ধুলোমুঠির গান
অয়ন ঘোষ
৭
এতো মনমরা নতুন বছর দেখিনি। ফিল্মি ডায়ালগের মতো বললে বলতে হয়, "ইতনা সন্নাটা ম্যায়নে কভি নেহি দিখা পয়লা বৈশাখ মে"। চুপচাপ, কেমন যেনো শোক দিবসের মতো কাটলো প্রায় গোটা দিনটা। ছোটবেলা থেকেই মা বলতেন বছরের নতুন দিনে গায়ে নতুন সুতো তুলতে হয়। আমি জীবনের অনেকটা সময় মামার বাড়িতে মানুষ, আমার বড় মামিমা যিনি প্রায় আমার মায়ের মতোই, এখনো প্রতি বছর এই দিনটায় আমার জন্য নতুন কিছু কিনবেনই। বাঙালি বাড়িতে এদিন সাধ্যমতো পাঁচ তরকারি ভাত রান্না হয়। পুজোআচ্চা করানো হয়। বেশ কদিন আগে থেকেই আমরা ছোটরা গুনতাম বাড়িতে কটা নববর্ষের হালখাতার নিমন্ত্রণ এলো। তখন তো আর জানতাম না, ঋণ থাকলে বা যে দোকানের সাথে সারা বছরের লেনদেন আছে, শুধু সেখান থেকেই নিমন্ত্রণ আসে। তখন ওতো কিছু মাথায় নেবার বয়স হয়নি, শুধু শুধু মাথা ভারী করে কোনো লাভ ছিল না। চাষীবাসী ব্যবসায়ী পরিবার আমাদের, খাতা পুজোর চল ছিল। স্নানটান করে নতুন জামা পরে সকাল ১০ টার মধ্যে রেডি। খুব ভালো লাগতো আমপাতার সাথে নানা রঙের কাগজের কদমফুলগুলো গাঁথতে নারকেল দড়িতে। লাল টুকটুকে গণেশ মামা পাশে বোন লক্ষ্মীকে নিয়ে লাল চেলির ওপর সিংহাসনে। লাল জাবদা খাতায় এক টাকার কয়েনের লাল ছাপ, " ওঁ সিদ্ধিদাতা গণেশায় নম", মা লক্ষ্মী একটু ব্যাকফুটে। নারীবাদীরা নাকের ওপর চশমা এঁটে বলতে পারেন এখানেও লিঙ্গ বৈষম্য! ওতো ভাবার সময় নেই, ধূপ দীপ আর ওই লাল রঙ মিলেমিশে আমার পয়লা বৈশাখ তখন সত্যিই রঙিন আর নতুনের আঘ্রানে মনের গোল্লাছুট। এখানেই শেষ নয়, কনে দেখা আলোর গোধূলি এখনো বাকি আছে। সন্ধ্যের গায়ে গায়ে, পাউডারের গন্ধ হাওয়ায় ভাসিয়ে বাবার সাইকেলে বসে পরিচিত দোকানে নতুন খাতা। গোলাপি রঙের মেঠাই আর দরবেশের স্বাদ সাথে পাঁজি বা লক্ষ্মী গণেশের ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার ছিল আমাদের "এসো হে বৈশাখ"। কোনো কোনো বড় দোকানে আবার রঙিন সরবত দিত বরফ মেশানো, নিশ্চিত জানতাম অমৃত এর চেয়ে ভালো খেতে নয়।
পয়লা বৈশাখের দিন মন্ডা মেঠাই এর সাথে সাথে একটা বেণীমাধব শীলের হাফ বা ফুল পঞ্জিকা বাড়িতে ঢুকতই, তাই দেখে গেরস্ত বাঙালি ঠিক করত কবে যাত্রা শুভ আর কবে যাত্রা নাস্তি। আমার ঠানদিদি তার সারা জীবন বেণীমাধবকে নিয়েই ঘর করে গেলেন, চাঁদের বাড়া কমার ওপর তার জীবন চলত, আকাশের গোল সাদা ভাতের মতো ধপধপে চাঁদকে তিনি যা না বিশ্বাস করতেন তার থেকে বেশি করতেন পাঁজির পূর্ণিমাকে। একটা কারণেই ওই বেণীমাধবের ওপর আমাদের আগ্রহ ছিল, সেটা কবে একাদশী আর পূর্ণিমা কারণ আর কিছুই নয়, গোলা রুটি বা পরোটার ভাগ পেতাম ঠান দিদির থালা থেকে। সে রামও নেই আর সে অযোধ্যাও নেই। না থাকলেই ভালো! ক্লাস নাইনের বাংলা বইয়ে দোরখা একাদশীর যা বর্ণনা ছিল তার থেকে সমাজ তো বেশ কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে। নাই বা রইল আমাদের বেণীমাধবের একাদশী।
