top of page
Search
agantukpotrika

বছরের প্রথম দিনে ।। ধারাবাহিক ।। স্নেহা নাগ


ওজনের ওজন

স্নেহা নাগ


পর্ব-১


"আর কতো খাবি মোটি, এবার ফেটে যাবি তো?"


সকাল সকাল তিন্নিকে ছটা রুটি একবাটি তরকারি আর একটা ডিম সিদ্ধ নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে খেতে দেখে বুবাই আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। টুপ করে ডিমটা তার পাত থেকে তুলে নিয়ে বোনের মাথায় একটা চাঁটি মেরে নিজের মন্ত্যব ব্যক্ত করতেই, তিন্নি খাবার ভর্তি মুখে তোতলা ভাষায় চেঁচিয়ে উত্তর দিলো,

"দেখ দাদা, সবসময় আমার খাবার দিকে নজর দিবি না। তুইও খা না, মা তো তোকেও খেতে দেয়; খাস না কেনো?"

ভাই বোনের এই খুনসুটিতে অতিষ্ট হয়ে তাদের মা রান্নাঘর থেকে গরম খুন্তিটা নিয়ে বেড়িয়ে এসে চিৎকার করে বললেন,

"কেনো রে বুবাই, তুই সবসময় তিন্নিকে এই রকম করিস! একটাই তো বোন তোর, দুদিন বাদে পরের বাড়ি চলে যাবে। তখন বুঝবি, বোনের মর্ম।"


"হুম, বুঝবি তখন কেমন লাগে"- মায়ের কথায় সায় দিয়ে তার সুরে সুর মিলিয়ে তিন্নি বললো এবং আবার খাওয়ায় মন দিলো।


তাদের মা-মেয়ের দলে বুবাই একা পড়ে গেলে এবার নির্বাণ বাবু অর্থাৎ তাদের বাবা শেষমেশ ছেলের দলেই যোগ দিলেন। খবরের কাগজটা ভালো করে ভাঁজ করে পাশে নামিয়ে রেখে, চোখ থেকে চশমাটা নাকে নামিয়ে মুচকি হেসে বললেন,



"তা গিন্নী, তুমি নিশ্চিত তো, যে তিন্নি পরের ঘরে যাবে! না মানে, যেভাবে ফুলছে তোমার মেয়ে; তাতে মনে হয় না যে, পাত্র পাওয়া যাবে। কারন সব ছেলেই তো বৌ চায়, কোলবালিশ বোধহয় সবার ঘরেই আছে!"


বলেই অট্টহাসি হেসে ঘর ভরিয়ে তুললেন, সাথে যোগ দিলো বুবাই। তাদের মা নন্দা দেবী তো রেগে আগুন। এতোদিন শুধু বুবাই-ই তিন্নিকে খাওয়ার খোঁটা দিতো। এখন বাবা হয়ে নির্বাণ বাবুও সেই খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তাই মেয়ের হয়ে তিনি প্রতিবাদ করতে গেলে, তিন্নি তাকে থামিয়ে বলল,


"ছেড়ে দাও মা। বেশি পাত্তা দিও না। আসলে কি বলো তো, দাদা আমায় হিংসে করে। কারন আমি সব খেতে পারি, আর ও রোগা হওয়ার জন্য না খেয়ে শুকোয়।"


বুবাইয়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের মনের মতো যুক্তি সাজিয়ে আবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করে তিন্নি। তাই দেখে বুবাই বললো,


"সেই, খেয়ে নে; খেয়ে নে, আর তো দুটো মাস। তারপরই তো কলেজে যাবি। তখন বুঝবি তোর বেশী ওজন কিভাবে লোকের সামনে তোর নিজের ওজন কমে করে দেয়। তখন আমার কথা মনে পড়বে'


বলে বাইকের চাবিটা নিয়ে 'আসছি' বলে বেরিয়ে গেল বুবাই। সাথে সাথে নন্দা দেবী তার পিছু পিছু ছুটে দরজার কাছে এসে চেঁচিয়ে বললেন,



"বাবু, হেলমেট পরে যাও।"


কিন্তু তার শব্দক্ষরণ সম্পূর্ণ বৃথা হয়ে গেলো। ততোক্ষনে বুবাই বেড়িয়ে গেছে।


"দেখেছো, ছেলেটা একদম কথা শোনে না আমার। পুরো বাবার মতো হয়েছে। আমার মেয়েই ভালো। অন্তত আমার পায়ে পায়ে তো ঘোরে"


কথাটা শুনে নির্বাণ বাবু বললেন,


"আঁচলের সাথে বাঁধা থাকলেই কি উপযুক্ত সন্তান হয় গিন্নী! ওদের নিজের মতো করে বাঁচতে দাও। হোঁচট না খেলে জীবনের অর্থ বুঝবে কি করে ওরা।"


কথাটা বাস্তব হলেও নন্দা দেবীর ঠিক পছন্দ হলো না। তবু কথা না বাড়িয়ে তিনি আবার রান্নাঘরে গেলেন এবং নিজের মনে গজগজ করতে শুরু করে দিলেন।


