
পরিপ্রেক্ষিত
ময়ূখ হালদার
(পর্ব- দুই)
গালে আফটার শেভ লাগিয়ে আরও কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। আয়নার বয়স বাড়ে না অথচ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার বয়স হু হু ক'রে বেড়ে যায়। কাচের ভেতর থেকে ভেসে আসা টিক টিক শব্দ মনে করিয়ে দেয় হাজারো টুকরো টাকরা মন্তাজ। মনে পড়ে প্রথম দাড়ি কাটার দিন থেকে আজ পর্যন্ত লেখা একটা বিরতিহীন উপন্যাস। যতিচিহ্ন বর্জিত সেই লেখা যে কোনও মুহূর্তে থেমে যাবে নভেলিস্টের ইচ্ছায়। তারপর? তারপর আর কী! আমার শরীরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আর আমি আইনস্টাইনের ফরমুলায় চ'ড়ে ঘুরে বেড়াবো। সে ভারি মজার বিষয়। শোনো তুষার, এসব কথা আবার ভুল করেও যেন অদিতির কানে তুলো না। পাগল নাকি! সে আর বলতে! তোমাকে আমার চরমতম ট্র্যাজেডির কথা বলি, আমি আর অদিতি হচ্ছি পাশাপাশি বয়ে চলা দুটো সমান্তরাল রেখা- ঠিক যেন রেললাইন। কী হলো? চুপ ক'রে গেলে যে! তুমি তো সবই জানো। প্রতিদিন সকালে নিয়ম ক'রে তোমার সাথে দেখা হলে এই কথাগুলোই তো বলি। হ্যাঁ, সে তুমি রোজই বলো। তোমাকে আরও একটা কথা বলি তুষার, আমার কেউ নেই- একমাত্র তুমি ছাড়া! আজকাল কোনওকিছুই আর ভালো লাগে না। ক্লান্তিহীন মোমবাতির মতো জ্বলছি নিরন্তর। মাঝে মাঝে মনে হয়, অনেক তো হলো। আর কেন? এবার দপ ক'রে নিভে গেলেই হয়! যাঃ, কী যে বলো না তুমি! কেন? আরে বাবা নিভে যাবো বললেই কি নিভে যাওয়া যায়? তুমি চলে গেলে ওদের কী হবে? কাদের? কাদের আবার! অদিতি আর তিথির। পঁচিশ বছর চাকরি হয়ে গেল। মরে গেলে এককালীন টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ড গ্র্যাচুইটি আর ফুল পেনশন। চিন্তা কীসের? তবে চিন্তা যে হয় না সেকথাও জোর দিয়ে বলতে পারি না। তিথিটা মাস্টার্স করে বসে আছে। নিজের পায়ে দাঁড়ালে আর কোনও টেনশন থাকতো না। দেখা যাক কী হয়! তবে কী জানো, তিথির ওপর আমার ভরসা আছে। ওর মতো স্কলার ঠিক শাইন ক'রে যাবে। নিজের মেয়ে বলে বলছি না, নাচ গান ছবি আঁকা পড়াশোনা- সবদিক থেকেই জিনিয়াস। আমি তো চাই জন্ম-জন্মান্তরে ও আমার মেয়ে হয়েই ফিরে ফিরে আসুক।
-তাড়াতাড়ি করো। চা জুরিয়ে গেল যে!
-হয়ে গেছে। এখনই আসছি।
শুনলে তো! ডাক এসে গেছে। আপাতত পাততাড়ি গোটাতে হবে। সাবধানে থেকো তুষার। হ্যাভ আ নাইস ডে।
আমি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বাথরুমের দরজা ঠেলে পা রাখলাম অন্য জগতে। টেবিলের ওপর টি-পট, কাপ, বাটার টোস্ট আর জলের বোতল আগলে চেয়ারে বসে আছে অদিতি। আমি তোয়ালেটা হ্যাঙারে রেখে দ্বিতীয় চেয়ারটাতে বসলাম।
-আমি ভেবে পাই না তুমি দাড়ি কাটো নাকি ধ্যান করো।
অদিতি মুখ ঝামটা দিল।
-যদি বলি দুটোই! শেভিংও রীতিমতো সাধনার ব্যাপার। কনসেনট্রেশন ব্রেক হলেই ঘ্যাচাং ফুঁ!
