অজয়পাড়ের উপকথা
সুদীপ ঘোষাল
অজয়নদের পাড়ে অবস্থিত কয়েকটি গ্রাম বর্ধিষ্ণু। সেইসব গ্রামের ছেলেরা ধনীর দুলাল।তারা কানডা,সিঙ্গাপুর,সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিন্তু এখানকার বেশিরভাগ লোক গরীবের দলে। আর অজয়নদের আশেপাশের গ্রামগুলিতে কবি জয়দেব থেকে শুরু করে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বাসস্থল। আমাদের একটা ক্রিকেট খেলার দল ছিল গ্রামে।সঞ্জয়,সুদীপ্ত,বাবু,ভম্বল,টুলাদা,মিলুদা,তাপস,বুড়ো,রিলীফ,বিশ্বরূপ,পিনু,মিলু,অধীর,প্রতাপ,শ্রীমন্ত,মকন,ঝপণ, ধ্রুব,সাক্ষী ও আরও অনেক সদস্য ছিল।এখন ছোটদের ব্যাচে,ছোট্টু,পুলক,সুমন,সায়ন ও আরও অনেকে।
১৯৭৫ সাল থেকে অজয়নদের পাড়ে আশেপাশের গ্রামের ছেলেদের নিয়ে বন্ধুদল।আমাদের বন্ধুদল সমাজসেবার কাজ ও ভ্রমণ করার উদ্দেশ্যে টাকা জমানো শুরু করে ।প্রতিমাসে একশ টাকা করে মোট তিরিশজন টাকা জমা রাখতাম আমাদের বন্ধুদলের কো অপারেটিভ সংস্থায়। দশ বছরে অনেক টাকা জমেছে।জীবনটা ঠিক ছবির মত। মন খেয়ালের তুলিতে রাঙানো যায় জীবনটা মধুবনি কৌশলে।আমাদের দলের ক্যাপটেন বিশু বলে, ঠিক দেড়শ বছর আগে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো ভারতেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল।গত শতাব্দীতে ভারতের বামপন্থী রাজনীতিও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গেছে, আর তাতে অক্টোবর বিপ্লব তথা সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল আগাগোড়াই।রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির লেনিন বা তার উত্তরসূরী স্তালিন একটা পর্বে ভারতের কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে আলোড়িত করেছেন, কিন্তু পরে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা মাও জে দংয়ের আবেদনই যে ভারতের বামপন্থীদের কাছে বড় হয়ে ওঠে তাতেও বোধহয় কোনও ভুল নেই।কিন্তু ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে একশো বছর আগেকার সেই অক্টোবর বিপ্লব ঠিক কীভাবে ছায়া ফেলেছে?বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা মূল কথাই হল আন্তর্জাতিক সংহতি বা সলিডারিটি। সুদূর রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়েই যে এদেশে কমিউনিজমের বীজ রোপিত হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই।আমাদের বন্ধু মীর আলি বলেন, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যার প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে।শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ।১৯৭১ সালে সিপিআই(এম-এল) ভেঙে দু টুকরো হয়ে যায়। চারু মজুমদারের দল থেকে সত্য নারায়ন সিং বেরিয়ে যান। ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন । তাত্ত্বিক নেতা সরোজ দত্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। পলিটব্যুরোর অন্যতম নেতা সুশীতল রায়চৌধুরী আত্মগোপন থাকা অবস্থায় মারা যান। প্রধান নেতৃবর্গের বড় অংশই জেল বন্দী হন। পরে নকশালপন্থী দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) বহু ধারা উপধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। অনেক বছর পরে অন্যতম প্রধান নেতা কানু সান্যাল ২০১০ সালের ২৩শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ী থানার হাতিঘিষা গ্রামের নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। শারীরিক অসুস্থতা সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। আমাদের সংস্থার সদস্য সংখ্যা কুড়িজন। আমরা গ্রামে গ্রামে গরীব লোকদের সাহায্য করি, অসহায় লোকের পাশে দাঁড়াই। এখন ১৯৮০ সাল। দশ বছরে আমরা অভিজ্ঞ হয়েছি কিন্তু বড় হইনি মনে। মন রয়ে গেছে অঙ্কুরে।আমরা যাত্রাদল খুলেছি,বড়দের নিয়ে। বিভিন্ন জায়গায় বড়দের সঙ্গে যাত্রাপালা দেখতে যাই । আমাদের কোন মোবাইল গেম ছিল না। তবু কত আনন্দ ছিল। আমরা এখন সকলে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে ভরতি হয়েছি। অজয় নদ সংলগ্ন গ্রামে যত কবি সাহিত্যিক আছেন আমরা তাঁদের জন্মদিন পালন করি। তাঁদের জীবন ও কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা করি। আমাদের সংস্থার নাম, জোয়ার। নামে কি আসে যায়। কাজটাই প্রধান। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম এক নম্বর ব্লকের অধীনে গ্রামগুলির ছেলে আমাদের বন্ধুদলে আছে। আট থেকে আশি বছরের বন্ধু আছে আমাদের দলে।।প্রবাদবাবু ছিলেন বিরাশি বছরের তরতাজা তরুণ।তিনি এই বয়সেও তাঁত নিজের হাতে চালান। ওনার বাড়ি আমাদের গ্রাম থেকে দূরের একটি গ্রামে। তিনি মাসে একবার করে আসতেন আমাদের মজলিশে। তিনি ছিলেন আমাদের সিনিয়র ফ্রেন্ড। প্রবাদবাবু বললেন, কতবার বলেছি একবার আমার তাঁত দেখতে চল তোমরা, তো তোমরা শুনছ না কথাটা।বিশু বলল,যাব একদিন নিশ্চয় যাব। আপনি বুঝিয়ে আমাদের তাঁত সম্বন্ধে কিছু বলবেন। বিশু ছিলো পটশিল্পীর নাতি। তবে বিশুর বাবা ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বিরাজুলের নানা ছিলেন শিলকোটানির শিল্পী।তবে বিরাজুল এখন চাকরি করে। রমেনের দাদু ভুলোলাগা বামুনের অভিনয় করত। আমার দাদু ছিলেন যাত্রাশিল্পী।তখন যাত্রাদলে মহিলারা আসেবর্ধমান জেলা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত বর্ধমান বিভাগের একটি জেলা। এটি মূলত কৃষি প্রধান জেলা। একে পশ্চিম বঙ্গের শস্য ভান্ডার বলা হয়। জেলার বৃহত্তম শহর বর্ধমান মহানগর। ধান এ জেলার প্রধান ফসল। এ ছাড়া গম, পাট, আলু, পেঁয়াজ, আখ হয়। জেলার রানিগঞ্জ এবং আসানসোল কয়লাখনির জন্য প্রসিদ্ধ। দুর্গাপুরে আছে লৌহ-ইস্পাত কারখানা। মীর আলি কম আসত আড্ডায়। ওর বাড়ি বিল্বেশ্বর গ্রামে। পায়ে হেঁটে সাত মাইল পথ।বিরাজুল ছিল ভ্রমরকোল গ্রামের ছেলে। বিশু, আমি ও রমেন একই গ্রামের ছেলে।