অজয়পাড়ের উপকথা
সুদীপ ঘোষাল
গত পর্বের পর....
তিনি একটা বড় আলোচনা শুরু করলেন। তিনি বললেন,, ম্যাক ক্রিন্ডল সম্পাদিত ভারতের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী মেগাস্থিনিসের যুগে অম্যস্টিস নামে একটি নদীর উল্লেখ আছে যা কাটাদুপা শহরের কাছে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আরেকজন ইতিহাসবিদ উইলফ্রেড মনে করেন সেই অম্যস্টিস হল বর্তমান অজয়ের কোন প্রাচীন নামের অপভ্রংশ। সাম্প্রতিক খননকার্যের ফলে অজয় নদের উপত্যকায় পাণ্ডু রাজার ঢিপিতে সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে অজয় নদে কম করে ২০ টি বন্যার লিখিত নথি আছে। নদের নিম্নভাগের বন্যা প্রতিরোধের জন্য বাঁধ রয়েছে। তেরশ শতকে গীতগোবিন্দর লেখক কবি জয়দেবের জন্মস্থান বীরভূম জেলার কেঁদুলি গ্রামে ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের অজয় নদীর ধারে।বার’শ শতকের সংস্কৃত কবি জয়দেব। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অজয়নদের তীরবর্তী কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি গ্রামে তাঁর জন্ম। কেউ কেউ তাঁকে মিথিলা বা উড়িষ্যার অধিবাসী বলেও মনে করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ভোজদেব, মাতা বামাদেবী এবং স্ত্রী পদ্মাবতী।জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণসেনের রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম; অপর চারজন হলেন গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ী ও উমাপতিধর। কারও কারও মতে তিনি কিছুকাল উৎকলরাজেরও সভাপন্ডিত ছিলেন।গীতগোবিন্দম্-এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে চরণশেষে অন্তমিল অনুসৃত হয়েছে, যা সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রায়শই দুর্লভ। এর ভাষা সহজ-সরল এবং প্রায় বাংলার কাছাকাছি। সংস্কৃত ও বাংলার যুগসন্ধিক্ষণে রচিত বলে গ্রন্থটির ভাষা এরূপ সহজ ও বাংলার অনুগামী হয়েছে।বিশু বলে, শ্রীধরদাসের কোষকাব্য সদুক্তিকরণামৃতে গীতগোবিন্দম্-এর ৫টি শ্লোক ব্যতীত জয়দেবের নামাঙ্কিত আরও ছাব্বিশটি শ্লোক পাওয়া যায়। শিখদের ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেবে জয়দেবের দুটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। নাভাজি দাসের ভক্তমাল, হলায়ুধ মিশ্রের সেখশুভোদয়া প্রভৃতি গ্রন্থে এবং প্রচলিত জনশ্রুতিতে জয়দেব ও পদ্মাবতী সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। বৈষ্ণব সহজিয়াগণ জয়দেবকে আদিগুরু এবং নবরসিকের অন্যতম বলে মর্যাদা দিয়ে থাকেন। বীরভূমের কেন্দুবিল্বতে প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেব উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘জয়দেব মেলা’ নামে পরিচিত। এ মেলায় এখন বাউলদের সমাবেশ এবং বাউল আখড়াসমূহ বিশেষ আকর্ষণীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিহারের জামুই জেলা চাকাই ব্লকের বাটপার অঞ্চলের ৩০০ মিটার উচু পাহাড় থেকে উৎসারিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে এটি দেবীপুরের নিকটে ঝাড়খণ্ডে প্রবেশ করে (দেওঘরের প্রস্তাবিত শিল্প অঞ্চল) দিয়ে গিয়ে অজয় নদ ঝাড়খণ্ডের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার চিত্তরঞ্জনের নিকট শিমজুড়িতে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে এবং এটি প্রথম পশ্চিম বর্ধমান জেলা এবং ঝাড়খণ্ড হয়ে এবং পরে পশ্চিম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া ঘাট, বীরকুলটি ঘাট, দরবারডাঙা ঘাট ও সিদ্ধপুর ঘাট হয়ে এবং বীরভূম জেলার বড়কোলা, তামড়া, বিনুই ও নবসন গ্রামের সীমানা হয়ে পূর্বে প্রবাহিত হয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার কেতুগ্রাম থানার নারেং গ্রামের প্রবেশ করে কাটোয়া শহরের কাছে ভাগীরথী নদীর সংগে মিলিত হয়েছে। অজয় নদের মোট দৈর্ঘ্য ২৮৮ কিলোমিটার তার মধ্যে শেষ ১৫২ কিলোমিটার পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে। অজয়ের প্রধান উপনদীগুলি হল ঝাড়খণ্ডের পাথরো ও জয়ন্তী এবং বর্ধমানের তুমুনি ও কুনুর।