ধারাবাহিকভাবে পড়ছেন 'হলুদপাখি'
আজ তার চতুর্থ অংশ।
পরাণ বন্ধু রে...
শর্মিষ্ঠা
রুজা ঘরে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলে মোবাইলটা রাখলো।কাঁচটা ঝাপসা লাগছে, ঝাপসা চারপাশ।পলক ফেলতেই গড়িয়ে পড়লো জল টসটস করে কপোল বেয়ে চিবুকে।এ ঘরে ম ম করছে বাসী চাঁপা'র সুবাস।রুজার একবার মনে হলো ফুলগুলো তুলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দেয়।পরক্ষণেই বুকে জড়িয়ে ধরলো ওদের।রাধাদি কেন বললো এগুলো 'শ্যাম দিয়েছে'! কে শ্যাম? একটা খটকা কাজ করছে।
চাঁপাগুলো যথাস্থানে রেখে রুজা জানলার দিকে এগিয়ে গেলো।বিছানায় খোলা 'সুবর্ণলতা', যেটা খেতে যাবার আগে পড়ছিলো।এখান থেকে পেছনবাড়ি দেখা যায়।শূন্য চাতাল।যেন অপেক্ষমান।পাশের হলুদ করবী থেকে শুরু করে গাঁদার গাছগুলো নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে।দেখলে মনে হয় খুব আনন্দ পেয়েছিলো।হঠাৎ জোর করে কেউ থামিয়ে দিয়েছে।আজকে এ বাড়ির পরিবেশ কেমন পৃথক ঠেকছে যেন!
এমনটা তো গত পাঁচবছর ধরেই হয়ে আসছে।প্রত্যেক সতেরোই জুলাইয়ের আগে-পরে দিন সাতেক আচ্ছন্ন লাগে রুজার নিজেকে।কিন্তু এবারে আচ্ছন্নতার সাথে উচাটনা মেশানো।'একবার পেছনবাড়ি ঘুরে আসি'! ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রুজা।
–আরে বাবা! তুমি কখন এলে? কোথায় গিয়েছিলে সক্কাল সক্কাল?
–ম্যাডামের দুপুর বারোটায় সকাল হলো বুঝি!
–বাবা! বাড়ি এলে সবাই রিলাক্সই করে।টেক ইট ইজি!
–ও।
–কোথায় গিয়েছিলে বললে না তো!
–সাসপেন্স।
–বাবা তুমি জানো আমার এরকম উৎপটাং সাসপেন্স ভালো লাগে না।প্লিজ বলো।
সুকুমারবাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে নিজের ঘরে পা বাড়ালেন।রুজাও নাছোড়বান্দা।এগিয়ে এলো বাবার পেছন পেছন।
–ও বাবা।বলো না!
–আরে সেরকম কোথাও না।একটু এদিক সেদিক।
সুকুমারবাবু অ্যাটাচ বাথরুমে প্রবেশ করলেন।সকাল থেকেই অবান্তর গন্ধগুলো রুজাকে উম্মনা করে রেখেছে।এবার পার্কএভিনিউ'র আফটার সেভ! কোত্থেকে এলো! আগেরবার বই নিতে এসে তো পাইনি!
–বাবা, তুমি আফটার সেভ পাল্টেছ?
–হম।কাল গিফ্ট পেয়েছি।ব্র্যান্ড নিউ।এই দ্যাখ্।
সুকুমারবাবু একগাল হাসি সহযোগে বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে, হাতে ধরা নীল রঙের শিশি।
–বাঃ।খুশি হলাম।অবশেষে বিখ্যাত ওল্ড স্পাইস পাল্টালো? তা কে দিলো শুনি?
আচমকা অযাচিত প্রশ্নে হকচকিয়ে উঠলেন সুকুমারবাবু।এরকম পাল্টা বাণ আসতে পারে এটা তো আশা করেননি উনি।ভারী মুশকিল ! এই জন্য মিথ্যা বলতে হয় না! এরপর একটার জন্য এক হাজার গল্প বানাও! যেমন ঝামেলায় পড়েছে অনুপ আমারও সেই এক জ্বালা হলো! গোটা ব্যাপারটার জন্য নিজের ওপরে ভীষণ রাগ হলো ওনার।
–সব কথা তোকে বলতে হবে কেন? আমি কিনেছি নিজের জন্য।
হাঃ হাঃ হাসিতে মধুর রিনিঝিনি।এবার বাড়ি এসে এই প্রথম হাসলো রুজা।
–বাবা আ আ
–হম।
–লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছো নাকি!
