চাতক
শর্মিষ্ঠা
রুজা মোবাইল অফ করে ছাদ থেকে দোলাদের পুকুর ছাড়িয়ে নিধিদের বাড়ির পেছনে তাকালো | সামান্য দু'হাত মতো রেললাইন দেখা যায় | দামুদার কথাটা যেন কানে বাজছে | রু.....জা |
পঁ অ অ অ অ.....
ট্রেনের হর্ন | এগারোটার ডাউন কৃষ্ণনগর লোকাল | রুজা দেখলো ওকে ঘিরে ধরা অনুপের জটলাগুলো একে একে ছত্রভঙ্গ হচ্ছে আর এগারোটার ডাউন ট্রেন ওদের গ্যালোপ করে এগিয়ে যাচ্ছে কলকাতার দিকে | হঠাৎ একটা শূন্যতা ঘিরে ধরছে রুজাকে | আকাশ কালো হয়ে আসছে ! অসময়ী বৃষ্টি! এতটা নিস্তব্ধ ছিলো কি চারপাশ ! ট্রেন চলে যাবার পরে সহজাতভাবে চারপাশের প্রকৃতি কিছু মুহূর্ত খুব শান্ত হয়ে যায় | হয়তো প্রত্যেকবার এই চলে যাওয়াগুলো যাপন করে |
'অশেষ বাসনা লয়ে ভাঙা বল
প্রাণপন কাজে পায় ভাঙা ফল...'
গুনগুন করতে করতে রুজা নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে নীচে | নাঃ, আর অনুপের ভাবনা নয় | একটু ঘুমাতে হবে | মাকে হেল্প করাটাও বাকি থেকে গেছে |
–গলাটা এখনো একদম নষ্ট হয়ে যায়নি | এক আধটু গাইতে পারিস তো !
–মা |
কী মনে হলো মেয়ের, প্রায় দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মায়ের গলা দু'হাত দিয়ে | তারপর কাঁধে মাথা রেখে আদুরে আবদার মায়ের কাছে |
–আজকে দুপুরে খাইয়ে দেবে মা !
–কবে বড় হবি তুই !
দস্যিপনা দেখানোর ছলে কোমরে হাত দিয়ে বেশ গুরুজনদের মতো বজ্রঘোষিত কণ্ঠস্বরে মাকে মনে করাতে লাগলো যে ওদের দুজনের এখন দাদার ঘরে অগোছালো ব্যাগগুলো গোছানোর কথা | কিন্তু সে গুড়েও বালি | বড় সাজা হলো না |
–ওসব অনেক আগেই গুছিয়ে ফেলেছি আমি | তোর জন্য বসে থাকি আর কী !
–আমি যে বললাম বিশুদার দোকান থেকে চা খেয়ে এসে হেল্প করে দেবো !
–থাক বাবা | রক্ষে করো | একে তোমার বাবাকে নিয়ে নাজেহাল, তারপরে তুমি | এক বালিতে কাম নাই সুগ্রীব দোসর |
–মা, প্লিজ |
–তোর নিজের ফ্ল্যাট গুছিয়ে রেখেছিস !
রুজা এবার গুটিগুটি নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো | কারণ ও জানে কলকাতার ফ্ল্যাটের অবস্থা হাওড়া স্টেশন, সেটা মা জানে | আর সেই কথাটা উঠলেই আবার কথায় কথায় বিয়ের কথা শুরু হবে | সেই একই ঘ্যান ঘ্যান | অতএব, কথা না বাড়ানোই ভালো | দুজন দুদিকে পা বাড়াতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন দু'পক্ষই |
ঘরে ঢুকতেই তীব্র চাঁপার গন্ধে মনটা আকুল হয়ে উঠলো | মাত্র চারটে চাঁপা লাগিয়েছিল কালকে খোঁপায় | কিন্তু বাসি ফুলের সুবাসে ঘর ভরে গিয়েছে |
–রু, চাঁপা কেমন লাগে তোর ?
