top of page
Search

আগন্তুক ।। কবি প্রণাম সংখ্যা ।। প্রবন্ধ ।। তপন তরফদার


তুমি যত ভার দিয়াছো বন্ধু 

তপন   তরফদার

 

                   শৈশব থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিত্য নতুন ধরনের চিন্তা -ভাবনার ধারক ও বাহক হয়ে উদ্যমী  হতে দেখা গেছে।  আজীবন নতুন নতুন কর্মযজ্ঞের  সঙ্গে  সামিল হয়েছেন।তিনি আপন ভাবনার রূপদানে উৎসাহী হয়েছেন। আমরা কজনে জানি কালির বদলে ফুলের রস কে কালি হিসাবে ব্যবহার করে ফুলেল গন্ধ  পাওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন

        বলেন্দ্রনাথ অর্থাৎ বলাই শান্তিনিকেতন সাধনা শ্রমের ট্রাস্টডিড অনুসারে এখানে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনে তৎপর হয়েছিলেন। সেই সলতে পাকিয়ে রাখা প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের কাজে হাত দিলেন রবীন্দ্রনাথ।  ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ, আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেন "ব্রহ্মচর্য শ্রম" বিদ্যালয়ের।



  নিজের সীমিত সঙ্গতি দিয়ে মাত্র পাঁচজন কে নিয়ে বিদ্যালয়টি শুরু করেছিলেন। এই পাঁচজন ছাত্রের মধ্যে কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ অন্যতম। এর আগে শান্তিনিকেতনে তেমনভাবে কোন স্থায়ী কাজ হয় নি। বিদ্যালয় সংগঠনের কাজে সহায়তা করার জন্য পেয়েছিলেন সম বয়সী ব্রহ্ম বান্ধব উপাধ্যায়কে। এখানে উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে "গুরুদেব" বলার প্রবর্তন করেছিলেন সুহৃদ ব্রহ্ম বান্ধব উপাধ্যায়।       রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টি কর্মে প্রাচীন ভারতের গুরু গৃহে থেকে শিক্ষা লাভের প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ভাবনাকেই বাস্তবে রূপদান করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই বিদ্যালয় গড়ে তোলার পিছনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি লক্ষ্য ছিল …. প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদের বেড়ে ওঠা, পরিবর্তনশীল ভারতে শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে শিক্ষাদান এবং বৃহত্তর বিশ্বকে গ্রহণের উপযুক্ত করে তোলার জন্য জ্ঞানদান ।       রবীন্দ্রনাথ যে ভাবনা থেকে ব্রহ্মচর্য শ্রম গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন বাস্তবের অভিজ্ঞতায় সেখানে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ ছাত্রদের চেলির কাপড় পরিয়ে তাপস কুমার সাজানো গেলেও শিক্ষক মহাশয়রা সবাই তপস্বী নয়…. তাঁদের সংসার আছে, আছে নিত্য অর্থের প্রয়োজন। অপর দিকে রবীন্দ্র আদর্শে মুগ্ধ হয়ে মুখে মুখে জয়গান গাওয়ার লোকের অভাব না থাকলেও অর্থ সাহায্য করার বিষয়ে অভাব ছিলো যথেষ্টই। তাই আশ্রম ধীরে ধীরে বোর্ডিং স্কুলে পরিণত হয়। শুরু হয় ছাত্রদের অবৈতনিক শিক্ষাদানের বদলে ছাত্র ও অভিভাবকদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্বন্ধ স্থাপন। তবুও কবির এই ভাবনা স্বতন্ত্রতার দাবী রাখে।  " যত্র বিশ্বম্ ভবত্যেক নীড়ম্ ।" বিশ্ব এক নীড়ে পরিণত হবে, এই  ভাবনা থেকেই এই বিদ্যালয় ১৯২১ সালে  "বিশ্বভারতী" বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে।" পৃথিবীর মধ্যে আমাদের এই আশ্রম এমন-একটি জায়গা হয়ে উঠুক যেখানে ধর্ম ভাষা এবং জাতিগত সকল প্রকার পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা মানুষকে তার বাহ্যভেদমুক্তরূপে মানুষ বলে দেখতে পাই।" এই ছিল কবির অন্তরের কথা। তাই "শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী" শুধুমাত্র তাঁর স্বপ্ন ও সাধনা ছিল না, ছিল তাঁর আত্মার টান।

