top of page
Search

বছরের প্রথম দিনে ।। ধারাবাহিক ।। ময়ূখ হালদার


পরিপ্রেক্ষিত [পর্ব ৬(খ)]


ম য়ূ খ হা ল দা র


আমার তা মনে হয় না। হয়তো সবাই তোমাকে বলবে, এটাই নিয়ম। এভাবেই চলে আসছে শুরু থেকে। এভাবেই চলতে হয়। বেসিক ইন্সটিংক্টকে ইগনোর করে বেঁচে থাকা যায় না। ঠিক। বেসিক ইন্সটিংক্ট আমার রক্তকে নিয়ন্ত্রণ করে- একথা একশো ভাগ সত্যি। তাই যদি হবে তবে কিসের জন্য এই ইঁদুর দৌড়? চাহিদার সিঁড়ি বেড়েই চলেছে প্রতিমুহূর্তে। আমরা খাওয়া পরা যৌনতা আর মাথা গোঁজার জায়গা ছাড়াও অনেক চাহিদা কে সঙ্গে নিয়ে চলি।



কারণ এই সমস্ত চাহিদা যাদের কোনো শেষ নেই, এগুলো পাওয়া গেলে বা অ্যাচিভ করতে পারলে আমাদের ভালো লাগে। খুশি হই। এখন আমার প্রশ্ন, খুশি আর সুখী কি সমার্থক? আমি ভীষণ খুশি- এর মানে কি আমি ভীষণ সুখী? আমার মনে হয় খুশি হওয়াটা শর্ট টার্ম প্রসেস আর উল্টো দিকে সুখে থাকা আসলে লং টার্ম প্রসেস। খুশি থাকার বিষয়টা খুবই ট্রান্সপারেন্ট। আমি এক্সপেক্ট করছি এবার টেট-এ কোয়ালিফাই করবো এবং যখন রেজাল্ট আউট হলো দেখা গেল সত্যিই আমি পাশ করেছি- এক্ষেত্রে আমার ইচ্ছা পূরণ হলো। আমার ভালো লাগলো। অতএব আমি খুশি। কিন্তু তা যদি না হতো, মানে কোয়ালিফাই না হলে আমার খারাপ লাগতো। কারণ আমি আশা করেছিলাম ভালো ফল অথচ হলো ঠিক উল্টো। অর্থাৎ আমার এক্সপেক্টেশন ফুলফিল হলো না। আসলে খুশি হওয়ার ব্যাপারটা আপেক্ষিক। কিন্তু জীবনে ভালো থাকা কিংবা খারাপ থাকার ওপর নির্ভর করে কে সুখী অথবা দুঃখী।



এটা একদিনের অবজারভেশন কিংবা কয়েকটি মুহূর্তে আমরা ধরতে পারি না। কিছু নির্দিষ্ট ফ্রেজের পার্সপেক্টিভে আমরা রিয়ালাইজ করতে পারি বিষয়টা। যেমন আমি এত দিনের যাপন অর্থাৎ লাইফ-স্টাইল থেকে নিজের সম্পর্কে ধারণা করতে পারি- আমি সুখী। আর এই কন্টিনিউয়াসলি ভালো থাকাটা আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছে। আমি সত্যিই হেজে গেছি। হয়তো এই ভাবনার জন্য অনেকেই আমাকে বলবেন দুঃখবিলাসী। সত্যি কথা বলতে এর পিছনে শুধু আমার বাবা-মার অবদানই নয় সোশ্যিও-ইকোনমিক স্ট্রাকচারেরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমার বাবা যদি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়ি না হয়ে একজন হকার হতো তবে কি এই স্বাচ্ছন্দ্য এই বিলাসিতা অর্জন করতাম আমি? অবশ্যই নয়। তখন আমার ভালো থাকা কিংবা স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং-এর গ্রাফ কিন্তু ডাউনওয়ার্ড হতো। এবং সেটা পভার্টি লাইনের আশপাশে ঘোরাফেরা করতো অথবা নিচে থাকতো। তখন আমার এতকিছু ভাবার ফুরসৎই হতো না কারণ আমি ব্যস্ত থাকতাম আমার সেই বেসিক নিড পূরণের জন্য যা আমাকে হার্ডকোর রিয়ালিটির মুখোমুখি দাঁড় করাতো। তাহলে কি ভাবনা শুধুই বিলাসিতা? আমি তা বিশ্বাস করি না। কারণ তখন আমার সমস্ত ভাবনাই পেট ওরিয়েন্টেড হতো। দু'বেলা কী ক'রে খাবার জোগাড় করবো সেটা নিয়েই ভাবতে হতো আমাকে। সুতরাং ভাবনার ক্ষেত্রে বিলাসিতার ব্যাপারটাও আপেক্ষিক ছাড়া কিছু নয়। আমার ক্ষেত্রে ভোট পলিটিক্স ডেমোক্রেসি ইত্যাদি বিষয়গুলোও ঠাণ্ডা ঘরে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় অক্ষর চালাচালির মতো। কারণ ইকোনমিক জায়গা থেকে একটা পজিশনে আছি বলেই এগুলোর ইমপ্যাক্ট গভীরভাবে পড়ে না আমার ওপর বিশেষত যতক্ষণ পর্যন্ত না এই সাবজেক্টগুলো ব্যাংক ইন্টারেস্টের হার কমাতে সাহায্য করছে অথবা পি এফের ইন্টারেস্টকে আঘাত করছে ততক্ষণ অবধি তো নয়ই। তাহলে এই পলিটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্সের সার্থকতা কোথায়? আমি যে বেসিকলি একজন সুবিধাভোগী সেটা ভালোমতোই বুঝতে পারি। পলিটিক্স কি তবে নিচুতলার মানুষের জন্য লড়াইয়ের হাতিয়ার আর আমাদের মতো অভিজাতদের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস নয়?



