top of page
Search

উপন্যাসিকায় শ্যামাপ্রসাদ সরকার - ২

agantukpotrika

কুসুমহার

শ্যামাপ্রসাদ সরকার


গত পর্বের পর...


৩)


একবুক লজ্জ্বায় সে তার বকুলফুলটিকে বাড়ি যাবার জন্য এবার সে গায়ে খোঁচা দেয়।  সে দেখে লক্ষ্মী  যেন কোন সুদূরগগনবিলাসী হয়ে স্থাণুবৎ হয়ে আছে। নিষ্পলক বিহ্বল দৃষ্টিতে সে ভিজে গায়েই দাঁড়িয়ে আছে এটা যেন তার বোধের অতীত হয়ে গেছে। আজ ওর মুগ্ধ চোখের ভাষায় যেটা আজ স্পষ্ট তা সে ভালো করেই জানে। কারণ সে নিজেও কতবার  বিশ্বরূপের বেলাতেও একইভাবে লক্ষ্মীপ্রিয়ার তা কাছে প্রকাশ করে ফেলেছে অজানিতেই। 


গৌর এবারে হঠাৎ স্নান সেরে ওদের দিকে স্মিত আননে এগিয়ে আসে।   " আরে! দিদি! কি খবর হে তোমাদের ? নবনীদাস কাটোয়ায় নতুন টোল খুলেছে বলে সম্প্রতিখবর পেলাম যেন!  স্মার্তদের স্বর্গরাজ্য নবদ্বীপে বুঝি তার স্থানাভাব হল? তা সেই কথাটা আমায় আগে বললেই তো হত! "


তারপর সে ঘাড় ঘুরিয়ে এবার সে লজ্জ্বাবনতা লক্ষ্মীপ্রিয়াকে দেখতে পাওয়ার ছদ্মঅভিনয় করে।  যৌবরাজ্যের প্রগলভতাকে ঈষৎ নিয়ন্ত্রণ করে সে আবার পরক্ষণেই বিশেষ ইঙ্গিতপূর্ণ কন্ঠে বলে ওঠে 


" আজকাল পন্ডিত বল্লভদাসের দ্বিতীয় সুকন্যাটির যে তার নবীনা হৃদয়ে নিজ বল্লভ লাভের ইচ্ছা হয়েছে দেখছি,  তাও দেখি আমায় বলনি  তো!"


মানগরবিনী চিত্রার্পিতের মত গৌরসুন্দরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার পাশে দন্ডায়মান লক্ষ্মীপ্রিয়ার তখন প্রায় " হে ধরণী দ্বিধা হও" গোছের অবস্থা। 


একটি সুউজ্জ্বল চন্দ্রমা যেন মেঘের আড়াল থেকে হেসে উঠল তার সুনিপুণ দন্তপঙক্তির মাধুর্য্যে। 


সে আবার ইঙ্গিতপূর্ণ স্বরে ঈষৎ বলে উঠলো, 


" আমার মাতৃদেবীর মুখে রোজ শুনি গৃহাভ্যন্তরে একটি তাঁর একটি পরমনিপুণা সেবিকার বড় প্রয়োজন! কিন্তু সেই গৃহকর্মনিপুণাটি আমাকেও কি তার হৃদয়ে স্থান দিতে সম্মত হবে?  


এমন প্রেমময়ী আদর্শ রমণী কি এই হট্টমেলার দেশে তোমার সন্ধানে আছে কি কেউ?" 


গৌরাঙ্গের চমকিত দুটি চোখের ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষাটি এতটাই স্পষ্ট যে এরপর আর কথা চলেনা। 


দুই সখীকেই নির্বাক রেখে গঙ্গার ঘাটে এই মোহময় পলটি যে আরো কিছুদিনের জন্য নিজেকেই  জীবনের অলীক নাট্যমঞ্চে বসাতে চলেছে সেটাই যেন মহাকালের এখন পরম অভীপ্সা আর সংকেত। গৌরের বক্তব্যে তার স্বরূপটিও যেন এখন প্রবলভাবে জাজ্বল্যমান। 


...................