           মৃত্যুর কিছুদিন আগে এ সম্পর্কে লিখেছিলেন-     "যখন রব না আমি মর্ত্য কায়ায় /  তখন স্মরিতে যদি হয় মন / তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায় /  যেথা এই চৈত্রের শালবন।"         রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৪০ সালে  গান্ধিজিকে বলেছিলেন যে, তাঁর অবর্তমানে তিনি যেন এই "বিশ্বভারতী" প্রতিষ্ঠানটিকে ভুলে না থাকেন। গান্ধীজিও পরে কবির সেই বার্তাটি জানিয়েছিলেন দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আজাদকে। সেই কারণে ১৯৫১ সালে "বিশ্বভারতী" ভারতের প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেয়েছে। আচার্য হলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, উপাচার্য হলেন কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিন থেকেই চেয়ে এসেছেন "বিশ্বভারতী" হবে বিশ্ব ও ভারতের মিলন ক্ষেত্র যেখানের আকাশে ও আত্মায় থাকবে অবিচ্ছিন্ন মানবতার আদর্শ। আবার আশঙ্কাও করেছিলেন,“আমি যতদিন আছি ততদিন হয়তো এ বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারি, কিন্তু আমার অবর্তমানে কার আদর্শে চলবে?..."         শিক্ষায় আমুল পরিবর্তন আনতে, ইংরেজ প্রবর্তিত দমবন্ধ শিক্ষা  ব্যবস্থার প্রতিবাদী বিকল্প হিসেবে শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার আশ্রম বিদ্যালয় কে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরিত করার উদ্যোগ ছিল রবীন্দ্রনাথের।  এই ভাবনাকে আকার দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এবং তার পরিবারকে অনেক মানসিক ও আর্থিক কষ্টের  ভিতর দিয়ে এগোতে হয়েছিল। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর  গয়না বিক্রি করে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ হারিয়েছেন স্ত্রী, মধ্যমকন্যা এবং কনিষ্ঠ পুত্রকে।  জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ পুত্রবধূ প্রতিমা আর কনিষ্ঠ কন্যা মীরার জন্য যে বিশ্বভারতী আর শান্তিনিকেতন কে রেখে রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানই এক সময় তাদের কাছে হয়ে উঠেছিল দুঃসহ বেদনার।

                     “বিশ্বমিলনের তীর্থস্থান” হিসেবে বিশ্বভারতী বহু ‘ত্যাগ-স্বীকারী’, ব্যতিক্রমী শিক্ষক এবং কর্মী পেলও, শেষ পর্যন্ত তার আদর্শ রক্ষায় শান্তিনিকেতনের আশ্রমস্থ সদস্যদের  উপর বিশেষ ভরসা করতে পারেননি। প্রতিষ্ঠার সাত বছর মাথায় প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশকে লিখেছেন, “বিশ্বভারতী প্রায় একলা আমার মনেই আইডিয়া রুপেই রয়ে গেল।“ তার জীবনাদর্শ এবং কর্মের প্রতি শান্তিনিকেতনবাসীদের যে এক ধরনের উদাসীনতা মিশ্রিত উপেক্ষা রয়েছে এ কথা রবীন্দ্রনাথ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছেন, কিন্তু বিশ্বভারতী নিয়ে তার ভাবনার রূপদানে বিরত হননি। 

