top of page
Search

অল্প কথার গল্পে মানসী গাঙ্গুলী


দীপশিখা


মানসী গাঙ্গুলী



      অনেকদিন থেকেই কথা চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি বিভাগে, ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এক্সকারশনে যাবার কিন্তু জায়গা নির্বাচনে প্রফেসরদের মধ্যে দ্বিমত হওয়ায় একটু দেরী হল। পুজোর ছুটিতে যাবার কথা ছিল তা গড়িয়ে নভেম্বর মাসে গিয়ে দাঁড়াল। একদিকে ভালই হল, একটু হালকা ঠাণ্ডার আমেজে ঘুরতে মন্দ লাগবে না।


      ঠিক হল মধ্যপ্রদেশের ভূপালে যে বিখ্যাত বৌদ্ধবিহারটি রয়েছে সেইটা দেখতেই নিয়ে যাওয়া হবে ছাত্রছাত্রীদের। নির্দিষ্ট দিনে সকলে রওনা হল। দু'জন স্যার, একজন ম্যাডাম ও ১৪জন ছাত্রছাত্রী মিলে মোট ১৭জনের গ্রুপ। একসাথে বন্ধুরা মিলে এভাবে যাওয়ার জন্য জার্নিটা খুবই উপভোগ্য হয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে স্যার, ম্যামরাও ওদের সাথে বন্ধুর মত মেলামেশা করছিলেন। ট্রেনে সবার সাথে লুডো খেলা, দাবা খেলা থেকে গলা মিলিয়ে গান গাওয়া সবতেই ওনারা যোগ দিয়েছিলেন। অপরাজিতা,যে বরাবরই একটু চুপচাপ, সিরিয়াস টাইপের মেয়ে, সেও সবার পাল্লায় পড়ে খুব মজা করেছিল। প্রথমে তো ও যেতে চাইছিল না কিন্তু যখন জানল এই এক্সকারশনের ওপর প্রোজেক্ট সাবমিট করতে হবে যার ওপর ৫০নম্বর থাকবে, তখন বাধ্য হয়েই রাজী হয় শামুকের মত নিজেকে গুটিয়ে রাখা মেয়েটি।



      যেহেতু আগে থেকে সব ব্যবস্থা করা ছিল, তাই ট্রেন থেকে নেমেই গাড়ী করে সবাই গেস্ট হাউসে পৌঁছাল। ভোর ভোর পৌঁছে গিয়েছিল তাই সকলে স্নান সেরে একসাথে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ল বৌদ্ধবিহারের গঠনশৈলী ও ভিতরের কারুকাজ দেখতে। সকলে মিলে গাড়ী করে রওনা দিল বৌদ্ধবিহারের উদ্দেশ্যে কারণ বিহারটি একটু দূরে। যাবার পথে সবাই চারিদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছে। মাঝে একটা পোড়ো বাড়ী পড়ায় অপরাজিতার দৃষ্টি সেদিকে আবদ্ধ হয়। ও দেখে বাড়ীটার ভগ্নাংশ, একদিকে একটা বটগাছ মাথা চাড়া দিয়েছে। কেমন যেন রহস্যময় লাগছে তার, নিজের অজান্তেই সারাশরীর বেয়ে শিরশিরানি নামছে , কেমন একটা অস্বস্তি, কাউকে কিছু বলতেও পারছে না, আর বলবেই বা কি, এ যে তার অনুভূতি। খানিক বাদে বাড়ীটা পিছনে পড়ে গেল, ওরা বিহারে পৌঁছাল।


     এই বৌদ্ধবিহারটি আয়তনে বেশ বড় এবং বহু প্রাচীন তা বাইরে থেকে দেখলেই বোঝা যায়। চারপাশে বড় বড় গাছ, মনে হয় যেন জঙ্গলের মধ্যে এটির অবস্থান। গাছপালা থাকায় বেশ ছায়া সুশীতল আর শহর থেকে একটু দূরে একটু নির্জন জায়গায়। একটা টিলার ওপর এই বিহারটি, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি নদী। নদীর ওপাড়ে বেশ উঁচু পাহাড়, বাইরে থেকে দেখলে একটু গা ছমছম করা পরিবেশ। ওরা ভিতরে প্রবেশ করল, মাঝে বড় হলে বিশাল বড় বুদ্ধমূর্তি। সেখানে অনেক ধূপ জ্বলছে, গন্ধে হলঘর ম ম করছে।


