top of page
Search

বইপত্র আলোচনায় আকাশ সাহা

agantukpotrika

উপন্যাস - পরবাস

ঔপন্যাসিক - সুচিত্রা ভট্টাচার্য

প্রকাশক- আনন্দ পাবলিশার্স

আলোচক- আকাশ সাহা



জীবন আমাদের এমন অনেক সময় অনেক কিছুর সম্মুখীন করে দেয় যা হয়তো কখনো কেউ কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। এক মুহুর্ত আবার চুপ করে কোনো বিকেলে একা বসে ভাবলে মনে হয় আহা জীবন তো এমনই। এমন রঙ্গময় এমন রঙিন পোষাকে আচ্ছন্ন জীবন, শুধু এক একজনের কাছে এক একরকম, সে বাদে পৃথিবীর আর সব বাকি মানুষের মধ্যে তার কোনো প্রভাবই পড়ে না, এই উপন্যাস পড়ার পরে আমি বহুদিন একা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি গ্রামের পথে রাস্তায় রাস্তায় খুঁজে চলেছি কুলদীপের মতো ছেলে কিংবা রাজিন্দরের মতো কোনো অভিভাবক যাকে এক মুহুর্ত থামিয়ে প্রশ্ন করতে পারি - জীবন সত্যিই কি আবার রঙ্গন ফুলের মতো সবার এমনভাবে ভরে উঠবে?


'পরবাস' উপন্যাস আমার মতে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মায়া জড়ানো শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি। উপন্যাসটির গোটা প্রেক্ষাপট জুড়ে রয়েছে একটি পাঞ্জাবী পরিবার, গোটা উপন্যাস ভিতরে ভিতরে তাদের এমনভাবে ভেঙেছে জীবনকে এইভাবে মুচড়িয়ে দেখার ক্ষোভ আমি জীবিতকালে কোনোদিন ভুলবো না।




উপন্যাসের শুরু রাজিন্দর আর কুলদীপের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে। তারা দুজনে হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকে তাদের আত্মীয়ের জন্য। আসলে বহুবছর পরে তাদের বাড়ির জামাই গুরুবচন সিং আর তাদের মেয়ে রোহিণী আসছে কলকাতা ঘুরতে, সেই কবে তারা এই শহরে এসেছিলো তারপর এতগুলো বছর পরে তারা আবার কলকাতায় পা দিচ্ছে। কলকাতায় এখন জমাটি ঠান্ডা পড়েছে বেশ। বাইরে শীতের আলো ম্লান হয়ে আসলে এই শহরটাকে কেমন রোগা অসুস্থ রুগীর মতো দেখতে লাগে। তবুও এই শহরের এক অদ্ভুত মায়া জড়ানো আবেশ আছে যা কাটিয়ে ওঠা খুব একটা সহজ কাজ নয় তাই হয়তো গুরুবচন সিং এসেই গাড়িতে উঠে বলেছিলেন, "তোমাদের শহর একই রকম রয়ে গেলো তবে ঠান্ডা এবারে বেশ পড়েছে"। সুখী পরিবার বলতে ঠিক কী বোঝায়? তা হয়তো রাজিন্দরের পরিবারকে না দেখলে ঠিক বোঝা যাবে না। সুচিত্রা দেবী উপন্যাসের এই সুখী পরিবারকে দেখানোর পাশে কুলদীপ চরিত্রটির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন আমার মনে হয় কুলদীপ হলো আমাদের সমাজে প্রতিনিধিত্ব করা সেই সমস্ত মানুষ যারা, কোনো না কোনো সময়ে ভয়াবহ কোনো বাস্তবতার শিকার হয়ে অন্য কোনো শহরে এসে পড়ে। কিন্তু তারা মিশেও যায় বেশ সহজভাবে সবার সাথে। কুলদীপ কলেজে পড়া একটি ঝকঝকে স্মার্ট ছেলে যে, বাড়ির পাশাপাশি কলজের বন্ধু বান্ধবীর সাথেও মিশে যায়, অন্য ধর্মের হওয়াতে তার কোনো লজ্জা বা আক্ষেপ নেই। বরং, লুকিয়ে দাঁড়ি কেটে বাঙালীর ধাতের হয়ে যায় এবং মনে মনে সে একটি মেয়েকে পছন্দ করে যে কিনা সম্পর্কে তার এক বন্ধুর বোন।


এই প্রসঙ্গে সুন্দর একটি মায়াবী উদাহরণ দিতে গিয়ে কুলদীপের মনের অবস্থাকে লেখক তার উপন্যাসের কয়েকটি লাইনে বুঝিয়েছেন-


"শুকনো বাতাসে অল্প শিরশিরে ভাব। হলুদ আলো মেখে সেজে উঠেছে শহর। এ সময় কি গ্যারেজে গিয়ে বসে থাকবে কুলদীপ?


