আবর্ত
হেমন্ত সরখেল
- দামু'দা…
আবছায়া ঠেলে ফুঁড়ে উঠেছে অবয়ব | দীর্ঘ কায়া | স্ট্রীট লাইটের আলোটা পেছনে, মুখ দেখা যাচ্ছে না | তবু এক প্রাচীন আওয়াজে যেন অশীতিপর স্মৃতির ঘুম ভাঙলো | চেনা সুরে চকিত দামু |
- কে?
- আমি | দ্যাখো তো চিনতে পারো কিনা।
- অনুপ দা! তুমি এখানে! এখন?একা? কোলে কে?
- দাঁড়াও দাঁড়াও, চেঁচিও না, অনেক কাজ, আড়ালে চলো |
- পেছনে চলো, এসো, এদিক দিয়ে এসো |
- একা কেন? রুজা দিদি?
- বুঝতে পারছি | সবটা বলছি | আগে কুসুমকে ধরো |
বেঘোরে ঘুমন্ত শিশুর কোল বদল হলো | একটু নড়ে উঠলেও চোখ খুললো না |
- ও আমার বোনের মেয়ে | ওকে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মা চলে গেছে | তুমি তো জানো আমি বিদেশে সেটলড্ | মূলতঃ ওর খবরেই আসা | বাচ্চাটা ওর কাকিমার কাছে ছিল এই চার মাস | ওর বাবা আবার একটা বিয়ে সেরে ফেলেছে | এখন ও আমার দায়িত্ব | না, ভুল বললাম, এখন ও কূজনের | আমি শুধু ওকে পৌঁছে দিয়ে গেলাম | তবে, ভেবো না | এখন আমার অনেক টাকা, আমি ওর জন্য ডোনেশন জমা করে দেব | তোমায় শুধু একটাই অনুরোধ,ওর আসল পরিচয় যেন কেউ না জানে, রু ও না |
- সেকি! কেন! রুজা দিদি তো খুশি হবে জানলে | বাচ্চাটা বিশেষ যত্ন পাবে |
- এই কারণেই আমি চাই যেন তুমি ছাড়া আর কেউ ওর পরিচয় না জানে | যদি অন্যে'রা দ্যাখে,ও বিশেষ যত্ন পাচ্ছে, তাহলে পেছনের কারণ খুঁজবে | কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হবে | তুমি চাপে পড়লেই আমার নাম সামনে এসে যাবে | রুজাকে তুমি বোঝাতেই পারবে না এতকিছু | সাধের কূজনে অশান্তি আমি চাই না, দামু'দা |
পোড় খাওয়া প্রৌঢ় বুঝলেন কথাটা | মসলিনের মতো গড়িয়ে গেল অন্ধকারে তরল সময় | ভাবতে ভাবতে ঠেকে গেলেন নুড়ি'তে |
- রুজা দিদি জানে না,তুমি এখানে?
- না | তুমি ওকে রেখে এসো | বলে এসো, ওর জন্য পোশাক কিনতে হবে | আমি গাড়িতে নিয়ে এসেছি | তোমায় দিয়েও দেব আর এক কাপ চা ও খাবো তোমার সাথে | আরও কিছু কথা আছে |
- আচ্ছা, ওকে রেখে আসছি আমি | তুমি কোথায় থাকবে?
- তৃতীয় গলিতে | অশ্বত্থের নীচে | একটা বড়ো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখবে,ওটা আমার |
- কী নাম যেন বললে ওর?