–রুজা! আরে বিনোদ দিয়েছে।
উত্তরটা দিয়েই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জিভ কাটালেন সুকুমারবাবু। যাঃ,আর কোনো নাম মুখে এলো না! বিনোদটাকেই এড়াতে চাইছিলাম আর ওটাই বলে ফেললাম! আসলে তখন থেকে ওটাই মাথায় ঘুরছে যে!
–ওমা! তুমি বিনোদদার ওখানে গিয়েছিলে! আমাকে বলোনি কেন? অবশ্য দামুদা বলেছিল কালকে বৌদি আর বিনোদদা সিঙ্গাপুর থেকে এসেছেন।কালকে খুব ভোরে বিনামাসির সাথে দেখা করেই ফিরে এসেছে ওঁরা।আমি 'কূজন'-এ পৌঁছানোর আগেই।কী বললো? আমার কথা বলেছো? আমাকে যেতে বলেছে? ওরা কবে ফিরবে?
–আচ্ছা রুজা, তোর এই প্রশ্নবাণ একটু থামাবি মা ? খেয়েছিস?
–হম। অর্ধেক।বাকিটা এখন তোমার সাথে খাবো।
–তাহলে খেতে চল্।
দুজনে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজানো সুসম্পন্ন।তিনজন একসাথে খেতে বসলো।
–বিনোদদা ক'দিন থাকবে বাবা?
খাওয়া থামিয়ে মেয়ের প্রশ্ন শুনে স্বামী স্ত্রী দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।নিস্তব্ধতা।সেটা ভাঙলেন সুকুমারবাবু নিজেই।
–কাল বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা।
–তাহলে তো আজই দেখা করতে হবে।
–না, না তোর ওখানে গিয়ে কাজ নেই।
–কেন মা? এখানে আছিই যখন একবার দেখা করে আসি।
–বললাম তো না।তাছাড়া ওরা ফিরবে।ঠিকমতো কেনাকাটা, গোছগাছ করুক।এসময় বিরক্ত করা ঠিক না।
রুজা অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো।মাকে এমন অদ্ভুত আচরণ করতে আগে দেখেনি।
–যেতে দাও।
সুকুমারবাবুর ভারী কণ্ঠস্বর।
ভাতের থালায় তিনজনের আঙুল চালনা স্থিমিত হয়ে এলো।চারপাশে আঁধার ঘনাচ্ছে।বোধহয় একবার আকাশ বর্ষণসুধা ঢালবে।
–রুজা।
বাবার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো রুজার।নিশ্ছিদ্র নীরবতায় যেন করাঘাত।
–হম।
–আমার বয়স হচ্ছে মা।শরীরটাও ভালো না।তোর জন্য বড্ড চিন্তা হয় রে!
–আমি ভালো আছি বাবা।
–জানি।তোর 'কুজন' তোকে খারাপ থাকতে দেবে না।কিন্তু আমি তো বাবা।
–কী করতে বলছো তুমি?
–এবার একটু নিজেকে নিয়ে ভাব।
–কী ভাববো বাবা!
–ইউ সুড মুভ রুজা।ইউ আর বিউটিফুল, চার্মিং, ইয়াং এন্ড আর্নিং লেডি! জীবন একটা জায়গায় থেমে থাকে না।তাকে সুযোগ দাও।তবে তো বুঝতে পারবে তুমি তার সাথে সঠিক বিচার করছো কি না!
–তাই তো দিচ্ছি! সময় দিচ্ছি তো!
–এটা কিছুই করা হচ্ছে না মা।তুমি আটকে আছো পাঁচ বছর আগের ঘটনায় আর টেনে বেড়াচ্ছ তার রেশ।তুমি আদপে এক মুহূর্তের জন্যও অনুপকে ছেড়ে থাকোনি!
–বাবা পারছি না তো!
গলা ভেঙে এলো রুজার।
–পাঁচ বছর কম সময় নয় রুজা! তাহলে কথা বলো ওর সাথে।তুমি জানো আমি হাইপারটেনশনের রুগী।আমি আর নিতে পারছি না রুজা।
খাবারের থালাটা আস্তে করে সামনে ঠেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রুজা।
–অনুপও তো বলতে পারতো! একবার!
