ওজনের ওজন
স্নেহা নাগ
(পর্ব-২)
বাবা আর দাদাকে বিদায় জানিয়ে তিন্নি তার ভারী মন নিয়ে ক্লাসে এসে পৌছালো। বুকের ভিতরটা কেমন যেন ধড়ফড় করছে তার। অচেনা শহরে অচেনা মানুষের ভিড়ে নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে। এতোক্ষন তার আশেপাশের মানুষদের দেখে তার অদ্ভুত মনে হলেও, ক্লাসের আর পাঁচ জনের মাঝে তার নিজেকে কোনো এলিয়েনের থেকে কম কিছু মনে হলো না। করিডোরের লম্বার রাস্তা পার করে আসার সময় সে অবাক হয়ে ছেলে মেয়েদের সাজ পোশাক দেখছিলো আর মনে মনে ভাবছিলো 'এ কেমন জায়গা রে বাবা, এরা পড়তে এসেছে না ফ্যাশন শো তে!' কিন্তু ক্লাসে ঢুকে সে প্রত্যক্ষ করে, যে এখন বাকিরা তার দিকে ওই একই দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগলেও সে তাতে বিশেষ পাত্তা দিলো না, বরং নিজের মনে কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা এসে বোর্ডের সামনে ফার্স্ট ডেস্কে এসে বসে ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে পড়তে শুরু করল।
ইতিমধ্যে ক্লাসে তাকে নিয়ে নানান গুজগুজ ফুসফুস শুরু হয়ে গেছে। সবাই সবাইকে আড়চোখে ইশারা করে তিন্নিকে দেখাচ্ছে আর তারপর ফিকফিক করে হেসে নিজেদের মনোরঞ্জন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তিন্নি সবটা অনুভব করতে পারলেও নির্বিকার চিত্তে বসে রইলো। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নির্বাণ বাবু তাকে ডেকে বলেছিলেন,
"শোনো মা, তুমি এখন বাইরে যাচ্ছ। এখন থেকে তোমার চলার পথ কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে আমি বা তোমার দাদা দুজনের কেউই থাকবো না। তাই নিজের অধিকার এখন থেকে তোমায় নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। হ্যাঁ, তবে তা অবশ্যই বুদ্ধি আর কৌশল দিয়ে। সবসময় মনে রাখবে তোমার আশেপাশে বন্ধুও আছে আবার শত্রুও। এদের মধ্যে থেকেই তোমায় ভালোটা বেছে নিতে হবে, তবে তা তোমার ভালো ব্যবহার দিয়ে। কখনোই কোনো কথায় উত্তেজিত হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারাবে না। উত্তপ্ত পরিবেশে যে ঠান্ডা মাথায় কাজ করে সেই কিন্তু জয়ী।"
তাই ক্লাসের সবাই যখন নীরবে নিজেদের অভিব্যক্তি দিয়ে তাকে বিরক্ত করছিলো, সে নিজের মতোই চুপ করে পরিস্থিতির গভীরতা মাপতে শুরু করে দিলো। ঠিক তখনই, একজন এসে তিন্নিকে বলল,
"হে ইউ, গো এন্ড সিট নেক্সট। আই ক্যান্ট সি দ্যা বোর্ড ফর ইউর হিউজ ফিজিক।"
কথাটা শুনে বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে তিন্নি দেখলো, তার সামনে চিউইংগাম চিবোতে চিবোতে একটি কল্কালসম মেয়ে বিদঘুটে একটা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রং ফর্সা হলেও তার শরীরে মাংস বলে কোনো পদার্থ নেই। শুধুই হাড় আর চামড়া। তার কণ্ঠীর খাঁজে খুব সহজেই কাপ কেক সংগ্রহ করে রাখা যাবে। মেয়েটিকে দেখে তিন্নি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না, ফিক করে হেসে ফেললো। তাই দেখে মেয়েটি তো রেগে লাল। সাথে সাথে বিদেশী ভাষা ছেড়ে সোজা নেমে এলো মাতৃভাষায়। ক্যাট ক্যাট করে তিন্নিকে উঠে গিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসতে বলতেই, সেও মিষ্টি সুরে জবাব দিয়ে বলল,
"আজ তো আমি আগে এসেছি, তাই আজ আমি প্রথমে বসি; তুমি বরং কাল একটু আগে এসে ফার্স্ট বেঞ্চে বসো।"
