়ন ঘোষ



"আচ্ছা, এইভাবে থাকা যায়? আর কতদিন কে জানে?" এই দুটো বাক্য আপাতত আমাদের সবার রিংটোন। এই স্বেচ্ছা বন্দিতে আমরা সবাই হাঁপিয়ে উঠেছি। আসলে এইটি নিয়ম। যখন কাজ ছিল তখন বিশ্রাম বিশ্রাম করে হাঁপিয়ে উঠতাম, এখন দিনরাত বিশ্রাম আছে, কাজ কাজ করে হেদিয়ে মরছি। ঘরে থেকে থেকে হাত পায়ে জং ধরে গেলো। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে পরে সব স্বাভাবিক হলেও আর বোধহয় হাত পায়ের জোর পাবো না, বাইরে বেরোনোর।



আর আমার মতো যারা ৯০০ স্কোয়ার ফুটের সম্রাট, তাদের কথা ছেড়েই দিলাম। নিজেকে এখন মনে হচ্ছে একটি সুসজ্জিত চিড়িয়াখানার অসুখী বাসিন্দা। গাঁয়ের ছেলে আমি বাড়ির উঠোনটাই ১৫০০ স্কোয়ার ফুট হবে,লক্ষ্মীর মন্দিরে দাওয়ায় ছিল খেলামপাতির শৈশব। তার জায়গায় আধুনিক জীবনের এই 3BHK বা 2BHK নামক গালভরা খুঁড়োর কলে আটকে প্রাণ আইঢাই, প্রায় কোনো খাবারই হজম হচ্ছে না। সকালে উঠছি, ব্রাশ করছি, খেয়ে একটু আধটু বাড়ির কাজ, পড়া, টিভি দেখা, গিন্নির সাথে গল্প, গল্প দীর্ঘায়িত হলে অবধারিত ভাবে খেলা গড়াচ্ছে ঝগড়ায়, এর মাঝে কন্যা রেফারি। দুই বুড়োবুড়ির মাঝে পরে বেচারির স্যান্ডুইচ অবস্থা। এরপর আবার পড়া আবার টিভি, নিজের সাথে কথা, কথার পিঠে কথা সাজিয়ে নিজেকেই ঠকানো। ট্রেনের একই বগিতে সফর, তাই যেতে আসতে দেখা হয়ে যাচ্ছেই। সহযাত্রীর সাথে কথা না বলাটা ভারী অভদ্রতা। তাই চায়ের সাথে বিস্কুটের মতো পুনরায় একই প্লেটে ঠাঁই। যেহেতু এখন গরম কাল তাই বরফ গলবেই, নিয়ম মেনে কথা শুরু তারপর আবার গোল গোল ঘুরে ঘুরে সেই ভালোবাসায় থুড়ি ঝগড়ায় শেষ। ভয় নেই মাথার ওপর কন্যা আছে, সে ঠিক সামলে নেবে। আর মা বলেন ঘটি বাটি এক জায়গায় থাকলে অমন একটু ঠোকাঠুকি লাগবেই, ওতে অসুবিধে নেই বরং তাতে নাকি সম্পর্ক আল্ট্রেটক সিমেন্টের মতো মজবুত হয়। কে বাটি আর কে ঘটি, এই নিয়ে আমি মুখে কুলুপ আঁটলাম। এইসব বিষয়ে কিন্তু আমি মায়ের খুব বাধ্য ছেলে। এও জানি নিশ্চিত ওই ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিকটুকু না থাকলে দাম্পত্য নামক দিল্লীর লাড্ডুটি ভারী পানসে লাগে, স্বাদ পাওয়া যায় না। (এ ঘটনা কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে কাল্পনিক, কেউ যদি এর সাথে নিজের জীবনের মিল পান, তা নেহাতই কাকতালীয়)।



এতো গেলো সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টার রুটিন। কিন্তু এই রুটিনের ফাঁকে ফাঁকে যে অবসরটুকু পাচ্ছি, তার গল্প একটু শোনাই। আমি নিজেও জানতাম না কতো যত্নে এই সংসার আমায় বেঁধে রেখেছে। দুটো নাকে মুখে গুজে, সকাল ৭.৫৫ ট্রেনে হরিপাল, ফিরতে বিকেল সাড়ে চারটায় থেকে পাঁচটা। এর সাথে রোজই লেগে থাকতো সাহিত্যসভা, সমিতি, কবিতা ও নানা রকমের সামাজিক, অসামাজিক অনুষ্ঠান। বই, ছাত্রছাত্রী, কলেজ আর কবিতা নিয়েই বেঁচে ছিলাম আমি। এরই ফাঁকে মেয়েটা কখন ক্লাস এইট হলো, খুব ভালো করে চেয়ে দেখিনি। হ্যাঁ, যদি বলেন দায়িত্ব পালনের কথা, করেছি অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে। সেটা সব ছিল কি! আমি ভাবতাম ওটাই সব, হয়তো বা। বাইরের পৃথিবীর খবর নিতে নিতে আমরা পাশের বালিশের ওপর মাথা পেতে রাখা মানুষটার মনের খবর নিতে ভুলে যাই, শরীরের খবর নিই অভ্যাস মতো। শরীরের নিয়মে শরীর বাঁচে, মন যদি না বাঁচে! আগুন শৃঙ্গার আমাদের খুব প্রিয়, ঠিক মতো না ছুঁলে, হাত পুরে যাবার সম্ভাবনা অনেক। মনে রাখতে হবে আগুন আবার শুধু পোড়ায় না, শুদ্ধও করে।



কিন্তু ঘরের পাশের শিশির বিন্দুতে আমাদের চোখ আর কবে থেমেছে। আমরা তো সুদূরের পিয়াসী। এই অবসর দেখতে শেখালো সকালের নরম আলো কি ভাবে শিয়রের জানালায় এসে থামে। ক্লান্ত বেডশিটে ঘুমিয়ে থাকা সংসার শীতের নরম হিমের মতো মায়াময়। হিং ফড়োনের গন্ধেও বসন্ত আসে। মায়ের হলুদ মাখা আঁচলের পুরনো গন্ধটা বাড়িময় ম ম করে। ৯০০ স্কোয়ার ফিট এক ঝটকায় ছুঁয়ে ফেলে ৯ মাইল বা ৯০০ মাইলের দূরত্ব, সত্যিই মনে হয়, "একসাথে থাকার কোনো ভূগোল হয় না"। চুপচাপ সারাদিন মন পেতে দেখি কি নিপুণ কৌশলে কাটা হয় শাক পাতা। ভালোবাসার ছোয়ায় সাধারণ লাউ খোলাও অমৃত লাগে। সকল অহংকার চোখের জলে ভেসে যায় নদী হয়ে।

( চলবে ... )



55 views0 comments
bottom of page