–চাঁপা ! খুব প্রিয় |
–তাহলে পরশু খোঁপায় চাঁপা লাগিয়ে আসবি |
–সরস্বতী পূজায় গাঁদা লাগাতে হয় | এটাও জানিস না তুই !
–না, হলে হবে | তুই চাঁপা লাগাবি |
–কেন ?
আয়নার ওপাশে অনুপ দাঁড়িয়ে | 'কেন জানিস না' | সজোরে ধাক্কা পিঠে |
–কী রে কখন থেকে জিজ্ঞেস করছি, তুই কি বিকেলে কলকাতা ফিরবি ?
–ও, তুমি!
–হ্যাঁ।কী জানি না , জানি না উত্তর দিচ্ছিস ! ফিরে যাবি না থাকবি ?
রুজা লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললো |
–না মা | দুদিনের ছুটি নিয়েছি | কাল বিকেলে ফিরবো |
মা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে |
গতকাল সতেরোই জুলাই হওয়াতে এইসব হ্যালুসিনেশন শুরু হয়েছে | চলবে কিছুদিন | বেশ কিছু বছর ধরে একই ঘটনার ব্যতিক্রম হয়নি | তারপর আবার আবেগগুলো ফিরে যাবে ঘুমের দরবারে আর রোজনামচা ব্যস্ত হয়ে উঠবে যান্ত্রিক জীবনের কলাপে | সেই অফিস আর বাড়ি | মাঝে একটু অক্সিজেন দেয় রবিবার 'কূজন' | ঐটুকুই তো সম্বল রুজার | বেঁচে থাকার কবচ |
–বাবা |
বাবার সাথে কথা বলার জন্য রুজা বাবার ঘরের দিকে এগোলো | কাল অত রাতে ফিরে বাবার সাথে দেখা হয়নি | যথারীতি আজ সকালে দেরি করে উঠে বিশুদার দোকানে চলে গিয়েছে চা খেতে | বাবার ঘরে ঢুকে দেখে বাবা ঘরে নেই | ব্যালকনিতে আরামকেদারাটা নিঃসঙ্গ বসে আছে আসন বিছিয়ে | মায়ের ড্রেসিং টেবিলের ওপর বাবার হাতঘড়িটা নেই | সুতরাং বাবা বাড়িতে নেই | বেরিয়ে আসতে গিয়ে কাঠের আলমারী খুলে 'সুবর্ণলতা' বের করে আনলো রুজা | এতে যদি মনের উদাসী বাউলপনা আর চঞ্চলতা কেটে একটু স্বস্তি পাওয়া যায় তার চেষ্টা |
–মা, বাবা কোথায়?
–বেরোলো তো ! কোথায় যাচ্ছে বলে যায়নি |
–আচ্ছা |
নিজের ঘরে ঢুকে সব জানলাগুলো খুলে দিলো ও | বিছানার উপর বইটা খুলে একবার গন্ধ নিলো | ভালোলাগা, ভালোবাসা সবারই পৃথক গন্ধ আছে | আর এই প্রত্যেকটা গন্ধ যেন ইন্দ্রিয়তে পৃথক জায়গা করে রাখে জন্ম জন্মান্তরকাল | যেমন রুজা এখনো চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলে অনুপের আফটার সেভের গন্ধ পায় | সদ্য দাঁড়ি কাঁটা হালকা সবজেটে গালের পরশ পায় | এসব স্পর্শ হয়নি ,সে আর কতদিন! মাত্র পাঁচ বছর ! তাতে কী ! অনুভব তো শিরায় শিরায় বহমান | রুজা জানে, আগামী পাঁচ জন্মেও অহল্যা হয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে অনুপের অনুভবে | প্রেম তো এমনটাই হবার কথা ছিলো !
