top of page
Search
agantukpotrika

অল্প কথার গল্পে শর্মিষ্ঠা সাহা


হলুদপাখী


শর্মিষ্ঠা সাহা


মুখমণ্ডলে ঠোঁট বলে কোনো অংশ দেখা যাচ্ছে না।কেবল সাদা ফেনা।চশমাটা নেমে এসেছে নাকের ডগায়।বারবার সেটা বাঁ হাত দিয়ে ঠেলে উপরে তুলতে গিয়ে খানিক ফেনা বুড়ো আঙুলে লেগে গেলো আর সেখান থেকে গিফ্ট প্যাকেটের লাল মোড়কে।

'ধুত্তেরি! কাজের সময় যত অকাজ'-

বাঁ হাতের তালু দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে সোজা বেসিনে চলে গেলো রুজা।চটপট ব্রাশ সেরে ইলেকট্রিক কেটেলে চা বানিয়ে চুমুক।

'আঃ, সারাদিন যতই কফি খাই, সকালবেলা এই চা না হলে দিনটা কেমন মাঠে মারা যায়।'

ভাবতে ভাবতেই লম্বা হাই তুললো।নাঃ, কালকের ঘুমটা পুরো হয়নি।একে অফিস থেকে ফিরতে দেরী হয়ে গেলো, তারউপর প্যাকিংগুলো অসম্পূর্ণ ছিলো।ওগুলো শেষ করতে প্রায় রাত কাবার, তিনটে বেজে গেলো।কিন্তু তাতে কি ! আজকের দিনের আগত ঘটনাক্রম ভাবলে এসব না ঘুমের ক্লান্তি কোথায় পালিয়ে যাবে !

স্নান সেরে ঘরে ঢুকে আলমারী খুললো।ডানদিকের জিন্সের পেছনে রাখা শাড়িগুলো থেকে সরষেফুল রঙের খাদির শাড়িটা বের করলো রুজা।রানী কালারের চওড়া পাড়।হলুদ রঙই ওরা পড়বে সবাই, সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কাল অফিস থেকে ফেরার পথে গিফ্টগুলো কেনার সময় রুজা নিজের জন্য হলুদ রঙের একটা জাঙ্ক জুয়েলারী সেট কিনেছে।ওটা পড়ে একটা লম্বা কালো টিপ পড়লো।নাঃ, আর চশমা না। লেন্সটা চোখে লাগিয়ে এগিয়ে গেলো টেবিলের কোণায়।চেয়ারের হ্যান্ডেলে ঝোলানো ব্যাগটা কাঁধে নিতে নিতেই দরজায় কলিং বেল,

ডিং ডং...



–ও নিতুদি এসে গেছো ! একটু হেল্প করো না প্লিজ।

–কী করবো !

–এই প্যাকেটগুলো আমার সাথে হাতে হাতে গাড়ি অব্দি নিয়ে চলো প্লিজ।এতগুলো একা পারবো না।

–আজ সতেরো তারিখ বুঝি !

–তোমার মনে আছে !

–তো থাকবে না ! ক'জন করে এমন কাজ ! আমাকে পাঁচ-ছ'টা দাও।তুমি শাড়ি পড়ে বেশি নিতে পারবে না।দুটো নিলেই হবে।

–এতগুলো পারবে ? আগে ঘরের চাবিটা ধরো।

নিতু ঘরের চাবি আর কুঁচি কোমরে গুঁজে পাঁচটা গিফ্ট প্যাকেট পরপর লম্বাভাবে সাজিয়ে দুহাত দিয়ে তুলে নিলো।ঘর থেকে বেরিয়ে লিফ্টের দিকে এগোলো।

–আস্তে এসো।শাড়ি পড়ে হোঁচট খেও না।

–না আস্তেই যাচ্ছি।

লিফ্ট থেকে নেমে পার্কিং-এ গাড়ীতে পেছনে গিফ্টগুলো সাজিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো নিতুর দিকে।

–ঠিক আছে তো !

–হেব্বি লাগছো। 'কিসিকা নজর না লাগে' আমার দিদিকে।যাও।দুগ্গা দুগ্গা।

আবাসনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল নীল অল্টো।অনেকটা রাস্তা যেতে হবে।যদিও প্রত্যেক রবিবার ওরা এইটাই সপ্তাহান্তের ঠিকানা।আজকে শনিবার।এই হপ্তায় শুক্রবার বাড়ি যায়নি।

প্রত্যেক শুক্রবার অফিস করে সোজা শিমুরালী।বাবা মায়ের কাছে।শনিবার রাত কাটিয়ে রবিবার সক্কালবেলা হাজির হয় সরশুনা উপনগরীর এই ঠিকানায়।সেখানে সারাদিন আরেকটু জোরদার অক্সিজেন নেবার পরে রাত্তিরে ফেরত যায় বিডন স্ট্রিটের নিজের ফ্ল্যাটে।এই নিয়ম চলে আসছে গত দুবছর হলো।

–হ্যালো, মা, আমি এই সপ্তাহে শুক্রবার কিন্তু যেতে পারবো না।

–কেন রে?

–কেন মানে !