       সেখানে একজন বয়স্ক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ওদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালেন। ইনি হিন্দী, ইংরাজী দুই ভাষাতেই সাবলীল, তাই সকলেরই বুঝতে খুব সুবিধা হচ্ছিল। কবে তৈরী, কিভাবে এখানে বৌদ্ধবিহার নির্মাণ হল তার ইতিহাস ইনি গল্পের মত বলে গেলেন। আর ছাত্রছাত্রীরা বিহারের গঠনগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে কিছু কিছু প্রশ্ন করছিল। সে ভদ্রলোকের সর্বব্যাপারে দারুণ জ্ঞান থাকায় প্রতিটি প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর দিয়ে সকলকে সন্তুষ্ট করলেন। অনেক জায়গায় পালি ভাষায় কিছু লেখা খোদাই করা ছিল। উনি পালি ভাষাতেও দক্ষ হওয়ায় তারও পাঠোদ্ধার করে দিলেন। কিছু ছবি কোনো জায়গায় পাথরে খোদাই করা ছিল, সেসবও বেশ গল্পের আকারে বুঝিয়ে দিলেন। 


       একরাশ এলোমেলো ভাবনা অপরাজিতার মাথায়। এখানেও যেন একটা অস্বস্তি ওকে ঘিরে রেখেছে। ঠিক বুঝতে পারছে না, কাউকে বোঝাতেও পারছে না বা হয়তো চাইছেও না বোঝাতে বরাবরের চাপা স্বভাবের মেয়েটি। তার অন্যমনস্কতা কারও কারও চোখে পড়লেও, সবাই তখন দেখতে ব্যস্ত। তাছাড়া তারাও জানে ওর স্বভাবের কথা, তাই বিশেষ গুরুত্বও দেয়নি কেউ।



   ভিতরে সব দেখা হলে ওরা পিছনদিক দিয়ে বার হয় যেখানে দেখে যে যার কাজে ব্যস্ত। বড়রা কেউ কাঠ কাটছে টুকরো করে উনুন ধরাবার জন্য। ছোটদের কেউ তা গুছিয়ে রাখছে, কেউ বা মাটি কোপাচ্ছে গাছ বসানোর জন্য। কেউ গাছে জল দিচ্ছে কিন্তু কোনো শব্দ নেই। চুপচাপ নিজেদের কাজ করে চলেছে।


       সব দেখেশুনে ওরা বেরিয়ে পড়ল। সারাদিন ঘুরে ঘুরে খাবারদাবার সব হজম, ফেরার জন্য ব্যস্ত সবাই। যদিও নভেম্বর মাস, গরম বিশেষ নেই কিন্তু আগের রাতে ট্রেনে কারও ভালভাবে ঘুম হয়নি, তার ওপর সারাদিন ঘোরাফেরায় সবাই ক্লান্ত, শ্রান্ত। চারিদিকে ছায়াছায়া, বেলা তিনটেতেই মনে হচ্ছে বুঝি একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে।


     এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় রোদ পড়ে গেছে, খানিক পরেই সন্ধ্যে নামবে। গাড়ী করে ফেরার সময় পাখিদের বাসায় ফেরার তাড়ায় ডানা ঝটপট শোনা গেল। সেই পোড়ো বাড়ীটার পাশ দিয়ে যাবার সময় অপরাজিতার আবার চোখ সেখানে আটকে যায়। কেন যেন ওর খুব চেনা মনে হতে থাকে, ওর মনে হয় ওখানে যেন কেউ আছে যে ওকে ডাকছে। ভেতরটা আনচান করতে থাকে এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে ভরে যায় তার মন। কাউকে কিছু বলে না। বেলা পড়ে গেছে বলে আর ভাত না খেয়ে হেভি স্ন্যাক্স নিল সবাই, সঙ্গে চা-কফি।


