ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ ও অনুবাদ সংক্রান্ত দু চার কথা:-
তাপস গুপ্ত
পর্ব:৯
গত পর্বগুলিতে অনুবাদ ও অনুবাদ সংক্রান্ত বেশ কিছু আলোচনা এবং সেই প্রেক্ষিতে আমার ব্যক্তিগত কিছু মন্তব্য সংযোজিত করলেও এখানে উল্লেখ্য যে আমরা যেহেতু লাতিন আমেরিকার কিছু কবির(মহিলা কবি) কবিতা অনুবাদে বেছে নিয়েছি তাই ল্যাটিন আমেরিকান ইতিহাস ও সংস্কৃতির সম্পর্কিত কিছু তথ্য আলোচনা সংযুক্ত করা আমাদের দায় ও দায়িত্বও বটে।
বাহামা অথবা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ কলম্বাসের প্রথম পদার্পণ কোন বিশুদ্ধ আলোকপ্রাপ্ত অভিযান ছিলনা, ছিল ধর্মীয় অভিযানের পতাকার আড়ালে হানাদারের সম্পদ লুণ্ঠনের দুর্বৃত্ত মানসিকতা। দীর্ঘদিনের সমৃদ্ধ অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতা ধ্বংস করে নির্বিচারে প্রায় 7000 নিরীহ ভারতীয় কে হত্যা করে, ধর্ষিত অ্যাজটেক নারীদের দাস বানিয়ে একটা জীবন্ত আর সজীব সভ্যতাকে অবলীলায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
এই সভ্যতার রাজধানী ছিল তেনোচিতলান।১৫২১ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাসের ভাইপো হারমেন কর্টেজ এই শহরটি কে ধ্বংস করে নাম দিলেন মেক্সিকো সিটি। জাহাজ ভর্তি সোনারূপো চলে গেল স্পেনের রাজকোষে। এই সম্পদ ভাগ করে নিয়েছে সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকা।পরবর্তী কালে আমেরিকা বা তার ঘনিষ্ঠ দেশ গুলি লাতিন আমেরিকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে চালিয়েছে শোষণ(গণহত্যাও)। দীর্ঘদিন ধরে ধর্মযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া স্পেনের রাজকোষ তখন রক্তশূন্য। তাই ধর্মের পতাকায় তারা অঙ্কিত করল লুন্ঠনের অধিকার, তরবারির ক্রুশ চিহ্নে খোদিত করল আলোকিত সভ্যতার বিজয় নিশান। সভ্যতা সম্পদ হারানো এক বিশাল দেশ আমেরিকার মধ্যেই চিহ্নিত হয়ে গেল লাতিন আমেরিকা নামে। জন্ম হলো এক মিশ্র ভাষা ও সংস্কৃতির। তাই তাদের গল্পে কবিতায় এসে যায় দাদু দিদিমা বা ঠাকুমার মুখে শোনা লোককথা রূপকথার জাদু বাস্তবতা। এই ভিন্ন কথনশৈলী, কথন ভঙ্গি হয়ে যায় তাদের রচনার নিজস্ব আইডেন্টিটি এবং আইডেন্টিটি ক্রাইসিসও। নিকারাগুয়ায় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেওয়া কবি ও দার্শনিক ক্ল্যারিবেল অ্যালিগ্রিয়ার এক সাক্ষাৎকারে উঠে আসবে মনোজাগতিক এই সংকট ও তার সত্যসন্ধানেরছবি।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ড্যানিয়েল ফ্লোরেস অ্যাসেন্সিও। এখানে অনুবাদে সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হল:-
ড্যানিয়েল:
আমরা বছরের পর বছর কথাবার্তা চালিয়েছি এবং একসঙ্গে দুজনে অনেক সময় কাটিয়েছি। কিছু কথা প্রায়শই মনে পড়ে,কোনো এক সময় তুমি আমায় বলেছিলে যে,উত্তর আমেরিকা থেকে এক নেটিভ আমেরিকান কবি তোমায় চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন, তুমি কোন্ ট্রাইব বা উপজাতির রক্ত বহন করছ?
ক্ল্যারিবেল:
হ্যাঁ, উনি ছিলেন জো হার্জ।আমি ওনার কবিতা স্প্যানিশে অনুবাদ করেছিলাম,এমনকি নিকারাগুয়ার একটি সাহিত্য সভায় পাঠ করেছিলাম।সেই সভায় তুমিও ছিলে, মনে আছে?
