top of page
Search

আগন্তুক ।। কবি প্রণাম সংখ্যা ।। প্রবন্ধ ।। চন্দন দাশগুপ্ত


মানুষ রবীন্দ্রনাথ 

চন্দন দাশগুপ্ত


        ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ ভারতের নবজাগরণের মধ্যদিন। যেসব মহাপুরুষ তাঁদের জ্ঞান, চিন্তাভাবনা ও আদর্শে ভারতবর্ষকে সমৃদ্ধ করেছেন, প্রতিভার বরপুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম। শতাব্দীর তুলাদন্ডে মহান জীবনের অস্তিত্ব শাশ্বত প্রমাণিত হলে সার্ধ-শতবার্ষিকী পালনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে সেই মহান আত্মার অমর জ্যোতিকে----যিনি জ্যোতির্লোকের অমৃতময় বাণী ও সাধনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন মানবতার সেবায়----কবিরূপে, দেশপ্রেমিকরূপে, শিল্পীরূপে-----সর্বোপরি 'মানুষ' রূপে।

        রবীন্দ্রনাথের রত্নাকরের মতো বিরাট প্রতিভার অনুসন্ধান করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সত্যিই দুঃসাধ্য। জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি নিজের প্রতিভার ছাপ রেখে গিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর সম্পর্কে বহু মূল্যায়ন হলেও তাঁর শতবার্ষিকী এবং সার্ধশতবার্ষিকীতে যে সেই আলোচনার পালে নতুন হাওয়া লাগে, সেকথা অনস্বীকার্য। স্বাধীনোত্তর যুগে সমস্ত সম্প্রদায়ের বাঙালি লেখকই নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে রবীন্দ্রচর্চা শুরু করেন। আর বলা বাহুল্য, এই রবীন্দ্রচর্চায় কবির সাহিত্যসাধনার সাথে সাথে তাঁর জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক চিন্তা, মানবতাবোধ, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাঁর ভগবৎপ্রেম----সবগুলিই কমবেশি সমান গুরুত্বলাভ করেছে।

         আমরা সকলেই জানি, রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয় সাহিত্যশিল্পী----তিনি রূপকার, বিশ্ববন্দিত কবি। কিন্তু শুধু এটুকুই কি তাঁর সঠিক পরিচয় ? পৃথিবীর বহু মনীষীর প্রতিভা কাব্যের ক্ষেত্রে, ধর্মের ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সার্থক হয়ে উঠেছে, কিন্তু তাঁদের শিল্পীসত্ত্বার সাথে ব্যক্তিসত্ত্বার কোনও সংযোগ নেই। কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই দেখা গিয়েছে, নিজের দীর্ঘ জীবনে তিনি শুধু সার্থক শিল্প-সৃষ্টিই করেননি, তাঁর সমগ্র জীবনই ছিল একটি শ্রেষ্ঠ শিল্পনিদর্শন। কর্মের মাধ্যমে বাস্তবজীবনের প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই 'মানুষ' রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করা সম্ভব। 

         প্রকৃত শিক্ষাই মানুষকে 'মানুষ' করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, যুগোপযোগী শিক্ষার, আধুনিক জ্ঞানের আলো না পেলে ভারতবাসী ভবিষ্যতে সত্যিকারের 'মানুষ' হয়ে উঠতে পারবে না। এইজন্য দেশের শিক্ষাসমস্যা ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কীয় বিভিন্ন রচনায় তিনি নিজের সুচিন্তিত মতামত জানিয়েছেন। আর শুধু অভিমত জানিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, শিক্ষাব্রতী কবি 'বিশ্বভারতী' ও 'শান্তিনিকেতন' প্রতিষ্ঠা করে নিজের কর্মসূচীকে সার্থকভাবে রূপায়িত করেছেন। শান্তিনিকেতনের মতো প্রকৃতির মুক্ত পরিবেশে শিক্ষাদান পদ্ধতি অত্যন্ত বিরল। উদ্ভাবনীশক্তি ও সহানুভূতি----উপযুক্ত শিক্ষকতার যে দুটি বিশেষ গুণ, তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। 'শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ও সাধনা' বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেছেন সুধীর চন্দ্র কর। সেখানে লেখক বলেছেন, "রবীন্দ্রনাথ মানুষকে দেশের মধ্যে দেখেছেন, দেখেছেন বিদেশ থেকেও। তাঁর জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেম আন্তর্জাতিকতা বা মানবতাবাদের পরিপন্থী নয়। গঙ্গোত্রীর মতো উৎপত্তি ও গতিমুখে আঞ্চলিক হতে হতে তা সমুদ্র হৃদয়ে মিশে গিয়ে হয়েছে বিশ্বলোক ব্যাপ্ত।"





