কুসুমহার
শ্যামাপ্রসাদ সরকার।
ভূমিকা-
ওই যে দীর্ঘদেহী এক আয়তচোখের অমিতকান্তি যুবা এগিয়ে আসছে ক্রমশঃ। সেই স্বয়ং নবদ্বীপ- চন্দ্র গৌরহরি। তাঁর অপরূপ কান্তি দেখলে মনে হয় যেন স্বয়ং বংশীধর যেন লীলাচ্ছলে আবার ধূলোমাখা এই মর্ত্যেভূমির বুকে নেমে এসেছেন।
আমরা তাঁর ফেলে আসা সেই পথটি ধরে একবার চলে যাই সেই পাঁচটি শতাব্দীর অতিক্রমণে। অন্য এক কাহিনীর মোড়কে দেখাই যাক না সেই গৌরসুন্দর'কে আর একটি বার।
....................................
উৎসর্গ- আমার মা স্বর্গীয়া শ্রীমতী অদিতি সরকারের চরণে প্রণাম জানিয়ে রেখে গেলাম নিশ্চুপে!
............
(১)
গঙ্গানদীর এই অঞ্চলে তার অতি মনোহর রূপটির জন্য সবাই তাকে ভালবেসে সুরধূনীর তীর বলে ডেকে থাকে। এই অঞ্চলটি নদীমাতৃক হওয়ায় সৃষ্টির আদি থেকেই যেন চিরহরিৎ ও শস্যশ্যামলা। নদীর জলতরঙ্গ যেন কখনো কখনো স্থানীয় মানুষের ভাবতরঙ্গে এসে হঠাৎ হঠাৎ মিশে গিয়ে একটা প্রাণের হিল্লোল তুলে দিয়ে যায়। তখন নদী আর মাতৃকার স্বরূপ আকস্মিকভাবে একীভূত হয়ে পড়ে।আসল কথা হল এই যে নদীবক্ষে আসা নিয়ত জোয়ারের স্রোত এর বহুদিনের অচলাবেশটিকেও যেন প্রাণময় করে দিয়ে এক নতুন জন্মচক্রের পরম্পরায় তাকে অকারণ যেন মূল্যবান করে দিয়ে যায়।
........................
বঙ্গদেশে যদিও এখন আর পুরনো দিনের সেই নির্মল শান্তিটি নেই। বরং তার বদলে এখন নতুন আসা ইসলামধর্মের সুলতানী শাসন আস্তে আস্তে তার পুরাতনী সাজপোষাকে বদল আনছে। স্থানীয় প্রশাসকটি হল সুলতান হোসেন শাহের নিযুক্ত ও বশংবদ। এই কাজীটির নাম চাঁদ মোহাম্মদ। তাকে এ অঞ্চলে সবাই অত্যাচারী চাঁদ কাজী বলেই ডাকে।
সে এসেই ইতিমধ্যে গৌড়ভক্তজনোচিত সমবেত নামসংকীর্তন আর শ্রীখোলের শব্দটিকে বন্ধ করার আদেশ দিয়ে একটা ফতোয়া জারি করেছে। এই শান্তিপূর্ণ নির্বিরোধী জনপদটিতে এসব ক্রমেই গোপনে আপাত নিরীহ কিন্তু আদর্শ ভক্তমনের ভেতরে ভেতরে এক প্রবল অসন্তোষ ডেকে আনছে।
এইসব নিয়েই ঘাটের কাছে প্রাচীন তেঁতুল গাছের সামনে কয়েকজন যুবা ও মাঝবয়সী মানুষ এখন জড়ো হয়ে ভীষণ উত্তেজিত কন্ঠে আলোচনা করছে। এদের মধ্যে আজ অন্যতম প্রবীণ পন্ডিত ও শান্তিপুরনিবাসী শ্রী অদ্বৈত আচার্য্যও এসে উপস্হিত। এই জন্য উত্তেজিত জনতার মাথার শিখার অর্কফলাগুলিও তাঁর প্রশ্রয়ে এক্ষণে ঈষৎ জোরেই যেন এখন বেশী করেই আন্দোলিত হচ্ছে।
ওদের এই আলোচনার কেন্দ্রভাগে এক মনোরম দেহলক্ষণ বিশিষ্ট যুবা গম্ভীর ভ্রূভঙ্গী করে নির্বাক হয়ে এসব শুনছে। তার শালপ্রাংশু মহাভূজ দেহাকৃতিটি প্রকৃতই সুডৌল ও সুগৌর। স্থানীয় যুবকের মধ্যে সে বর্তমানে নেতাগোছের হয়ে উঠেছে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই।
সে জগন্নাথ মিশ্রের কনিষ্ঠ পুত্র। পিতৃদেবের অকস্মাৎ দেহত্যাগ আর তার অল্প আগেই জ্যেষ্ঠভ্রাতা বিশ্বরূপ গৃহত্যাগী হয়ে ভক্তিবাদের এক নতুন সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে আচম্বিতে সন্ন্যাসজীবন বেছে নেওয়ায় এখন পরিবারের সব কিছুই তার একার কাঁধের ওপর এসে পড়েছে। আবার ইদানীং
