ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ এবং অনুবাদ সংক্রান্ত দু চার কথা:-৬
অনুবাদিত কবিতা মুলানুগ হয়ে উঠতে পারে না অথবা তার আত্মাটা ই অনুবাদে বিলীনতা প্রাপ্ত হয় -- এরকম অভিযোগের পাশাপাশি এটাও আমাদের নজর তীব্রতায় ধরা দেয় যে, অনুবাদিত সাহিত্য এবং সাহিত্যিক অতি দ্রুত বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায়
লহমায়। শুধু তাই নয়, এক দেশের অবরুদ্ধ অন্তরালের কাহিনী আর এক দেশের উঠোন বারান্দায় বৃষ্টি রোদের খেলায় মাতে, উভয় পক্ষেরই মানসিক দর্শন মননের জগৎ আলোকপ্রাপ্ত হয়ে ওঠে আদান প্রদানে।
শোপেন হাওয়ার উপনিষদের পুঁথি পড়ে উপলব্ধি করেছিলেন, " উপনিষদ তাঁর জীবনব্যাপী সান্ত্বনা ও মৃত্যু কালীন শান্তি। " কি বা কোন ভাষায় উপনিষদ পড়েছিলেন শোপেন হাওয়ার? অনুবাদক ই বা ছিলেন কে?
দ্যু পেরন নামে এক ফ্রেঞ্চ এটির অনুবাদ করেন।ল্যাটিন গ্রীক আর ফার্সি মেশানো এক অদ্ভুত ভাষায় তিনি ১৮০১ সাল নাগাদ অনুবাদ টি করেন,, যা পাঠ করেছিলেন শোপেন হাওয়ার। এই অনুবাদ মূল সংস্কৃত ভাষা থেকে ছিল না।
শাহজাহানের পুত্র দারাশুকোর সম্পাদনায় উপনিষদের একটি ফার্সি অনুবাদ বার্নিয়ে ইউরোপে নিয়ে যান, যার থেকে অনুবাদ করেন ফরাসি ভদ্রলোক এবং ইউরোপীয় গণ "ভারতীয় চিত্তের" স্পর্শ লাভ করেন এবং প্রাচ্য ভারতীয় ভাষা সংস্কৃতি নতুন রূপে তাদের কাছে উন্মোচিত হয়ে ওঠে।
সম সাময়িক সময়ের দাবি এবং সামাজিক দায় বদ্ধতা র তাগিদে অনুবাদক কে অনেক সময় মূল ভাব সরে আসেন। এর ফলে মূল কাব্যের ভাব বা আত্মা হয়ত বেশ খানিক টা দূরে সরে যায় কিন্তু অনুবাদক পাঠক হৃদয়ে অমর হয়ে থাকেন। আমাদের বাংলা সাহিত্যে যেমন কৃত্তিবাস ওঝা। পরবর্তীতে রাজশেখর বসু মূলের অনেক টাই কাছাকাছি থেকেছেন, আধুনিক সময়ের নিরিখে তার প্রয়োজনও ছিল।কৃত্তিবাস ও রাজশেখর বসু র অনুবাদ দুটি পাশাপাশি সাজালে শ্রদ্ধেয় পাঠক গণ বিষয় টি সহজেই অনুধাবনে নিতে পারবেন --( রামের খোঁজে আসা ভরত ও তার সঙ্গীরা ভরদ্বাজ মুনি র আশ্রমে যেভাবে আপ্যায়িত হয়েছিলেন)
রাজশেখর বসু কৃত অনুবাদ:
এমন সময় ব্রহ্মা ও কুবের কর্তৃক প্রেরিত বহু সহস্র স্ত্রী দিব্য আভরণে ভূষিত হয়ে উপস্থিত হল।তারা যে পুরুষ কে গ্রহণ করে তারা উন্মাদের তুল্য হয়। কাননের বৃক্ষ সকল প্রমদার রূপ ধারণ করে বলতে লাগল --
সুরাপায়ী গণ সূরা পান কর; বুভুক্ষিত গণ পায়স ও সু সংস্কৃত মাংস যা ইচ্ছা খাও।
এক একজন পুরুষ কে সাত আট জন সুন্দরী স্ত্রী নদীতীরে নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে অঙ্গ সংবাহন করে মদ্য পান করাতে লাগল। পান ভোজনে এবং অপ্সরা দের সহবাসে পরিতৃপ্ত সৈন্য গণ রক্ত চন্দনে তৃপ্ত হয়ে বললে --
