বন্ধন
শর্মিষ্ঠা
গুপ্তিপাড়া পেরিয়ে গাড়িটা যখন বাঁ দিকের কালভার্ট ক্রস করে নীচের ঢালে গড়িয়ে নামলো তখন প্রায় রাত দেড়'টা বাজে | কলকাতা হলে এ কানা রাত্রে তাও দু'একটা ফ্ল্যাটে আলোর নমুনা জ্বলে থাকে | কিন্তু এই মফঃস্বলের রাত দেড়'টা হলো গিয়ে স্বপ্নপুরী | কেবল গুটিকয়েক পোকার দল হলুদ হ্যালোজেন বাতির নীচে অযথা ঘুরে ঘুরে বচসায় মত্ত | বাড়ির গেটে পৌঁছে রুজা স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ি থেকে নেমে এলো | এবার ফোনটা করাই যায় | রাত দশটায় হঠাৎ যদি ও বাবাকে জানাতো যে, আজকে বাড়ি আসছে গাড়ি ড্রাইভ করে কলকাতা থেকে তাহলে স্ট্রোক না হলেও বেচারা সুকুমার বাবুর বি পি নির্ঘাৎ এভারেস্টের চূড়া ছুঁয়ে ফেলতো | রুজা ওর বাবাকে হাড়ে হাড়ে চেনে | অতএব, নো রিস্ক |
–হ্যালো বাবা, দরজা খোলো |
ওপাশের ঘুম জড়ানো গলা কিন্তু কোনো বিস্ময়বোধ নেই |
–এসে গেছিস ! মা যাচ্ছে |
রুজা একটু অবাকই হলো | তারপর ভাবলো, বাবা ঘুমের ঘোরে ঠিক কী হচ্ছে ঠাহর করতে পারেনি হয়তো |
গেটের ওপরে ঝোলানো সন্ধ্যামালতীর ঝাড়টা বেশ সুন্দর বড়ো হয়েছে | থোকা থোকা লাল-হলুদ ইচ্ছাগুচ্ছ | মা ভেতরের দরজা খুলে গ্যারেজের চাবিটা হাত বাড়িয়ে দিলো |
–গাড়ি ঢুকিয়ে দে |
–কেন ? সকালে ঢোকাই না ! এখন ইচ্ছা করছে না | পেছনে রেখে দিই |
–না, না | পেছনে যেতে হবে না | গ্যারেজে ঢোকা |
–ওমন চেঁচিয়ে উঠলে কেন ? পেছনে কী আছে ?
–আরে বলছি, এত রাত্তিরে পেছনবাড়ি যেতে হবে না |
–বাব্বা, এমন চেঁচিয়ে উঠলে ! ভয় পেয়ে গেলাম !
–তুই আসবি এটা জানালি না কেন ? তখন যে বড় বললি আসবি না |
রুজা ডানহাতের তর্জনীতে গ্যারাজের চাবিটা বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে গেলো গেটের দিকে |
–চলে এলাম |
সেই কলকাতা থেকে টানা তিনঘন্টা অল্টো চালিয়ে শিমুরালী পৌঁছেছে | একটু অবসন্নতা ঘিরে ধরাটাই স্বাভাবিক | দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করে দিলো | সোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে | হলুদ শাড়িটা একটু এলোমেলো হয়েছে | যদিও নতুন শাড়ি কিন্তু যা ধকল গেলো সারাদিন ! কপালের কালো টিপ খুলে আয়নায় আটকে দিলো | দুটো টিপ | মাঝে কাঁচের দেয়াল | কত রাসায়নিক পদার্থের বিক্রিয়ায় তৈরি অথচ স্বচ্ছ, যেন কথা বলছে এপার ওপার | জাঙ্ক জুয়েলারী সেটটা খুলে রেখে কাঁধের কাছের সেফটিপিনে হাত রাখল |
–অনুপ, একটা কাজ করে দিবি প্লিজ |
–কী ?
–সেপ্টিপিনটা আটকে দে না একটু !
–শাড়ি পড়তে পারিস না ,পড়িস কেন ?
–বাজে কথা বলবি না |
–একটা তো লাগানোই আছে | আর কতগুলো লাগবে আপনার মহারানী ?
–এটা একটু পেছনের দিকে লাগা | তাহলে আর শাড়িটা নড়বে না |
–এর থেকে ভালো উপায় আমি বলছি | মন দিয়ে শোন | সেলোটেপ কিনে আন ডজন বিশেক | আমি গোটা শাড়ীটাই গায়ের সাথে আটকে দিচ্ছি |
–অনুপ !!
গুমগুম করে যে কতগুলো কিল বেচারার ভাগ্যে জুটলো এই অভিনব পরোপকারী পরামর্শের জন্য সেটা গোনা সম্ভব না | শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁকা ক্যান্টিনে বেচারা অনুপ স্থির দাঁড়িয়ে কিলগুলো হজম করে গেলো | জানে, এখন দৌঁড়ালে রুজা ধপাস হবে আর তারপর ওরই কপাল পুড়বে | কতদিন যে দেখা হবে না পা মচকালে কে জানে ! এভাবে একদিনই সম্ভব না !