"প্রায়শই আমরা অন্যমনস্কতার মধ্যে বাস করে থাকি, তাই সৌভাগ্য যখন আসে তখন তাকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারি না | উপলব্ধি আসে তখন ,যখন সেই সৌভাগ্যের ক্ষণটুকু হারিয়ে ফেলি |" রুজার প্রিয় লেখিকার উক্তি |
ক্রিং ক্রিং
রাইমা দেবী ফোনটা করেই ফেললেন ওনার স্বামীকে | এত রোমহর্ষক কাজ এই বয়সে করাটাও দুঃসাধ্যের ব্যাপার | অনুপ তো সেই সকালে বেরিয়ে গেলো আর গাড়িটা নিয়ে গেলো না | গাড়ি স্টার্টের আওয়াজে রুজার ঘুম ভেঙে যেতে পারে | বেচারা সারাটা রাত বিনিদ্র কাটিয়েছে ছেলের ঘরের ভেতর লুকিয়ে | এবার ওর গাড়িটা রুজার চোখ এড়িয়ে পেছনবাড়ি থেকে সরানো একটা জটিল কাজ |
–হ্যালো গাড়িটা বের করেছো ?
–হম | অনেক্ষন |
–কই শব্দ পেলাম না তো !
–তুমি তো রাস্তার দিকের জানলায় ছিলে |
–কোথায় রাখলে ?
–বিনোদদের বাড়ি |
–বিনোদ ! কেন !!
–তুমি বুঝবে না | হারানদের বা নিধিদের বাড়িতে রাখলে ওরা জিজ্ঞেস করতো কার গাড়ী, কী ব্যাপার | অন্তত রাস্তায় রুজার সাথে দেখা হলেই কথাটা শুরু করতো | তার থেকে এটাই ভালো যাঁরা ব্যাপারটা একটু জানে সেখানে রাখা |
–কিন্তু বীণাদিকে জানানো হয়নি তো !
–কী জানাবে ?
–অনুপ এসেছিলো |
–আমি দামুকে ফোন করেছিলাম | বলেছি | বললো এখনই জানাতে হবে না | বিনোদকেও বলেছি | ওর মাকে জানাতে না করেছি | বুঝতে পেরেছে | আর ওরা কালকে তো সিঙ্গাপুর চলেই যাবে | যে নিজের মায়ের সম্পর্কে এত উদাসীন সে অন্যের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবে না | তাছাড়া, আমাদের কাছে ও একটু হলেও ঋণী | 'কূজন'-এর খোঁজ আমরাই ওকে দিয়েছি | বহাল তবিয়তে থাকতে পারছে নিজের পরিবার নিয়ে বিদেশে | সাথে ওর বাড়িটাও আমরাই দেখাশোনা করি সাধ্যমতো | এটাই ঠিক হলো | অনুপ এর মধ্যে একসময় এসে গাড়ী নিয়ে যাবে |
–একটু আগে তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছি, ও দুদিন থাকবে | ছুটি নিয়েছে |
–ভারী মুশকিল হলো | আচ্ছা দেখছি কী করা যায় | আপাতত এখানেই থাক |
–অনুপকে একটা ফোন করে নিও |
–হম | বিনোদ, বৌমা গতকাল কলকাতায় গিয়েছিলো 'কূজন'-এ | সকালে রুজা ওখানে পৌঁছানোর আগে মায়ের সাথে দেখা করে বেরিয়ে গিয়েছে | কালীঘাট গিয়েছিলো শুনলাম |
–এ কেমন ছেলে গো ! বছরে দুবার আসে | তাও মাকে কাছে নিয়ে এসে রাখতে পারে না এই ক'দিন |
–বললো তো, তাই বলেছিলো | বীণা রাজি হয়নি | ভালোই ...
খটাস | রাইমা দেবী ফোন রেখে দিলেন | রুজা ঘরে ঢুকছে |
–মা, খেতে দাও |
–হম | চল্ |
–বাবা কখন ফিরবে ?
