top of page
Search

জামাইষষ্ঠীর বিশেষ প্রবন্ধে অয়ন ঘোষ

agantukpotrika

জামাইষষ্ঠী: প্রথা ও প্রচলন

অয়ন ঘোষ


আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যে দেশের যাপনের মূল কাঠামোটি বসানো রয়েছে বিশ্বাসের ওপর। সেটি লৌকিক, সামাজিক অথবা ধর্মীয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই বিশ্বাসগুলো আমাদের জীবনের সাথে এমনই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে যে, সে বাঁধন খোলা তো দূর সময়ের সাথে তার আকার বা অবয়বের পরিবর্তন হলেও বাঁধন আরো দৃঢ় হয়েছে। কালক্রমে, এগুলোর সাথে এসে মিশেছে অর্থনৈতিক ধারণা ও প্রয়োগ। আস্তে আস্তে লৌকিক বা ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর বাণিজ্যিকিকরন হয়েছে আর এখনকার ভাষায় যাকে আমরা ইভেন্ট বলি সেই ইভেন্টে পরিণত হয়েছে এগুলোর বেশিরভাগই। পরিবর্তন জীবনের ধর্ম আর এতে ভুল কিছু নেই। সময়ে সাথে সাথে জীবন পাল্টাবে, তার ধরনধারণ পাল্টাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই পরিবর্তনের মধ্যে আমাদের একটা বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন তা হলো বিশ্বাসের মূল উদ্দেশ্য বা কাঠামোটা যেন একই থাকে। জামাইষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী এমনই এক লৌকিক প্রথা যা প্রায় বৈদিক যুগ থেকে এই বঙ্গভূমিতে প্রচলিত। তবে মঙ্গলকাব্যের সময়ে এটি ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ও সাহিত্য পাঠেও এর নিদর্শন রয়েছে। এখানে যদিও আমরা জামাইষষ্ঠী ও অরণ্যষষ্ঠীকে সমার্থক ধরছি তবে আদিতে এটি অরণ্যষষ্ঠী নামেই এদেশে প্রচলিত ছিল। আসলে এই প্রথার প্রচলন অরণ্য বা বনে শুরু হয়েছিল বলেই একে অরণ্যষষ্ঠী বলা হয়ে থাকে। এটি একদমই একটি লৌকিক আচার যার শুরুটা হয়েছিল গ্রাম্য এক লৌকিক কাহিনীর মাধ্যমে।