       গেস্টহাউসের লনেই ওদের স্ন্যাক্স সার্ভ করা হল। ওখানেই আড্ডাটা বেশ জমে উঠল। গরম চা কফি সকলের ক্লান্তি খানিকটা দূর করে দিল। বেলা পড়ে এল, ওরা সকলে হলে ঢুকল। সবাই সোফায় গা এলিয়ে দিল, খানিকক্ষণ গল্পগুজব, টিভি, আরেক রাউন্ড চা এই করেই সন্ধ্যেটা কাটল। সবাই যখন চা কফি খাচ্ছে, কত কথা বলছে, ওই বৌদ্ধবিহারটি নিয়ে আলোচনা করছে কিন্তু অপরাজিতা চুপ। ওর মাথায় কেন জানি না ওই পোড়ো বাড়ীটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।


       রাত ৮টা নাগাদ ডিনার রেডি। সবার পেটে তখন আগুন, বাইরে হালকা ঠাণ্ডা। রুটি, চিকেন আর স্যালাড, বলাই বাহুল্য, সবাই গপগপ করে খেতে লাগলো। খাবার পর সবাই গুড নাইট করে শুতে গেলো। রাত ১০টার মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। 


      অপরাজিতা ও আরো তিনজন একই ঘরে ছিল। শোবার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর রাত গভীর হলে ঘুমের মধ্যেই অপরাজিতা উসখুস করতে থাকে। এভাবে কিছু সময় চলার পর রাত দুটো নাগাদ অপরাজিতার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখে, ওর মাথার কাছে একজন সাদা কাপড় পরা মহিলা, মাথায় ঘোমটা, হাতে প্রদীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপরাজিতা মন্ত্রবৎ উঠে বসল। চোখ কচলে ভাল করে দেখল, ভাবল ভুল, দরজা বন্ধ, কি করে কেউ আসবে? শুয়ে পড়ল, কিন্তু একটা অস্বস্তি যেন ওর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঘুম আসছে না। চোখ খুলে আবার দেখে নারীমূর্তি প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষে ওর দিকে তাকিয়ে। অপরাজিতা নেশাগ্রস্তের মত উঠে বসল। নারীমূর্তি এগিয়ে চলল। অপরাজিতা পিছন পিছন দীপশিখা অনুসরণ করে চলল।ঘরের দরজা খুলে গেল, অপরাজিতা বেরিয়ে চলল দীপশিখার পিছন পিছন। নারীমূর্তি আর দেখা যায় না অন্ধকারে। দীপশিখা আবছা আলো সৃষ্টি করে পথ দেখায়, অপরাজিতা এগিয়ে চলে। বারান্দা, সিঁড়ি পার হয়ে গেটের কাছে। রক্ষী ঘুমিয়ে পড়েছে। গেট খুলে গেল, অপরাজিতা চলল, চলছে তো চলছেই।


        এদিকে অপরাজিতার ঘরে ওর এক বন্ধু মানালির ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল জল তেষ্টা পেয়ে। ও উঠে বসে। জলের বোতলটা ওর আর অপরাজিতার বেডের মাঝে ছিল। খুঁজে না পাওয়ায় মোবাইলে টর্চ জ্বালায় আর সেই আলোয় দেখে অপরাজিতা নেই বিছানায়। ভাবে টয়লেট গেছে। কিছু পরেও না ফেরায় ও এবার উঠে ঘরের আলো জ্বালায়। সবাই উঠে পড়ে। টয়লেটে নেই, ঘরের দরজা খোলা। সবাই ওর নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলো, পাশের ঘরগুলো থেকে সবাই বেরিয়ে পড়ল। আলো জ্বেলে চারিদিক খুঁজতে খুঁজতে নিচে যখন গেল, রক্ষীরও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। দেখে তালা দেওয়া গেট খোলা। সবাই বাইরে বেরিয়ে পড়ল টর্চ হাতে, রাস্তার আলোগুলো জ্বলছে না। ওরা অবাক, যদিও অপরাজিতা একটু অন্য প্রকৃতির,একটু চুপচাপ,বেশিমাত্রায় সিরিয়াস তবু এরকম কাজ সে কিভাবে করতে পারে? রাস্তায় বেরিয়ে সবাই ঠিক করে দু'ভাগ হয়ে গেটের দু'ধারে রাস্তা দিয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দিল আর অপরাজিতার নাম ধরে চিৎকার করতে লাগল। অনেকটা ছোটার পর দূর থেকে ওরা দেখতে পেল একটা আলোর শিখা এগিয়ে চলেছে আর সেটা অনুসরণ করে কেউ যেন এগিয়ে চলেছে। ওদের গা ছমছম করে উঠল, খানিক থমকে দাঁড়াল। দীপশিখা এগিয়ে যাচ্ছে। নাঃ এরপর হদিস করতে পারবে না, ক্ষণিক ভয় পেলেও আবার ছুট লাগাল। এবার ওরা কাছাকাছি এসে পড়েছে। হঠাৎই দীপশিখা গেল মিলিয়ে আর অপু আছড়ে পড়ল রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে। সামনে সেই পোড়ো বাড়ী কয়েকহাত দূরে। ওরা খুব ভয় পেয়ে গেছে তবু ৭-৮জন একসাথে থাকায় সামলে নিয়েছে। অপুর শরীর এলিয়ে পড়েছে। জল দরকার, কারো কাছে জল নেই। ওকে ধরে পাঁজাকোলা করে সবাই মিলে গেস্ট হাউসে নিয়ে এল। চোখে মুখে জল দিলে অপু একটু নড়াচড়া করে ওঠে। সবাই মিলে ওকে হাওয়া করে, হাত পায়ের তলা ঘষে সুস্থ করার চেষ্টা করল। খানিক পরে ও উঠে বসল। জিজ্ঞেস করলে মনে করে বিশেষ কিছু বলতে পারল না।