খচ করে মধ্যমায় সেপ্টিপিনটা গেঁথে গেল |
'আঃ', অস্ফুট শব্দ | হাতটা সরিয়ে এনে দেখে রক্ত বেরিয়ে গেছে | লাল বিন্দুর মতো জমছে রক্ত | রক্ত বাড়ছে, বাড়ছে বিন্দুর পরিধি | বড় হতে হতে একদম সেই লাল তিলটার মতো আকৃতি নিল | কুসুমের পিঠের একদম মাঝখানে ছিলো যেটা | আর কারও পিঠে দেখেছে কী !
–দামুদা, এই একটাই পাঞ্জাবি আছে তোমার বলো ?
–তোরা হলুদ রঙ ঠিক করলে আমি কী করতে পারি ? সরস্বতীতেও হলুদ, লক্ষ্মীতেও হলুদ |
–এতে লক্ষ্মী এলো কোত্থেকে !
–কেন ! কেক খাবো, গিফ্ট পাবো | লক্ষ্মী নয় !
–দামুদা !
রুজা ভেতরে চলে গেলো | সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় আর বিমল |
–রেডি ?
–হ্যাঁ দিদি |
–একটা কাজ কর না সোনা ! গাড়ি থেকে কয়েকটা গিফ্ট নিয়ে আয় | দামুদা বের করে দেবে | আমি অতগুলো একা আনতে পারছি না |
–আচ্ছা দিদি | চল্ সঞ্জু |
ওরা দু'জন লাফিয়ে লাফিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো |
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠেই চক্ষু চড়কগাছ |
–মাধু ! কী মিষ্টি কী মিষ্টি লাগছে |
পেছনে দাঁড়িয়ে চৈতালী আর বিনাদি |
–এসে গেছো রুজা !
ঘরে থেকে বেরিয়ে এলেন রাধাদি | ঘাড়ের কাছে একটা চাঁপাফুল গোঁজা | গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে সাতহাত দূর থেকেই |
–চাঁপা !
–তোমার জন্য ভেতরে রাখা আছে | লাগিয়ে নাও |
আলতো করে গালদুটো নাড়িয়ে দিলো রাধাদি |
–কোথায় পেলে গো ?
–শ্যাম এনে দিলেন |
–শ্যাম ! সে কে ?
রাধাদি চলে গেল নিচে |
ভেতর থেকে ভেসে এলো বাচ্চার কান্নার শব্দ |
–কুসুম !
রুজা একছুট্টে ঘরে ঢুকে দেখে বিনাদির খাটের মাঝখানে শুয়ে আছে একটা হাত পা নাড়া পুতুল | ওকে দেখতেই চুপ |
রুজা অর্ধেক শেষ হওয়া মিনারেল জলের বোতল আলোর দিকে ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতেই কুসুম খিলখিল করে হেসে উঠলো | দেয়ালা আঁকছে ও | আবার ঝাঁকাচ্ছে, আবার হাসি | কত বয়স হবে ! চারমাস ! দামুদা ঠিকই বলেছে, ন্যাপি আমাকেই পাল্টাতে হবে | একটা কেমন গন্ধ বেরোচ্ছে |
–এ বাব্বা, জামাটাও পেছনে ভিজে গেছে |
ন্যাপির সাথে পুরো জামা প্যান্ট খুলে ফেললো রুজা | নতুন ন্যাপি পরিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে বের করলো হলুদ ফতুয়া দুটো | আলতো করে কুসুমকে পাশ ফিরিয়ে ফতুয়া পড়াতে গিয়ে নজরে এলো পিঠের মাঝ বরাবর লাল তিল | এতটা মিল !
'নাঃ, কত মানুষেরই তিল আছে | আমি কি সবার জামা খুলে পিঠ দেখতে গিয়েছি যে জানতে পারবো ! যতসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা |'
নিজের মনেই খানিক হেসে নিলো রুজা | যাইহোক, রুজা আর কুসুমের বন্ধুত্বটা এই পনেরো মিনিটে পনেরো জন্ম গাঁথা হয়ে গেলো |
কুসুমকে কোলে নিয়ে নিচে এলো রুজা |
–এই তো, যথার্থ স্থান পেয়েছে মেয়ে |
দামুদা এগিয়ে এলো রুজার দিকে |
–তোকে কাল বলেছিলাম, খরচ বাড়লো |
–ওসব নিয়ে ভেবো না দামুদা | আমি ম্যানেজ করবো |
–তুই ভাবিস না | একটা বিরাট ডোনেশন এসেছে |
–কে দিয়েছে ?
তক্ষুনি, সঞ্জয় আর বিমল দূর থেকে এসে প্রায় টানতে টানতে দামুদাকে নিয়ে গেলো টেবিলের দিকে | উচ্ছ্বসিত ওরা | সব্বার জন্য গিফ্ট আছে | দামুদার জন্য আনা মাথার ক্যাপটা বের করে দিলো সঞ্জু |
–দ্যাখো, আর তোমার রোদে বাজারে যেতে কষ্ট হবে না |
রুজার উত্তর অধরাই থেকে গেলো | তারপর চললো আনন্দ অবসর 'কূজন' প্রাঙ্গনে | লাইট লাগানো, কেক কাটা, স্পেশাল বিরিয়ানি আরো কত কী !