-ওসব ছেলেভোলানো কথা আমাকে শুনিও না প্লিজ। আর তো কেউ দাড়ি কাটে না! উনি একাই...
-তিথি এখনও ওঠেনি?
আমি কৌশলে থামিয়ে দিলাম অদিতিকে।
-না। সারারাত মোবাইলে খুটুর খুটুর করলে সকাল সকাল ঘুম ভাঙে!
- নিশ্চয়ই দরকারি কাজ করছিল। তুমি যা ভাবছ তা নয়। মেয়ে আমাদের যথেষ্ট সিরিয়াস।
দিনের দ্বিতীয় বাউন্সারটাও সামলে দিলাম। দিন কে দিন পোক্ত ব্যাটসম্যান হয়ে উঠছি।
-এই তোমার আশকারাতেই গোল্লায় যাচ্ছে মেয়েটা! নাচো, আরও বেশি ক'রে মাথায় তুলে নাচো! আমার কী! কতবার বলেছি, অনেক তো পড়াশোনা হলো এবার একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়েটা দিয়ে দাও। তা কে শোনে কার কথা!
-আঃ! বাজে কথা ব'লো না তো! সকাল সকাল যতসব ফ্যাচাং! বেড়াতে এসেও শান্তি নেই। সবসময় কানের কাছে খনার বচন আউড়ে যাচ্ছে!
আমি বাটার টোস্ট অর্ধমৃত অবস্থায় প্লেটে ফেলে রেখে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সাতসকালে মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। কিন্তু এ কী অদ্ভুত মায়া! সামনে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে নগরাজ হিমালয়, যেন সূর্যের ওম নিচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট ক'রে হাসছে! মুহূর্তে সমস্ত মন খারাপ উধাও। হয়তো কয়েক জীবন তপস্যা করলে এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। আমি মন্ত্রমুগ্ধর মতো সামনে তাকিয়ে রইলাম! সাদা ক্যানভাসের ওপর কোনও দক্ষ শিল্পী যেন একটার পর একটা রঙের স্ট্রোক টেনে দিচ্ছে ব্রাশ দিয়ে! আমি ক্রমশ ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যেতে লাগলাম। এমন অপূর্ব দৃশ্যের সামনে, সৌন্দর্যের সামনে সমস্ত জাগতিক চাহিদা তুচ্ছ মনে হয়। কীসের জন্য এত মারামারি? খুনোখুনি, রক্তপাত? পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন? আমার ইচ্ছা করছে চিৎকার ক'রে সবাইকে ডেকে বলি, ওরে দ্যাখ! ভালো ক'রে দ্যাখ... অন্ধের দল! অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার আগে একবার পাহাড়ের দিকে তাকা। মনে হচ্ছে না, আমরা কি ভীষণ ক্ষুদ্র? আত্মশ্লাঘা জন্ম নিলে আমি খোলা আকাশ, মহান পর্বত আর আদিগন্ত সমুদ্রের কাছে নিজের অস্তিত্ব বয়াঁ করি। নিজেকে তখন আইন-স্টাইন মনে হয়। সমুদ্রের পাড়ে ছড়িয়ে থাকা একটা নুড়িপাথর। জার্মান ভাষায় 'আইন' মানে 'এক' আর 'স্টাইন' হলো 'নুড়ি-পাথর।' তখন এই শব্দবন্ধের ঔরসে সিনট্যাক্সের জন্ম হয়- আইনস্টাইন অন দ্য বিচ... সমুদ্রের ধারে একটা নুড়ি-পাথর! এভাবে কতক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেল-হঠাৎ খেয়াল করলাম তিথি এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। ওর চোখদুটো মেলে দিয়েছে সামনে। কেমন এক ঘোরলাগা দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে রয়েছে অপলক। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম।
-যদি মানুষ হতে হয়, পাহাড়ের মতো হও।
-বাবা!