হৃৎপিন্ডে অন্য এক শব্দ উঠছে কুলদীপের। রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম।"




উপন্যাসের এই পর্যায় অব্ধি সব কিছু সুন্দর ছিলো। ছিলো একটি সুখী পাঞ্জাবী পরিবার, সেখানে বেড়াতে আসা তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং তাদের আনন্দের রেশ। কিন্তু গোটা উপন্যাসের দ্বিতীয় মোড় শুরু হয় ঠিক এইখান থেকেই যখন, রাত্রি বেলায় সবাই খেতে বসার পরে হঠাৎ এক আচমকা দুর্ঘটনায় তাদের জামাই গুরুবচন সিং আর মেয়ে রোহিনী খুন হয়ে মারা যায়। এরপরে পুলিশ আসে, কীভাবে তারা মারা যায় বা কেনোই বা তাদের মারা হয় এর জন্য উপন্যাসটি ভালো করে পাঠককে পড়তে হবে আর এখানেই উপন্যাসের আসল চমক, লেখকের উপন্যাসগুলো ঠিক যেনো এখানেই মানুষের জীবনের সাথে একত্রিত হয়ে যায়।


উপন্যাসের দ্বিতীয় ভাগ শুরু হয় ঠিক এর পরের থেকেই, গোছানো একটি সংসার হঠাৎ করে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যায়। এতদিন যারা তাদের বন্ধু মনে করে এসেছে যারা তাদের বিপদে সবসময় পাশে থেকেছে তারাই পিছু হটে যায়, এমন খুনী পরিবারের সাথে আসলে কেউ থাকতে চায়না। তারা চায় নিঝঞ্ঝাট জীবন। তাই একে একে রাজিন্দর, তার স্ত্রী তার পুত্র কুলদীপ একা হয়ে যেতে থাকে। উপন্যাসের গতি এভাবেই শেষ পর্যায়ে একসময় এসে দাঁড়ায় যেখানে তারা এই শহরের থেকেই চলে যেতে চায় কিন্তু রাজিন্দরের মনের জোর তাকে বলে যে, সে এই শহরেই থাকবে।


এই গল্প শুধু কুলদীপ আর রাজিন্দরের নয়, এই গল্প শুধু কুলদীপ আর রিমঝিমের নয়, এই গল্প শুধু রাজিন্দর আর সমরের নয়, এই গল্প গুরুবচন সিং ও তার পরিবারেরও নয় এই গল্প আমাদের সবার। এই সমাজের, এই সময়ের এক জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে "পরবাস" উপন্যাস।




ছিমছাম এই গোছানো সংসারে আসলে আমরা সবাই ভালো থাকতে চাই, সবাই আসলে সুখ চাই। সবাই ভাবি পৃথিবীর মানুষের যা হচ্ছে হোক আমি এবং আমার পরিবার যেনো শুধু ভালো থাকি। কিন্তু হায়! নিজের সংসারে যখন আগুন লেগে যায় তখন যদি আপনার পাশের লোকজনও আপনার মতোই স্বার্থপর হয়ে ওঠে, কেমন লাগে তখন? মনে হয় জীবন একটা অদ্ভুত খেলা যার মূল দড়ি ধরে থাকে একমাত্র শুধু নির্মম সময়।


উপন্যাসের শেষ বাক্যগুলো কুলদীপের কথা দিয়েই শেষ করা যাক-


"কুলদীপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। চুপচাপ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। হাজার হাজার প্রশ্ন ভিড় করে মাথায়। কোন ছবিটি আসলে সত্যি? মানুষ বাইরে যে মুখোশ দেখায় সেটা না ভিতরে যে ক্ষোভ লালসা লুকিয়ে রাখে সেটা? মানুষ কি এরকমই? কুলদীপ চাইলেও এত সহজ সরল হিসেবে ফেলতে পারবে না মানুষকে? কোন ভিত্তিতে তবে মাপা যায় এদের? ধর্মের? জাতের? মনুষ্যত্বের?


ব্যালকনির নীচেই এক ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়া। আনমনে বেড়ে উঠেছে ফুটপাথে। ডালপালা লকলকিয়ে উঠে এসেছে অনেকটাই। গাছ ভরা লাল ফুল ঝুমঝুম দুলছে হাওয়ায়। হাতছানি দিয়ে ডাকছে কুলদীপকে। বুঝি বা চাইলেই শুধু এদেরকেই সারাজীবনের মতো ছোঁয়া যায়।।।"

31 views0 comments

Comentários


bottom of page