মা ষষ্ঠী লৌকিক দেবী। সাধারণ ভাবে সন্তান কামনা, সন্তানের ও সংসারের মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীর ব্রত ও পূজা করা হয় থাকে। আবার এও মনে করা হয় আদিম সমাজ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির ও কন্যা সন্তানের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধির কারনেও ষষ্ঠী পুজো করত, অরণ্যষষ্ঠী প্রচলন এভাবেই হয়েছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। ( বাংলার ব্রত কথা, পৃষ্ঠা ১১)। ব্রাহ্মণ্যধর্ম মা ষষ্ঠীকে বৈদিক দেবতা স্কন্দের সাথে জুড়ে দিয়ে এর বৈদিকিকরন করার চেষ্টা করেছিল খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে। এই শতকেই বায়ুপুরাণ অনুযায়ী ষষ্ঠীকে উনপঞ্চাশ দেবীর অন্যতম এক দেবী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি দ্বিভূজা, দ্বিনয়না, গৌরবর্ণা, দিব্যবসন পরিহিতা, সুলক্ষণা ও বরাভয়দায়িনী। তিনি মাতৃত্ব স্বরূপিনী, তার বাহন বিড়াল। বায়ুপুরাণে তাকে সব মাতৃদেবীর আরাধ্যা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু তার পরিচয় নিয়ে পুরান ও স্মৃতি শাস্ত্রের মধ্যে জটিলতা রয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে তার স্বরূপ তিনি স্কন্দের পালিত মা ও রক্ষয়িত্রী। আবার পদ্মপুরান অনুযায়ী  তিনি স্কন্দের স্ত্রী। বাংলার মঙ্গলকাব্যের জগতে ষষ্ঠীমঙ্গল নামে একটি কাব্য রয়েছে সেখানে সর্পদেবী, শিব কন্যা মনসার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশে নানা প্রকারের ষষ্ঠী পুজোর প্রচলন রয়েছে যেমন - অরণ্যষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠী, লুণ্ঠনষষ্ঠী, ধুলাষষ্ঠী, কোড়াষষ্ঠী, লোটনষষ্ঠী, দুর্গা বা বোধনষষ্ঠী, মূলাষষ্ঠী, পাটাইষষ্ঠী, শীতলাষষ্ঠী, অশোকষষ্ঠী, নীলষষ্ঠী, আঁতুড় বা সুতিকাষষ্ঠী, সেটেরা বা ষাট্ষষ্ঠী, একুশ্যাষষ্ঠী, বিবাহষষ্ঠী, জলষষ্ঠী, গোষষ্ঠী, নাড়িষষ্ঠী, অন্নষষ্ঠী, কৃষ্ণষষ্ঠী, স্কন্ধষষ্ঠী, চান্দনীষষ্ঠী, কার্দমীষষ্ঠী, ঝিঙেষষ্ঠী, চাপড়া বা মন্থনষষ্ঠী। মা ষষ্ঠীর যে মূর্ত রূপ আমাদের এখানে বানানো তা সাধারণত জননী রূপ, মার্জারবাহিনী ও কোলে শিশু থাকে। অনেক জায়গায় নানা রকম প্রতীকেও তার পুজো হয় যেমন মাটির কলস, অশ্বত্থ বা বট গাছের গোড়ায়। মন্দিরে না, এই দেবীর পূজা খোলা আকাশের নিচেই করা হয়ে থাকে। ঘুমের মধ্যে শিশুরা হাসলে বা কাঁদলে মনে করা হয় মা ষষ্ঠী তাদের সাথে দেয়ালা করছেন বা খেলছেন। তিনি শিশুদের রক্ষয়িত্রী। আসলে  আগেকার দিনে শিশু মৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি আর আমরা এও জানি কোনো একজায়গায় মৃত্যুভয় ও প্রাকৃতিক সংকট মানুষকে দেবতার আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। সেই পথ ধরেই বোধহয় ষষ্ঠী পুজোর প্রচলন। সাধারণ হিন্দু ঘরে সন্তান জন্মের ছ'দিনের মাথায় ষষ্ঠীর পুজো দেওয়া হয় সদ্যজাত সন্তানের মঙ্গল ও দীর্ঘ জীবন কামনায়। পাশের রাজ্য ওড়িশায় ২১ দিনের মাথায় এই পুজো করা হয়।