কোথাও কী কিছু ভুল হয়ে যাচ্ছে ! কুসুমকে ঘুম পাড়িয়ে রুজা দোতলার জানলায় গিয়ে দাঁড়ালো | ন'টা বাজে | কেন এত বছর পরে অবান্তর আবেগ বেইমানি করলো আবার ! কেন মনে হলো, দরজার ওপাশে অনুপ দাঁড়িয়ে আছে ? রাস্তার মোড়ে অশ্বত্থ গাছের নিচে ডিস্যায়ারটায় অনুপ মুখ লুকিয়ে ফেললো কি ? ফেলে আসা প্রিয়তম দিন আজকে এতবার কেন তাড়া করছে ! নাঃ, আজকে বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে ফিরে ওর পক্ষে একা থাকা সম্ভব না | যত রাতই হোক, সিমুরালী ফিরতেই হবে |
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল রুজা | ভোরবেলায় দিকে হবে হয়তো | যখন ঘুম ভাঙলো বেলা পেরিয়েছে | ঘড়িতে দশটা বাজে | অফিসে একটা মেইল পাঠিয়ে দিলো দু'দিনের ছুটি চেয়ে | এই অবস্থায় কলকাতা ফেরৎ গিয়ে একা থাকাটা অসম্ভব |
–মা, ডাকোনি কেন?
–কত রাত্তিরে এলি ? ঘুমা একটু | ঘুমাতেই তো পারিস না |
–তা হলেও, দশটা বাজে !
সাদা চুড়িদারের ওপরে লাল ওড়না জড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো |
–মা, একটু রাস্তায় গেলাম | হেঁটে আসি |
–চা খাবি তো ?
বেরোতে গিয়ে চোখ পড়লো দাদার ঘরের দিকে | ওটা খোলা | দাদার তো এখন আসার কথা নয় | পুজোতে আসবে | রুজা এগিয়ে গেলো |
–ওটা আমিই খুলেছি | কয়েকটা ব্যাগ নামিয়েছি | একটু গুছিয়ে রাখবো |
–তুমি কী কাজ পাচ্ছ না মা ! অযথা কাজ খুঁজে বের করো |
–ওরকম মনে হয় | সংসার তো করোনি ! করো একবার !
–আবার শুরু লেকচার ! একা করো না যেন | আমি এসে হেল্প করে দেবো |
রুজা বেরিয়ে গেলো | মসজিদ ছাড়িয়ে দত্তদের বাড়ির পেছনের রাস্তা ধরলো | ওটা রেললাইনের দিকে গিয়েছে | যেই ট্র্যাকটায় মালগাড়ি যায়, ওতে পাটকাঠির বান্ডিল গুচ্ছ গুচ্ছ দাঁড় করানো | যেন তূনীরে বান যোজনা করা আছে | কতগুলো বাচ্চা ছেলে খোলা টায়ার ছোট লাঠি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্ল্যাটফর্ম বরাবর দৌড়াচ্ছে | আজ রবিবার | প্ল্যাটফর্মে গুটিকয়েক যাত্রী | রুজা স্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো বিশুদের চায়ের দোকানে | বাড়ি এলে বিশুদার চা খেতেই হবে ওকে |
–বিশুদা এলাম |
–বসো |
একটা প্লাস্টিকের টুল টেনে বসলো রুজা | সামনের অমলতাসের একটা ডালে তিনটে হলুদঝুড়ি হয়েছে | ওদিকে তাকিয়ে ওটা কে দাঁড়িয়ে আছে ! পেছন করে দাঁড়িয়ে | বোঝার উপায় নেই !
বিশুদাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বড্ড বিরক্ত লাগলো এবার নিজের আচরণে | আবার ! সেই কল্পনা !
চটপট চা খেয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো |
–আসছি বিশুদা | একটু তাড়া আছে | বিকেলে আসবো |
–আচ্ছা |
বাড়ি পৌঁছে মোবাইলটা নিয়ে সোজা ছাদে এলো |
–হ্যালো, দামুদা | কাল বললে না তো, ডোনেশনটা কে দিয়েছে ?
–দিয়েছে কেউ একজন |
–নাম বলো |
–তুমি চেনো রুজা |
শেষের রুজা বলার সময় দামুদা রু বলার পরে একটু থামলো মনে হলো | নাঃ, এইসব অযাচিত ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না | সামনের দোলাদের পুকুরের জলে হালকা বাতাস বইছে | জলের উপরে বাতাসের হিল্লোলজাত ঝিরাঝিরি বৃত্ত শুধু আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে ছাদের নামচায় | এ প্রহরের উপকরণ শুধুই প্রমত্ততা | চোখের চশমাটা খুলতেই রু'এর মনে হলো ওকে ঘিরে ধরেছে অনুপের জটলা | প্রেম তো এরকমই হবার কথা ছিলো !
Comments