top of page
Search

ধারাবাহিকে ময়ূখ হালদার - ৫ (ক)

agantukpotrika

পরিপ্রেক্ষিত [পর্ব- পাঁচ(ক)]


ম য়ূ খ  হা ল দা র





-তো আপ চলে যাওগে?

রুটি সবজি চিবোতে চিবোতে ঠোঁট নাড়লো ফর্সা পেটানো বেঁটেখাটো চেহারার ছেলেটা যার শরীরে বইছে নেপালি রক্ত। আর্মিছাট চুল আর শক্ত চোয়ালের ফাঁকে চোখদুটো ছটফট করছে। যেন মিলছে না কিছু একটা। সে আটপৌরে বিছানার উপর ব'সে প্লেটে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল ঠিকই কিন্তু মুখে তুলছিল সামান্যই। তার হাতের আঙ্গুলগুলোতে কড়া পড়ার দাগ। দিনের বেশিরভাগ সময়েই তাকে স্টিয়ারিং ধ'রে থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে সে-মুখ তুলছিল আর আমাকে দেখছিল অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে। তার সুন্দরী বউ ঘরের এক কোণে জোড়াতালি মারা মান্ধাতা আমলের কাঠের চেয়ারে বসে সোয়েটার বুনছিল একমনে। হয়তো সে আমাদের কথা শুনছিল অথবা শুনেও না শোনার ভান করছিল। তার হাত মাঝেমধ্যেই থেমে যাচ্ছিল। আমি নাক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম,



-হ্যাঁ ভাই।

-কোই খাস ওয়াজা?

আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। ঠোঁটে ঝুঠা হাসি ঝুলিয়ে উচ্চারণ করলাম,

-কলকাতা থেকে আমার বন্ধু এসেছে। আজকের রাতটা দার্জিলিঙে থেকে কাল সকালেই পেলিংয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হবে। ওরে ইচ্ছে আমিও ওর সঙ্গে যাই।

-আপকা দোস্ত ইহা নেহি রহে সকতা? হামারে সাথ?

-না। আসলে ও একটু অন্যরকম। মানে, সবার সঙ্গে ফ্রি হতে পারে না। আমি ওকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। এটা অসম্ভব।

-জ্বি। ফির কব মিলেঙ্গে?

-আমি এ শহরে এলেই দেখা হবে।

-কব আওগে?

-সেটা এখনই কী ক'রে বলি!

দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম। এরই ফাঁকে বউটার চোখ বার দুয়েক আমাকে যেভাবে মেপে নিল তাতে আমি নিশ্চিত সেখানে অব্যক্ত কিছু কথা জমে আছে। গতকাল রাতের ঘটনার জন্য আমি সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না। বিশেষ ক'রে বাইরে এসে কেইই বা চায় উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে! কিন্তু ঝামেলা হঠাৎ করেই আসে। ইচ্ছে না থাকলেও জড়িয়ে পড়তে হয়। নইলে এমনটা কেন হবে! আমি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলাম। সকাল আটটা কুড়ি। মনে মনে ওঠার প্রস্তুতি নিতেই শুনতে পেলাম,

-এ মংলু তিমি কিনঅ বসিরহেকেছো? কারবাট বাহির নিষ্কনুহোস? কামমা যানু হুঁদেইনু?

মংলু কোনও কথা না ব'লে বাধ্য ছেলের মতো উঠে দাঁড়াল। খাবার প্লেটটা নামিয়ে রেখে হাত ধুয়ে তোয়ালে কাঁধে আমার সামনে এসে হাসার চেষ্টা করল।

-ঠিক হ্যায়, য্যায়সা আপকা মর্জি। বাট, আগলিবার মিলিয়েগা জরুর। ম্যায় যা রহা হুঁ লেকিন আপ নাস্তা কর কে ফির... আচ্ছা, রাম রাম দাদা। ম যাঁদেছু রওশনি।