এই বারে প্রশ্ন এই প্রথার মধ্যে জামাইরা এলেন কি ভাবে কারন জামাই তো আর শিশু নন। আসলে শ্বশুরালয়ে জামাইকেও সন্তান হিসেবেই দেখা হয়, সে যতই একটি বিরুদ্ধ প্রবাদ বাংলা ভাষায় থাক না কেন - "জন জামাই ভাগ্না তিন নয় আপনা"। জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় শাশুড়ি মা এই ব্রত করেন, তাকে সন্তানজ্ঞান করে। আমাদের দেশে অবশ্য যত ব্রত পার্বণ আছে তার দায় মেয়েদের ওঠাতে হলেও মঙ্গল কামনা কিন্তু পুরুষের উদ্দেশ্যই নিবেদিত। এটিও তেমনই এক ব্রত। জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে স্ত্রীরা সাবিত্রী ব্রত করেন স্বামীর দীর্ঘ জীবন ও মঙ্গল কামনায়। এর পরে পরেই শুক্লপক্ষের প্রথম ষষ্ঠীই  হচ্ছে জামাইষষ্ঠী, মানে পরপর দুই পক্ষে দু-দুটি মঙ্গল ব্রত পুরুষের উদ্দেশ্যই, একটি মেয়ের দ্বারা ও অপরটি মায়ের। বলা যেতে পারে ডবল অ্যাকশন। কিন্তু প্রাচীন প্রথার ইতিহাস ঘেঁটে যতটা জানা যাচ্ছে এই অরণ্যষষ্ঠীর মধ্যে কোথাও জামাইয়ের গল্পই ছিল না। অনেক পরে জামাইরা এটির মধ্যে নিঃশব্দে অনুপ্রবেশ করে গোটা বিষয়টিকে নিজেদের খাতে বইয়ে দিয়েছেন, শ্বশুর মশাইয়ের মাথায় ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে। কিন্তু কি ভাবে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটল তা জানতে হলে একটি প্রাচীন গল্পের অবতারণা প্রয়োজন। অনেক প্রাচীন কাল থেকেই ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ায় একটা প্রথা প্রচলিত ছিল যে কন্যার বিবাহের পর কন্যা যতদিন না সন্তান ধারণ করছেন ততদিন কন্যার পিতামাতা কন্যার শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারতেন না। সেকালে মেয়েরা ছিল অন্তঃপুরবাসিনী তাই তার একা বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা কল্পনাতেও ছিল না। সেই কারনে জামাইকে কন্যাসহ নিমন্ত্রণ করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসার নিমিত্ত এই প্রথা শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয় এবং কন্যা পিতৃগৃহে এলে মা ষষ্ঠীর পুজোর আয়োজন করা হতো যাতে কন্যা দ্রুত সন্তান লাভ করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে এটি একেবারেই কন্যার সন্তান লাভের কামনায় তার পিতৃগৃহের একটি ব্রত বা পার্বণ। পূর্ববঙ্গের  ময়মনসিংহে এই বিষয়ে একটি গল্প প্রচলিত ছিল। দুই সই, একজন গোয়ালিনী ও অন্যজন ব্রাহ্মণী একবার তারা এক গণকের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে অরণ্যষষ্ঠী ব্রত পালন করতে মনস্থ করল। এই ব্রতে সব উপকরণ লাগে ষাটটা করে, মানে ষাট কাঁদি কলা, ষাটটা আম, ষাট ধামা খই, ষাট ধামা চিঁড়া, ষাট হাঁড়ি দই ইত্যাদি ইত্যাদি তারা সব সংগ্রহ করল। সব জোগাড় করে ব্রতের দিন ব্রাহ্মণীর ছোটো পুত্রবধূকে পাহারায় রেখে নদীতে স্নান করতে গেলো। এদিকে সেই পুত্রবধূ ছিল খুব লোভী, সে সব জিনিস থেকে কিছুটা করে খেয়ে রেখে দিয়ে তাদের পোষা বেড়ালের ওপর দোষ চাপলো। এতে মা ষষ্ঠী কুপিত হলেন আর শাশুড়িও ব্রত পূর্ন না হওয়ায় ক্ষুন্ন হলেন। বধুটি সন্তান সম্ভবা ছিল। যথা সময়ে সে একটি মৃত সন্তান প্রসব করল ( মতান্তরে সন্তান জীবিত প্রসব হয়েছিল কিন্তু বিড়ালটা তাকে তুলে নিয়ে মা ষষ্ঠীর জিম্মায় রেখে আসে) এই ভাবে পরপর ছ'বছর সেই বধূটি মা ষষ্ঠীর পুজোর প্রসাদ চুরি করে খায় আর বিড়ালের নামে দোষ চাপায় আর সেই সাথে তার ছয়টি সন্তান মৃত প্রসব হয় বা হারিয়ে যায়। সেই কারনে তার শাশুড়ি বা পাড়া প্রতিবেশীরা তাকে ডাইনি নামে অভিহিত করে বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেয় ও অবশেষে তাকে জঙ্গলে নির্বাসন দেয়। জঙ্গলে নির্বাসন দেওয়ার সময়ও সে গর্ভবতী ছিল। তার সন্তান যাতে সুস্থ ভাবে জন্মায় ও সুরক্ষিত থাকে, সেই কারণে সেই বধূ মা ষষ্ঠীর কাছে আকুল প্রার্থনা করে ও দোষ স্বীকার করে। ভক্তের প্রার্থনা মাতৃস্বরূপিনী মা ষষ্ঠী মঞ্জুর করে তার নবজাত সন্তানকে রক্ষা করেন ও আগের সব সন্তান তাকে ফিরিয়ে দেয় এবং তাকে দিয়ে এই প্রতিজ্ঞাও করিয়ে নেয় যে সে ভবিষ্যতে বিড়ালের ওপর দোষ চাপাবে না বা বিড়ালকে অশুভ মনে করবে না। সব সন্তান নিয়ে সেই বধূ ফিরে এলে সংসারে আনন্দের বান ডাকে এবং তাকে মহা সমারোহে তার বাপের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে বধুটির মা মহাউল্লাসে, পরম যত্নে মা ষষ্ঠীর পুজোর ব্যবস্থা করেন ও ভুঁড়ি ভোজের আয়োজন করে জামাইকে যথাবিহিত আপ্যায়ন করা হয়। সেই থেকেই মনে করা হয় এই অনুষ্ঠানের মধ্যে জামাইদের প্রবেশ বা অনুপ্রবেশ যাই বলি না কেন তার শুরু হয়েছিল।