       রবীন্দ্রনাথ কখনই বাস্তববিমুখ, সংসারপলাতক, ভাববিলাসী কবি ছিলেন  না। স্বদেশ ও স্বজাতিকে তিনি প্রবলভাবে ভালবাসতেন। দেশকে বড় করতে, দেশের মর্যাদা বাড়াতে তাঁর প্রয়াস ছিল অন্তহীন। মনেপ্রাণে তিনি বাঙালি ছিলেন----মানসিকতার দিক দিয়ে ছিলেন ভারতীয়। তিনি উপলব্ধি করেন যে, একটি জাতি যখন দীর্ঘদিন ধরে পরাধীন হয়ে থাকে, তখন তার আত্মবিশ্বাস, কর্মশক্তি ও সাহস ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়। বাঙালিজাতির তৎকালীন অবনত অবস্থার জন্য কবির অন্তরের সুগভীর খেদোক্তি তাঁরই ভাষায় প্রকাশিত :

       "সাতকোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,

        রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।"

        রবীন্দ্র রচনাবলীর একটি বড় অংশ স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদের আদর্শে রচিত। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিকতাবাদে। এই বিষয়ে ১৯০৮ সালে  'প্রবাসী' পত্রিকায় তিনি 'পূর্ব ও পশ্চিম' নামক প্রবন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন। বিশ্বমানবের মুক্তিলাভকেই তিনি স্বাধীনতা মনে করতেন। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলাদেশে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবোধের বন্যা এসেছিল। তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল ১৯০৫ সালে----চতুর বৃটিশ শাসকের করা বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে। স্বদেশী আন্দোলনে কবি যোগদান করলেন, রাজনীতির আঙিনায় এসে দাঁড়াতে তাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা হল না। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কবি গর্জে উঠলেন----বক্তৃতা দিয়ে, কবিতা ও গান লিখে তিনি বাঙালির জীবনে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনার ঢেউ তুললেন। ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে বিশ্বের মহত্তম 'নোবেল পুরস্কার' পান, আর ঠিক দুবছর পরেই ১৯১৫ সালে ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে 'স্যার' উপাধি দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র ভারতীয়দের ওপর নির্দয়ভাবে গুলি চালিয়ে বৃটিশ সরকার যে বর্বরতা প্রদর্শন করে, তার প্রতিবাদে মানবদরদী কবি বৃটিশশাসকের প্রতি চরম ঘৃণায় সেই 'স্যার' উপাধি বর্জন করেন। পাঞ্জাবের সেই মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে তৎকালীন বড়লাটের কাছে অগ্নিস্রাবী ভাষায় যে চিঠি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তা অবিস্মরণীয়। শক্তিস্পর্ধিত শাসকের রক্তচক্ষুকে তিনি ভয় করেননি।

         মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনা কিন্তু এই দেশের গন্ডীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। একাধিক বার তিনি ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। সর্বত্রই তিনি পেয়েছেন বিপুল সম্বর্ধনা এবং শুনিয়েছেন মৈত্রীর বাণী। রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি সম্পর্কে ধূর্জটিপ্রসাদ লিখেছেন  :  "রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের ( ন্যাশনালিজম ) পার্থক্য অনেক। তিনি দেশমাতাকে বন্দনা করেই চরিতার্থ নন, জনগণের মনের জাগ্রত অবস্থাই তাঁর কাম্য।" 

          প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালীন রবীন্দ্রনাথ অসত্য ও মিথ্যার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন-----তাঁর হাতের লেখনী হাতিয়ারে পরিণত হয়। পৃথিবী তখন রণোন্মত্ত। পশ্চিমের স্বৈরাচারী জঙ্গী ফ্যাসিবাদকে তিনি তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানাতে শুরু করেন। এইখানে তাঁর মানসিক গঠনের পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। মাত্র সতেরো বছরের বয়সেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'কবি কাহিনী' প্রকাশিত হয়। এতে তিনি লিখেছিলেন  :

       "যা দেখিছ, যা দেখেছ, তাতে কি এখনো

        সর্বাঙ্গ তোমার, গিরি, উঠেনি শিহরি 

        কি দারুন অশান্তি এ মনুষ্যজগতে,

        রক্তপাত, অত্যাচার, পাপ, কোলাহল 

        কত কোটি কোটি লোক, অন্ধকারাগারে

        অধীনতা শৃঙ্খলেতে আবদ্ধ হইয়া

                ভরিছে স্বর্গের কর্ণ কাতর ক্রন্দনে।"

আবার আশি বছর বয়েসে তিনি পরিণত মানসে লিখেছেন  :