এই ক'বছরে বঙ্গদেশে নবদ্বীপের নৈয়ায়িক কূলে তার পান্ডিত্যটি এখনই সবার বিশেষ আগ্রহ কেড়েছে বিস্ময়ের সাথে। স্মৃতি আর ন্যায়শাস্ত্রে তার কাছে তর্কযুদ্ধে পরাজিত প্রবীণ পন্ডিতদের অর্কফলাগুলি সে নিজে পুরষ্কারস্বরূপ কর্তন করে সহাস্যে আবার একটি কাঠের তৈরী বিচিত্র বাক্সে সংগ্রহ করেও রেখেছে। মাঝেমাঝে ওই কাঠের বাক্সটি খুলে সেগুলির দিকে সে খানিক চেয়ে থাকে আর মিটিমিটি মুখে দু্ষ্টুমীর চপল হাসি হাসে।
তাকে এখানে সবাই শচীদুলাল গৌরাঙ্গ বা গৌর বলেই ডাকতে সবাই অভ্যস্ত। আজন্ম তার মুখমন্ডলটি পূর্ণিমার চন্দ্রের মত জীবন্ত ও উদ্দীপক। আবার তার মধ্যে আরও বেশী সজীব ও সুগভীর তার সেই আয়ত চক্ষুদুটিতে একটা অণ্বেষণস্পৃহার অস্হিরতা সর্বদাই খেলা করে।
সংসারে একমাত্র মাতৃদেবী শচী ই আজন্ম তার বড় একান্ত প্রিয়জন। এছাড়াসসন্তানস্নেহে সস্ত্রীক স্বয়ং অদ্বৈত আচার্য্যও তাকে প্রচন্ড স্নেহ করেন।
সেই এখন নবদ্বীপের উদীয়মান কূলচূড়ামণি। বিদ্যা আর সৌম্যকান্তির একই দেহে এরকম সমাহার তো বিশেষ দেখা যায়না।
এতক্ষণ সবার কাছে উত্তেজিত বাদানুবাদ শুনে সে এবার দাঁতে দাঁত চিপে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অথচ বয়সে সামান্য জ্যেষ্ঠ শ্রীবাসের কাঁধে হাত রেখে জোর গলায় বলে উঠল , " আরে না ! না ! কীর্তন বন্ধ করার কোন প্রশ্ন উঠতেই পারেনা। আমি নিজে দরকার হলে কাজীর সামনে দাঁড়িয়ে সংকীর্তন করব। কারুর আর কোন চিন্তা নেই! এই সামান্য সমস্যাটির শীঘ্রই একটা সমাধা হয়ে যাবে। "
তারপর হঠাৎ মধ্যাহ্ণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে সচকিত হয়ে পরক্ষণেই সে আবার বলে উঠল,
" এখন বরং আমি স্নানে যাই। বেলা দ্বিপ্রহর হতে যায়। মা' হয়তো এখনো মুখে কিছু না তুলে আমার ফেরার প্রতীক্ষায়! কাজেই এখন আসি ! "
এই বলে অদ্বৈত আচার্য্যকে প্রণাম করে একছুটে সে ঘাটের দিকে দৌড়ে গেল।
এত সহজ গলায় তার মুখে অথচ দৃপ্তস্বরে এই কথাটা শুনে সবাই বেশ খুশী হয়ে উঠল।
কারণ, গৌরাঙ্গ নিজে বলেছে যখন এর একটা প্রতিকার সে করবেই।অগত্যা সভা ভঙ্গ করে সবাই এখন গৃহমুখী হওয়ার পথ ধরল।
......................
(২)
স্নানের ঘাটে একজোড়া কৌতুহলী চোখ নিবিষ্ট হয়ে এখন গৌরাঙ্গকে অবলোকন করছিল। সেই দর্শনপথে আবিষ্ট দু'জোড়া রমণীচক্ষু নদীবক্ষের জলবিন্দুর অঙ্গরাগ যুবাটিকে যে ক্রমশঃ অলৌকিক ও দেবতূল্য করে তুলেছিল বলে তার দিকেই তাদের কৌতুহলী দৃষ্টিপথটি নিবদ্ধ রেখেছিল অথচ তা গোপনেই। এতক্ষণে এই স্নানদৃশ্য তাদেল আচ্ছন্ন করে ক্রমশঃ ভূমার থেকে উঠে গিয়ে তাদের সেই স্মরোদ্দীপকপ্রবণ মনটাকে বরং এক দৈবপ্রেমের আকূতির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। এ যেন স্বর্গাদপী সুরূপে কোন ছদ্মবেশী জলদেবতা!