                 “ভয়শূন্য” পরিবেশে, দারিদ্র্যের ভূষণে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে গভীর অধ্যায়ন, প্রাচ্য এবং প্রতীচীর ভাবের মেলবন্ধন, যুক্তির চর্চা, মানবিক মন আর নান্দনিক বোধ গড়ে তোলা, নিজেকে প্রকাশ করার শিক্ষার পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন শ্রদ্ধা আর সহযোগের সম্পর্কে বিশেষভাবে সহায় হবে বিশ্বভারতীর। কবির মোহভঙ্গ হয়েছিল। আর্থিক সংকটের পাশাপাশি উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব, দলাদলি, সঙ্কীর্ণতা, বিশ্বভারতীর প্রশাসনিক জটিলতায়  রবীন্দ্রনাথ জেরবার হয়ে যান। ১৯০৯ সালে  ক্ষিতিমোহন সেনকে   লিখেছেন, “রথী একটা কথা লইয়া দুঃখ প্রকাশ করেছে।  “অধ্যাপকদের কেহ কেহ ছাত্র সমক্ষেই অন্যান্য অধ্যাপক ও ছাত্রদের সম্বন্ধে বিরুদ্ধ সমালোচনা করেন -- শুনিয়া আমি ক্ষোভ অনুভব করিতেছি।” আদর্শের কথা লিখতে গিয়ে ১৯২৯ এ অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীকে কবিগুরু লিখলেন, “অন্য দেশের লোকের কাছে যখন  শান্তিনিকেতন কথা বলি তখন এইসব আদর্শের কথা বলে থাকি এবং তা শুনে তারা বিস্ময় বোধ করে -- কিন্তু এগুলি যে অধিকাংশই অনুষ্ঠিত না হয় তাহলে আমার পক্ষে তার চেয়ে লজ্জার বিষয় কিছুই হতে পারে না।“ বিশ্বভারতীর কাজে বাবার পাশে ছায়ার মতো থাকা পুত্র রথীন্দ্রনাথ কবির কানাডা ভ্রমণের সময় তার থেকে বিদ্যালয় পরিচালনার অস্থায়ী দায়িত্ব পেয়ে  বিশ্বভারতী সমিতির একাংশের বিদ্রুপের পাত্র হয় , আশ্রমে পরিবারতন্ত্র কায়েম করার অভিযোগ শুনে ক্রুদ্ধ  রবীন্দ্রনাথ নির্মল কুমারী মহলানবীশকে ১৯২৯-এ লিখলেন, “যে ভার আমার সে ভার আমি প্রাণ দিয়ে পেয়েছি – আমিই  জানি সে ভার কার উপর দেওয়া চলে -- কিন্তু আমি বেশি দিন বাঁচবো না -- এবং অচিরকালের মধ্যেই ডেমোক্রেসির জয়পতাকা আমার সৃষ্টির বুক ফুঁড়ে আকাশে উড়বে।” বিশ্বভারতীর কারণে রথীন্দ্রনাথের অপমান নিয়ে নিজের অবস্থান জানিয়ে নির্মল কুমারীকে কবি লিখেছিলেন, “সে আমার আপন লোক বলেই তাকে বাধা ও অপমান সইতে হবে। এটা তো তার উত্তরাধিকার।” আরও লিখেছেন, -- বিশ্বভারতী সম্বন্ধে মমতাবোধ করতে আমার হাসি পাচ্ছে-- কিছু আসে যায় না এটা কিভাবে টিঁকে যায়। আমার ধ্যানের সামগ্রী আইডিয়া রুপেই থাকবে -- বাকিটা সরকারি মালের নৌকায় বোঝাই করে দিয়ে ডিমোক্রেসির হাটে তার যে গতি হয় হোক।“

