top of page
Search

বিজয়া দশমী ।। বিশেষ সংখ্যা ।। ছোটগল্পঃ- মৌসুমী রায়


পালঙ্ক

মৌসুমী রায়


শোভন বাবুর মনে পড়ে তার সেই পালঙ্কের কথা।  যেটা তিনি কিনেছিলেন যখন তিনি প্রথম এদেশে এসে নতুন পাকা বাড়ি করেন।  তখন সেই সময় একটু মধ্যবিত্ত বা খুব ধনী পরিবারে পালঙ্ক তখন খুব শৌখিন জিনিস ছিল তাদের কাছে।  আর কিছু না হোক পালঙ্ক তাদের ঘরে থাকা চাই।  আর শোভন বাবুর অবস্থাও ভালোই ছিল।  তিনিও কিনেছিলেন একটি নতুন পালঙ্ক নিজের জন্য। কিন্তু সে তো অনেক আগের সময়ের কথা এই সব।  এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে আর কত জনের বাড়িতেই বা পালঙ্ক দেখা যায় ? এখন সব নতুন মডেলের আরও অনেক ভালো ভালো খাট বিছানা পাওয়া যায়। তাই শোভন বাবুর যে ছেলে সোমনাথ,  সে একটু আধুনিক স্বভাবের। তাই সোমনাথ একদিন তার বাবা শোভন বাবুকে বলে যে, 



সোমনাথ : বাবা একটা কথা ছিল তোমার সঙ্গে!! 


শোভন বাবু : হ্যাঁ বল কি বলবি? 


সোমনাথ : যেটা বলার সেটা হলো,  দেখো বাবা এখন আধুনিক যুগ পড়েছে,  সব কিছুই বদলে গেছে।  বাজারে অনেক নতুন নতুন জিনিস এসেছে।  তাই বলছি যে..... 


শোভন বাবু : কি হলো,  থেমে গেলি কেনো,  এত ইতস্তত বোধ না করে বল কি বলতে চাস? 


সোমনাথ : কথাটা শোনার পর তুমি আমায় ভুল বুঝো না বাবা। দেখো আমি বলি কি,  তোমার ঘরে যে পালঙ্কটি  আছে সেটা এবার আমার মনে হয় বদলে ফেলা উচিত। 


শোভন বাবু : দেখ তুই তোর ইচ্ছে মতো সব কিছু বদলে ফেল, জানি এখন বাজারে অনেক নতুন কিছু এসেছে কিন্তু আমায় দয়া করে বলবি না যে এই পালঙ্কটা বদলে ফেলার কথা। কারন এই পালঙ্ক আমার যে কতটা কাছের সেটা হয়ত তোকে আমি বোঝাতে পারবো না। 


সোমনাথ : কিন্তু বাবা এই পালঙ্কের গায়ে মরচে পড়েছে,  আর তার চারপাশ গুলো রঙও চটে গেছে দেখতে বড় খারাপ লাগছে তাই আমি বলি কি তুমি এটা বিক্রি করে ফেলো, আমি তোমায় নতুন খাট এনে দেবো। 


শোভন বাবু : দেখো বাবা তুমি শত চেষ্টা করলেও আমি আমার এই সাধের পালঙ্ক বিক্রি করতে পারবো না। 


    এরপর সোমনাথ তাকে অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করলেও শোভন বাবু আর তার কথা শুনতেন না।  এরপর এক বছর পরে গিয়ে সোমনাথ বিয়ে করে নতুন বউ আনল ঘরে।  সোমনাথের স্ত্রী অর্থাৎ মনি প্রথম দিনই তার শ্বশুরের ঘরের পালঙ্কটি দেখে খুবই আনন্দিত হয়।  মনি বলে যে, "বাবা আপনার ঘরের পালঙ্কটা তো বেশ সুন্দর... অনেক বছরের পুরোনো বোধ হয়?"... 


শোভন বাবু : হ্যাঁ মা এটা অনেক বছরের পুরোনো। মা তোমায় একটা দায়িত্ব দেবো পালন করবে তুমি? 