        "কোটি কোটি মানবের শান্তি স্বাধীনতা

         রক্তময় পদাঘাতে দিতেছে ভাঙিয়া

         তবুও মানুষ বলি গর্ব করে তারা

         তবু তারা সভ্য বলে করে অহঙ্কার।"

         এই কবিতাদুটি থেকেই বোঝা যায়, সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও কবির মানবতাবাদী মানসিক গড়নের কোনও পরিবর্তন হয়নি। লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত মানব সমাজের প্রতি তাঁর অসাধারণ অনুরাগের ফলেই তিনি "সভ্য নামধারী মানব আদর্শের এত বড় নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ" দেখে সেইদিন আতঙ্কিত হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে যখন সাম্রাজ্যবাদী জাপান অসহায় চীনকে আক্রমণ করে সেই দেশের এক বৃহৎ অংশকে গ্রাস করে, তখন রবীন্দ্রনাথ শিহরিত হন। তৎকালীন জাপানী কবি নোগুচি ইয়োনেজিরো-কে লেখা একটি চিঠিতে অসহায় চীনের প্রতি তিনি অকৃত্রিম বেদনা প্রকাশ করেন এবং জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে ধিক্কার জানান। একজন জাপানী কবি হিসাবে নোগুচিকে তিনি দেশীয় সরকারের নিন্দনীয় কাজের প্রতিবাদ করতে আবেদন জানান। 

         চেকোশ্লাভাকিয়া যখন নাৎসী বাহিনীর দখলে চলে যায়, তখন রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। তাঁর লেখনীতে তখন বিশ্বাসভঙ্গজনিত ক্লান্তি ফুটে ওঠে, 'আহ্বান' কবিতায় তিনি লেখেন  :

        "বিশ্বজুড়ে ক্ষুব্ধ ইতিহাসে,

                অন্ধবেগে ঝঞ্ঝাবায়ু হুঙ্কারিয়া আসে

         ধ্বংস করে সভ্যতার চূড়া।

         ধর্ম আজি সংশয়েতে নত

         যুগ যুগের তাপসদের সাধনাধন যত,

                 দানবপদ দলনে হল গুঁড়া। 

         তোমরা এস তরুণ জাতি সবে

                মুক্তিরণ ঘোষণাবলী জাগাও বীরবরে,

         তোলো অজেয় বিশ্বাসের কেতু।

         রক্তে রাঙা ভাঙন ধরা পথে

                দুর্গমেরে পেরোতে হবে বিঘ্নজয়ী রথে

         পরাণ দিয়ে বাঁধতে হবে সেতু।"

ক্ষোভ, রোষ, দুঃখ, অপমানের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ আশার বাণী শোনাতে পারতেন। এই কবিতাতেও তা তিনি শুনিয়েছেন।

         ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে রবীন্দ্রনাথের ওপর জমিদারী দেখাশোনার ভার পড়ে। পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে সেই কাজে তাঁকে ঘুরতে হত। সুদীর্ঘ দশটি বছর তাঁর কেটেছে পদ্মাতীরে শিলাইদহে। সেই সুযোগে তিনি দেশের আকাশ-বাতাসকে চিনে নিয়েছেন-----পরিচিত হয়েছেন বাঙলার পল্লীপ্রকৃতি ও গ্রামাঞ্চলের সুখদুঃখময় সহজ সরল জীবনযাত্রার সাথে। উদার প্রকৃতির সংসার ও সুবৃহৎ মানবসংসারের নিকটসান্নিধ্যে এসে তিনি এক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন। শচীন্দ্রনাথ অধিকারী শিলাইদহের সেরেস্তায় বহুকাল কর্মী ছিলেন, তাই তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন। দেশের মাটি আর মানুষের সাথে কবির কেমন যোগাযোগ ছিল, তা শচীন্দ্রনাথের 'শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থ পাঠ করলে জানা যায়। কর্মী ও জমিদার রবীন্দ্রনাথের এক বিচিত্র রূপ এই গ্রন্থে আঁকা হয়েছে। কুটির শিল্পের প্রচলন, ব্রতীবালকদল গঠন প্রভৃতি কাজে রবীন্দ্রনাথের অসীম আগ্রহের কথা তিনি বিস্তারিত লিখেছেন। ১৯২২-২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ 'বেহালা' গ্রামে পল্লীসংস্কারের উদ্দেশ্যে জামাতা নরেন্দ্রনাথকে পাঠান এবং সেখানে কর্মীসংঘ, চরকা ও তাঁত, নাইট স্কুল, কুটির শিল্প স্থাপন ---- এইসব কাজে প্রচুর অর্থব্যয় করেন। শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর গ্রন্থে পল্লীসংগঠনের উদ্যোক্তা রবীন্দ্রনাথ এক নতুন ভূমিকায় উজ্জীবিত। 