বলে সে আবার তার বইয়ের পাতায় মনোনিবেশ করলো আর সেই মেয়েটি রাগে গজগজ করতে করতে তার পিছনের ডেস্কে এসে বসলো। ইতিমধ্যে ক্লাসে ম্যাডাম এসে হাজির। তারপর ইন্ট্রোডাকশনের মাধ্যমে শুরু হলো ক্লাস।
*****
ভালোয় ভালোয় ক্লাস শেষ হলে সকলে যখন নিজেদের মতো আলাপ আড্ডায় ব্যস্ত, তিন্নি তখনও একাই বসে আছে। কেউই বিশেষ তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। বলবেই বা কেনো, তার মতো বেঢপ মোটা মেয়ের সাথে কথা বলতে কারই বা ভালো লাগবে! ক্লাসের ছেলেরা সকলে আগ্রহী ছিলো সুন্দরী হাড়গিলে মেয়েদের প্রতি। আর মেয়েরা আড়চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে। কিন্তু সব কিছুর মাঝে একজন ছিলো যে নিজের মনে কিছু একটা ভাঁজছিলো।
পরপর দু তিনটে ক্লাসের পর অবশেষে লাঞ্চ ব্রেক হয়। তিন্নির সব থেকে প্রিয় সময়। সেই কখন খেয়েছে সে, তারপর জল ছাড়া র কিছুই জোটে নি। তাই বেল পড়ার সাথে সাথেই সে হুড়মুড় করে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে ডেস্ক থেকে বেরোতে যাবে, তখনই সেই হাড় কঙ্কাল বের করা মেয়েটি তিন্নির পিঠে হাত রেখে তাকে ডাকলো এবং মেকি হেসে তিন্নিকে বলল,
"হে, সরি ইয়ার। আসলে সবসময় প্রথমে থাকতে থাকতে এখন কেমন যেন অভ্যেস হয়ে গেছে। তাই প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় জিনিস কিছুতেই আমার পছন্দ হয় না......বাই দ্যা ওয়ে, আমার নাম প্রিয়া।"
প্রথম পরিচয়ের তিক্ততা তার মিতভাষা নিমেষে মিলিয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে এবং তিন্নিও মৃদু হেসে বলল,
"আমার নাম শ্রীলেখা। তবে তুমি আমায় তিন্নি বলেও ডাকতে পারো।"
নাম শুনে প্রিয়া তাকে বলল,
"চলো ক্যান্টিনে যাই।"
মনের মতো প্রস্তাব শুনে মুহূর্তে রাজি হয়ে গেলো তিন্নি। তারপর তার চললো ক্যান্টিনের দিকে।
*****
একদিকে প্রিয়ার ক্যাট ওয়াক দেখে কোনো মডেল ছাড়া বিশেষ কিছু মনে হয় না, অন্য দিকে তিন্নির এলোমেলো হাটা। কলেজের সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তবে তিন্নি এটা বুঝতে পারছিল না যে সবাই তাকে দেখে এমন পাগলের মতো হাসছিলো কেন! প্রথমে একটু অদ্ভুত লাগলেও, খিদের জ্বালায় তিন্নি আর কনোদিকে তাকালো না, বরং আরো তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ক্যান্টিনে এসে উপিস্থিত হলো।
সে আরো এক আজব জায়গা। ক্যানিয়নের সব কাউন্টার গুলো যেনো মাছি মারছে। সবাই বসে আছে ঠিকই তবে সকলেরই যেন খাদ্যে অনীহা। সবাই স্লিম থাকতে চায়। একটু ভালো করে কান পেতে শুনলে জানা যাবে যে তাদের বেশ কয়েকজন তো ডায়েটিং নিয়ে জ্ঞান দিতে ব্যস্ত। তাদের দেখে তিন্নির কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগতে শুরু করলো। তাই সে খাদ্যের যোগ্য মর্যাদা দিতে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে কাউন্টার থেকে পিজা, বার্গার, কোল্ড ড্রিংক ও দু তিনটে পেস্ট্রি কেক নিয়ে সামনের টেবিলে এসে বসল, সাথে এলো প্রিয়া। কিন্তু যখনই সে খাওয়া শুরু করল, তখনই সবাই তাকে দেখে হোহো করে হাসতে লাগলো। তিন্নি কিছুই বুঝতে পারছিলো না। অনেকক্ষন ধরেই তার সাথে এই ঘটনা ঘটতে থাকলে এবার সে একটু সজাগ হয় এবং ব্যথিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে জিজ্ঞেস করল,
"তোমরা সবাই হাসছো কেন?"
