জয় রাজা জয়বর্ধনের জয়
গোবিন্দ মোদক
(পাঁচ)
জ্যোতিষীর কথামতো একপক্ষ কাল ধরে খুঁজে চলেছেন রাজা জয়বর্ধন। কিন্তু এই ঘোর অরণ্যে সুগন্ধার সঙ্গে রাজার কোথায় দেখা হয়েছিল তা কিছুতেই নির্ণয় করতে পারছেন না তিনি। অথচ উনিশ দিনের মধ্যে পনেরো দিনই অতিক্রান্ত, হাতে আর মাত্র তিন দিন ! তারপরেই চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে পুত্র রূপকুমার। হায় ! রাজা আর ভাবতে পারেন না ! ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে, অবসন্ন দেহে বসে পড়েন একটি গাছের নিচে, তারপর গাছের গুঁড়িতে হেলান দিতে গিয়েই বিপত্তি ! পিঠে শক্ত কিছু একটা খোঁচা লাগছে যেন ! রাজা পিছন ফিরতেই দেখতে পান একটা তীর বিঁধে আছে গাছটির গুঁড়িতে। তীরটিকে খুব চেনা-চেনা মনে হয় জয়বর্ধনের --- একটানে তীরটা উঠিয়ে নিতেই দেখতে পান তীরটায় তাঁরই নাম খোদাই করা রয়েছে ! তার মানে এই সেই জায়গা ! এখানেই সুগন্ধাকে বাঁচাতে রাজা তীর ছুঁড়েছিলেন, আর বাঘটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আহ্ ! অবশেষে তিনি খুঁজে পেলেন তাহলে জায়গাটা ! কিন্তু অবসন্ন দেহ নিয়ে রাজা আর উঠতে পারলেন না --- ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় তাঁর দেহে নেমে এলো নিদারুণ ক্লান্তি ! শুধু ক্লান্তি !
ঘুম ভাঙতেই রাজা দেখলেন তীর হাতেই গাছের নিচে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, আর গাছটা হলো একটা আমগাছ। গাছে পাকা ফল ঝুলছে। রাজা তীর ছুঁড়ে ছুঁড়ে কয়েকটা আম পাড়লেন। টুসটুসে পাকা আম। অত্যন্ত সুমিষ্ট আর সুস্বাদু ! কয়েকটি আম খেতেই তিনি শরীরে যেন বল পেলেন। তীরটা হাতে করে রাজা উঠতে যাচ্ছেন, এমন সময় বিচিত্র স্বরে একটি ব্যাঙ ডেকে উঠল।
রাজা ব্যাঙটিকে দেখে অবাক হলেন --- সাধারণ কুনোব্যাঙের মতোই দেখতে, কিন্তু গলার স্বরটা যেন অনেকটা মানুষের মতো ! রাজার মনে হলো ব্যাঙটি তাঁকে কিছু বলতে চাইছে যেন। তিনি দু'হাতে ব্যাঙটিকে নিচের থেকে তুলে এনে কানের কাছে ধরতেই শুনতে পেলেন ব্যাঙটি মৃদু অথচ পরিষ্কার স্বরে বলছে --- মহারাজ ! আমি আপনার হতভাগ্য সেই জ্যোতিষী। আপনাকে সাহায্য করার অপরাধে রাক্ষসী-রাণী আমাকে ব্যাঙ বানিয়ে দিয়েছে ! আমাকে মেরেই ফেলতো, কিন্তু পারেনি। পারেনি শুধু মহাদেবীর আশীর্বাদে। যাই হোক, আর দেরি নয় মহারাজ, শীঘ্র চলুন। আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো ব্রহ্মগড় তথা সেই রাক্ষস-গড়ে। আপনি আমাকে আপনার সামনে রাখুন।
(ছয়)
ব্যাঙ-রূপী জ্যোতিষার্ণবকে অনুসরণ করে রাজা এসে উপস্থিত হলেন রাক্ষসগড়ে। উঁচু প্রাসাদ, কারুকার্য করা থাম, অসাধারণ সব মূর্তি, পুকুর-দীঘি, উদ্যান, বাগিচা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এত বড়ো রাজপুরী, কিন্তু কেউ কোত্থাও নেই। সমস্ত রাজ্য যেন ঘুমিয়ে রয়েছে। খাঁ-খাঁ শূন্য-পুরী যেন। রাজা এ ঘর, ও ঘর করতে করতে এসে পড়লেন সুন্দর একটা বাগানে --- অজস্র ফুল-ফলের গাছ, ফোয়ারা, শ্বেতপাথরের পরী, দোলনা, বসবার বেদী, বিশ্রাম কক্ষ দিয়ে সাজানো এমন অপরূপ বাগান রাজাও কখনও দেখেননি। ইতস্ততঃ ঘুরতে ঘুরতে রাজা এসে উপস্থিত হলেন একটা বড় আপেল গাছের নিচে। গাছে ঝুলছে দৃষ্টিনন্দন পাকা পাকা আপেল। গাছটির নিচে বেদীতে বসে রাজার খুব মনে পড়তে লাগলো রূপকুমারের কথা। রূপকুমার খুবই ভালবাসতো আপেল খেতে। হায় ! না জানি রূপকুমার এখন কোথায় আছে ! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রাজা আপনমনেই বলে উঠলেন -- রূপকুমার ! তুমি কোথায় আছো পুত্র !
