আরাধনা
হেমন্ত সরখেল
ট্রেনটা যতক্ষণ না গতি নিলো,অনুপ ডাউন কৃষ্ণনগর লোকালের গেটে দাঁড়িয়ে রইল। একচিলতে দেখতে পাওয়া যায় ও বাড়িটাকে। সেটুকু দেখার বাসনা দমক নিয়েছে। রু আছে এখন। ওকে ফিরতে দেখেছে স্টেশন থেকে অলক্ষ্যে। সামনে যাওয়ার প্রশ্ন ছিল না, যায়নি। মোটা মাদার গাছের আড়াল থেকে আনমনা রু'কে দেখে মনে হলো, আরও একটু কমনীয়তা বাসা বেঁধেছে যৌবনশিষে। সামান্য মেদ জমেছে নিতম্বে। কী যেন অস্থিরতা! ওটুকু সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত দোলাচ্ছে সামনে পেছনে। কস্তুরিগন্ধে মত্ত হরিণী। কাকে খুঁজছে! কাকে চাই! অনুপকে ছাড়া কে ধরেছে মনে! এমন কী আছে ওর ব্যত্যয়হীন জীবনে যেখানে সিদ্ধান্ত নিতে এত ছটফট মুদ্রা এক্তিয়ার করতে হচ্ছে! ভাবনাসৈকতে আছড়ে পড়লো ট্রেনের খবর। রু ফিরছে। স্টেশন চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দেখলো। তারপর এগিয়ে গেল টিকিট কাউন্টারের দিকে।
নিমজ্জিত আশার বড়ো গুণ হলো নৈরাশ্যের ঘেরাটোপ থেকে উদবিড়ালের মতো সে চোখ ভাসিয়ে রাখে।জলের উপরি বিম্বে নজর রাখে। বিম্ব বলে দেয় শেষের আগে শেষ আশাটুকু কোন তলদেশে ঘাঁটি গেড়েছে। এ সময় অনুভব তীক্ষ্ণ। মনোযোগী যোগীর মতো ধারণাকে আমূল করায়ত্ব করা। তারপর টুপ করে ডুবে যাওয়া অতলে। লয়ের আগে প্রলয়ের উন্মাদনায় ফালা ফালা করে দেওয়া নিরাশার দেহ। সেটুকু নিয়েই অনুপ দাঁড়িয়ে ট্রেনের গেটে। একচিলতে ফাঁক। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে পার হয়ে যাবে ট্রেনের এই অংশটা। সে সময় যদি ও বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে রু একদৃষ্টে, দেখার ইচ্ছে নিয়ে দেখতে চায়, যদি চায়, তবে হয়তো দেখবে, ট্রেনের গেটে দাঁড়িয়ে অনুপ তাকিয়ে আছে তার দিকে। যদি এই সমস্তটা এখন ঘটে যায়, তাহলেই তো রু জানতে পারে, ও এসেছিল। এসেছিল ওকে চাইতে। এসেছিল অজানা কাহনের বিলম্বিত লয়ে আবার সুর বাঁধতে।
না, বাড়িটার রং মুছে গেল লহমায়। কেউ ছিল না যার চোখে চোখ পড়তে পারে। সময়ের সাথে হ্রাসমান প্রগাঢ়তা বড্ড সত্যি। মেনে নিতে হয়। কম্পার্টমেন্টে গান ধরলো কেউ।
'আমায় ডুবাইলি রে
আমায় ভাসাইলি রে
অকুল দরিয়ায় বুঝি কুল নাই রে…'
গেট থেকে সরে একটা সিটে বসলো অনুপ। এখন ভীড় নেই। বেশিটা ফাঁকা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা যাত্রী। গানটা ভালোই গাইছে।
'আশমান চাহে দরিয়ার পানে
দরিয়া আসমান পানে
লক্ষ বছর পার হইল
কেহ না তা জানে…'
কে জানবে! কেন জানবে! জানতে চাইবেই বা কেন!জানবে তারা,যারা কনসার্ন। রু'এর বাবা-মা জানতে চাইবে। অনুপ চাইবে। সেই জানতে জানাতেই তো গতরাতে এসে ঢুকলো ওদের বাড়ি। হাত মুখ ধুয়ে সটান খাওয়ার টেবিলে। হঠাৎ অনুপকে দেখে আশ্চর্য হলেন দুজনেই। আরও অবাক হলেন সাথে রু না থাকায়। বিস্ময়ের পারদ চড়লো যখন শুনলেন, এখানে আসার পর, এখনও ওরা মুখোমুখি হয়নি। সুকুমার বাবুর হাত ভাতের থালায় ধীমে হলো। ছোট ছোট প্রশ্নে পুরুষ চোখ পুরুষের দৃষ্টিতে খুঁজে নিতে লাগলেন ঘটনাক্রম এবং জড়ানো সত্যতা। সবটা বললো অনুপ। ব্যর্থতা, লজ্জা, অদম্য সংঘর্ষ আর সাহসী বিজয়ের আখ্যান।
-- তবে রু যে বলে তুমি এমিলিকে নিয়ে সুখে আছো!
-- ও নিজের কষ্ট লুকিয়ে ফেলতে চায় আপনাদের কাছ থেকে।
-- কষ্ট? বুঝলাম না!
-- আমি জেলে যাওয়ার পর প্রায় সাড়ে তিন বছর ওর সাথে একেবারেই তো যোগাযোগহীন! তখন এমিলি আর জন আমাকে বের করবার জন্য আকাশ-পাতাল এক করছে। আমার কন্ট্যাক্টদের ওরা জানাতে চেয়েছিল। সঙ্গত কারণেই আমি বারণ করেছি। ওরাও কিছু জানায়নি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় রু'য়ের ভাবনা বদলাতে শুরু করলো। কয়েকবার আমার মুখে এমিলির নামটা ও শুনেছিলো, ও ভাবলো আমি ওখানেই অ্যাটাচ হয়ে গেছি। আমার খুশি ছাড়া ও কোনদিনই তো কিছু চায়নি! আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আপনাদের দমিয়ে রাখা সহজ ছিল,রাখলো। আমার ছোঁয়া ছিল কূজন ঘিরে, ওটাকেই নিয়ে মেতে উঠলো। আমি ওকে চিনি।তাই এই দুইয়ে দুইয়ে চার করতে আমার অসুবিধা হচ্ছে না। তবে, আসল সমস্যাটা শুরু এখানেই। এবার আমি এই ঘটনাগুলো ওকে কী করে বলি? বললেই যে বিশ্বাস করবে, তারই বা কি গ্যারান্টি আছে? যদি বিশ্বাস না করে তাহলে তো এ মুখ নিয়ে দ্বিতীয়বার ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো না! তাছাড়া, এখন ওর জীবনে অন্য কেউ এসেছে কিনা সেটাও তো আমি জানি না। যদি কেউ এসে থাকে তাহলে আমি ওদের সুখের বাধক হবো না। ওর ভালো থাকা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কিছুই চাওয়ার নেই আমার।
খাওয়া শেষ করে ঘরে যাওয়ার আগে আর সমস্যার সমাধান খুঁজে পাননি ওঁনারা। এমন অবস্থায় তাঁদের নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্যও সময় দিলো অনুপ। হয়তো সকালে আরেক প্রস্থ বসা যেত এটা নিয়ে। কিন্তু রু! কেন আজই এলে তুমি রু! একটা সকাল কি আমায় দেওয়া গেল না! কাকে দেব এ দোষ! ভাগ্যকে?
Comments