আগেই বলেছি অরণ্যষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠীর উদ্দেশ্য কিন্তু মাতৃত্ব, সন্তান ধারন ও বংশবৃদ্ধি। ষষ্ঠী পুজোর উপকরণ হিসেবে সাধারণত লাগে আম্রপল্লব, তাল পাতার পাখা, ধান দূর্বা, পাঁচ থেকে নয় রকমের ফল, ফুল, বেলপাতা, সাদা সুতো ও হলুদ। জামাইষষ্ঠীতে জামাই বরণের উপকরণ  হিসেবে রেকাবিতে কাঁঠাল পাতার ওপর পাঁচ বা সাত রকমের ফল, তার মধ্যে একটি ফল করমচা হওয়া বাঞ্ছনীয়। এর সাথে ১০৮ গোছা দূর্বা। স্নান করে শাশুড়ি মা শুদ্ধ কাপড়ে মঙ্গল ঘট ভরে নিয়ে তাতে আম্র পল্লব দিয়ে সেই ঘট স্থাপন করেন মা ষষ্ঠীর পট বা আঁকা প্রতীকের সামনে। উপচারের সাথে থাকবে তাল পাখা। সব উপকরণ সামনে রেখে তিনি শুদ্ধ অন্তরে ব্রতকথা পাঠ করবেন। পাঠ সমাপন হলে সাদা সুতোয় আশীর্বাদী হলুদ মাখিয়ে, সেই সুতো সন্তানদের হাতে বেঁধে দেবেন। কোথাও কোথাও আবার সুতো না বেঁধে তেল হলুদের ফোঁটা কপালে দেওয়ার প্রথাও আছে। অনেকে বিশ্বাস করেন খরবার হলে ফোঁটা দিতে নেই। জামাই গৃহে এলে তাকেও একই ভাবে বরণ করা হয়, সাথে থাকে চিঁড়া মুড়কি, দই, ফলাহার ও মিষ্টির নানা পদ। এই যে জামাইয়ের হাতে বেলপাতা দূর্বা ও হলুদ মাখানো সুতো বাঁধা হয় তার অর্থ হলো জামাইয়ের পরিবারের সাথে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক যেন অটুট হয় বা জামাই ও মেয়ের বন্ধন দৃঢ় হয়। তাল পাতার পাখা দিয়ে বাতাস করার অর্থ যেন জামাইয়ের সব বিপদ আপদ দূরে যায়। সংসারে যেন শান্তি থাকে। তিন তিন বার ষাট ষাট ষাট বলার অর্থ জামাই যেন দীর্ঘায়ু লাভ করে। জামাই ষষ্ঠীর একটি ছড়াও আছে, সেটি এরকম :

জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট

শ্রাবণ মাসে লোটন ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট

ভাদ্র মাসে মন্থন ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট

আশ্বিন মাসে দুর্গা ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট

পৌষ মাসে পাটাই ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট

মাঘ মাসে শীতল ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট

চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট

বারো মাসে তেরো ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট

এর সাথে বলাই বাহুল্য পঞ্চব্যঞ্জনের আয়োজন তো চিরকালীন। বাঙালির যেকোনো পার্বণের মূল উদ্দেশ্য তো রসনা বিলাস। তাতে কখনো বাঙালী কার্পণ্য করেনি আর করবে বলে মনেও হয় না। তবে শাশুড়ি বা মাতৃস্থানীয় যারা ষষ্ঠীর ব্রত করেন তারা সেদিন নিরামিষ খাবার খান।


এই জামাই ষষ্ঠীর ব্রত পালন দেবতার মন্দিরেও হয়, এমন উদাহরণ কিন্তু রয়েছে এই বাংলায়। নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরে মহাসমারোহে জামাইষষ্ঠী পালিত হয়।বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাইয়েরা বংশ পরম্পরায় এই মন্দিরের সেবাইত। এই দিনটিতে মহাপ্রভু বিষ্ণুর অবতার নন, তিনি সেদিন গৃহস্থের জামাই। প্রায় ৩৫০ বছর ধরে এই প্রথা পালিত হয়ে আসছে। এইদিন স্থানীয় প্রবীণরা বিগ্রহের হাতে হলুদ সুতো বেঁধে দিয়ে পাখার বাতাস করেন। পড়ানো হয় রাজকীয় পোশাক। রূপোর রেকাবিতে মরশুমি ফল, রূপোর বাটিতে ক্ষীর ও রূপোর গেলাসে জল নিবেদন করে নিমাইয়ের ঘুম ভাঙানো হয়। এরপর জল খাবারে দেওয়া হয় চিঁড়ে, মুড়কি, দই, আম কাঁঠাল ও মিষ্টি। দুপুরে নানাপদ, ডাল, ভাজা, থোড়ের তরকারি, বেগুন পাতুরি, ছানার ডানলা, ধোঁকার ডালনা, লাউ ও চাল কুমড়োর তরকারি থাকে তালিকায়। দিবা নিদ্রার পর বিকেলে ছানা ও মিষ্টি। রাতে শয়নের আগে গাওয়া ঘিয়ের লুচি, রাবড়ি ও মালপোয়া।