অমনি বয়ে গেল একঝলক হাওয়া আর চমকে ওঠে রাজা দেখলেন একটা আপেল অনেকটা বড়ো হয়ে তারই সামনে একটা ডালে ঝুলছে ! আশ্চর্য ! এতো বড়ো আপেল ! এমন সময় বিচিত্র স্বরে ডেকে উঠল ব্যাঙ-রূপী জ্যোতিষী। বললো --- মহারাজ, আমার মন বলছে রাজকুমার খুব কাছাকাছিই আছেন। আপনি বারো বার ওর নাম ধরে ডাকুন।
রাজা জয়বর্ধন তখন আকুল হয়ে রূপকুমারের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। প্রতিবারের ডাকে সাড়া দিয়ে বয়ে যেতে লাগলো অস্থির বাতাস, আর আপেলটাও একটু একটু করে বড়ো হতে লাগল ! বারোবার ডাক পূর্ণ হতেই আপেলটা বিশাল বড়ো হয়ে মাটি ছুঁলো, তারপর আপেলটি ফেটে বেরিয়ে এল চমৎকার এক রাজপুত্র ! তেইশ-চব্বিশ বছরের সুদর্শন রাজপুত্রটিকে দেখে রাজার মন ভরে গেলো, কিন্তু দু'চোখ ভরে উঠলো কান্নায়। এ তো তাঁর রূপকুমার নয় ! সে তো মাত্র একাদশবর্ষীয় কুমার।
--- হাসালেন মহারাজ ! বলে উঠলো ব্যাঙ-রূপী জ্যোতিষী। দীর্ঘ বারো বছর ধরে রূপকুমারও তো বড়ো হয়ে উঠেছে। তাই আপনি তাকে চিনতে পারছেন না।
রাজা তখন রূপকুমারকে বুকে টেনে নিলেন। রূপকুমারও চিনতে পারলো তার পিতাকে। এমন সময়ে ব্যাঙ-রূপী জ্যোতিষী তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলো --- মহারাজ সাবধান ! কুমার সাবধান ! ওরা টের পেয়ে গেছে কুমারের মুক্তির কথা ! ঐ শুনুন ওরা আসছে ! শীঘ্র প্রাসাদে চলুন, হাতে তুলে নিন অস্ত্র !
মহারাজ ও কুমার দু'জনেই শুনলেন শোঁ-শোঁ ঝড়ের মতোন আওয়াজ --- রাক্ষস-রাক্ষসীদের ধেয়ে আসবার শব্দ ! তাড়াতাড়ি প্রাসাদে ঢুকে রূপকুমার নিলো দুই-দিকে ধারওয়ালা দীর্ঘ একখানা তলোয়ার, আর মহারাজা নিলেন একদিকে ধারওয়ালা এক-খানা বাঁকা তলোয়ার। ততক্ষণে এসে পড়েছে রাক্ষস-রাক্ষসীদের দল ! সুগন্ধা এসেই এক মহা-রাক্ষসীর রূপ ধারণ করে রূপকুমারকে আক্রমণ করলো -- রূপকুমারও দু'ধার-ওয়ালা তলোয়ার দিয়ে প্রতিহত করতে লাগলো তার আক্রমণ। মহারাজা তাঁর বাঁকা তলোয়ারের কোপে একে একে কচুকাটা করতে লাগলেন রাক্ষসদেরকে।
এমন সময় ব্যাঙ-রূপী জ্যোতিষী বলে উঠলো, -- মহারাজ ! আপনি এই রাক্ষস বংশ এভাবে ধ্বংস করতে পারবেন না। ওদের জীবন বাঁধা আছে বাগিচার বিষবৃক্ষে ! আপনি শীঘ্র সেটা সমূলে তুলে ফেলুন !
মহারাজা তখন ছুটে গেলেন বাগানে --- ব্যাঙ-রূপী জ্যোতিষী তাঁকে বিষবৃক্ষটি চিনিয়ে দিয়ে বললো, -- সাবধান মহারাজ ! গাছটি উপড়াতে গিয়ে যেন ছিঁড়ে না যায়। যদি বিষবৃক্ষের মূল এতটুকুও মাটির নিচে থাকে তাহলে কিন্তু রাক্ষস বংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে না। তাই মূলসহ ওটাকে উৎপাটিত করতে হবে।
মহারাজ প্রাণপণ শক্তিতে বিষবৃক্ষটি উৎপাটিত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। রাক্ষসেরা হাঁউ মাঁউ করে ছুটে এসে তাঁকে বাধা দিতে লাগলো। রাজা এক হাতে তলোয়ার চালিয়ে তাদেরকে ঠেকাতে লাগলেন, অন্য হাতে বিষবৃক্ষ তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু বিষবৃক্ষ তোলা কি অতই সহজ ! তার মূল যে অনেক গভীরে প্রোথিত ! অতএব তিনি তলোয়ার চালনা করতে করতেই রূপকুমারকে ডাক দিলেন। তারপর দু'জনে মিলে প্রবল টান দিতেই পড়্-পড়্ করে উপড়ে এলো বিষবৃক্ষ ! অমনি সব রাক্ষস-রাক্ষসীর দল কাটা কলাগাছের মত ধুপ্-ধাপ্ করে পড়তে লাগলো মরে মরে। আনন্দে রাজা বুকে জড়িয়ে ধরলেন রূপকুমারকে।
Comments