        প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের অকৃত্রিম মানবপ্রেম কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক গন্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, ভাবের বিনিময় না হলে বিশ্বমৈত্রী প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনসেতুরূপে তিনি একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন----বিশ্বভারতী। এই বিশ্বভারতী একদিন সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলনস্থল হয়ে উঠবে, কবি এই আশাই পোষণ করতেন। 

        ১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এই সময়েই আমেরিকাবাসী তাঁকে সঠিক উপলব্ধি করেছিল শুধু প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার একজন প্রতিনিধি হিসেবে নয়, স্বাধীন মানবাত্মার প্রতিভূরূপেও। আর শুধু আমেরিকা নয়, রাশিয়া, চেকোশ্লাভাকিয়া, জার্মানির মতো আরও যেসব দেশে তিনি গিয়েছেন, সেখানেই পেয়েছেন উষ্ণ অভ্যর্থনা। সেই সময়ের সমাজতান্ত্রিক জার্মান রাষ্ট্র জিডিআর ( তৎকালীন পূর্ব জার্মানি )-এর মানুষের কাছে 'রবীন্দ্রনাথ' একটি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন নাম। শুধু কবি হিসেবে নয়, যোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ হিসেবেও। তারা যথার্থই বুঝেছে, যে-কবির গীতিকাব্য মস্তিষ্কের কোষে সূক্ষ্মতম অনুভূতি জাগায়, প্রাথমিক দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠে ফ্যাসিস্ট আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবের স্বপক্ষেও সেই কবির সহযোগিতার পরিচয় পাওয়া যায়। সর্বোপরি প্রেম ও শান্তির বাণী এবং মানবিকতার আদর্শ প্রচারের জন্যই রবীন্দ্রনাথ সেই দেশের জনগণের বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেছিলেন। সেদেশের মানুষ বিশ্বাস করত, রবীন্দ্রনাথ নিজের দেশের মানুষের জন্য যা চেয়েছিলেন----সামাজিক ন্যায় ও উন্নতি----পূর্ব জার্মানি ছিল তারই বাস্তব রূপ।

         রবীন্দ্রনাথের মানবপ্রেম শুধু তাঁর সাহিত্যে বা বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি কর্মের মাধ্যমে সমগ্র মানবসমাজের উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। এদেশের অল্প শিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান চর্চাকে প্রসারিত করার জন্য তিনি শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞান-গবেষণাগার এবং টেকনিক্যাল বিভাগ খোলার জন্য যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন, তা আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে লেখা তাঁর বেশ কিছু চিঠি থেকে জানা যায়। "লোক বিজ্ঞান গ্রন্থমালা" সিরিজে বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক সহজবোধ্য পুস্তিকাগুলি তাঁর এই কর্মপ্রয়াসেরই সার্থক প্রতিফলন।

         প্রকৃত শিক্ষার মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ভারতবাসী তথা বিশ্ববাসীকে 'মানুষ' করে তুলতে চেয়েছিলেন। সমস্ত জীবন ধরে তিনি আনন্দ ও সুন্দরের জয়গান করেছেন। ভগবৎপ্রেমকে তিনি তাঁর কাব্যের মধ্যে নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভাষায় : "প্রেমই জীবনের শক্তি। এই শক্তি দিয়া আমরা জীবনে সফলতা লাভ করি এবং এই শক্তি দিয়াই আমরা ভগবানকে লাভ করিতে পারি।" রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন জীবন ও শিক্ষার প্রকৃত সমন্বয় সাধন। তাঁর মতো এমন উচ্চকন্ঠে আর কে মানবতার বাণী ঘোষণা করেছেন ? সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মদান প্রোজ্জ্বল মানবিকতা। তাঁর ঘোষিত এই মানবিকতার বাণীই পৃথিবীর দূরদূরান্তরের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। মানুষের মূল্যকে অকুন্ঠ স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন বলেই বিশ্ববাসীর তিনি অন্তরঙ্গ আত্মীয়। আর এই মানবপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়েই প্রতীচীর মহাপুরুষেরা বলেছেন  : "ভারতবর্ষ পৃথিবীর মধ্যে সার্থকতম দেশ।" নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপ্রেম আজ সমগ্র বিশ্বকে ভারতের দ্বারে এনে দিয়েছে। "এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে" দাঁড়িয়ে বিশ্ব আজ বিশ্বকবিকে প্রত্যক্ষ করছে।



 
 
 

Comments


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page