–ও, এটা তো সতেরোই জুলাই।আচ্ছা।সবকিছু ঠিকঠাক কিনে রাখিস আগে থেকেই।

–তোমরা সাবধানে থেকো।



মা তো বলেই খালাস।অফিস থেকে ফিরতে রোজ রাত সাড়ে ন'টা।তখন কি আমার জন্য দোকান খোলা রাখবে ? অগত্যা শুক্রবার একটু তাড়াতাড়ি বেরোনোর চেষ্টা করে মরার সময় হরিনামের মতো গিফ্ট কিনে বাড়ি ফেরা।নিশ্বাস নেবার সময় পায়নি বেচারি !

কোত্থেকে কালো মেঘ উড়ে এলো আর ঝমঝম করে ভিজিয়ে দিলো গাড়ীর কাচ।ধুয়ে গেলো গায়ে জমে থাকা ধুলোর আস্তরণ।

–জানিস রুজা, আমার একটা স্বপ্ন আছে।

–কী ?

–কেন বলবো ?

–বেশি ভনিতা না করে বলে ফেল।

অনুপটা পি এইচ ডি করতে কানাডা চলে যাবার পরে মাস তিনেক ফোন এসেছিলো।তারপর আর ফোন আসেনি।শেষের দিকে একদিন ফোন করে এমিলির কথা বলেছিলো।ওর সহ রিসার্চার।খুব ভালো আর মিষ্টি মেয়ে।ধীরে ধীরে ফোন কলগুলো অনিয়মিত হতে হতে একসময় বন্ধ হয়ে গেলো।তাও প্রায় বছর তিনেক আগের কথা।তারপর নিজেকে বুঝিয়ে, নিজের জীবনে নিজেকে ব্যস্ত করে তুলতে কেটে যায় একবছর।এখন রুজা আদ্যোপ্রান্ত নতুন, সবুজ।ওর ভালোবাসা থেকে আহরণ করেছে বেঁচে থাকার রসদ।

গাড়ীটা চৌরাস্তা থেকে ডানদিকে বাঁক ঘুরলো, তারপর আঁকাবাঁকা পিচ রাস্তা বকুলতলা পেরিয়ে সরশুনা পাঠাগার ছাড়লো।বাঁ দিকের সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে রুজা আনমনা হয়ে গেলো।

–অনুপ দ্যাখ, ভদ্রলোক কেমন মাথা নিচু করে এলিয়ে পড়েছে।

–আরে, নিজের মনে বসে আছে।তোর যতসব উল্টোপাল্টা ভাবনা।

–বলছি না।ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।

–চল্।তোর কথা যদি সত্যি না হয় তো দেখিস কেমন মজা দেখাই।

এগিয়ে গেলো রুজা আর অনুপ।স্যারের বাড়ি থেকে ফিরছিলো।তারপর দুজনে একসাথে রিকশায় ওনাকে পৌঁছে দেয় উপনগরীর ডাকঘর লেনের একুশ নম্বর বাড়িতে।দোতলা বাড়ি।সামনে সামান্য খোলা জায়গা।একমাত্র ছেলে আমেরিকা নিবাসী এবং দেশে ফিরবে না।স্ত্রী গত হয়েছেন দু'সপ্তাহ আগে।

তারপর স্বপ্নের স্বপ্ন দেখা বাস্তবের মাটিতে।জনা আটেকের নতুন সংসার।কিচিরমিচির পাখীর বাসা।এ বাড়ির নাম 'কূজন'।ঠিক হয় ওদের জন্মদিন পালন হবে সতেরোই জুলাই।ওইদিন অনুপ আর রুজার ভালোবাসা শুরুর দিন।কাল বিকেলে বুড়ো দামুদার সাথে কথা হচ্ছিলো রুজার।

–তোর খরচ বাড়লো।

–কেন ?

–কাল একটা কুসুম কেউ দোরে ফেলে গিয়েছে।এবার এলে একদিন তুই ন্যাপি পাল্টাবি।

–দামুদা,আমি সব পারি।

–জানি তো !



ওপরের ঘরে রেডি হচ্ছে চৈতালী হলুদ সালোয়ারে, বিনাদির হলুদ নাইটিটা এগিয়ে দিলো মাধু।আট বছরের মেয়েটা কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে!হলুদ ফ্রকে যেন হলুদপাখী।বিনাদির বয়স হয়েছে প্রায় পঁচাত্তর।দামুদা আর বিনাদিতে খুব ঝামেলা হয় কে বড় তাই নিয়ে।খুনসুটি বলা যায় আরকি ! নীচে সঞ্জয়, বিমল দুটোই পাঁচ বছরের।হলুদ ফতুয়া পড়েছে।সকালবেলাতেই হাজির সবার রাধারানী।ওরা বলে ওদের মেট্রন কাম গভর্নেস।সেও ওই রাধাচূড়া রঙের শাড়ি পড়া।রুজা কুসুমের জন্য দুটো পাতলা হলুদ সুতির জামা এনেছে।গাড়ী থেকে নামতেই দ্যাখে একগাল হাসি নিয়ে গেটে দাঁড়িয়ে আছে দামুদা, সেই সরস্বতী পূজার পাঞ্জাবি পড়ে।

'শুভ জন্মদিন'

এই একটা দিন বুড়ো পায়ে হাত দিতে দেয়।

রুজা যেন দেখতে পেলো,গেট পেরিয়ে অনুপ ওপাশে দাঁড়িয়ে হাসছে।

45 views0 comments

Комментарии


bottom of page