              নিজের পরিবারের বাইরে রবীন্দ্রনাথ যাদের স্নেহ করতেন, যাঁরা তাকে ঘিরে রাখতেন, তাঁদের অনেকের, এমনকি বিশ্বভারতীর আচরণও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতিকূলে গিয়েছিল। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে এযাবৎ অপ্রকাশিত কিছু চিঠি পত্র দেখা যাচ্ছে যা পড়লে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কবির মৃত্যুর পর বিয়ে ভেঙে যাওয়া, প্রায় কপর্দক শূন্য কন্যা মীরা কঠিন অসুখে ভুগছেন। নিজের বাসভবন ‘মালঞ্চ’র আম বিক্রি করে, বাড়ি ভাড়া দিয়ে, রেশন তুলে সংসার  চালাতে হচ্ছে। উত্তরায়ণের পরিচারকেরাও তাঁর ডাকে আর সাড়া দিচ্ছে না। কন্যা এবং জমাতার কাছে অর্থের জন্য ক্রমাগত হাত পাততে হচ্ছে। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় বিশ্বভারতীর অ্যাম্বুলেন্স-এ যেতে আধিকারিকদের সিদ্ধান্তের  মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে। উপাচার্য কোন খবর নেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য বিশ্বভারতী মীরাকে ‘বিল’ ধরাচ্ছে।

 জামাতা কৃষ্ণ কৃপালনীকে মীরা লিখেছেন, “সকলের কাছে এরকম করে ভিক্ষে নিয়ে বেঁচে  থাকতে হবে মনে করে আমার খুব দুঃখ হয়েছিল।“ কন্যা নন্দিতাকে মীরা লিখেছেন, “দুঃখ হয় যে বাবা এত কষ্ট করে লোকের কাছে ভিক্ষে করে যে বিশ্বভারতী রেখে গেলেন কান্ডারীর অভাবে আজ তা তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে কোন পথে চলছে। শুনছি নাকি আরো ১৫০ টা বাড়ির তৈরি হবে তা হলেই বুঝতে পারছি ওখানকার  প্রাকৃতিক দৃশ্য আর থাকবে না।“ নন্দিতার অকাল মৃত্যুতে বিশ্বভারতী তাঁকে স্মরণে সম্পূর্ণ নিরাৎসহ দেখে  সদ্য কন্য হারা মীরা যার পর নাই আহত হচ্ছেন।

         কবির পরিবারকে অন্ধকারে রেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য মহলানবিশ দম্পতিকে দায়ী করে ১৯২৮ এ প্রতিমা দেবী মীরা কে লিখেছেন, ”প্রশান্ত মহলানবিশ জানে বাবা মশায়ের উপর তার প্রভাব এখন বেশী নেই তার কারণ রাণীর প্রভাব বেশি কাজেই রাণীকে দিয়ে সে নিজের কাজ উদ্ধার করিয়ে নেয়।“ ভানুদাদা’র মৃত্যুর পর রানু মূলত রবীন্দ্রনাথের ছবির জন্য কবি পুত্রের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেখে প্রতিমা বিরক্ত হচ্ছেন। রানুর থেকে কিছু সাহায্য চেয়ে না পেয়ে নন্দিতাকে লিখেছেন, “ও বড্ড স্বার্থপর এবং হাল্কা প্রকৃতির মেয়ে।“

আশ্রম বিদ্যালয় আর বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কেন ঘর আর বাহিরের আগলটুকু ভেঙে নিজের আর পরিবারের সামনে খুলে দিলেন বিপর্যয়ের এক সিংহদরজা। বাবামশায়ের মৃত্যুর পর উদয়নের অন্তঃপুর ক্রমশ বিশ্বভারতী গ্রাস করে নিচ্ছে দেখে প্রতিমা ব্যথিত হচ্ছেন। মীরা অভিযোগ করছেন বৈষয়িক স্বার্থে তাঁর বৌঠানকে এক নিকট আত্মীয় হাতের পুতুলে পরিণত করেছেন। আশ্রমের কুৎসা আর অবিচারের শিকার, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ পদত্যাগ করে চিরতরে শান্তিনিকেতন ছেড়ে আশ্রমের ড ইংরেজি শিক্ষকের স্ত্রীর সঙ্গে দেরাদুনে বসবাস করার সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সব দেখে প্রতিমা নন্দিতাকে লিখেছেন, “সত্যি বলছি বুড়ী, আমাদের আর বেঁচে সুখ নেই। সব দিক থেকেই একটা বিতৃষ্ণা আসছে।“ বাবার শতবর্ষে বিশ্বভারতীর আমন্ত্রণ টুকুও পাচ্ছেন না রথীন্দ্রনাথ। নিজের জীবন আর পৈত্রিক সম্পত্তি প্রায় পুরোটাই বিশ্বভারতীকে সমর্পণ করেও তহবিল তছরুপের মামলায় জড়াচ্ছেন। ১৯৫৪য় এক করুণ চিঠিতে কবির স্নেহ ধন্য, দিল্লীর ক্ষমতায় অলিন্দে আনাগোনা করা

