top of page
Search

জামাইষষ্ঠীর বিশেষ প্রবন্ধে সৌম্য ঘোষ


জামাই ষষ্ঠী --- "বঙ্গ জীবনের অঙ্গ"


 সৌম্য ঘোষ





               জামাইষষ্ঠী মানেই "বঙ্গ জীবনের অঙ্গ"! জামাইষষ্ঠী নিয়ে হাজারো রকমের রম্যগল্প। চুটকির শেষ নেই। ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে বিশাল মিষ্টির হাঁড়ি ঝুলিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ জামাইয়ের আগমন। আনকোরা জামাই থেকে বুড়োভাম জামাই বাংলা পঞ্জিকার জৈষ্ঠ্য মাসের বিশেষ দিনে জামাই আদর নির্ধারিত। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিবসে। এটি মূলতঃ  লোকায়ত একটি প্রথা ও ষষ্ঠী দেবীর পার্বণ। পরবর্তীকালে সামাজিক রূপ পায়।


            আধুনিকতায় যতই বাঙালি সমকালীন হোক না কেন, এই প্রথা-পার্বণ আজও বাঙালির ঘরে থেকে গেছে। গ্রামবাংলা বা নগরকেন্দ্রিক যেখানেই হোক না কেন আঙ্গিকের ভেদ থাকলেও প্রথা প্রকরণ একই। মেয়ে-জামাইকে ঘরে আপ্যায়ন করে এনে,  জামাইয়ের কপালে ষষ্ঠীপূজার নৈবেদ্য স্বরূপ পাঁচ রকমের ফল,  পান-সুপারি, ১০৮টি দুব্বো বাধা আঁটি , ধানের ছড়া, হলুদ তাগা, মাঙ্গলিক হলুদ, দই এবং তালপাতার নতুন পাখার উপর আম্রপল্লব সাজিয়ে জামাইর শ্রীকপালে ঠেকাতে হয়। সঙ্গে শঙ্খ ও উলুর ধ্বনি। দুপুরে চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় ভুরিভোজের এলাহি ব্যবস্থা।


               ষষ্ঠীদেবী দ্বিভূজা, দু'নয়না, গৌরবর্ণা, দিব্যবসনা, সর্বসুলক্ষণা ও জগদ্ধাত্রী শুভপ্রদা। তিনি মাতৃত্বের প্রতীক। বিড়াল তাঁর বাহন। মূলতঃ সন্তান কামনায়,সন্তানের কল্যাণে ও সংসারে সুখ শান্তি নিশ্চিত করাই এই পূজার উদ্দেশ্য। সম্ভবতঃ এটি বৈদিক রীতি। কেননা, ষষ্ঠীদেবী বৈদিক দেবতা। 


            আশুতোষ ভট্টাচার্যের লোকায়ত ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, দেবী ষষ্ঠী প্রসূতি ও শিশুর রক্ষয়িত্রী। নৃতত্ত্ব পন্ডিত সুধীররঞ্জন দাস দাবি করেছেন,  হরপ্পাতেও এমন প্রাগৈতিহাসিক দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে, যা দেখে অনুমান হয়, সিন্ধু সভ্যতাতেও ষষ্ঠীর আরধনা চলত অর্থাৎ আনুমানিক চার হাজার বছরের পূর্বের রীতি। উইলিয়াম জোনস প্রাচীন ইউরোপে একই রূপ রীতি,লোকাচারের মিল দেখেছেন। 


পশ্চিম ভারতেরও প্রচলিত।


          ব্রাহ্মণ্য ধর্ম একাধিকবার এই লোকয়ত পূজাকে বিনাশ করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফলকাম হয় নি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে হিন্দু যুদ্ধ দেবতা স্কন্দ ও তার সহযোগী যৌধেয়র সঙ্গে দেবী ষষ্ঠীকে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকের  মধ্যে বিভিন্ন শাস্ত্রে, বিবরণে ও মূদ্রায় দেবী ষষ্ঠীর ছটি মাথা দেখানো হয়েছে। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্তযুগে এই রূপ মূর্তির বর্ণনা পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকে বায়ুপুরাণে ৪৯টি দেবীর মধ্যে দেবীষষ্ঠী অন্যতম আরাধ্যা। চতুর্থ পঞ্চম শতাব্দীতে যাজ্ঞাবল্ক্য স্মৃতিতে,


তিনি স্কন্দদেবের পালিকা মা ও রক্ষয়িত্রী। অথচ পদ্মপুরাণে দেবী ষষ্ঠীকে স্কন্দদেবের স্ত্রীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ষষ্ঠী মঙ্গলে, সর্ব দেবীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। বিহারের সন্তান জন্মের পরে  ছ'দিনের অনুষ্ঠানকে বলা হয়---ছ'টি। দেবীষষ্ঠী হলেন ছ'টি মাতা। উড়িষ্যায় এই রীতির প্রচলন আছে। 


                কিন্তু এই যে এত পূজা-রীতি-লোকায়ত আচার অনুষ্ঠান, সেখানে কোথাও জামাইষষ্ঠীর কথা উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাহলে, জামাইবাবাজীবন কোন্ ফাঁকতালে ঢুকে পড়ল!!


            জৈষ্ঠ মাসে সাবিত্রী চতুর্দশীতে স্ত্রীরা স্বামীর দীর্ঘজীবন কামনা করে যমের আরধনা করেন।


অনুমান, এই লোকাচারের সূত্র ধরে কলকাতার "বাবু-সংস্কৃতি" এই ষষ্ঠীকে জামাই আপ্যায়নের জন্য নিবেদন করে। আঠারো-ঊনিশ শতকে বাংলার সচ্ছল শ্রেণীর মধ্যে বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ ব্যাপক প্রচলন ছিল "বাবু - সংস্কৃতি"তে।


ফলস্বরূপ, ব্যাপক বাল্যবৈধব্যের যন্ত্রণাময় জীবন এবং সতীদাহ প্রথা। প্রেক্ষাপটে রাজা রামমোহন রায় না আসা পর্যন্ত চলতে থাকে। এইরূপ সময়ে, জামাই ও স্বামীর দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা মা ও মেয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে, কলকাতা ও তার চারপাশে এই রীতির প্রচলন ঘটে। ক্রমে সমগ্র বঙ্গদেশ। 


              প্রকৃতপক্ষে, জামাইষষ্ঠীর আসল উদ্দেশ্য হলো, মাতৃত্ব, সন্তান ধারণ ও বংশবৃদ্ধি। মেয়ে যাতে সুখে-শান্তিতে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে পারে, তার জন্য মঙ্গল কামনা। জামাইষষ্ঠীর অনুষ্ঠানের আচরণগুলো প্রত্যেকটি অর্থবহ।


            যেমন,


           ফুল, বেলপাতা দিয়ে হলুদের রাঙানো সুতো বেঁধে দেওয়ার অর্থ পরিবারের অটুট বন্ধন ও সুখকামনা।


         নতুন তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করার অর্থ জামাই-র সমস্ত আপদ-বিপদ দূরে যাক।


        তিনবার "ষাট-ষাট-ষাট" বলার অর্থ দীর্ঘায়ু কামনা করা।


       ধান সমৃদ্ধি ও সন্তানাদির প্রতীক। দূর্বা চিরসবুজ ও চির সতেজতার প্রতীক।


       এসব কিছু জামাইর মঙ্গলের জন্য যেমন শুভকামনা, তেমনি মেয়ের মঙ্গলচিন্তা ও সুন্দর সাংসারিক জীবন যাপনের জন্য মা ষষ্ঠীর কাছে প্রার্থনা।।

 
 
 

Comentarios


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page