থিয়েটার রোড : নাট্যচর্চার ইতিহাস,ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা অধ্যায়।
সৌভিক রাজ
আমাদের চেনা কলকাতার মধ্যেই রয়েছে আরেকটা অচেনা কলকাতা,তাকে দেখতে শিখুন।
কলকাতায় একদা থিয়েটার রোড নামে এক রাস্তা ছিল। যার অস্তিত্ব আজ আর আপনি খুঁজে পাবেন না। নাম শুনেই বোঝা যায় এই রাস্তার সঙ্গে থিয়েটারের নিবিড় যোগাযোগ ছিল।
কালের নিয়মে সে নাম হারিয়ে গিয়েছে। আজ এ রাস্তার নাম হয়েছে শেক্সপিয়র সরণি।
২৫ শে এপ্রিল ১৯৬৪ সালে শেক্সপীয়ারের জন্মের ৪০০ বছর উপলক্ষ্যে, কলকাতা পৌরসংস্থা থিয়েটার রোডের নাম বদলে শেক্সপীয়ার সরণি রাখে।
সে যুগের বিখ্যাত রঙ্গমঞ্চ চৌরঙ্গী থিয়েটার,এই রাস্তার উপরেই অবস্থিত ছিল।
থিয়েটার রোড ও চৌরঙ্গি রোডের সংযোগস্থলে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত ছিল চৌরঙ্গি থিয়েটার।
এই থিয়েটার হলের কারণেই এই রাস্তার নামকরন করা হয়েছিল থিয়েটার রোড।
সময় ও স্মৃতির সরণি বেয়ে হয়তো নাম পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ওই থিয়েটার রোড নামটির মধ্যেই তদানিন্তন কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদেশি নাট্যচর্চাকেন্দ্রের ঐতিহ্য, ইতিহাস অক্ষত ছিল।
যদিও এ রাস্তার ইতিহাস আরো প্রাচীন। অতীতের কলকাতায়, রাজপথের আলাদা করে নামকরণ করা হতো না। রাস্তা দিয়ে যেখানে যাওয়া যেতো, সেই জায়গার নামেই রাখা হত রাস্তার নাম।
১৮৫০ সালের "বেঙ্গল অ্যান্ড আগ্রা ডিরেক্টরি" অনুযায়ী থিয়েটার রোডের নাম ছিল "পুরানা নাচঘর কা উত্তর রাস্তা"।
এযুগের শেক্সপীয়ার সরনী এবং চৌরঙ্গীর মোড়, আজ যেখানে সাহারা সদন, সেখানেই ছিল পুরানা নাচঘর ছিল। অর্থাৎ পুরানা নাচঘর যাওয়ার রাস্তার নাম হয়েছিল পুরানা নাচঘর কা রাস্তা।
এই রাস্তার উপরেই ছিল চৌরঙ্গী থিয়েটার, যার নামেই এই রাস্তার নামাঙ্কন হয় থিয়েটার রোড।
লালবাজার স্ট্রিট এবং মিশন রো-এর মোড়ের ঠিক পূর্ব দিকে, ১৭৪৫ সালে তৈরী হয়েছিল কলকাতার প্রথম সাহেবদের থিয়েটার। যার নাম ছিল ওল্ড প্লে হাউস।
১৫৫৬ সালে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেন, সেই সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওল্ড প্লে হাউজ।
খুব সম্ভবত প্লে হাউজের মালিক মিস্টার ফিঞ্চ সেই যুদ্ধেই মারা গিয়েছিলেন।
৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধের পর, ওল্ড প্লে হাউস, নিলামঘর হিসেবে পরিবর্তিত হয়।
১৭৫৬-এর সিরাজের কলকাতা আক্রমনের সময় যুদ্ধেই মারা যান মিস্টার আয়ার, অধুনা রাইটার্স-র কাছেই সে সময়ে তাঁর একটি বাড়ি ছিল।
সেই জমিতেই ১৭৭৫ থেকে ১৭৭৬ সালের মধ্যেই তৈরী হয়েছিল ক্যালকাটা থিয়েটার।
সাধারনমানুষ নাম এর নাম দিয়েছিল, নিউ প্লে হাউস। সেখানেই পরে তৈরী হয়েছিল ফিনলে ম্যুরি অ্যান্ড কোম্পানির অফিস। আজও সেই বাড়ি বর্তমান। আজ সেখানে এখন এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের কার্যালয় অবস্থিত।
টিনের তলোয়ারের পাঠকেরা তো বটেই, সেই সঙ্গে এই নাটকের শ্রোতা-দর্শকদের কাছে গ্যারিক, একটি বহুল পরিচিত নাম। সকলেই নামটির সঙ্গে পরিচিত।
আধুনিক থিয়েটারের প্রায় প্রত্যেকটি বিভাগের ওপরেই যাঁর প্রশ্নাতীত প্রভাব ছিল; শোনা যায় সেই ডেভিড গ্যারিকই, স্বয়ং তাঁর এক সহযোগীকে ক্যালকাটা থিয়েটারের দায়িত্ব নিতে পাঠিয়েছিলেন।
জনপ্রিয়তার দিক থেকে,এই সব কিছুকেই পেরিয়ে গিয়েছিল চৌরঙ্গী থিয়েটার। যার পোশাকি নাম ছিল দি প্রাইভেট সাবস্ক্রিপশন থিয়েটার।