.......
অথচ জলবিহারে গৌরাঙ্গ যেন সেই স্বপ্নিল মায়াবলোকনের লেশমাত্রটিকে একবারের জন্যেও ভ্রূক্ষেপ না করে তার মহাভূজদ্বয়কে নিবিষ্ট সন্তরণের গতিতেই কেবল চালনা করছিল।
সে যেন অযথাই এরকম নিরাসক্তির ছদ্মবেশ ধরেই এক অদ্ভূত আনন্দ পেতেই অভ্যস্ত।
মাঝখান থেকে আজ তার পরণের কার্পাস বস্ত্রের লাল শাদা রঙের সেই শাটিকাটি অধৌত রয়ে গেল। একটি গোপনচারিণী মেয়েটির নাম হল লক্ষ্মীপ্রিয়া। সে নবদ্বীপের প্রখাত বল্লভদাস আচার্যের একমাত্র আদরিণী কন্যা। তার অবশ্য একটি অনুজ সবে জন্মেছে বলে সে এখন কার্যতঃ তার পিতা -মাতার দ্বিতীয় সন্তান হলেও বয়সে সেই জ্যেষ্ঠা।
লক্ষ্মীপ্রিয়া এখন সবে পঞ্চদশী হবার পথে সদ্য প্রবেশ করেছে। নবযৌবনটি তার সুকোমল পল্লবিত দেহে প্রেমের কুসুমরাজিকে সবেমাত্র ফোটাতে শুরু করেছে বলে ঈষৎ যেন সে নিজেই আকূলহৃদয়া হয়ে উঠছে। নদীঘাটে আজ অবশ্য সে একা নয় তার একান্ত সই 'বকুলফুল' সামান্য বয়সে জ্যেষ্ঠ্যা মানগরবিনী দাসীও তার সাথেই আজ এসেছিল বলে এতক্ষণ ধরে দুজনেই একসাথে সেই যুগপৎ বিস্ময় ও চিত্রার্পিতবৎ সন্তরণ দৃশ্যটি মোহিত হয়ে দেখছিল। ভাবছিল,
আচ্ছা! স্বর্গের দেবতারা কি এর চেয়েও সুন্দর হতে পারে কি?
মানগরবিনী যদিও গৌরাঙ্গকে এর আগে থেকেই চিনতো। তার নিজ খুল্লতাতের পুত্র নবনীদাস আর এই গৌর একদা গঙ্গাধর দাসের কাছে পোড়া মা' তলার পাঠশালায় অধ্যয়ন করতে যেত। আবার সে অতি অল্পবয়সেই প্রবীণ পন্ডিত অদ্বৈত আচার্যেরও স্নেহধন্য হয়ে ওঠে। সেও তো অনেককাল আগেরই কথা। আর তখন থেকেই যথেষ্ট স্মৃতিধর ও বুদ্ধিমন্ত। মানগরবিনী এই প্রবীণ ব্রাহ্মণ জগন্নাথ মিশ্র ও তাঁর পুত্রদ্বয়কে এযাবৎকালে একদা ভাল করেই চিনতো। যদিও তার নিজের অবশ্য একান্তভাবে গৌর-অগ্রজ বিশ্বরূপকেই মনে মনে মনে পছন্দ করা ছিল ভবিষ্যৎের কল্পিত দাম্পত্য ও তার অনিবার্য সুখময়তার অভিনিবেশে। কিন্তু সে সব কষ্টকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়ে কিছু্কাল পূর্বে বিশ্বরূপ এখন শংকরাণ্য পুরী নাম গ্রহণ করে সংসার ত্যাগ করে উধাও হয়েছে বলে সে তার কোমল নারীসুলভ মনচোরা আবেগটির কন্ঠরোধ করে নির্মম হাতে ইতি টেনে দিয়েছে।
বরং বিশ্বরূপের এই কনিষ্ঠ ভ্রাতাটিকে এযাবৎ সে ভ্রাতৃজ্ঞানে দেখলেও আজ লক্ষ্মীর সাথে সেও তাকে স্নানরত অবস্থায় গঙ্গাবক্ষে দেখতে দেখতে এক গর্হিত অপরাধবোধ সত্ত্বেও কন্টকিত হয়ে উঠেছে। গৌরহরি ইদানীং যে সত্যিই এতটা বড় হয়ে গেছে এই কয়েকমাসে সেটা সেও বোধহয় জানত না।
.....................
(ক্রমশ...)
Comments