অজয় নদের ধারা থেকে অনেকদুর অবধি পার্বত্য অঞ্চলের ল্যাটেরাইট মাটির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বর্ধমানের আউশগ্রামে এসে পাললিক সমভূমিতে প্রবেশ করে। অজয় নদের উপত্যকায় শাল, ও পলাশের ঘন জঙ্গল ছিল। কিন্তু অধুনা খনিজ নিষ্কাষণ ও অন্যান্য মনুষ্যজনিত উপদ্রবে বেশিরভাগ জঙ্গল সাফ হয়ে গেছে।সম্প্রতি, ভারত সরকার অজয় নদকে জাতীয় নৌপথ আইন, এর আওতায় জাতীয় জলপথ সাত, হিসাবে ঘোষণা করেছে।আমি জানি কাটোয়া মহুকুমা ও কেতুগ্রাম থানার গ্রামগুলিতে বাস করি আমরা। কাটোয়া মহুকুমার মধ্যে প্রতিটি ব্লকের অন্তর্গত গ্রামগুলিকে নিয়ে পথচলা আমাদের । তাছাড়া অজয় নদের ধারে ধারে অনেক কবি সাহিত্যেকের জন্মস্থান।
এবার আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখলেন কবি তারকেশ্বর চট্টরাজ।তিনি বলতে শুরু করলেন, কবি নজরুল ইসলামও অজয় নদের ধারে অবস্থিত চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিশু বলে, চুরুলিয়ার অবস্থান ২৩.৭৮° উত্তর ৮৭.০৮° পূর্ব] সমুদ্রতল হতে এর গড় উচ্চতা হল ৯৪ মিটার। চুরুলিয়া অজয় নদের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত।আসানসোল ঢেউ খেলানো ল্যাটেরাইট অঞ্চল দ্বারা গঠিত। দামোদর এবং অজয় এই অঞ্চল দুটি শক্তিশালী নদীর মধ্যে অবস্থিত।
আর একজন বলেন,এ অঞ্চলে উপর দিয়ে একে অপরের সাথে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়, দুটি নদীর মাঝখানের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলটিতে প্রচুর বনভূমি সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে ডাকাত এবং খুনীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কয়লার আবিষ্কারের ফলে এই অঞ্চলটি শিল্পায়নের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু. এরফলে বেশিরভাগ বনভূমি সাফ হয়ে গেছে।এখন পশ্চিম বর্ধমানে অবস্থিত। পূর্বে বর্ধমান জেলা হিসাবে পরিচিত ছিল।অবশ্যই আমাদের গর্ব এই কবির কথা অনেকের কাছে জেনে আমরা গর্বিত।আলোচনা শেষে সকলে বাড়ি যেতেন পরবর্তী আসরে আসার কথা দিয়ে।
আমদের এলকার সিঙ্গি,রামদাসপুর,চাঁড়ুলে গ্রামের তাঁতিপাড়ায় তাঁত বোনা হত। কুমোরপাড়া, কামারপাড়া,ছুতোরপাড়া,মুড়ি আর চিড়া তৈরির পাড়া ছিল। আশেপাশে আঠারোপাড়া গ্রামে বিভিন্ন জীবিকা ছিল তখনকার মানুষের। কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে ছিল লাঙ্গলের ফলা, কাস্তে, নিড়ানি, খুন্তি ইত্যাদি।কামারদের কারখানা ক্ষুদ্রশিল্পের আওতায় পড়ে। কামারের কর্মস্থলকে বলে কামারশালা। কামারশালায় হাপর দিয়ে কয়লার আগুন-কে উস্কে রাখা হয়। এই আগুনে লোহা গরম করে তাকে পিটিয়ে বিভিন্ন আকারের জিনিস তৈরি হয়।বাংলাদেশের অধিকাংশ কামারই বৈষ্ণব হলেও কিছু শাক্তধর্ম ধর্মালম্বী কামারও দেখা যায়।কুম্ভকার বা কুমোর একটি পেশা। এই পেশার মানুষ মৃৎশিল্পী - মাটি দিয়ে পাত্র, খেলনা, মূর্তি ইত্যাদি তৈরি করে। কুম্ভকার শব্দটির অর্থই হল কুম্ভ অর্থাৎ কলসি গড়ে যে শিল্পী। কুমোররা মিলে যে পাড়ায় থাকে তাকে বলে কুমোরপাড়া বা কুমোরটুলি। কুমোররা গোল আকৃতির জিনিস বানাবার জন্যে একটি ঘুরন্ত চাকা ব্যবহার করে।বিভিন্ন সাজে মানুষকে আনন্দ দেয়,বহুরূপী সম্প্রদায়।বীরভূম থেকে এক দাদু সেজে আসতেন মেয়েদের সাজে। ঘুঙুর বাজিয়ে বলতেন, খিচাক দম, আলুর দম, আমার বাড়ি বীরভূম। সিউড়িতে করোনা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে দেখা গেল বীরভূমের বহুরূপী সম্প্রদায়ের মানুষদের। সিউড়ির ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে করোনা ভাইরাসের সাজে পথে বেরিয়ে আসা মানুষদের সচেতনতা করেন তাঁরা। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এতদিন এদের দেখা গেছে কালী, কৃষ্ণ, শিব, হনুমান, রঘু ডাকাত, দৈত্য ও ছিনাথ বহুরুপীর বেশে। এবার জেলার মানুষকে করোনা ভাইরাসের বিপদ থেকে সচেতনতা করার জন্য করোনা ভাইরাসের সাজে দেখা গেল বহুরূপী সম্প্রদায়ের এই মানুষদের। বীরভূমের লাভপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ছোট্ট গ্ৰাম বিষয়পুরের ব্যাধ পাড়ায় এই বহুরূপী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন।বাংলার পটচিত্র পট বা বস্ত্রের উপর আঁকা একপ্রকার লোকচিত্র।
(ক্রমশ...)
Comments