–দেরি হবে বললো |
–তাহলে এখন অর্ধেক ভাত দাও, বাবা এলে বাকি অর্ধেক খাবো |
–পাগলী মেয়ে আমার |
মিসেস সুকুমার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন | ভ্রু কুঞ্চিত |
টেবিলে খাবার দিতে দিতে কথাটা শুরু করলেন রাইমা দেবী |
–রুজা এভাবে তো জীবন কাটে না মা |
–মা, আবার | এখন না প্লিজ | খাই একটু |
–না মা |শোন |
–পটলপোস্তটা ব্যাপক হয়েছে |
–যদি অনুপ ফিরে আসে তুই কী করবি ?
স্তব্ধ চারপাশ | আশেপাশে কোথাও একটা ঘুঘু ডেকে যাচ্ছে অবিরাম |
'লেট হিম টু কাম', 'লেট হিম টু কাম'...
এটাই যেন উচ্চারিত হচ্ছে প্ৰত্যেকবার | পরের গ্রাসটা মুখে তুলতে গিয়েও রুজা নামিয়ে নিলো হাত |
–অনুপ খুব ভালো আছে মা |
–তুই কী করে জানলি ?
–এমিলি খুব ভালো মেয়ে | অনুপ বলেছে |
–কত বছর আগে ?
–সেটা তো বিবেচ্য নয় | এই ঘন্টা মিনিটগুলো ওরা ওদের মতো সুখী, আর আমি আমার মতো |
–আমার প্রশ্নের উত্তর নয় এটা |
–অবান্তর প্ৰশ্ন মা |
–কেন অবান্তর হবে! ও তো মানুষ !
–শুধু অবান্তর নয়, অবাস্তব ও বটে !
মাছটা রেখে উঠে দাঁড়ালো রুজা |
–মাছটা খেয়ে ওঠ |
–রেখে দাও | বাবা এলে বাকি ভাত দিয়ে তোমাদের সঙ্গে একসাথে খাবো |
এগিয়ে গেলো বেসিনের দিকে | তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে,
–মা, কাকে ফিরে আসার কথা বলছো ! যে কোথাও যায়ইনি কোনোদিন | অনুপ আমার কাছে যেখানে যেমন অবস্থায় ছিলো সেখানে সেই অবস্থাতেই আছে | আমিও বেঁচেছি ওই সময়টুকু অব্দি | আর এখন সেই বেঁচে থাকাটা বাঁচিয়ে রাখতে চাইছি | আমার 'কূজন', আমার হলুদপাখী হয়ে ওঠা, আমার চাঁপা সবই তো অনুপ | এমনকি কুসুমের পিঠে সেদিন লালতিলটা দেখে...
থেমে গেলো রুজা | একটা যন্ত্রণা দলা হয়ে আসছে গলার কাছে | নাঃ, মায়ের কাছে অকপট হয়ে গেলে ওঁরা দুজন থাকতে পারবেন না | এই বয়সে এতটা হয়তো সহ্য করতে পারবেন না | উল্টোদিকে ঘুরে বেসিনে গোটা মুখ ধুয়ে রুজা নিজের ঘরের দিকে এগোলো |
–আজ যদি সে রিক্ত হস্তে তোর সামনে এসে দাঁড়ায় সেই বাঁচিয়ে রাখার অধিকারে !
ঘরে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়ালো রুজা | তারপর ধীর কণ্ঠে বললো,
–আমিও তাই চাই মা, ও একবার আমার সামনে এসে দাঁড়াক।আমি তো "সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের তরে" |
–রুজা !
দরজা বন্ধ করার আওয়াজ আসলো রাইমা দেবীর কানে | ডাইনিং টেবিলে আনত মা, অশ্রুসিক্ত | আর, চতুষ্কোনে জমছে জটলা আবার ধীরে ধীরে | বৃষ্টি হবে কি !!
Comments