                       


হাজার-হাজার মৃদঙ্গ এবং করতালসহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ে এক বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে আজ নবদ্বীপ-চন্দ্র নবীন গৌরাঙ্গ একাই। 


তারা সবাই এখন চাঁদ কাজীর সেই আইনটি অমান্য করে তাদের দল নিয়ে পথে বেরিয়েছে। সমবেত জনতার হুঙ্কার হল আজ কেবল হরিনাম আর অস্ত্রের বদলে মোক্ষম আয়ুধটি হল প্রেমাবেশের আলিঙ্গন।



এ হেন বিচিত্র শোভাযাত্রাটিকে নিয়ে এখন নবদ্বীপের পথে পথে মধুর স্বরে হরিনাম কীর্তন করতে করতে ওরা সবাই ধীরপদক্ষেপে  কাজীর বাড়ীর দিকে এগিয়ে চলেছে।  নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হয়ে এদিকে এখন প্রায় রাত্রি দ্বিপ্রহর। 



যদিও ওদের এই সমবেত রূপটিকে দূর থেকে দেখলে আজ যেন একটা ভয়ঙ্কর বন্যার স্রোতের মত মনে হচ্ছে বলে  ভয়ে তার  নিজের বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে বলে চাঁদ কাজী স্বয়ং আজ তার বাড়ির উপরতলার একটি ঘরে গিয়ে লুকিয়ে বসে আছে। 



ওদের একটি দলের  পুরোভাগে নেতৃত্বে স্বয়ং গৌর। অন্যদল দুটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তার ভ্রাতৃসম ও বন্ধুবর  নিত্যানন্দ ও প্রবীণ বিদগ্ধজন সেই অদ্বৈত আচার্য্য।



কি আশ্চর্য এত উত্তেজনার পরেও গৌরাঙ্গের মুখে তার পবিত্রতম স্মিত ও অমলিন হাসিটি লেগেই আছে। ক্রোধের মালিন্যটিকে সে যেন কবেই দূর করে দিয়ে আজকাল এক অন্য ভবিষ্যৎের পথে চলতে শুরু করেছে। 



কাজী এবার গলা খাঁকড়িয়ে যেন  খানিকটা বাধ্য হয়েই সেই জনসমুদ্রের সামনে এসে করজোড়ে দাঁড়াল। এই তো ক'দিন আগে তার লোকজন ওদের কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙে দিয়েছিল বলে আগেভাগেই আজ সবার সামনে এসে সে নিজে যে ক্ষমাপ্রার্থী সেটা জানাল।



আজ যেন একটি  অতিলৌকিক বিভায় গৌরাঙ্গের মুখমন্ডলটি বিধৌত। এখন সবার মনে হচ্ছে তার চোখের দিকে বেশীক্ষণ যেন তাকিয়ে থাকাটাই কঠিন। কাজী একটা তালপাতার পাতায় বাধ্য হয়ে একটা ফতোয়া লিখে সীলমোহরের ছাপ দিয়ে বলে ওঠে, 


" সংকীর্তনের ওপর এখানে আর কোনও নিষেধাজ্ঞা বজায় রইল না। সে বা তার ভবিষ্যৎ এর শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এটা মেনে নিতে দায়বদ্ধ ! "



সবাই দেখল যে গৌরাঙ্গের আপাতকঠিন মুখে নেমে এসেছে জ্যোৎস্নাময় সেই আকূল আলোকবর্তিকাটি। সে সহাস্যে এবারে এগিয়ে এসে স্বয়ং চাঁদ কাজীকেই আলিঙ্গন করে বসে। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে নরম অথচ দৃঢ়স্বরে বলে ওঠে, " বল হে সবাই  ! হরি বোওওওল্ !


 হা কৃষ্ণ! হে নয়নপথগামী! হে করুণাসিন্ধু! হে জগৎপতেএএএ..."।


.....................


                          (৪)


লক্ষ্মীপ্রিয়া তার আরেক গঙ্গাজল সৌদামিনী ওরফে 'সদু'র মুখে গতরাত্রের চাঁদ কাজীর পরাজয়ের আখ্যানের বর্ণনাটি একমনে শুনছিল। আর থেকে থেকেই তার চোখের সামনে কেবল একটি আজানুলম্বিত সুডৌল দেহের বিদ্যূৎ শিখাটির ছবিই  কেবল বারবার ভেসে উঠছিলো। আহা! গৌরাঙ্গের সেই  আয়তগম্ভীর চোখদুটোর মধ্যে তার একান্ত কালাকালের আত্মবিলোপকারী সম্বন্ধটিকে কে বা কারা যেন জোর করে লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে!


 আজ প্রথমবার ওই তেজস্বী যুবাটির কাঁধে নিজের মাথাটি রেখে কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থাকতে খুব ইচ্ছা করছে।


.............. 