আমরা অযোধ্যায় যাবো না, দণ্ডকারণ্যেও যাবো না, ভরতের মঙ্গল হোক, রাম সুখে থাকুক।
…... ভরতের সৈন্যরা মদ্য পানে মত্ত হয়ে নন্দন কাননে দেবগণের রাত্রি যাপন করলে। গন্ধর্ব অপ্সরা প্রভৃতি নিজ নিজ স্থানে ফিরে গেল।
এই রিয়েলিস্টিক আপ্যায়ন 'কৃত্তিবাসের সহ্য হল না, ' তিনি লিখলেন ---
ভোজনে বসিল সৈন্য অতি পরিপাটি।
স্বর্ণপীঠ স্বর্ণথাল স্বর্ণময় বাটি।।
স্বর্ণের ডাবর আর স্বর্ণময় ঝারি।
স্বর্ণময় ঘরেতে বসিল সারি সারি।।
দেবকন্যা অন্ন দেয় সৈন্য গণ খায়।
কে পরিবেশন করে জানিতে না পায়।।
--- কৃত্তিবাস শুধু সরে এলেন না, 'দুস্তর ব্যবধান ' রেখে বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দিলেন।
সুতরাং এখানে পাঠক মূল থেকে বঞ্চিত হলেও অনুবাদ এখানে নিজস্ব সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। আজ উরুগুয়েন কবি ডেলমিরা আগাস্টিনি র একটি কবিতা পাঠকদের জন্য রাখলাম: কবি সম্পর্কে আলোচনা পরের কিস্তিতে।
The knot
Their idyll was a smile of four lips...
In the warm lap of blond spring
They loved such that between their wise fingers
the divine form of Chimera trembled.
In the glimmering palaces of quiet afternoons
They spoke in a language heartfelt as weeping,
And they kissed each other deeply, biting the soul!
The hours fluttered away like petals of gold,
Then Fate interposed its two icy hands...
Ah! the bodies yielded, but tangled souls
Are the most intricate knot that never unfolds...
In strife with its mad superhuman entanglements,
Life’s Furies rent their coupled hands
And wearied your powerful fingers, Ananké
গিঁট / The knot
চার ঠোঁট জুড়ে হেসেছিল
তার মেঠো জীবনের কবিতা স্বত্ব সরলতায়
হেমকান্তি বাসন্তিকার কোলজোড়া উষ্ণতায়
আন্তরিক কত নিখাদ ভাঁজ,
সে সব সুডৌল দৈবভাব নির্মাণ
কল্পনায় বাঁচে কম্পন
বীভৎস হতে চায় ক্ষিপ্ত সিংহ দৈত্য,
যদিও আঙুলে জড়ানো যুদ্ধ বিচক্ষণ।
নিথর প্রাসাদ হয়ত বেঁচে
এখন শান্ত বৈকালিন
মিটমিটে অপরাহ্নে ধরা ক্রন্দন
আলোক প্রাপ্তি মরে ক্ষীণ,
ছিঁড়ে আত্মা হেঁচড়ায় তীব্র শ্লেষ চুম্বনে
স্পন্দিত কলিজা ঝাপটায় ডানা
সুবর্ণ অহং জুড়ে বিক্ষোভ,কুট দংশনে।
বরফশীতল হাতে ফাটল নিয়তি মধ্যস্থতায়
সমর্পণে শরীর হার মানা বশ্যতায়
বিভ্রান্তির জটে আত্মা পিছল
চ্যুত সমুদ্র শ্যাওলায়,
জটিল জটে বিছানো গিঁট ও গাঁটের বিজড়ন
আহা, পাট ভাঙা সেসব প্রসারিত প্রদর্শন,
লোকাতীত উন্মাদী দ্বন্দ্ব বিসংবাদ
প্যাঁচানো ঘুর্ণায় ভাড়া খাটে মিলিত হাত,
কুদরতি আঙুল এবার রণক্লান্ত
তবুও রয়েছে 'অ্যানানকে'
চাঁদ বৃহস্পতির
শ্রান্ত সেই ভাগ্যদেব নয় লুণ্ঠিত।
(ক্রমশ)
Comments