- কুসুম |
দামু বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কূজনে ঢুকলো | অন্ধকারে অপেক্ষা করছে অনুপ | ভেতরে কথাবার্তা শুরু হতেই তীব্র গতিতে পার হয়ে এল গেটটা | এখন ওকে কেউ লক্ষ্য করবে না | সবাই কুসুমে ব্যস্ত | রাস্তা পার হয়ে গাড়ির কাছে এল | শান্তি | কাজটায় ঝুঁকি ছিল | সহজে মিটে গেল | তবুও সন্দেহ নিরসনটা বাকি রয়ে গেছে দামু'দার | এটাও বড়ো কাজ, যার ওপরেই নির্ভর করছে কুসুমের ভবিষ্যৎ | একটা ডানহিল ধরালো ও | অপেক্ষা করতে হবে দামু'দার |
অপেক্ষাই তো করেছে শুধু | জেলে সময় কাটার অপেক্ষা করেছে, বাইরে থেকে এমিলি কী করতে পারবে তার অপেক্ষা করেছে, অপেক্ষা করেছে রুজার কোন একটা খবরের | অপেক্ষা করেও জানতে পারেনি কবে বাবা চলে গেছে দীর্ঘ অভিমান নিয়ে, মা ওর অপেক্ষায় থেকে থেকে ব্যর্থ হয়ে বোনকে কুপাত্রে তুলে দিয়েছে ওর কুলাঙ্গার মামার প্ররোচনায় | সব খবর পাওয়ার পরেও, অপেক্ষা করেছে পাসপোর্ট হওয়ার | বারবার কাউন্সিলিং হয়েছে জেলফেরতা আসামীর | অপেক্ষা অপেক্ষা আর অপেক্ষায় শীতলতর থেকে শীতলতম হয়েছে ও | এভাবেই হয়তো পরিপক্কতা বিস্তৃত করে শরীর | জন্ম নেয় স্থৈর্য |
কখন যে ফিল্টারে এসে গেছে আগুন ও টের পায়নি | গরম ধুঁয়ো হাতে লাগতেই হাত থেকে খসে গেল ওটা | ডান জুতোয় জ্বলন্ত আগুনটা পিষে নেভাতে সামনে দামু'দা | গাড়িটাকে পেছনে ফেলে সামনে হাঁটলো ফুটপাত ধরে | চার কদমে পাশে দামু |
- শোনো দামু'দা | রুজা জানে না, আমি এদেশে এসেছি | ওখানে গিয়ে এতরকম কাজে জড়িয়ে পড়েছিলাম যে সময় মতো ওর খবরটুকুও নিতে পারিনি আমি | হ্যাঁ,দোষটা আমার | তাই, ওটা আমাকেই দূর করতে হবে | আর সেটা করতে হবে ওর সামনে উপস্থিত হয়ে | বুঝতে পারছো তো আমি কী বলতে চাইছি?
- কেন বুঝবো না? দিদি যদি আমার মুখ থেকে কুসুমের পরিচয় শোনেন তাহলে আরও কষ্ট পাবেন, তাই তুমি চাও না ওনাকে এটা আমি জানাই | আর জানাবোই বা কেন! তোমাদের মধ্যে কেন ঢুকবো!
- আমি জানি কী ভীষণ অভিমান জন্মেছে তোমার রুজা দিদির | আচ্ছা, একটা কথা বলো তো! ও কী কাউকে পছন্দ করে?
- কী সব বলছো গো! যে তোমার জন্য অপেক্ষায় অহল্যা হয়ে রইল,তাকে তুমি এইসব বলছো?
- অন্যভাবে নিও না দাদা | আমি যে এখনও তার সামনে যাওয়ার সাহস জুটাতে পারিনি!
হেসে ফেলল দামু | এবার সবটা বুঝেছে সে | ফুটপাত ছেড়ে রাস্তাটা পার করে ওপিঠের চায়ের দোকানের বেঞ্চে এসে বসলো দুজনে | বিস্কুট দিতে বললো অনুপ | অনেকদিন খাওয়া হয় না | জলের জগ থেকে ঢকঢক করে গলায় ঢাললো খানিক |
- সামনে গিয়ে দাঁড়াও দাদা, সব গলে জল হয়ে যাবে | বয়স তো কম হলো না আমার, বুদ্ধিটা শোনো,কাজে লেগে যাবে। আরেকটা কাজ করতে পারো |
- কী কাজ?