                         


শ্রুত‍্যানন্দ বনমালী পারিবারিক বিষ-বৈদ‍্যর জীবিকা ছেড়ে এখন বিবাহ-ব‍্যবসায়ী ঘটকের ভূমিকায় সদ‍্য অবতীর্ণ হয়েছে। অর্ধেক পণ কড়ির বিনিময়ে সে এই প্রজাপতির নির্বন্ধের কাজটি করে থাকে। সে আবার গৌরের বাল‍্যসুহৃদ বলে তাকেই ডেকে দুপুরে ফলারের নিমন্ত্রণ করেছিলেন শচীদেবী।  খান ছয়েক সবরী কলা ও কাগমারী থেকে আনা দধিভান্ডটি নিঃশ্বেষ করতে করতে সে বলল অতি শীঘ্রই সে নিজেই  বল্লভদাসের গৃহে বরপণ স্বরূপ ছ'টি কড়ি ও মধুপর্ক নিয়ে গিয়ে তার জ্যেষ্ঠ কন‍্যাটিকেই না হয়  গৌরাঙ্গের জন‍্য চেয়ে আনবে। তাছাড়া সমগ্র নদীয়ায় তার মতো নাগর আর কে-ই বা আছে? 


শচী কান্না সামলে কাপড়ের খুঁট দিয়ে তার চোখের জল মোছে। স্বামীর মৃত্যু আর জ্যেষ্ঠ্যপুত্রটির অকালবৈরাগ্য তাকে এতদিন সংসার সম্পর্কে বীতস্পৃহই করে তুলেছিল। কিন্তু গৌর আজকাল দূরন্তপনা ছেড়ে বড়দের মত পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছে। এবার সে বিংশতি বর্ষে পড়তে চলেছে।



 তার মায়াবী মুখচন্দ্রটি দেখলে আবার নতুন করে ওর জন্য বেঁচে থাকতে সাধ হয়।


 


গৌর প্রকৃতই নবদ্বীপের এক উদীয়মান প্রতিভা। ওকে তো সবাই ভালবাসে। তাহলে একটি পাত্রীও কি ওর জন্য সহজে জুটতে পারেনা? ঘরে লক্ষ্মী আসলে ছেলের সংসারটি স্থিতি লাভ করে বিকশিত হবে। আর তারপর যদি নাতি..নাতনী আসে...আহা! ততোদিনের পরমায়ু কি শচী নিজে পাবেন?বরং শ্রীজনার্দনের পাদপদ্মে ঘুমিয়ে পড়ার আগে অন্তত গৌরের শ্রীবৃদ্ধিটুকু অন্ততঃ দেখে যেতে পারলেই এখন হয়...।


...............


গৌর আর ওর বন্ধু মুরারী আজ টোলের ভীড় থেকে বেরিয়ে এসে একটু গল্প করতে করতে নদীর ঘাট পর্যন্ত খানিক হেঁটে এল। আসলে সেদিনের পর  যে নবদ্বীপের সুলতানী শাসকগোষ্ঠী যে একটা মোক্ষম হোঁচট খেয়েছে আর তাতেই যে তাদের সম্বিৎ ফিরেছে সেটাই এখন লোকের মুখে মুখে ফিরছে। 



কিন্তু যার জন্য এই অসাধ্যটি শেষপর্যন্ত সাধিত হল সেই গৌরহরি কিন্তু এ বিষয়ে নির্বিকার। যেন তাদের ওপর কোনওরকম বিদ্বেষই তার মনোজগতে আর নেই। সে বরং থেকে থেকেই নির্মোহের মত গঙ্গার স্রোতের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। বাকী অন্যসময় সে ন্যায় আর স্মৃতির কি সব জটিল তত্ত্ব মন্হন করে আর থেকে থেকেই স্বপ্নালু দৃষ্টিতে কি যেন একটা খোঁজে। 



তখন মনে হয় তার মন যেন এই মাটীর পৃথিবীতে যেন থেকেও আর নেই। এমনকি তার বন্ধুবৃত্তের জগতেও তাকে এ নিয়ে ঠাট্টা করার মত কারোর সাহস নেই। 



সে যেন ভবসংসারের মধ্যে থেকেও কোথায়  কোন এক অপার্থিব আনন্দলীলার হাটে গিয়ে তার অন্তরাত্মাকে বিলিয়ে দিয়েছে বলে এখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে সর্বদা চেষ্টা করে আর তন্মধ্য অবস্থায় থাকে। 


..............


(ক্রমশ...)

18 views0 comments

コメント


bottom of page