*************



দেখতে দেখতে সময় কখন যে ডানা মেলে উড়ে গেলো বোঝাই গেল না আর তিন্নির উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিন দোর গোড়ায় এসে হাজির হলো। সারা বাড়ি সন্ত্রস্ত। নির্বাণ বাবু অফিস ছুটি নিয়ে নিউজ চ্যানেল খুলে বসে আছেন সকাল থেকে। বুবাইটাও আজ উনিভার্সিটি যায় নি। নন্দা দেবী হত্তে দিয়ে পড়ে আছেন ঠাকুর ঘরে। সবার এক চিন্তা, তিন্নির রেজাল্ট কেমন হবে! কিন্তু যাকে নিয়ে এতো চিন্তা তার-ই কোনো হেলদোল নেই। সে তো দিব্যি একটা চিপ্সের প্যাকেট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই দেখে বুবাই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলে তিন্নি বলল,


"চাপ নিস না দাদা, আমি জানি আমার রেজাল্ট ভালোই হবে"


বলে আবার উল্টো পথে নিজের ঘরে চলে গেলো।


"আজব মেয়ে একটা, কোনো চিন্তা ভাবনাই নেই!"


বুবাইয়ের বিষ্ময়ে নির্বাণ বাবু বললেন,


"আসলে কি বল তো, তোর বোনের জীবনে খাওয়া আর পড়া ছাড়া অন্যকোন পিছুটান নেই। তাই তো, এই দুটো কাজই সে পুরো মন দিয়ে করে যাতে কোনো ফাঁক না থাকে, ফলে ওর এই রেজাল্ট নিয়ে ভয়টাও কম।


"কিন্তু বাবা...."


তার কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকে থামিয়ে দিলেন তিনি, বললেন;


"দেখ, খবরে কি বলছে..."


তারপর তারা আবার টিভির দিকে মন দিলেন।


বেশ কিছু সময় পরে, তিন্নির ভালো রেজাল্টের খবরের আনন্দে মেতে উঠলো পুরো বাড়ি। সাথে পাড়ায় পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ শুরু হলো। তিন্নি জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। পাড়ার ছেলেরা বাড়িতে এসে তাদের নিমন্ত্রণ করে গেছে, সন্ধ্যে বেলায় তিন্নিকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। নন্দা দেবী ও নির্বাণ বাবু আজ ভীষণ গর্বিত।


**************


ছোট থেকেই তিন্নি ও তার বাড়ির লোকের স্বপ্ন ছিল যে, সে অনেক বড় ডাক্তার হবে। দীর্ঘদিনের এই স্বপ্নটা একটু একটু করে লালন করেছে সে। এখন সেই স্বপ্নকে বাস্তব রুপ দেওয়ার পালা। জয়েন্টের জন্য প্রস্তুতি তো সে মাধ্যমিকের পরেই শুরু করে দিয়েছিল, তাই সেখানেও একটা দুর্দান্ত ফল করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে গেলো। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, পড়াশোনার জন্য তাকে তার ঘর ছাড়তে হলো।


নন্দা দেবী তো কেঁদে কেটে একসা। এতোদিন এতো সুখে দিন কেটেছে তিন্নির। বাড়ি ছেড়ে একটা দিনের জন্যও সে কোথাও থাকেনি; সেখানে দীর্ঘদিন কিভাবে বাইরের হোস্টেলে থাকবে সেই ভেবেই তো সকলে অস্থির হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু তখনও তিন্নির কোনো হেলদোল নেই।


সেদিন ছিলো তিন্নির কলেজের প্রথম দিন। টুবলু আর নির্বাণ বাবু আগের দিন গিয়ে হোস্টেলে সব মাল পত্র রেখে এসেছিলেন। যাতে তিন্নিকে সমস্যায় পড়তে না হয়। কলেজের গেটে বোনকে বিদায় জানানোর সময় বুবাই বলল,


"মোটি, এবার বুঝবি জ্বালা। হোস্টেলে মুঠো মুঠো খাবার কোথায় পাস দেখবো!"


উত্তরে কাঁদো কাঁদো স্বরে তিন্নি বলল,


"আমি তো চলেই যাচ্ছি দাদা, এখন অন্তত খাওয়ার খোঁটা দিস না....."


বোনের অভিমান মাখানো কথায় এবার তারও চোখের কোনটা চকচক করে উঠলো, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বনকে বিদায় জানিয়ে তারা গাড়িতে উঠলো।

এতোদিন হাজার খুনশুটির মাঝেও তিন্নি ছিল বুবাইয়ের সব সময়ের সাথী। ঝগড়া মারামারির মধ্যেও তার সব থেকে কাছের মানুষ। তাই এই কঠিন পৃথিবীতে তাকে একা ছেড়ে আসতে বুক ফেটে যাচ্ছিলো তাদের। সারা রাস্তা সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এলো। নির্বাণ বাবু অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। বলেছিলেন,


" সারাজীবন কিন্তু আমরা কেউ তিন্নির সাথে থাকতে পারবো না। তাই ওকে যুগের উপযুক্ত হতেই হবে। তাতে তোরা যদি এমন করিস, তাহলে তিন্নি জোর পাবে কি করে!"

কিন্তু তাতেও বিশেষ কাজ হলো না।



অন্যদিকে কলেজের প্রথম দিনে মনের মধ্যে অজস্র স্বপ্নের ডালা সাজিয়ে তিন্নি শুরু করলো তার জীবনের নতুন যাত্রা.........


15 views0 comments

Comments


bottom of page