চৌরঙ্গি থিয়েটার ছিল অভিজাত্য আর ঐতিহ্যের অপর নাম। তদানিন্তন কলকাতার বরেণ্য ব্যক্তিদের দানে ও মদতে পুষ্ট এক অভিজাত রঙ্গালয়। এই নাট্যশালার ইতিহাস আর কলকাতার নাট্যচর্চার ইতিহাস প্রায় সামর্থকই বল চলে। ১৮১৩ সালের ২৫ শে নভেম্বর চৌরঙ্গী থিয়েটারের উদ্বোধন হয়েছিল।
কলকাতার বিখ্যাত কৃতী মানুষেরাই এর খরচ বহন করেছিল,এই থিয়েটারের শেয়ার বিক্রি করা হতো। ১০০ টাকা করে এক একটি শেয়ার বিক্রি করা হয়েছিল।
বহু ইংরেজদের সঙ্গে প্রিন্দ্ব রকানাথ ঠাকুরও চৌরঙ্গী থিয়েটারের শেয়ার কিনেছিলেন সেই সময়ে।
থিয়েটারে উদ্বোধনের রজনীতে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং বড়লাট, লর্ড ময়রা।
প্রথম রজনীতে অভিনীত হয়েছিল ‘কাসল স্পেক্টার’ নামে একটি ট্র্যাজেডি নাটক এবং ‘সিক্সটি থার্ড লেটার’ নামে একটি অপেরা। সেযুগের বিখ্যাত ইংরেজ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এই রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন মিসেস এসথার লিচ।
চৌরঙ্গী থিয়েটার ছিল ওই সময়ের কলকাতার সর্ববৃহৎ প্রেক্ষাগৃহ, বসার জন্যে প্রায় ৩০০ দর্শকাসন ছিল প্রেক্ষাগৃহের ভেতরে।
সে যুগে থিয়েটারে মহিলারা অভিনয় করতেন না। কেবল ভারতীয় নাটকেই নয়, সাহেবদের নাটকেও, কম বয়েসী ছেলেদেরই মেয়ে সাজিয়ে অভিনয় করানো হতো। এখানেও ব্যাতিক্রম চৌরঙ্গী থিয়েটার, প্রচলিত প্রথা ভেঙে এখানেই প্রথমবারের মতো মঞ্চে মহিলাদের অভিনয় করতে দেখা যায়। পেশাদারী অভিনয়ের বিষয়েও পথিকৃৎ ছিল এই মঞ্চ, এই মঞ্চেই প্রথম পেশাদার অভিনেতাদের দেখা যায় কলকাতায়। চৌরঙ্গী থিয়েটারে হেনরি দি ফোর্থ, রিচার্ড দা থার্ড এবং দি মেরি ওয়াইভস অফ উইন্ডসের মত শেক্সপীয়ারের একাধিক নাটক অভিনীত হয়েছিল।
এই নাট্যমঞ্চের স্থাপত্যও ছিল অপূর্ব। শুধু ভিনদেশী সাহেবেরাই নন, দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো সে যুগের অভিজাত ভারতীয়েরাও চৌরঙ্গী থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
প্রথমদিকে এই থিয়েটার তেমন ভাবে লাভের মুখ দেখেনি।
বারো বছর চলার পরে, ১৮৩৫ সালে এই থিয়েটার হল নিলাম হয়ে যায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর কিনে নেন এই থিয়েটার। ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বহু টাকা লগ্নিও করছিলেন তিনি সেখানে। নতুন করে পথ চলা শুরু হল চৌরঙ্গি থিয়েটারের।
১৮৩৫ নাগাদ দ্বারকানাথ ঠাকুর এই প্রেক্ষাগৃহের আধুনিকীকরণ করিয়েছিলেন, বছর চারেক ভালোই চলছিল থিয়েটার কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
১৮৩৯ সালের ৩১ শে মে এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড হয় চৌরঙ্গী থিয়েটারে। আগুনের হাত থেকে বাঁচানো যায়নি চৌরঙ্গী থিয়েটারকে। ১৮৩৯ সালের ৩১ শে মে রাত ১-টা থেকে ২-টোর মধ্যে আগুন লাগে চৌরঙ্গী থিয়েটারে, মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় শেষ হয়ে যায় সমগ্র প্রেক্ষাগৃহ।
ঘটনাস্থলে দমকল পৌঁছেছিল ঠিকই, কিন্তু আগুনকে কোনো ভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।
প্রথমত কাঠের তৈরী প্রেক্ষাগৃহ, সেই সঙ্গে ভেতরে মজুত সব সরঞ্জামই ছিল দাহ্য। দ্বিতীয়ত, সে সময় প্রযুক্তিও উন্নত ছিল না।
অসহায় ভাবে দমকল কর্মীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোটা প্রেক্ষাগৃহকে আস্তে আস্তে ধ্বংস হতে দেখেন। রাত আড়াইটা নাগাদ বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ে থিয়েটারের গম্বুজ। এই ভয়ংকর অগ্নিকান্ড থেকে প্রেক্ষাগৃহের একটি আসবাব পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব যায়নি।