ড্যানিয়েল:
হ্যাঁ,মনে আছে।
ক্ল্যারিবেল:
আমি উত্তর দিয়েছিলাম,আমি ঠিক জানি না আমি কোন্ উপজাতির রক্ত বহন করছি,তবে কোনো একক মানুষের নিশ্চয় হতে পারে(হাসি)।
ড্যানিয়েল:
তুমি তোমার বরের সঙ্গে রসিকতা করে বলতে,আমি এক হারিয়ে যাওয়া উপজাতির অন্তর্ভুক্ত।
ক্ল্যারিবেল:
হ্যাঁ, এটা বাড ( স্বামীর নাম) সব সময় বলত।
ড্যানিয়েল:
সত্যিই কি তুমি মনে কর আমরা হারিয়ে যাওয়া উপজাতির অন্তর্ভুক্ত, সাংস্কৃতিক মান্যতা দিয়েই বল?
ক্ল্যারিবেল:
আমি সেই চমৎকার উপজাতির অন্তর্গত,মায়ান, অ্যাজটেক।আমার এই ভারতীয় পটভূমির জন্য আমি গর্বিত।কত কত বছর আগে চিচেনইতজা (বহু প্রাচীন কালে মায়ানদের তৈরি পিরামিড, বর্তমানে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর অন্তর্গত) মেক্সিকোর প্রথম মানমন্দির ছিল? বাড প্রায় বলে,আমাদের ভালো রাখার জন্যে পালামোর পর্বত রয়েছে।এই সভ্যতার ঐশ্বর্য আজও স্বীকৃত নয়।কিন্তু আমি মনে করি একদিন তা হবে।
ড্যানিয়েল:
আশাকরি আমিও ,আগামী শতাব্দীর মধ্যে।
ক্ল্যারিবেল:
ড্যানিয়েল,তুমি জানো আমার হাজব্যান্ড বাড সাড়ে চার বছর হল মারা গেছে।এটা ছিল আমার কাছে সাংঘাতিক এক ধাক্কা।সে ছিল আমার এক চমৎকার সঙ্গী। আমাদের একসঙ্গে কাটানো সাতচল্লিশ বছরের জীবনে ছিল শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন এবং সন্তানও। বাড বহু বছর ধরে আমার লেখার অনুবাদকের কাজ করেছে।আমরা একসঙ্গে উপন্যাস লিখেছি, অ্যাসেস অফ ইজালকো,১৯৩২ এ এলসালভেদরে ভারতীয়দের ওপর সংঘটিত গণহত্যার ওপর। ওর মৃত্যুর পর ভেবেছিলাম কিছুই লিখতে পারবো না। কিন্তু ঈশ্বর কে ধন্যবাদ, কবিতা এল আমার কাছে এবং বইটি লেখা হয়ে উঠল। একাকীত্ব কে আমি ভালোবাসতে শুরু করলাম।যদিও বাড এর অনুপস্থিতি দিন দিন অসহনীয় ভারি হয়ে উঠেছিল।কিন্তু বইটি লেখা শুরু করে দেবার পর আমি ওই কাজের অনুশীলনে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম,যদিও তা ছিল খুবই কঠিন।
ড্যানিয়েল:
তাহলে নিকারাগুয়াই তোমার স্থায়ী ঠিকানা এখন?
ক্ল্যারিবেল:
ঠিক, আমার বাড়ি এখন নিকারাগুয়ায় তার অনেক কারণ আছে।এখানে আমার একটি ছোট্ট বাড়ি আছে, আমার ছেলেও থাকে এখানে আর আছে বাড এর কবর। কিন্তু আমার পক্ষে যতটা সম্ভব হয় আমি যাই এল সালভাদর।
(সাক্ষাৎকারের বাকি অংশটি পরের পর্বের জন্য
রইল। )
ক্ল্যারিবেল এ্যালিগ্রিয়ার একটি অনুবাদিত কবিতা দিলাম:
ইংরেজি কবিতাটি হল
That kiss
That kiss
Yesterday-- a door
Swung wide,
And every memory
I believed was a ghost
Spramg up,
Persistent,
to bite me.
অনুবাদে:
সেই চুমু
সেই চুমু
আর গতকাল -- আর দরজাটির
বহর বিস্তৃত দোলন,
এবং প্রতিটি স্মৃতি
যে গুলি বেঁচেছিল ভূতের মতন
তারা ফুঁড়ে উঠল,
নাছোড় অটল
আমাকে দংশাতে
(চলবে)
Comments