-ঠিক ছ। হোস্ গরঅ।

মংলু হনহন করে নেমে গেল নিচে। তারপর বেশ কয়েক মিনিট রেস করানোর পর সাদা স্করপিওটা নিয়ে রাস্তায় উঠল। রোশনি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মংলুর চলে যাওয়া দেখছিল। ঠিক এখান থেকে শুরু হল আমার অস্বস্তি। আর মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ঝুলে রইলো গত রাতের ঘটনা। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম ঘরের জিনিসপত্রে মনোযোগ দিতে কিন্তু রোশনি আমাকে কিছুতেই স্থির থাকতে দিচ্ছে না। না, রোশনি নয়; বলা ভালো, ওর শরীর আমাকে অস্থির ক'রে তুলছে। আমি কোলের ওপর দুই হাত শক্ত ক'রে ধরে রাখলাম। মন শান্ত করতে একভাবে তাকিয়ে রইলাম বুদ্ধমূর্তির দিকে। বুঝতে পারলাম, আমি খুবই সামান্য একটা মানুষ যে একটা বিশেষ রিপুর সঙ্গে যুদ্ধে নামার আগেই হেরে ব'সে আছে! এত ক্ষুদ্র! এত নীচ! নিজের ওপর প্রচণ্ড ঘেন্না হতে লাগল আমার। ঠিক করলাম, অনেক হয়েছে; আর নয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই বেরিয়ে যাবো এখান থেকে।



-কী হলো কবি? ইয়োগা করতে বসলে নাকি!

বিষাক্ত হাসিতে ভরে গেল গোটা ঘর। আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম! সবকিছু কেমন ওলট-পালট হয়ে যেতে লাগল!

-অবাক লাগছে তো? আরে আমার মামার বাড়ি শিলিগুড়ি। ছোট থেকে আনাগোনা সেখানে। বাংলা আমি ভালোই জানি।

আমি কোনওমতে বলতে পারলাম,

-তবে মংলুর সাথে...

আবার একচোট হাসি আমাকে নীল করে দিল।

-আরে ওটা একটা বুরবাক! গোঁয়ার বোঝ, গোঁয়ার?

আমি চোখের পলক ফেললাম। রোশনি ঠোঁট ওল্টালো।

-ওর গিঁটে গিঁটে গোঁয়ার্তুমি! বলে কিনা ঘরে বাপ-দাদার ভাষা ছাড়া কথা বলা যাবেনা!

-নিজের ভাষায় কথা বলাটা কি অপরাধ?

-ওরে আমার শালার ঘরের শালা! ভাইয়ের জন্য দরদ উথলে উঠেছে দেখছি! এদিকে আমি যে হাঁপিয়ে উঠেছি সে খবর রাখো?

আমি অবিশ্বাস্য চোখে বললাম,

-দেখে বোঝা যায়না!

-বাইরে থেকে দেখে আর কতটুকু বোঝা যায়! বুঝতে হ'লে ভেতরে ঢুকতে হয়।

-আমি যাই।

বলেই ঘরের বাইরে বেরোতে যাবো, রোশনি দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল।

-এটা কী হলো?

-দেখতেই তো পাচ্ছ।

-দরজা খোলো। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবো না। -চলে যাও। কে তোমাকে বেঁধে রেখেছে!

কথা শেষ করেই রোশনি ওর গা থেকে চাদর সোয়েটার ছুঁড়ে ফেলল। তারপর জামার বোতাম খুলতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার পা ভারী হয়ে গেল! আমার হাঁ-মুখ থেকে ছিটকে বেরোলো,

-কী হচ্ছে এসব?

-দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? চলে যাবে বলছিলে না! যাও! রোশনি বুকখোলা জামার একটা হাতা ছেঁড়ার চেষ্টা করছিল। ওর উদ্দেশ্য আমার কাছে পরিস্কার। আমি ওর হাত চেপে ধরলাম নিরুপায় হয়ে অথচ মুখে বললাম,

-জামাটা নষ্ট হবে!

-অ্যাই শালার ঘরের শালা! গোটা মানুষটা নষ্ট হতে চাইছে সেটা বুঝিস না? জামা নষ্ট হবে!