আজ সারাদিন বেশ চুপচাপই কেটেছে অবশ্য দেওয়াল জুড়ে শুভেচ্ছা অনেক। অনেক আশার কথাও বলেছে বন্ধু স্বজন। একটা সুস্থ পৃথিবীতে দেখা হবার আশায় বুক বাঁধছে সবাই। আচ্ছা সুস্থ বলতে ঠিক কি বোঝাতে চাইছি আমরা? করোনা মুক্ত পৃথিবী, তাই তো। কিন্তু মাঝে মাঝে ভাবছি আমরা সত্যিই সুস্থ ছিলাম তো! আয়নার সামনে চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে পারি আমরা? আমার তো চোখ আপনিই নেমে আসে, মনে হয় কে যেনো একটা হিম দৃষ্টিতে জরিপ করে নিচ্ছে আমার ভেতরটা। খুব ভয় পেয়ে যাই, পাছে নিজের কাছে নিজে ধরা পড়ে যাই। ওস্তাদের মার শেষ রাতের মতো আমরা ভেবেছিলাম সব বাজিতেই জিতে যাবো। আর হিন্দি ফ্লিম দেখে তো ডায়ালগ একদম মুখস্ত, "জো জিতা ওহি সিকন্দর"! আমায় আর পায় কে। যাচ্ছেতাই করে গেলাম। গুলিয়ে গেলো সাধ আর (সাধ্য নয়), যোগ্যতার পরিমাপ। নিজের সীমানার কথা কখনো ভাবিনি বা ভাবার অবকাশই তো ছিল না। "আকাশ নীল নয়, পাখি জানে, ঘুড়ি কিছুটা জানে, যে বালকের হাতে লাটাই, সে জানে না"। আমার দশা ছিল ওই বালকটার মতো, তবু তো বালকের সারল্য থাকে আমার সে পূণ্যটুকুও নেই। বাড়তে বাড়তে, কোথায় থামতে হবে শিখিনি, তাই পড়লামও আছাঢ় খেয়ে। এবার যদি একটু শোধরাই তো ভালো, না হলে কপালে আর দুর্গতি আছে।
মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, ওই রঙিন রেলগাড়ি চাপিয়ে এই দেশে এনে ভাবার অবসর দিল জীবন। যে কাছের সম্পর্কের থেকে দূরের আলেয়াকে আলো ভেবে আমোদ করেছি, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখার সময় এসেছে কোনটা আসল আর কোনটা নকল। জানি, মানুষ কষ্টে আছে, দিন দিন দুর্গতি বাড়ছে। কিন্তু এর মধ্যেও যদি খুঁজেপেতে দেখেন, দেখবেন কিছু কিছু ভালোও হয়েছে। আমাদের হাত থেকে মুক্তি পেতেই পৃথিবী আর প্রকৃতি দুটোই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। দেখোনদারি কমেছে কিছু হলেও, কমেছে রাস্তা ঘাটের দুর্ঘটনা, যৌন হয়রানি বা অপরাধ। দূষণ কমেছে, কমেছে ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতা। পরিবারকে পাশে পেয়ে মরচে পড়া সম্পর্কগুলো আবার একটু হলেও ঝলমল করছে। এটাও কম কিছু পাওয়া নয়। আমরা ভেবে নিয়েছিলাম এই পৃথিবীটা বোধহয় এক চেটিয়া আমাদের, সেই ভাবনাও পরিবর্তন এসেছে খানিক। এই মনোবৃত্তির সাথে থাকার চেষ্টা করছি। পৃথিবীতে মানুষের বাচ্ছাকেই একমাত্র মানুষ হয়ে উঠতে হয়, বাকি অন্য সব মনুষ্যতর প্রাণীর সন্তানরাই কিন্তু জন্ম থেকেই নিজের পরিচয় পেয়ে যায়। এটা মনে হয় সেই মানুষ হবার একটা অবসর।
এতো কিছু ভাবছি, তবু নিশ্চিত হতে পারছি কই! নিঝুম যাপনের এই মুহূর্ত বড় দীর্ঘ ঠিক শীতের রাতের মতো। চাপ চাপ কুয়াশা ঘিরেছে আমাদের যৌথ ঠিকানা। বোকা দৃষ্টি বার বার হওয়ার পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে আমারই নাগালের মধ্যে। গলা ছেড়ে ডাক দিচ্ছি, কিন্তু সাড়া দিচ্ছে না প্রিয় পথ, প্রেম, ও প্রতিবেশী। বুকের মধ্যে হাপর টানছে ভয়, মৃত্যু এসে টহল দিয়ে যাচ্ছে অলিগলি। কিন্তু এতো সহজে তো হারলে চলবে না। কথা দিয়েছি যে আমার আস্তিনে লেগে থাকা শিশিরের শব্দে ঘুম ভাঙাবো, মনের পাশে মন পেতে রাখা মানুষটার। বন্ধু, তোকে ফেলে আসা গানটুকু ফিরিয়ে দেব নতুন স্বরলিপিতে। মা যেমন ধুম জ্বরে জল সেঁক দেয় কপালে, তেমনি হাতের ওম কপালে রাখব অসুখ না হওয়া জ্বরে। তাই ফিরব আমি বা আমরা নিশ্চিত, সেদিন দুজনে মুখোমুখি বসে একটা ডার্ক চকোলেট ভাগ করে খাবো আগামী সাত জন্ম।
(ক্রমশ...)
Comments