 অনিলকুমার চন্দকে তার “রথীদা” লিখছেন, “আমি শুনে আশ্চর্য ও মর্মাহত হয়েছি যে তুমি আমার নিন্দা বিশেষত পণ্ডিতজী ও বিধান বাবুর কাছে করতে বিরত হওনি। আমার সম্পত্তির সব বিক্রি করে দিচ্ছি-- এ খবরটা সত্য না মিথ্যা আমার কাছ থেকে জানতে কি কোন বাধা ছিল?  --নানা ষড়যন্ত্রে আমাকে চলে আসতে হয়েছিল। তোমরা কি এখনো আমাকে শান্তি দেবে না?”

মৃত্যুর কিছুদিন আগে এ সম্পর্কে লিখেছিলেন-   "যখন রব না আমি মর্ত্য কায়ায় /   তখন স্মরিতে যদি হয় মন   / তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়  /  যেথা এই চৈত্রের শালবন।"      রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৪০ সালে  গান্ধিজিকে বলেছিলেন যে, তাঁর অবর্তমানে তিনি যেন এই "বিশ্বভারতী" প্রতিষ্ঠানটিকে ভুলে না থাকেন। গান্ধীজিও পরে কবির সেই বার্তাটি জানিয়েছিলেন দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আজাদকে। সেই কারণে ১৯৫১ সালে "বিশ্বভারতী" ভারতের প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেল। আচার্য হলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, উপাচার্য হলেন কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিন থেকেই চেয়ে এসেছেন "বিশ্বভারতী" হবে বিশ্ব ও ভারতের মিলন ক্ষেত্র যেখানের আকাশে ও আত্মায় থাকবে অবিচ্ছিন্ন মানবতার আদর্শ। আবার আশঙ্কাও করেছিলেন,“আমি যতদিন আছি ততদিন হয়তো এ বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারি, কিন্তু আমার অবর্তমানে কার আদর্শে চলবে?..."  “ডেমোক্রেসির জয়” পতাকা উড়াবার আশঙ্কায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিষ্ঠানের সব দায়িত্ব দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন প্রিয় পুত্র আর বৌমাকে ১৯৩৮এ এক চিরকুটে লিখে গিয়েছিলেন, “আমার অবর্তমানে এখানে ভূতের কীর্তন কেমন হবে তা এখন থেকে কল্পনা করতে পারি নে।“ যে রুচিবোধের উৎকর্ষের সর্বোপরি মানুষের সঙ্গে মানুষের ভাবনাকে মিলিয়ে দেওয়ার সীমানাবিহীন উদার ক্ষেত্রে হিসেবে কবি দেখতে চেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটিকে, তা  যেন শুধুই রয়ে গেল তাঁর এক আইডিয়া থেকে গেল আইডিয়া হয়েই।  

  আজ আমরা রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষজন সত্যিই কি এ বিষয়ে চিন্তিত নয়! বিশ্বভারতী ধীরে ধীরে কবির সেই উদার উন্মুক্ত আদর্শের পরিবর্তে কি রক্ষণশীলতার নামান্তরে পরিণত হচ্ছে না!   কবির সুরে বিশ্বভারতীর বীণার তার বাঁধা শেষ হলো না আজও।



 
 
 

Comments


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page