আমি আলগোছে সামনের দিকে চোখ রাখলাম। হোম স্টের লনে একটা বিরাট টেন্ট বসানো আছে যেটা এখানে আসার প্রথম দিন থেকেই দেখতে পাচ্ছি। তার নিচে একটা গোল টেবিল আর পাঁচটা চেয়ার রয়েছে। এখন সেখানে সদানন্দ দত্ত অ্যান্ড কোম্পানি বসে আছে। সম্ভবত তারা আজ বাইরে বসেই টিফিন সারছে। লনের পাথরের রাস্তাটা পৌঁছে গিয়েছে মেইন গেট পর্যন্ত। সামনে দিয়ে আড়াআড়ি বয়ে চলেছে সি আর দাস রোড। লোকজন যে যার মত চলাফেরা করছে। চলছে বাইক এবং মাঝে মাঝে ফোর হুইলার। রাস্তার ওপারে বাঁদিকে একটা স্টেশনারি দোকান। সেখানেও লোকজনের আনাগোনা। আমি দু'বার ওখানে গিয়েছিলাম যখন আমার সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল। মাঝারি হাইটের ফর্সা নেপালি লোকটার বয়স মেরেকেটে পঁয়তাল্লিশ কি ছেচল্লিশ হবে। দারুণ হাসি খুশি। তবে বেশ গায়ে পড়া। প্রায় প্রত্যেক কাস্টমারের সঙ্গেই খেজুরে আলাপ করছিল আর ঠোঁটের কোণে ঝুলছিল একপ্রস্থ হাসি।

-এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক প্লিজ।

-আপনারা সুভাষদার ওখানে উঠেছেন তো? সিগারেটের প্যাকেট বের করার সময় ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন। আমি উচ্চারণ করলাম,

-সরি?

দোকানদার একগাল হেসে বললেন হিমালয়ান ইন-এ উঠেছেন? ওর মালিক সুভাষদা, সুভাষ ছেত্রী।

-ও আচ্ছা। হ্যাঁ আমরা ওখানেই আছি।

-কোলকাতায় থাকা হয়?

এবার বিরক্ত হলাম।

-না। একটু তাড়াতাড়ি দিন আমার তাড়া আছে।

-এই নিন আপনার এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক... আর কিছু?