রোশনির কথা শুনে আমি পাথর বনে গেলাম! ধীরে ধীরে আমি ওর চোখে চোখ রাখলাম। ও উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ক্ষুধার্ত সিংহী! ফাঁদে পড়ে গেছে ঘুঘু। আমি খাটের কোনায় হাত রেখে দাঁড়ালাম। এখন আর বাঁচার স্কোপ নেই। যদি কাল রাতেই এখান থেকে চলে যেতাম তাহলে অন্তত এই অকওয়ার্ড সিচুয়েশনে পড়তে হতো না। রোশনি জামাটা ছুঁড়ে মারলো আমার মুখে। আমি কোনওরকমে সেটা সরিয়ে দেখলাম ওর হাত ক্লিভেজ ছুঁতে চাইছে।

-স্টপ ইট রোশনি!

আমি গলায় ঝাঁকুনি দিলাম। আমার কন্ঠস্বর ওর কানে পৌঁছায়নি এমন ভাব করে বুকের শেষ ঢাকনাটাও খুলে ফেলল! আমি সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম! আমার চোখ আটকে গেল পাহাড়ের চুড়োয়। ভীষণ ইচ্ছে করছে দেখতে পাহাড়ের উপর সূর্যের আলো পড়লে কেমন লাগে। সে ছবি বোধকরি টাইগার হিল থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর আলোর ঝকমারির চেয়েও সুন্দর। হাজারগুণ সুন্দর।

-কী দেখছো কবি?

রোশনিকে দেখে আমার মনে হলো কোনও এক মায়াবী শহর! আমি অস্ফুটে ঠোঁট নাড়লাম,

-কবিতা!

-লিখবে না?

-লিখবো।



আমার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে রোশনি। ওর সরু সরু আঙুলগুলো খেলে বেড়াচ্ছে ওপর থেকে নিচ। আমি এক হাতে জড়িয়ে রেখেছি ওকে; অন্য হাতে সিগারেট। আমার এক হাতে সৃষ্টি, আরেক হাতে ধ্বংস। এই মুহূর্তে নিজেকে সুখী রাজপুত্রের মতো মনে হচ্ছে। যার না আছে পক্ষীরাজ ঘোড়া, না আছে রাজত্ব! তবুও সে ক্ষমতাবান! কী অদ্ভুত সমাপতন! বেড়ালের আদব-কায়দা যতই বাঘের মতো হোক না কেন দিনের শেষে সে বেড়ালই। এটাই তার পরিচয়। আসলে সে সুযোগসন্ধানী ছাড়া আর কিছু নয়।

-সাপের ধর্মই এই। বিষ ঢালার পর আর নড়তে পারে না!

রোশনি ফিসফিস করে ঠোঁট নাড়লো। আমি হাসলাম। -তাই বুঝি?

-তবে...

-তবে কী?

রোশনি বিছানার উপর উঠে বসলো। ওর কপালে ফুটে উঠল অসংখ্য ভাঁজ। চোখ থেকে ঝরে পড়লো মেঘ। ঠোঁটদুটো তিরতির ক'রে কাঁপছে।



-তবে দুনিয়ায় এমন সাপও আছে যারা কখনোই ফণা তুলতে পারেনা!

আমি এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলতে পারলাম না। শূন্যতা এমনই সে যেখানে যায় সেখানকার সবকিছু ছারখার করে দেয়। আসল কথাটা হচ্ছে পূর্ণতা ব'লে আদৌ কিছু হয়না। তা হলো শূন্যতারই একটা রূপ। আমি সিগারেটের ফিল্টারটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দুইহাতে রোশনির মুখটা আলতো ক'রে তুলে ধরলাম। পূর্ণিমার চাঁদ থেকে কালো কালো যন্ত্রণাগুলো চেটেপুটে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু হ'লে কী হবে, আমি যে আসলে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড! জ্বালা জুড়ানোর জন্য সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার যতই চেষ্টা করি না কেন, জল ছোঁয়ার আগেই যে ছাই হয়ে যাই !


( ক্রমশ...)

 
 
 

Comments


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page