তিথি আলতো ক'রে আমার কাঁধে মাথা রাখলো। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ওকে স্তব্ধ ক'রে দিয়েছে। আমি কোনও কথা বললাম না। ধীরে ধীরে ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলাম। আরও কয়েক মিনিট এভাবেই কাটলো। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, ওর শরীরটা থরথর ক'রে কাঁপছে! আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আছড়ে পড়লো সুনামি! তিথি কাঁদছে! আমাকে জাপটে ধরে সে কী বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাস!
-কী হলো রে!
তিথি আরও শক্ত ক'রে চেপে ধরলো আমাকে। ওর কান্না থামছে না কিছুতেই। আচমকা মেঘভাঙা বৃষ্টির তল খুঁজতে লাগলাম মনে মনে। নিশ্চিত জানি, ছেলেমানুষি করার মেয়ে তিথি নয়। তবুও বললাম,
-ওরে ছাড় ছাড়! কী ছেলেমানুষি করছিস? ওঠ, তাকা আমার দিকে। ইস... কী অবস্থা! দাঁড়া...
-থাক! ঝরতে দাও। ঝরে যাক... সব ঋণ...
-ধুর পাগলি! কিছু দেনা থেকেই যায়... জন্মান্তরেও শোধ হয় না!
-জানি, মন তবুও মানে না!
-হয়েছে রে হয়েছে... এবার ওঠ তো! চোখদুটো একেবারে লাল হয়ে গেছে। যা জল দিয়ে আয়... ফ্রেশ হয়ে নে।
তিথি হাসি ফিরিয়ে দিল। আমি খানিকটা কাব্য ক'রে বললাম,
-চটপট তৈরি হয়ে আয়। আজ বাপ-বেটিতে দারুণ মজা করবো।
-আর মামণি?
-অ! তা তাকে জিজ্ঞেস কর। যদি রাজি হয় তবে তাকেও সঙ্গে নেবো।
-ওহ্ বাবা! তুমি পারোও বটে! তোমাদের কেমিস্ট্রিটা মিষ্টি আদা আর কাঁচকলার মতো!
নিজেকে অবাক ক'রে হো হো ক'রে হেসে উঠলাম। সত্যি বলতে এমন দিলখোলা হাসি শেষ কবে হেসেছি মনে পড়ে না। ঠিক এই মুহূর্তে, মনে হচ্ছে, জীবনের সমস্ত প্রাপ্তির পরীক্ষায় ফুল মার্কস পাওয়া ফার্স্ট বয় আমি! কী যে ভালো লাগছে তা ব'লে বোঝাতে পারবো না। হঠাৎ গালদুটো ঠাণ্ডায় কনকন করে উঠলো! খেয়ালই করিনি কখন জল নেমে এসেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে! বেঁচে থাকার স্বাদ আবার যেন নতুন ক'রে উপভোগ করলাম। এজন্য জীবনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার কাছে বর্তমান অর্থাৎ এই মুহূর্ত এবং আমার অস্তিত্ব- এটাই শেষ কথা। নতুন ক'রে সৃষ্টি অথবা ডিকনস্ট্রাকশনে আমার কোনও আগ্রহ নেই। এই যে জন্ম থেকে মৃত্যুর বৈচিত্র্যময় সফর- এর মাঝে অসংখ্য ছোটবড় দ্বন্দ্ব আমাকে এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগায়। এই কনফ্লিক্টের জন্যই যেমন বেঁচে থাকতে সাধ হয়, তেমনি কখনও আবার নিজেকে শেষ ক'রে দিতেও ইচ্ছে করে। তবে এই মুহূর্তে আমি মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকাকেই গুরুত্ব দিতে চাইছি। জীবনে আরও কত চমক অপেক্ষা ক'রে আছে কে জানে! দার্জিলিঙে এটাই প্রথম নয়, আগেও এসেছি বারকয়েক। তবে এবার এই শৈলনগরী আমার কাছে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে ধরা দিল। যা কখনোই বহরমপুরে আমার গোরাবাজারের বাড়িতে ব'সে থাকলে সম্ভব হতো না।
-গুড মর্নিং, দাদা!
