কুসুমহার
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
( আগের পর্বের পর )
(৭)
আজ একটা দীর্ঘপত্র এসেছে সুদূর শ্রীহট্টদেশ থেকে। কিছুই না বিষয় - বিষের এ এক সামান্য আলোড়ন। এই সংবাদে শচী'র মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। তার নিজের পিতৃদেব নীলাম্বর চক্রবর্তী তো এখন অতি প্রবীণবয়সী ও তদ্বজনিত কারণে ঈষৎ অথর্বপ্রায় ! নৈলে এরকম পারিবারিক দূর্যোগে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ পৌত্রের পাশে থেকে স্বস্তি দিতেন সবাইকে।
"কী হবে এখন! সুখের দিনে এ কী আবিলতা! হে জনার্দন! রক্ষা করো বাছা 'দের।" শচীদেব্যা অশ্রুবিগলিত হয়ে পড়েন।
তাঁর যত আশংকা গৌরসুন্দরের বিপদ নিয়েই। সে একাধারে সদ্যবিবাহিত ও তরুণ ! লক্ষ্মীপ্রিয়া'র সর্বস্ব ধন সে। আর তাঁরও যে অন্ধের হাতের যষ্টি সে সদ্যযুবাটি।
............
লক্ষ্মীপ্রিয়া এসবের সবটাই শচীদেব্যার কাছে শুনেছে বলে সে তার আচরণে যদিও অনেকটাই সংযত আছে অন্তত গৌরের সামনে বিশেষ ভণিতা করে থাকতে পারছে না। সে নিজে এখন ভালো করেই জানে যে নিছক পন্ডিতন্মন্যতা তার স্বামীটির ভাবাবেগকে এখনো অযথা অহঙ্কারের গ্রাসে মেরে ফেলেনি। এই তো কাল রাত্রে কোথা থেকে "গোবিন্দ দাস" বলে একজন সুখ্যাত পূর্বদেশীয় কবির "অভিসারযাত্রা"র পুঁথি যোগাড় করে এনে তাকে ডেকে একান্তে "কন্টক গাড়ি’, কমল সম পদতল মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি/গাগরি-বারি ঢারি, করি পিছল পথ, চলিছি অঙ্গুলী চাপি "- এই পদটা আবৃত্তি করে শোনাতে শোনাতে সে হঠাৎ নিজেই ভাববিহ্বল হয়ে পড়েছিল। আর ঠিক তখনই লক্ষ্মীপ্রিয়ার ডান' পা এর অলক্তরঞ্জিত পাতাটি ধরে তার মুখের সামনে এনে চুম্বন দিতে যাচ্ছিল গৌর! সত্যি বলতে কি ঠিক ক'দিন আগে ওই জায়গাতেই একটা কাঁটা ফুটেছিল ঘাট থেকে ফেরার সময়! হে ঈশ্বর !সেটাও কি তার গৌর জানে? ভাগ্যিস সে তখন সম্বিৎ এনে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনমষ্কারের অছিলায় গৌরকেই প্রণাম করে প্রাণে বাঁচে! উফফ্ ওইরকম ভাববিহ্বলতা কি মানুষের আবার হয় নাকি!
..........
দ্বিপ্রহরে গৌর অন্নগ্রহণে আজ অনীহা দেখাল।
সে হঠাৎ তার উন্মনা মনোজগতটিতে ক্রমশঃই জড়িয়ে পড়ছে বলে আজকাল একটু যেন বেশী তন্মধ্যভাবেই থাকে।
এরমধ্যে গত কয়েক দিনে সে আবারো একটা কান্ড বাধিয়ে এসেছে। জগন্নাথ আর মাধব এই দুই সহোদর ভ্রাতা যেমন মদ্যপ তেমনই দূরাচারী ও পাপাসক্ত কোটাল পদাধিকারী রাজপুরুষ বলে পরাক্রান্ত ও জনমানসে নিন্দিত। লোকে আড়ালে ওদের মধু-কৈটভ বলে সম্বোধন করে। ওরা এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে গোপনে ভোগ করার জন্য একটি প্রাঙ্গণে এক দরিদ্রার পর্ণকুটিরে অগোচরে লুক্কায়িত করে রেখেছিল। মেয়েটি অনূঢ়া ও কোমলপ্রাণা। সে মেয়ে যদিও এক বণিকনন্দনকে ভালবাসে বলে লোকসমাজে সে ইদানীং একটু গ্রাম্য সমাজে মুখরোচক আদিরসের উৎস বলে সদা কম্পিতপ্রাণা।
..................
(৮)
গৌর তার প্রণয়ী ওই বণিকতনয়টিকে গঙ্গার ঘাটে যাতায়াতের ফলে চিনত। সে নিজে ওই ছেলেটির জীবনে প্রকৃত ভাবালু প্রেমের বিড়ম্বনা দেখে আর নিজে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেনি। তার প্রেমে যথার্থতা বিচার করে ওই মেয়েটিকে বুদ্ধিবলে উদ্ধার করে তার প্রণয়ী সেই বণিকতনয়টির সাথেই সে অগ্রদ্বীপের পথে নদীবক্ষের উপর একটি বজরায় গোপনে গন্ধর্বমতে তাদের বিবাহটি যে দিয়ে এসেছে শুধু তাই নয়, এমনকি সেই আড়ম্বরবিহীন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পৌরহিত্যটিও সজ্ঞানে সে করে এসেছে। নর-নারীর প্রেমানুরাগ যে ঐশ্বরিক মাধূর্য্যের এক অভিন্ন প্রকাশ লক্ষ্মীপ্রিয়া তার জীবনে না আসলে বোধহয় তা ওর অগোচরেই থেকে যেত।
এইসব ঝামেলার কারণে গত কয়েকদিন সে বিশ্রামের সময়টিও ভাল করে জোটাতে পারেনি বলে যেন আজ বড় ক্লান্ত।
এরই মধ্যে আবার সে জয়দেব নামের এক পূর্বদেশীয় পদকর্তার বিরচিত " গীতগোবিন্দম্ " কাব্যটি পাঠ সমাপ্ত করে একইসাথে পরম বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছে।
গৌর তার ভার্যা লক্ষ্মীপ্রিয়ার মধ্যে যদিও সর্বদাই স্বয়ং শ্রীরাধিকার মহাভাবাবেশটিকে দেখতে পায় বলে সেও যেন জানে তাদের এই ঐহিকতার আবেশটিও অচিরাৎ যেন এক বিষাদময় গভীর অন্ধকারে দ্রুত হারিয়ে যেতে চলেছে।
তাই নিজেকে তখন লক্ষ্মীপ্রিয়ায় আরো বেশী করে ডুবিয়ে দিতে মন চায়। যেন যেকোন মুহূর্তেই বিরহ হঠাৎ এসে গৌরের এই অনুরাগের আসরটি হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেবে! গৌরকে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে যায় এই জন্মে বংশীধর নিজেই তাঁর আরাধিকা হ্লাদিনীর সেই আজন্ম বিরহের ভাগ্যটি নিজের করে নিয়ে এবারে নিমজ্জ্বমান হতে চলেছেন গৌরহরির এই মানুষী অবয়বে।
তাই যেন তার অন্তরে এই স্বয়ং সেই কৃষ্ণ বোধ আর বাইরে আরাধিকা রাধার প্রেমজ আকূলতাটি এজন্মের পরম ভবিতব্য। যদিও বৈষ্ণবদের শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগতম্ আর প্রাচীন হরিবংশপুরাণেও তা যেন এখনো অকথিতই হয়ে আছে।
.............
( ক্রমশ...)
Comments