"কি হয়েছে?"
কিন্তু জবাবে ফিরে এলো আরো অট্টহাসির ঢেউ। প্রিয়াও কোনো প্রতিবাদ করছিল না বরং সেও মিটিমিটি হাসছিলো। এবারে তিন্নি নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। অজানা অপমানে ও লজ্জায় তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল রুপোলি জলের ধারা। নিজেকে ভীষণ একা লাগতে শুরু করেছিল তার আর তাই তো সে মনে মনে নিজের দাদাকে বারবার ডাকতে লাগলো।
তার এই প্রার্থনা হয়তো স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে পৌঁছেছিলো, তাই তো তিনি সকলের মাঝে তার দূত হিসেবে পাঠিয়ে দিলে এমন একজনকে যে তাকে এই অপমান থেকে রক্ষা করতে পারতো। ক্যান্টিনের একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলো তিন্নি। কি করবে বুঝে উঠতে পাড়ছিলো না সে। তখনই পিছন থেকে কেউ একজন এসে তার চুড়িদার ধরে টান মারলো আর আচমকা সেই টানে ভয়ে ছিটকে সরে দাঁড়াতেই সে দেখলো, লম্বা চওড়া শ্যামবর্ণ একজন দাঁড়িয়ে। ফর্মাল পোশাক, টানাটানা চোখ, টিকলো নাক যার ওপর রিমলেস একটা চশমা। দেখে বেশ ভদ্র বলে মনে হচ্ছিলো তবে তিনি যে ছাত্র নন তা বেশ বোঝা গেল। তাকে দেখেই সবাই চুপ। মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সবাই, কিছুজন তো ছুটে পালিয়ে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যেই জানা গেল, তিনি কলেজের প্রফেসর, ডক্টর. দাশগুপ্ত। তার হাতে একটা সাদা কাগজ, যাতে কিছু একটা লেখা আছে। কাগজটা আটকানো। তিনি খুব মন দিয়ে লেখাটা পড়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
"কে লিখেছে এটা?.....কার কাজ?...."
কিন্তু সকলে নিরুত্তর। মাঝখান থেকে তিন্নি বুঝতে পারছিল না যে কাগজটায় কি লেখা আছে। তাই কৌতূহল বসত সে কাগজটা তার হাত থেকে নিয়ে নিলো এবং দেখলো তাতে লেখা আছে,
"আই এম এ বিগ ফ্যাট কাও.... কাম এন্ড টেক মিল্ক ইফ ইউ ওয়ান্ট"
কাগজটা চিউইংগাম দিয়ে তার পিঠে চেটানো ছিল। তিন্নির এটা বুঝতে বাকি রইলো না যে প্রিয়াই তখন তার পিঠে হাত দিয়ে এই কাগজটা তার গায়ে লাগিয়ে দিয়েছে। তবু সে চুপ করে রইলো এবং প্রশ্নালু চোখে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে।
এই জন্যই হয়তো তার বাবা তাকে বলেছিলেন যে, মুখোশের আড়ালে লুকানো আসল মানুষটাকে চিনতে শেখা খুব জরুরী।
Comments