মনি : হ্যাঁ বাবা বলুন না কি দায়িত্ব?  আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। 


শোভন বাবু : মা আমি যদি এরপর আর না থাকি তাহলে আমার এই সাধের পালঙ্কটির একটু যত্ন নিও।  তুমি অন্তত বাবুর মতো এটা বিক্রি করো না মা।  এটাই আমার তোমার কাছে অনুরোধ। 


মনি : সে নয় আমি দেখে রাখবো বাবা কিন্তু এসব কি কথা বাবা, থাকবো না মানে কি।  আমি এই বাড়ি এসে আবার আমার ছোটো বেলার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে ফিরে পেলাম আর আপনি এইসব বলছেন? 


শোভন বাবু : না মা,  দেখো আমার তো বয়স হলো অনেক তাই না। আর কদ্দিন বলো?  আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি তাই তোমায় এই দায়িত্বের ভারটা দিয়ে রাখলাম।  


মনি : হ্যাঁ বাবা আপনার ছেলে যতই বলুক না কেন এই পালঙ্ক বিক্রির কথা,  কিন্তু আমি তাও এটা বিক্রি হতে দেবো না বাবা। 


শোভন বাবু : এই ঘরের লক্ষীর মতো কথা বলেছ মা।  আমি তো আর বাবুকে বুঝিয়ে পারলাম না। দেখো তুমি বোঝাতে পারো কি না? 


     এইসব কথা বলেই শোভন বাবু এরপর বললেন, "ঠিকাছে মা তুমি এবার তোমার ঘরে যাও।  তোমার তো আরও অনেক কাজ আছে না,  যাও মা"। 


        এরপর মনি তার ঘরের দিকে চলে গেলে শোভন বাবু তার হেলান দেওয়া চেয়ারে গিয়ে পিঠটা হেলান দিয়ে বসলেন তারপর কি সব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েও পড়েন। 


    এইভাবেই তারপর থেকে তিন জনের সংসারে শোভন বাবুর বেশ হেসে খেলে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু একদিন দুপুর বেলায় মনি আর শোভন বাবু দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে শোভন বাবু নিজের ঘরে গেছেন শুতে আর সোমনাথ তখনও সেদিন অফিস থেকে ফেরেনি বাড়ি।  বলেই গিয়েছিল যে,"আজ ফিরতে তার অনেক দেরী হবে"। তাই মনিও তারপর খেয়ে দেয়ে নিজেও নিজের ঘরে গিয়ে হাতের কাজ গুলো সারছিল। তারপর বিকেল হয়ে যাওয়াতে মনি ঘড়ি দেখে মনে মনে ভাবল যে, "বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল আর বাবা এখনও উঠলেন না? দেখি গিয়ে বাবার ঘরে।  হয়ত ক্লান্ত আছেন তাই আজ বোধহয় তিনি একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়েছেন"। তারপর মনি তার ঘরের সামনে গিয়ে তাকে "বাবা"..."বাবা"... বলে অনেকবার ডাকা সত্ত্বেও যখন মনি দেখল শোভন বাবুর আর কোনো সাড়া শব্দ নেই তখন মনি তার গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই দেখে যে তার বাবার গা একদম ঠান্ডা বরফের মতো হয়ে গেছে। তার শরীরে আর কোনো সার নেই। তখন মনি সবটাই বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি করে সোমনাথকে ফোন করে আর কিছুক্ষন পরেই সোমনাথ ফিরে এসে দেখছে মনি তার বাবার সামনে হাউহাউ করে কাঁদছে। তারপর সোমনাথ তার পাড়া প্রতিবেশীদের ডেকে আর আত্মীয় স্বজন যারা ছিলেন তাদের ডাকেন তারপর তারাই শোভন বাবুর দেহ দাহ করে আসে শ্মশানে। 


      সোমনাথ তখন দিনের পর দিন তার বাবার ঘরের পালঙ্কটা দেখে আর মনে মনে ভাবে যে, "কতই না বাবার সঙ্গে এই পালঙ্ক বিক্রি নিয়ে ঝগড়া ঝামেলা করেছি".... হঠাৎ সোমনাথ নিজেই মনিকে একদিন ডেকে বলে, "না গো বাবার এই সাধের পালঙ্কটা বিক্রি করার কথা ভাববো না।  বাবার শেষ স্মৃতি বলতে তো শুধু আমাদের কাছে এই পালঙ্কটাই আছে।  এটাই নয় আমরা খুব যত্ন করে রেখে দেবো আর ভাববো বাবা আমাদের মধ্যেই আছেন"....। 

 
 
 

Comments


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page