- কাল সতেরোই জুলাই | দিদি আসবেন | তুমিও চলে এসো সন্ধেয় | একেবারে সামনে এসে গেলে তোমার খুব সুবিধার সম্ভাবনা থাকবে | আমরাও তো থাকবো!
- না, দাদা | আগে আমি আরেকটু কাজ সেরে নিই | মা চলে গেছে, বাবা তার আগেই | রু-এর অপেক্ষায় আমি আর আমার অপেক্ষায় রু | এবার গোছানোর সময়, আমাদেরও তো কিছু পাওয়ার আছে | সেটুকু করেই আমি ওর সামনে আসতে চাই | তুমি শুধু এইটুকু করো,যাতে ও কুসুমকে না চিনতে পারে | অবশ্য...
- অবশ্য?
- কুসুমেরও আমার মতোই পিঠের মাঝখানে একটা লাল তিল আছে | ওর মায়েরও ছিল | যদি ও কখনও মেয়েটার পিঠ খেয়াল করে, তবে, তবে...
- আরে না, অত কি আর খেয়াল করে কেউ! আমি বলবো না কিছু | তবে, আর দেরি কোরো না দাদা আমার!
- না গো, এমনিই বহু দেরি হয়ে গেছে | আর না | চলো, ওর জামাগুলো নিয়ে নেবে |
সতেরোই জুলাইয়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি অনুপ | কূজনে দৃষ্ট রু ওকে সোজা ছুটিয়ে নিয়ে গেছে সে রাতেই শিমুরালী | ন'টা নাগাদ বাড়ির গেটে | একটা সময় হাতের তালুর মতো চিনতো, কিছু পরিবর্তন ঘটলেও রাস্তারা চওড়া হওয়া ছাড়া নিজেদের বদলায়নি | দু'বার হর্ণ দিতেই বেরিয়ে এলেন সুকুমার বাবু | ও গাড়ি থেকে নামলো,
- আমি, অনুপ |
- আসছি |
অনেক রাতে গাড়ির আওয়াজে স্তব্ধ হয়ে গেছিল অনুপ | কথা শেষ করে খাওয়া সেরে অত রাতে আর ওকে ফিরতে দেননি ওরা | ছেলে নেই, ওর ঘরেই থাকবে | রু ও আসবে না | আসবার হলে মেয়ে ফোন করেই দিত মাকে | সে ফোন যখন আসেনি তখন অসুবিধা তো নেই!
অন্ধকার ঘরের জানলার পর্দা সরিয়ে ও বুঝলো আজ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে | রু এসেছে ফোন না করেই | যদিও, গাড়ি রাখা আছে পেছনবাড়িতে | এ ঘরের দরজাও বন্ধ | তবুও,তবুও, সারারাত নিজের চাপা শ্বাস গুনলো অনুপ | এখনি ও রু-এর সামনে আসতে চায় না | মা কথা বলবেন ওর সাথে | ওর মন বুঝবেন, তারপর জানাবেন | তখন সামনে আসবে ও | রু যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে থাকে, ও সরে যাবে | ওর সুখ ছাড়া আর চাইবার কি থাকতে পারে অনুপের!
মাকে বলে সকালেই বেরিয়ে এল অনুপ | গাড়ি বের করা গেল না | আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলেই সবটা শেষ | একটা ট্রেন আছে এগারোটায় | সেটাই ধরবে বলে প্রণাম সেরে বেরিয়ে এল | রু ঘুমাচ্ছে | এদিক সেদিক ঘুরে বার পাঁচেক বিভিন্ন দোকানে চা খেয়ে দশটা নাগাদ ও স্টেশনে এল | টিকিট কেটে বিশুদার দোকানে | চা খেয়ে এগিয়ে গেল অমলতাসকে পেছনে রেখে | রু কি বিশুদার দোকানে আজকাল একদমই আসে না?স্মৃতি'রা কি এতই বেইমান ?
Comments