নিচে দাঁড়িয়ে সুভাষ ছেত্রি। হিমালয়ান ইন হোম স্টের মালিক। আমি হাত নেড়ে ইশারা করলাম। আমার প্রফেসর বন্ধু আখতারুজ্জামান পুজোর ছুটিতে যখন দার্জিলিঙে এসেছিল তখন সপরিবার এখানেই উঠেছিল। ওর কাছেই জানতে পারি এই হোম স্টে-র কথা। প্রকৃতিগতভাবে আমি আর আখতার দুজনই নির্জনতা প্রিয়। যখন শুনলো আমরা দার্জিলিং যাবার পরিকল্পনা করছি তখন ও আমাকে এখানকার কথা বলেছিল। আমার এখানে দারুণ লাগছে। ম্যাল থেকে খানিকটা নিচে হলেও জায়গাটা বেশ নিঃঝুম। আর ভিউও বেশ ভালো। আরও কিছুটা এগোলে মিউজিয়াম। ছিমছাম পরিপাটি দোতলা বাড়ি। সাধারণত প্রিবুকিং থাকলে নিচের ঘর অ্যালাও করা হয় কিন্তু আমি ফোনেই কথা বলে নিয়েছিলাম সুভাষের সঙ্গে যাতে আমাদের দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ছেলেটাকে আমার বেশ লেগেছে। ভীষণ ফ্যামিলিয়ার। সত্যি কথা বলতে একবারের জন্যও এটা ফিল করতে দেয়নি যে আমরা বাইরে আছি। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশ। সুন্দর আপ্যায়ন, নম্র ব্যবহার দিয়ে ওরা আমাদের মন জিতে নিয়েছে।
-কী ব্যাপার? একা একা হাসছো যে!
অদিতি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যেন মেঘমুক্ত আকাশ। ঝর্নার জলের ওপর সূর্যের চোখ পড়লে যেমন লাগে তেমনই চকচক করছে ওর মুখ। আমার শীতকালের ওপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক রাজহাঁস। আমি গেয়ে উঠলাম,
-"এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ হে..."
অদিতি আমার হাতের আঙুল নিয়ে খেলতে খেলতে আনমনে শুনছিল গান...
ও হনহন ক'রে হেঁটে চলেছে ইউনিভার্সিটির গেটের দিকে। মাথায় নীল ছাতা। আমিও একছুটে ওর পাশে গা ঘেঁষে।
-ক্লাস বাঙ্ক করতে পারবো না আজ!
-আরে আজ যেতে কে বলছে! কাল যাবো, সিনেমায়,
আগর তুম না হোতে।
-দেখা যাক, কথা দিতে পারছি না এখনই।
-আমি অপেক্ষা করবো। ক্লাসের শেষে কথা হবে।
আমি হাত নেড়ে রাস্তার এপারে চলে এলাম...
-কতদিন পরে গাইলে বলো তো?
- নেচার'স ইনফ্লুয়েন্স, বুঝলে!
আমি সিগারেট ধরিয়ে হাসলাম। অদিতির চোখ আটকে গেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার শরীরে। অস্ফুটে বলল,
-সত্যিই তাই! কী সুন্দর, না?
আমি হাসি ফিরিয়ে দিলাম।
-তবে একথা মানতেই হয় প্রকৃতির একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। এমন সৌন্দর্য মনকে শান্ত ক'রে দেয়।
- বলছো? তবে তোমাকে দেখে কিন্তু সেটা মনে হয় না!
অদিতি গাল ফোলায়,
-এবার কিন্তু তুমি শুরু করলে!
-আচ্ছা বেশ... এখন থেকে নো ঝগড়াঝাটি।
-মনে থাকে যেন!
-আচ্ছা, তাহলে সিঙ্কিং সিঙ্কিং ড্রিঙ্কিং ওয়াটার!
বেশ বেশ! আমি রেডি। দেবাদেবীর কৃপা হলে এখন আমরা রওনা হতে পারি।
তিথি কাঁধ নাচালো সহজাত ভঙ্গিতে। আমরা ওকে লনের দিকে নেমে যেতে দেখছিলাম। ওর প্রতিটা পদক্ষেপে তাল কাটছিল বারবার।
(ক্রমশ....)
আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য ক্লিক করুন-
Comments