অরিন্দম, সোহন,অশোক,বিথিকা, অপরূপা ও আরও অনেকে পাশাপাশি গ্রামের ছেলেমেয়ে। সব খবর ছড়িয়ে পড়ত বাতাসে বাতাসে। সকলে আমরা সকলের আত্মীয়র মত হলে গ্রাম্য হিংসা বা রাজনীতি কম ছিল না। একশজনের মধ্যে চল্লিশ শতাংশ অপরের সমালোচনা করতে ভালবাসে,হিংসা করে আর ভালো লোককে, গরীব লোকদের একঘরে করে অত্যাচার করে। সর্দার পাড়ার,হাজরা,পাড়ার,বায়েনপাড়ার লোকদের অস্পৃশ্য, অশুচি বলে। এই তো গতমাসে বিমান বামুন প্রাতঃকালে ভ্রমণে গিয়ে হাজরাপাড়ায় দেহ রাখলেন। শেষবারের মত জল দিয়েছিল ধাতৃমাতা বিশাখা হাজরা। বিমান বামুন ওকে বেসকা নামে ডাকত। শোনা যায় যৌবনে অই বেসকার সঙ্গে বিমান বামুনের প্রেম ছিল। বেসকা ঝিগিরি করত ওদের বাড়িতে।বেসকা বলত, বামুনের রূপ দেখেছি চেঁটে খাওয়ার সময়। শেষে সে জল খেল ওর হাতেই। জীবন এইরকমই। জেলা সদর বর্ধমান থেকে অল্প দূরে কাঞ্চন নগর ছুরি, কাচির জন্য প্রসিদ্ধ। ধাত্রিগ্রাম তাঁতের কাপড়ের জন্য প্রসিদ্ধ।ন নি। দাদু মহিলা সেজে চমৎকার অভিনয় করতেন। অবিভক্ত বর্ধমান জেলার অজয় নদের উপর কাশীরামদাস সেতু কেতুগ্রাম থানার চড়খী গ্রামে অবস্থিত।কাটোয়া মহুকুমা বিরাট এলাকা।আমাদের এলাকার লোকেরা বেশিরভাগ কৃষিকাজে যুক্ত। তাছাড়া তাঁতি, পটশিল্পী,শিলকোটানি,ছুতোর, জেলে,কুমোর,কামার সকলে মিলিত হয়ে বাস করেন এখানে। একদিকে কেতুগ্রাম থানার বিভিন্ন গ্রাম আর একদিকে কাটোয়া থানার বিভিন্ন গ্রামের পরিবেশ, প্রাচীন কবি সাহিত্যিক ও সমাজজীবন নিয়ে চলছে প্রবাহ । অজয় নদের ধারে ধারে গীতগোবিন্দম এর রচয়িতা কবি জয়দেব থেকে শুরু করে চুরুলিয়া গ্রামের কবি নজরুল,কোগ্রামের কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া কাটোয়া মহুকুমার কড়ুই গ্রামে কবিশেখর কালিদাস রায় ও সিঙ্গি গ্রামের কবি কাশীরামদাস উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া এখনকার কবি সাহিত্যিকগণ এই কাটোয়া মহুকুমার গর্ব। আধুনিক কালে আটের দশক থেকে শুরু করে শূণ্য দশকের অনেক কবিসাহিত্যিক এই কাটোয়া মহুকুমার প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করেন। অজয়ের পলি শুধু চাষরবাসে নয় মনজমির উর্বরতাও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। বিশু আমাদের দলের প্রধান। আমাদের একটা কো অপরাটিভ সংস্থাও আছে।আমরা সকলে সদস্য এই সংস্থার।বিশু বলে, অজয় নদের জল বাড়লেই আমাদের কাঁদরের জলও বাড়ে।এই কাঁদরের নাম ঈশানী নদী। এঁকেবেঁকে গঙ্গাটিকুরী, বেলুন,কেতুগ্রাম ভুলকুড়ি প্রভৃতি অসংখ্য গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত। এই কাঁদরে আমরা মাছ ধরি, চান করি, চাষের জমিতে জল দিই। ভারতবর্ষের নদ নদীগুলো আমাদের মা। তাই আমাদের দেশ নদীমাতৃক। কেতুগ্রামের বিরাজুল, সিরাজ আমাদের প্রিয় বন্ধু।
আমাদের একটা সাহিত্যচক্র হত মাসে মাসে। সেখানে নানা জ্ঞানীলোকের সমাগমে আমরা কবি জয়দেব থেকে শুরু করে কবি রাজকুমার রায় চৌধুরী, কবি মহম্মদ মতিউল্লাহ ও কাটোয়ার উঠতি কবি লেখকদের সম্পর্কে জানতে পারতাম।আজ প্রফেসর ডঃ দাস এসে বলছেন সাহিত্যের কথা।
( ক্রমশ...)
Comments