ধুলোমুঠির গান
অয়ন ঘোষ
৫
দূরে দূরে থেকে ভালো থাকার এই সময়ে, যদি প্রাণ ভরে ডাক দিই, শুনতে পাবেন? ওই যে, টেলিপ্যাথি বলে একটা কথা আছে না, যাতে মন মনের কথা শুনতে পায়। ভারতীয় যোগশাস্ত্র কিছু কিছু পড়ার সুবাদে জেনেছি, অনেক মহাপুরুষ যোগীরা মনের তরঙ্গ পাঠিয়ে ভাবের আদান প্রদান করতেন। শব্দ করার দরকার পড়ত না। অনেক অনেক দূর, দূরত্বের এককে হয়ত কয়েক হাজার মাইল, কিন্তু একজন অন্যজনের মন পড়ে নিতে পারেন। আমাদের শোবার ঘরের এক জায়গায়, দুই বাবার ছবি আছে, মানে আমার বাবা ও আমার সহধর্মিণীর বাবার ছবি। ছবি দুটি উৎকল বঙ্গের সার্থক রূপায়ণ। দুজনেই গত হয়েছেন, জীবিত অবস্থায় আলাপের সুযোগ হয় নি। এখন তাদের অখণ্ড অবসর, গল্পের জীবন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কি ভাষায় তারা আলাপ করেন। যতদূর জানি আমার পিতৃদেবের হিন্দী আমার চেয়েও খারাপ ছিল। অন্যজনের কথা বলতে পারবো না, একবারের আলাপে উনি নিজের মাতৃভাষাতেই কথা বলেছিলেন। আমার বেশ মনে হয় দু'জনে ভালোই গল্প করেন, খুনসুটিও করেন কারণ সম্পর্কে তো বেয়াই। তাই যখনই মালা কিনে আনা হয়, চেষ্টা করি একই মালা আনতে, পাছে কারোর অভিমান না হয়। ছবি দুটো যদি কখনো, একটু সরে যায় বা নড়ে ওঠে, গিন্নীকে মজা করে বলি, দুই বুড়োতে মনে হয়, কিছু একটা নিয়ে গোল করেছে। আমার বেশ মনে হয় ওরা কথা বলেন, আমাদের চোখে চোখে রাখেন, শাসন করেন। তাই কোনো অপরাধ হলেই অপরাধ বোধ জাগে, গুরুজনের সামনে ভুল করে ফেললাম। মাথার ওপর কেউ আছে ভেবে ভরসা পাই। আসলে, কথা বলতে সত্যিই ভাষা লাগে না, মনের তরঙ্গই লাগে বোধহয়। তাই এই আকালের দিনে মনের দরজা জানলা খুলে রেখেছি, কোন পথ দিয়ে কখন মনের সুজন আসবে কে জানে!
তাই যদি না হবে তবে কোন কোন দূর দেশের কবিদের অক্ষর গান আমাদের মনের দুয়ারে এসে ছায়া দেয়, মায়া দেয় কেনো? কেনো ওদের নিজস্ব অনুভূতিগুলো আমার বেশ নিজের নিজের মনে হয়। নির্জন অবসরে খুঁজে পেতে দেখি, কি অনায়স দক্ষতায় আমার মনে ঝাঁক দিয়ে আমার সব গল্প তারা তুলে নিয়ে গেছেন, আমি জানতেই পারি নি। যখন সেই শব্দরূপ আমার হাতে পড়ল, অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম কি নিখুঁত আয়োজনে আমিই সেখানে প্রধান চরিত্র। প্রতিটা বর্ণনায় আমার এমন সব গল্প তারা আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ির মতো বলে গেলেন, তার খবর আমার নিজের কাছেই ছিল না। একটা বড় আয়নায় ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠলো ভিতরের আমিটা, ডেকে বলল, চল একটু ঘুরে আসা যাক তুমি আর আমি, অচেনা বা আধচেনা পথে, অস্থির সন্ধ্যে গুটি গুটি পায়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে বেদেনীর চুবড়ীতে। মাদার গাছের তলায় চাপ চাপ অন্ধকার। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, একি আমাদের কথা নয়!
আমি তো চোখ বন্ধ করে, দশ হাজার না হলেও প্রায় শ'খানেক চরিত্রকে স্পষ্ট দেখতে পাই, তাদের সাথে নির্ভার আলাপ করি, জেনে নিই পথের হদিস। নির্জনচারী কবি, দেখলেন একাকী এক ব্রজবালা দাঁড়িয়ে যুমনার তীরে, কণ্ঠে তার পদাবলী সুর। সেই সুর তাকে ভাসিয়ে নিল অশ্রুত স্রোতে। তিনি একবর্ণ বুঝলেন না সেই গানের অর্থ। শুধু যাবার বেলায় ইপ্সিত বস্তু যেমন মানুষ বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে, ঠিক তেমনি করে বয়ে নিয়ে গেলেন ডাভ কটেজে,তার আগামীদিনের বেঁচে থাকার রসদ হিসেবে। সতীর মৃত্যুর পর স্বয়ং জগৎ পালক অস্ত্র ধরে যেমন তার শরীরকে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ধরার ধূলিতে, ঠিক তেমনি সাগর পাড়ের মগ্ন কবি ওই গানের এক একটি ধুন বিলিয়ে দিয়েছেন আমাদের মনে মনে। তাই আমার এই ফ্ল্যাটের সামনের ফাঁকা জমিতে এই দেখার বেলায় আমি রোজই অমন এক বিজন বধূকে দেখতে পাই। কঠিন এই সময়ে স্বামীর রোজগার বন্ধ। বাচ্ছাকাচ্ছা নিয়ে চারটে পেট।
কিছু কাঠকুটো জমা ছিল ওই জমিতে। সে যখন ওই কাঠকুটো ভেঙে নিয়ে যায় খিদের আগুন নেভাতে, তাকে আমার মনে হয় প্রমিথিউস, সে যেমন স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিল, সৃষ্টির কল্যাণে। এই বধুটিও রোজ জীবনের কাছে আহুতি দেবে বলে আগুন চুরি করে নিয়ে যায়। গৃহ বন্দীর এই অবসরে এই দেখাটুকু আমার পরম প্রাপ্তি। আগে কখনো দেখা হয়নি এমন করে যে, বিলেতে লেখা হলেও 'সলিটারি রিপার' কেবল বিলেতবাসী নয়। আমার দেখা গাঁ'গঞ্জে তারা নিত্য ঘুরে বেড়ায় প্রাণের টানে জীবনের প্রয়োজনে। আমার ভোঁতা দৃষ্টির কারণে এতদিন দেখা হয়ে ওঠেনি। দু'হাত তুলে দুর থেকে প্রণাম জানাই ওই আগুন সংগ্রামকে আর অক্ষর দেবতাকে ডেকে বলি আশীর্বাদ করো মন বাড়িয়ে যেনো দূরের কথা শুনতে পাই।
( ক্রমশ ...)
Comments