চৌরঙ্গী থিয়েটারের আজ আর কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই। আজ চৌরঙ্গি থিয়েটারের অস্তিত্ব পাওয়া যায় উইলিয়াম উডের আঁকা একটি ছবিতে এবং পুরনো কিছু বই-এর পাতায়। রাস্তার নামের সঙ্গে, যাও কিছুটা নষ্টালজিয়া রয়ে গিয়েছিল, তাও রাস্তার নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যায়।
নতুন করে নাম পরিবর্তনের দেড় দশক পরে এই রাস্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে আরো এক ইতিহাস। কাঁটাতার পেরিয়ে সে ইতিহাস মিলিয়ে দিয়েছে দুই বাংলাকে।
১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিলে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে এই বৈদ্যনাথতলার নাম বদলে মুজিবনগর হয়ে যায়। তদানিন্তন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্যালয় ছিল কলকাতার ঐতিহাসিক এই থিয়েটার রোডেরই ৮ নম্বর বাড়িতে। এই বাড়িতে বসেই পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের নানান কার্যকলাপ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন,কলকাতার মাধ্যমেই ভারতের সামরিক বাহিনী ও বিদেশ দপ্তর,প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখত।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বহু বুদ্ধিজীবী, লেখক -শিল্পীরা ওই কয়েকমাসের জন্যে কলকাতাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন।
প্রবাসী সরকারকে ভারত সরকারই এই ভবনটি দিয়েছিল।
বাড়িটি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী অরবিন্দ ঘোষের,পরবর্তীতে যিনি হয়ে উঠেছিলেন ঋষি অরবিন্দ। এটি ছিল তাঁর মাতুলালয়, এ বাড়িতেই তিনি জন্মেছিলেন। এখন ওই ৮ নম্বর বাড়িটির নাম অরবিন্দ ভবন। বাড়িটি এখনও রয়েছে, তবে সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলক পর্যন্ত নেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ওই বাড়িতে নিয়মিত খবর সংগ্রহ করতে যেতেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত। তাঁর বিবরণ থেকেই জানা যায়, "বাড়িটার চারদিকে বি এস এফ পাহারা দিত, আর ভেতরে থাকত প্রবাসী সরকারের নিজস্ব প্রহরীরা। বাড়িটার ঠিক উল্টোদিকে নিউ কেনিলওয়ার্থ হোটেল। ওই হোটেলে পাকিস্তানের চর এসে ওঠে। ওপর থেকে বাড়িটির ছবি নিয়ে তা পাকিস্তানের সব খবরের কাগজে প্রকাশ করা হয়। বলা হয়েছিল কোথাও কোনও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না। কিছু মানুষ কলকাতার একটি বাড়িতে বসে ভারতের রক্ষীদের প্রহরায় এসব মিথ্যা রটাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নামে।" তাঁর বর্ণনা থেকে আরো জানা যায়,"এই ভবনেই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, সেনা প্রধান কর্ণেল ওসমানি, অর্থমন্ত্রী মনসুর আলি - এরা বসতেন। তাজউদ্দিন আহমেদের পরিবার থাকত অন্য মন্ত্রীদের পরিবারের সঙ্গে ইন্টালি অঞ্চলে। কিন্তু মি. আহমেদ কোনও দিন সেখানে যাননি। ওই নয় মাস তিনি বোধহয় ঘুমোননি - এত পরিশ্রম করতেন। শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেব এই বাড়িতে বসতেন না। তার আলাদা একটি দপ্তর ছিল কাছেই।"
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পরে ১৯৭২ সালে ভারত সরকার এই বাড়িটিকে শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের হাতে অর্পণ করে।
পরের বছর ১৯৭৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে এই বাড়িটি শ্রী অরবিন্দ ভবন হিসেবে পথচলা শুরু করে।
Yorumlar