          সকাল হলে আশপাশের লোকজন কেউ কেউ জানতে চাইল রাতে কি হয়েছিল। রক্ষীর কাছে শুনে এক খুব বুড়ো ভদ্রলোক ভিতরে এসে ওদের কাছে ভাল করে সব শুনতে চাইলেন। সব শোনার পর উনি বলতে লাগলেন, "ঐ পোড়ো বাড়ীটা তখন পোড়ো ছিল না, সে প্রায় ৫০বছর আগের কথা। থাকতেন ওনার এক বন্ধু যিনি ছিলেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, তার বউ ও এক মেয়েকে নিয়ে। খুবই রমরমে অবস্থা ছিল। হঠাৎই সেই ভদ্রলোক এক সমুদ্রযাত্রায় জাহাজ ডুবিতে মারা যান আর তারপর তার স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে ঐ বাড়ীতে থাকাকালীন ২২বছরের মেয়ে হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে মারা যায়। ভদ্রমহিলা মেয়েকে আঁকড়ে ছিলেন, সে চলে যাওয়ায় শোকে পাগল হয়ে যান। সেই ধাক্কা সামলে উনি ৭-৮টি অনাথ শিশুকে ঐ বাড়ীতে রেখে লালন করতে থাকেন।ওদের নিয়ে উনি সব ভুলে থাকার চেষ্টা করতেন। ওদের নিজের সন্তানের মত ভালবাসতেন। রাতে সবাই ঘুমালে উনি হাতে প্রদীপ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতেন বাচ্চারা ঠিকঠাক আছে কিনা। আলো জ্বালতেন না, পাছে ওদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিন্তু নিয়তির এমনই পরিহাস, একদিন রাতে উনি যখন প্রদীপ হাতে পরিদর্শন করছিলেন, সেইসময় প্রবল ভূমিকম্প হয় ও বাড়ীটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। পরদিন ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ভদ্রমহিলা ও বাচ্চাগুলোকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় আর ভদ্রমহিলার হাতে তখনও প্রদীপটি ছিল ধরা।


     এই অবধি বলে ভদ্রলোক খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। নতুন করে উঠে আসা বন্ধুর শোকটা চুপ করে সামলালেন। তারপর কোন মেয়েটি বেরিয়েছিল অর্থাৎ অপরাজিতাকে দেখতে চাইলেন। অপরাজিতা পাশের ঘরে শুয়েছিল, ওকে আনা হলে ভদ্রলোক দেখামাত্র চমকে উঠলেন। ওনার বন্ধুর অর্থাৎ ঐ বাড়ীর যে মেয়ে মারা গিয়েছিল, তাকে দেখতে ছিল অবিকল অপরাজিতার মত। সবাই শুনে বিস্ময়ে স্থাণুবৎ। অপরাজিতার দিকে সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ।


    ভদ্রলোক বললেন, এই বিজ্ঞানের যুগে আজও এমন কিছু ঘটে বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না।ভদ্রলোক চলে গেলে সবাই গোছগাছ করে নিল, আর একমূহুর্তও এখানে নয়---।

 
 
 

Comments


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page