বেসিনে হাত ধুয়ে এগিয়ে গেলো নিজের ঘরের দিকে।
–আজ বিকেলেই ঘুরে আসিস বিনোদের বাড়ি।
বাবার কথায় অবাক হয়ে পেছনে ফিরলো ও।আরশোলা রঙের ফ্রেমের পেছনে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ।
–অনুপের গাড়িটা দেখতে পাবে তো!
মায়ের ফিসফিস করা শব্দগুলো ওর কান অব্দি পৌঁছালো না।
–তথাস্তু।
সুকুমারবাবু বাঁ হাত তুলে একবার স্ত্রীর দিকে অন্যবার কন্যার দিকে নাড়লেন।তারপর খাওয়ায় মন দিলেন।
–পটলপোস্তটা বড্ড উপাদেয় করেছো গিন্নী!
টেবিলের ওপাশে দু'জোড়া অনুসন্ধিৎসু চোখ তাকিয়ে নিষ্পলক।
রুজা উঁকি দিয়ে দেখলো বাবা আরামকেদারায়।বুকের ওপর ওল্টানো 'আরণ্যক'। চশমার পেছনের দুটো চোখ বন্ধ।ঠোঁটদুটো একপাশে ঈষৎ খোলা আর সেই অনতিগভীর গহ্বর ঠেলে বেরিয়ে আসছে গরম হাওয়া নিঃশব্দে একই ছন্দে।বাবা ঘুমাচ্ছে।বাবা'র হাতটা সরিয়ে বইটা তুলে বন্ধ করবার ইচ্ছা ওর হলো না।ঘুম ভেঙে যেতে পারে! বরং প্রশান্তি অনুভব করলো।এই একরত্তি জীবনের দমকা দামালগুলোর ভেতরে এইটুকুই পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিগত শান্তির পরিসর।আর ওই 'কূজন'। একটা লম্বা শ্বাস নিলো ভেতরে।বাবা বাবা গন্ধ।ওপাশে মা খাটের এককোণে কুচিমুচি করে শুয়ে।তাঁর হাটু, কনুই সব বুকের কাছে একটি কেন্দ্রস্থিত বিন্দুতে সমাহিত।রুজা নিজের মনে হেসে উঠলো। 'এঁরা আর কোনোদিন বড় হবে না!'... তারপর সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।মেইন দরজা ওয়ান সাইডেড লক।নীচে সিঁড়ি দিয়ে নেমে মেইন গেট খুলে বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলো ডানদিকে।এখন ঘড়িতে সাড়ে চারটে।একটু পরেই রোদ্দুর মুছে যাবে।দুপুরের বৃষ্টির পরে বেশ চকচকে রোদ।
বিনোদদার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতেই দেখতে পেলো একটা ব্ল্যাক ডিসায়ার গেট দিয়ে বেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে চলে গেলো।আর পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছালেই রুজা জানতে পারতো ওতে কে ছিলেন।নিজের এই অবাঞ্ছিত কৌতূহলের জন্য রুজা বেশ অস্বস্তিবোধ করলো।কিন্তু গাড়িটা বড্ড চেনা লাগছে ওর।কোথায় যেন দেখেছে! রুজা নিজের মনকে নিজেই খানিক ধমকের সুরে বলে উঠলো, 'কালো ডিসায়ার কি একটাই তৈরি হয়েছিলো পৃথিবীতে!'
–বৌদি!
–ও মা রুজা! তুই কখন এলি!
–এই তো কাল গভীর রাতে।
–নাঃ, সেটা তো জানি।এখানে কখন এলি?
–ও, বাবা তাহলে বলেছে।এইমাত্র তো!
–হ্যাঁ।
বৌদি যেন হাঁফ ছাড়লেন।যেন রুজা খানিক আগে এলে কুরুক্ষেত্র হতো।
–কেমন আছো তোমরা? বিনোদদা কোথায়?
–ভালো আছি রে।এই যে এখনই বেরোলো।চলে আসবে। তুই বোস।
উসখুস করতে করতে অপ্রস্তুতের মতো রুজা কথাটা জিজ্ঞাসা করেই ফেললো।
–বৌদি, একটা ব্ল্যাক ডিসায়ার বেরোতে দেখলাম।তোমরা নতুন কার নিয়েছ?
–না তো! আর ওটা তো...
