অম্বর
বিষ্ণু চক্রবর্তী
দর্শকের জোর করতালির মধ্য দিয়ে মঞ্চে উঠলো অম্বর, তার কথা শোনার জন্য সভাগৃহ লোকারণ্যে পরিণত হয়েছে। আর হবে নাই বা কেন! ডঃ অম্বর দাসকে কে না দেখতে বা শুনতে চাইবে ? দর্শক মহলের এই উচ্ছাস হাসায় অম্বরকে। একটা সময় ছিল রাস্তার ধারে ধর্ষিত শরীরটার গোঙানি শোনারও লোক ছিল না সে রাতে। এটুকু ভেবেই শিউরে ওঠে সে, এবং ঠিক করে আজ কোনো মোটিভেশনাল স্পিচ নয়, বরং নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঐ ঘটনাটা বলবে।
- ' আপনারা এখানে ডঃ অম্বর এর মনস্তাত্ত্বিক বক্তব্য শুনতে এসেছেন। আমি খুশি, কৃতজ্ঞতা জানাই আপনাদের। তবে যে ডঃ অম্বরের নাম শুনে আপনারা এলেন , তাকে কি চেনেন ? হয়তো না। আমি অম্বর। আমার জন্ম হয় একটা ছেলের শরীর নিয়ে। বাড়ির বড়ো ছেলে, শুনেছি ছেলে হওয়ার খুশিতে ঠাকুমা গোটা পাড়াকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন বাড়িতে নেমতন্ন করে। আমার শৈশব বড়ো আদরে কেটেছে। কিন্তু যতো বড়ো হতে থাকি, ঐ আদুরে চোখগুলোতে দেখি কী তীব্র ক্রুড়তা ! যেন আমি একটা ঝামেলা, না চাইতেই তাদের ঘাড়ে এসে পড়েছি। কারণ আমি আর দশটা ছেলের মতোন প্যান্ট শার্ট পড়িনা, তুতো বোনেদের জামা পড়ি। খেলার সঙ্গী পাড়ার মেয়েরা, আমি ফুলের গয়না পড়ে সাজি। মনে আছে জানেন, ঠাকুরমা একদিন মাকে প্রশ্ন করেছিলেন , 'বৌমা, সত্যি করে বলতো, এই অনাসৃষ্টি হতচ্ছাড়া আমার ছেলের ঔরসে হয়েছে? মার কান্নাটা আজও চোখে ভাসে। আপনারা আজ আমাকে এতো সম্মান দিচ্ছেন, যদি মা একবার দেখে যেতে পারতো !
আমার জীবনে সবকিছু অন্যরকম ছিল হয়তো, কিন্তু একটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল। যখন কলেজে পড়ি, হ্যাঁ, মা চাকরি করতো, তাই বাড়ির লোকজন না চাইলেও আমায় অশিক্ষিত হয়ে পড়ে থাকতে হয়নি। তো, কলেজে পড়াকালীন একটি ছেলে আসে জীবনে। যাকে দেখে মনে হয়েছিল , মায়ের পরে তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে পারি। কিশোরী বয়স, মনটা তখনও এসব আবেগে বিশ্বাসী। মুহুর্তে নিজের সব সত্তা দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তাকে। আপনারা নাম জানতে চাইছেন নিশ্চয়ই? সে প্রশ্ন থাক না হয়। তো, প্রেমে ভাসছি আমি, স্বপ্ন বুনছি। একদিন বিকেলে টিউশন ক্যানসেল হলে আমরা বেরিয়ে পড়ি ওর বাইকে করে ঘুরতে। মাকে বলেছিলাম, ফিরে রাতের খাবার একসাথে খাবো। হা হা ! কিন্তু সব ভাবনা, সব কথা কি আর আমার আপনার পক্ষে রাখা সম্ভব হয় ? আমি রাতে ফিরতে পারিনি। আমার সেই প্রেমিক, যাকে মায়ের জায়গায় বসিয়েছিলাম, সে ও তার কিছু বন্ধু মিলে আমাকে সেই সন্ধ্যায় চারবার ধর্ষণ করে। আরো কয়েক বার হয়তো করেছিল , ঠিক জানি না, চারবারের পরে আর আমার জ্ঞান ছিল না। আমার মায়ের উচ্চ রক্তচাপ ছিল। পরদিন ভোরে রক্তাক্ত আমি যখন বাড়ি ফিরি, মা তখন খাবারের টেবিলের ওপর শুয়ে আছেন। এক বন্ধুকে ফোন করি, তার সাহায্যে মা'র সৎকার করেছিলাম। না, বাবা বা আমার বাড়ির কেউ সেদিন আসেনি। মা আর আমি একে অপরকে জড়িয়েই বাঁচি আজও। শরীরের ক্ষত শুকোতে অনেকটা সময় লেগেছিল। কিন্তু আমি পেরেছিলাম। আসলে, মা নিজেকে সবসময় সম্মান করতে শিখিয়েছিলেন। একটা মানুষের জন্ম পরিচয় নিতান্তই প্রাকৃতিক নিয়ম। এটাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবার দরকার থাকে না। আর আমি নিজের জীবন দিয়ে জেনেছি, ধর্ষণ শরীরের হয়, সম্মান বা আত্মার নয়। যতক্ষণ তুমি নিজেকে অসম্মানিত বোধ না করছ, কারোর ক্ষমতা নেই তোকে অসম্মান করার। জীবন একটা, তাকে সবকিছু নিয়েই উদযাপন করা দরকার। নিজেকে ভালোবাসুন, দেখবেন একদিন আপনিও অম্বর হয়ে উঠেছেন। ভালোবাসা নেবেন, ভালো থাকবেন।'
অনেক অনেক ভাল লেগেছে 😍😍