এপর্যন্ত যা আলোচনা হলো তাতে বোঝাই যাচ্ছে ষষ্ঠী পুজোর বিবিধ প্রকারভেদের মধ্যে অরণ্যষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠী অন্যতম এবং বহুল প্রচলিত এই বঙ্গদেশে। সময়ের সাথে সাথে এর বহিরঙ্গে অনেক পরিবর্তন এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। মেয়েরা আর অন্তঃপুরচারিনী নয়। তারা অনেক ক্ষেত্রেই জীবনে ও যাপনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এর সাথে সাথে শাশুড়ি জামাইয়ের সম্পর্কও অনেক সহজ হয়েছে। আমি নিজের দিদাকে আমার বাবার সামনে কখনো ঘোমটা ছাড়া বেরোতে দেখিনি। এখন সম্পর্কে সেই আনুষ্ঠানিকতা নেই। আমি আনুষ্ঠানিকতা না থাকারই পক্ষে। কারণ সম্পর্ক সহজ হলে দু'পক্ষেরই সুবিধে। আগে একবার বলেছি যে কোনো বাঙালী পরবে রসনার ব্যাপারটা আন্তরিক ভাবেই খেয়াল রাখা হয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উপহার প্রথা। হয়ত আগেও হতো এখনও আর এর বাণিজ্যিকীকরন হয়েছে। তবে বর্তমানে রান্নার পদের পরিবর্তন হয়েছে। মুড়িঘন্ট, পাতুরি, তেলকই, মুড়ো দিয়ে সোনা মুগের ডাল, পাঁঠার মাংস, ডানলার জায়গা নিয়েছে বিরিয়ানি, মাঞ্চুরিয়ান, বেকড চিকেন, রেজালা, চিলি চিকেন বা রেশমি কাবাব। জামাইরা এখন সাস্থ্য সচেতন অনেক বেশি, ক্যালরি মেপে খান। তাই শ্বশুরশাশুড়ি খেয়াল রাখেন হালকা মিষ্টির আইটেম পাতে দিতে বা কম তেল যুক্ত রান্নার দিকে। অনেকই আবার রান্নার ঝামেলা বাড়িতে না রেখে নামীদামী রেস্তোরায় টেবিল বুক করে রাখছেন। রেস্তোরাগুলোও এখন এই অনুষ্ঠানকে ইভেন্ট করে তুলতে নানারকম পদক্ষেপ নিচ্ছে। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে একটা কর্পোরেট ব্যাপারও চলে এসেছে এটা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। আধুনিকা শাশুড়ি তার যদি রান্না না আসে তাহলে তিনি সুইগী বা জ্যমাটোতে একটা ফোন করলেই পছন্দ মতো খাবার হাজির বাড়িতে। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে জীবন যাপনের কারনে যেখানে দূরত্ব বেশি সেখানে ভিডিও কলের মাধ্যমে আচার অনুষ্ঠান সেরে মা লক্ষ্মী একাউন্ট ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছেন। এতে সবটাই বজায় রইল, শাশুড়ি জামাই দু'জনেই খুশি। সুতরাং পরিবর্তন এসেছে কিন্তু উন্মাদনা বা উল্লাস আগের মতোই আছে তা জামাইষষ্ঠীর দিন বা আগের দিন বাসে ট্রেনে ভিড়, মিষ্টি বা মাংসের দোকানের লাইন দেখলেই বোঝা যায়। হাজার হোক বাঙালীর তো এসবে কোনো আপস নেই আর আপস না রাখলেই ভালো, কি বলেন!!



 
 
 

2 Comments


Shreya Chatterjee
Shreya Chatterjee
Jun 16, 2021

Darun❤️❤️

Like

অসাধারন❤️

Like

Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page