হকচকিয়ে আমতা আমতা করতেই পেছনে পুরুষালি কণ্ঠস্বর।
–ওটা আমার এক বন্ধুর।
–বিনোদদা! কেমন আছো? কত্তদিন পরে দেখা।
–ফাইন, মিস হোমস।
একটা আনন্দঘন মুহূর্ত হাসিতে ভরে উঠলো।
–কাল চাঁপাগুলো লাগিয়েছিলিস খোঁপায়?
–তুমি কী করে জানলে? ও, তুমিই ওগুলো দিয়ে এসেছ!
–হম।রাস্তায় একজনের সাথে হঠাৎ দেখা।তারপর প্রাপ্তিযোগ।ভাবলাম তোর জন্য দিয়ে আসি।তোর তো খুব পছন্দের!
রুজার মাথাটা নিচু হয়ে এলো।কী করে ও বলবে ওই গন্ধের পরে সবটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো কাল।
–রুজা, মাকে একটু দেখে রাখিস। সবটাই তো জানিস।একদিনের জন্যও এখানে এলো না।কেন যে এত রাগ? আমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাইলে যাবে না।অথচ...
–হম।আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।তোমরা চিন্তা করো না।
–অনুপের খবর কিছু জানিস?
আচম্বিতে বৌদির প্রশ্ন। নির্বাক রুজা।
–বছরখানেক আগে একবার খবর পেয়েছিলাম।তছনছ হয়ে গেছে ছেলেটার জীবন...
আর কিছু বলার আগেই রুজা সোফা থেকে ঝটিতিপর উঠে দাঁড়ালো।
–আচ্ছা আমি বেরোই।তোমরা গোছগাছ সারো।কাল সকালেই তো বেরোনো।বিরক্ত করলাম।তাও দেখা করবার লোভ সামলাতে পারলাম না।
একমুহূর্ত দেরি না করেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো রুজা সোজা রাস্তায়।একপ্রকার পালিয়ে এলো।অনুপের খবর যেন ও শুনতে চায় না এই পৃথিবীর কারো কাছ থেকে।যা ওর নিজস্ব তা ওর নিজের।অন্য কারো কাছে তাকে নিজের বলে ব্যক্ত করাতে তীব্র আপত্তি ওর। 'নিজেরকে নিজের বলে চেঁচিয়ে কী লাভ'... দু'হাত দিয়ে মুখটা একবার ঢেকে ফেললো রুজা।নাঃ, অন্য কেউ কেন? কেন অনুপ নিজে নয়? আমি তো 'সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের তরে।' একবার অনুপ, তুমি বলো।একটিবার। একটিবার গণ্ডি পেরিয়ে এসেই দেখো, রু তোমার, শুধু তোমার।তোমার কথা শুনবে বলেই তো অপেক্ষমান।সমস্ত প্রকৃতি, চারপাশ তোমার কথা আমাকে শোনানোর জন্য যেন ব্যস্ত! আমি বুঝতে পারি অনুপ।কিন্তু আমি যে একমাত্র তোমার নারী, তুমিই আমার একমাত্র পুরুষ।এর মাঝে হাওয়ারও স্থান নেই। রাস্তার ধারে পুকুরপরের কমলা-সাদা বেঞ্চে বসে পড়লো রুজা।তারপর সুতীব্র অসহায় আর্তি ঝরে পড়লো গলায়, 'অনুপ একটিবার'। জল মুছতে মুছতে মনে পড়লো, তাড়াহুড়োতে মোবাইল আনতে ভুলে গিয়েছে রুজা। 'নাঃ, বাবা মা চিন্তা করবে। ফিরতে হবে।একবার বিশুদার দোকান হয়ে ফিরবো।'
–হ্যালো কাকাবাবু, রুজা বেরিয়ে গেছে।
–কী বুঝলে!
–ভাগ্যিস আপনি টের পেয়েছিলেন ঘুমের মধ্যে।আর একটু হলেই...
ওপাশের গলিতে কথোপকথন পরিচালিত হচ্ছে টেলিফোনের তারে।এদিকে উঠে দাঁড়ালো রুজা।রাস্তার দুপাশে নীল-সাদা আলো জ্বলে উঠেছে।বিশুদার চায়ের দোকানে পৌঁছাতে আধঘন্টা লাগবেই।পুকুরের জলে একটা ঢিল ছুঁড়ে রুজা হাঁটতে শুরু করলো।
========================
Comments