-নো, থ্যাংকস।

আমি দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। ব্যালকনি থেকে সেই দোকানটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে দু-তিনজন কাস্টমার রয়েছে। আমি সেখান থেকে লুক শিফট করতেই আচমকা নজরে এল বাদামি জ্যাকেট আর ডেনিম জিন্স পরা একটা লোক, দোকানের একেবারে ডানদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, বাঁ-হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, মুখের আদলে নেপালি বলেই মনে হচ্ছে, মোটা গোঁফ, যদিও এরকম ঘন গোঁফ আমি কোনও নেপালি ছেলের এর আগে দেখিনি। একভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামিয়ে নিল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার চোখ রাখলো আমার চোখে। বরফের মতো দৃষ্টি! এত ঠাণ্ডা, মরা মাছের মতো অথচ তীক্ষ্ণ চাউনি আমি আগে কখনো দেখিনি! নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলাম! ভয়, নাকি বিস্ময়? ঠিকঠাক ঠাওর করার আগেই সারা গায়ে কাঁটা ফুটলো। লোম খাড়া হলো। আমি ঘরের ভেতর চলে এলাম। মাথায় হাজারো চিন্তা পাক খেতে লাগলো। লোকটা কে? আগে যে কখনও এচত্বরে দেখিনি সে ব্যাপারে নিশ্চিত। ওই চোখ কেউ একবার দেখলে কোনোদিনও ভুলতে পারবে না! লোকটা কি কিছু বলতে চাইছিল? আই ডোন্ট থিংক সো। কোনও মেসেজ ওর দৃষ্টিতে ছিলনা। বক্তব্যও না। ও শুধু দেখছিল। না, শুধু দেখছিলই না; ও আমাকে স্ক্যান করছিল! এখন অল্প অল্প মেলাতে পারছি। এইরকম চাউনি যা কোনও মন্ত্রীর সিকিউরিটিদের চোখে দেখা যায়। যাকে আমরা বলি "চোখে চোখে রাখা।" সেম টু সেম। কিন্তু কেন? এত লোক থাকতে আমাকে কেন ফলো করবে! কোনও কারণ ছাড়া...আমার ভাবনা হঠাৎই হোঁচট খেল! তবে কি মূর্তির সাথে এর কোনও কানেকশন আছে? যে কারণে আমাকে ওয়াচ করছে। সম্ভবত সেটাই। আমি কৌতুহলবশত দরজাটা সামান্য ঠেললাম। সাবধানে উঁকি দিলাম যতটা সম্ভব আমাকে বাইরের রাস্তা থেকে দেখা না যায়। লোকটা ওখানেই দাঁড়িয়ে। এখন সে মোবাইলে কথা বলছে। তার নজর ঘনঘন এই ব্যালকনির দিকে আছড়ে পড়ছে। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, লোকটা এখানে মূর্তির খোঁজেই এসেছে। আমার কী করা উচিত ভাবতে-ভাবতে ঘরের দরজা বন্ধ করে সিগারেট ধরালাম। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবা-মাকে সব কথা খুলে বলবো? না, থাক। এই লোকটার কথা শুনলে ওরা চাপ নিয়ে ফেলবে। এমনকি তিলকে তালও করে দিতে পারে। যদিও ব্যাপারটা এখন আর তিলের পর্যায়ে নেই, তবুও... আচ্ছা আমি যেটা ভাবছি সেটা যদি না হয়? ওই লোকটা হয়তো অন্য কোনও দরকারে দাঁড়িয়ে আছে। আমিই টেনশনে সবটা ঘেঁটে ফেলছি! না। মেয়েদের চোখ এতটা ধোঁকা খেতেই পারে না। তবে? এভাবে ঘরবন্দি হয়ে থাকাটাও তো বিরক্তিকর। একসময় না একসময় বাইরে বেরোতেই হবে। তখন? ওরা কি এতো সহজে ছেড়ে দেবে? সোনার মূর্তি বলে কথা! তাছাড়া ঘরে বসে থাকলেই যে সেফ তাইই বা নিশ্চিত হই কী ক'রে? আজ রাস্তা থেকে ফলো করছে; কালকে যে ওরা ভেতরে ঢুকে মূর্তিটার খোঁজ করবে না তার কী গ্যারান্টি আছে! কেন জানিনা এখন মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে থানাপুলিশ না করাটাই ভালো। আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। ওই মূর্তিটা আমার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতক্ষণ না ওটাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি নেই। আমি সিগারেটের ফিল্টারটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে উঠে দাঁড়ালাম। চাদরটা খুলে রেখে পছন্দের হলুদ পুলওভারটা পরে নিলাম। তার ওপর ব্রাউন লেদার জ্যাকেটটা চাপিয়ে ব্যালকনিতে এলাম। মোটাগোঁফ খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে বসেছিল। আমাকে ঘরের বাইরে বেরোতে দেখেই মুখ তুললো। আমি পাশের ঘরের দরজায় নক করলাম,

-আমি নিচে আছি।



তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই নেমে এলাম লনে। দত্ত অ্যান্ড কোম্পানিকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না এখন। ওদিকে মোটাগোঁফও উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর মুখটা চকচক করছে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে যেন শিকারকে পেয়ে গেছে থাবার নাগালে। ডাইনে-বাঁয়ে চোখ বুলিয়ে মেইনগেট ক্রস ক'রে পা রাখলাম রাস্তায়। এপারে আমি, ওপারে মোটাগোঁফ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ডিসট্যান্স। এমন সময় আমার প্ল্যানের মা মাসি এক ক'রে আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো একটা সাদা রঙের বোলেরো! যার সামনের উইন্ডস্ক্রিনে বড় বড় ক'রে লেখা একটাই শব্দ- "POLICE!"


[চলবে]

 
 
 

Commentaires


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page