ধারাবাহিকভাবে পড়ছেন 'হলুদপাখি'
আজ তার চতুর্থ অংশ।
তবু তুমি সুন্দরী কত…
হেমন্ত সরখেল
বিনোদ'রা পৌঁছে যাবে দুটো নাগাদ।দমদম এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে থাকতে হবে ওকে।বহুদিন পর লোকাল ট্রেন যাত্রা হলো।কত মানুষ!এখানে ধনী-গরিব নেই।নেই ছোট-বড়ো জাতের ভেদ।একসময় নিত্য দৌঁড়ে অভ্যস্থ ছিল ও।তখন এভাবে ভাবেনি,আজ ভাবছে।সত্যিই তো!মানুষের জীবনে একটাই ধর্ম, খিদে।একটাই মন্দির, পেট।একই মন্ত্রে আরাধনা, কাজ-কাজ আর কাজ। নিজের ভেতর থেকে না বেরিয়ে যেতে পারলে বহুকিছুই বোধগম্যতা হারায়।হারায় ঠিক না,লুকিয়ে থাকে।থাকে চোখের সামনেই অথচ নজরে আসে না।নইলে কি আর ওকে বিদেশ ছুটতে হয়!এভাবে সাজানো ঘুঁটি এলোমেলো করে আবার সাজাতে বসতে হয়!
বিক্রি বাড়ছে ওদের সফ্টওয়্যারের।একটা সেমিনার অ্যারেঞ্জ করতে হবে।একটা স্যুইটেবল্ প্লেস সিলেক্ট করতে হবে।ও সাবর্ডিনেটকে ডিটেইল ইন্সট্রাকশনটা সেন্ড করে যখন ল্যাপি বন্ধ করল তখন চারটে।ওকে এদেশেই থাকতে হবে, অন্তত ততদিন,যতক্ষণ না রু'কে সবটা বুঝিয়ে উঠতে পারে।তার জন্য ওকে বাংলাদেশের প্রোজেক্টটাও নিজের হাতেই রাখতে হবে।কথায় কথায় এমিলি বলেছিল,বাংলাদেশটা ও কভার করতে চায়।তাতে,ওর ভাষাটাও শেখা সহজ হবে।সংস্কৃত আর বাংলাটার প্রতি প্রবল ঝোঁক মেয়েটার।বিশেষ করে যেদিন থেকে শুনেছে মহাজাগতিক শব্দের অনুরণন ভাসে ওঁ-এর সাথে সাদৃশ্য রেখে,সেদিন থেকেই ওকে অত্যুৎসাহী হতে দেখা গেছে।এদিকে,অনুপ এখনও যে কেন রু'এর সামনে দাঁড়ানোর সাহস জোটাতে পারছে না!এভাবে তো অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে!সময় তো চাই অনুপের। নিজের জন্য, নিজেদের জন্য।যুদ্ধ শেষে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের তল্পি মনোহর,এবার তো রু'কে চাই!নইলে যে এ সবই ব্যর্থ!আর সে সময়টুকু ও পেতে পারে যদি বাংলাদেশের প্রোজেক্টটা নিজের হাতে নিতে পারে।এদেশ থেকে বাংলাদেশে দৌঁড়ানো সহজ,চার ঘণ্টায় ও রু'এর কাছে চলে আসতে পারে।কথা বলতে হবে এমিলির সাথে।সবটা বললে, নিশ্চয়ই বুঝবে ও।এ ছাড়া তো আর উপায় নেই,সময়টা অনুপের চাই।
জেল-এ বসে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত ও একটাই প্রার্থনা করেছে।রু যেন ওর এই নিস্তব্ধতাকে অন্য কিছু ভেবে না বসে।ও জানতো, অভিমানীর মান ভাঙানো সহজ হবে না।দুটো ছত্র ভেসেছে মনে,
"কোন বিশ্বাসে,কার আশায়
ফেলে রাখো এত সুদীর্ঘ দিন
সংবাদহীনতায়?"
যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধে হয়।এই সে প্রদোষ।সামনে দাঁড়িয়ে সত্যিটাও বলবার শক্তি জুটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না।ভেবেছিল, যদি রু'এর বাবা-মা কোন হেল্প করতে পারেন!সেটাও কেঁচিয়ে গেল রু'এর কারণেই।আরেকটু কথা বলার দরকার ছিল মুখোমুখি বসে।ওনারা কতোটা কী করতে পারবেন,বোঝা গেল না,লুকিয়ে পালিয়ে আসতে হলো।বিনোদও থাকছে না, আর কে আছে ওকে সাহায্য করার মতো!নেই, কেউ নেই।নিজেকেই নিজের সাহায্য করতে হবে।কিন্তু যদি রু সত্যিটা বিশ্বাস না করে!এই অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পায় না অনুপ।এত অসহায় তো কখনই ফিল করেনি ও।
রুমের এ.সি.টা কমিয়ে দিয়ে জানলার পর্দাটা সরিয়ে দিল। স্লাইড ঠেলে দিল একপাশে।যদিও ভোর,তবু গরম হলকা লাগলো চোখে মুখে।কার্বনমনোক্সাইডের বিষের এই স্তুপ কি কোনদিন গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবে মহানগরেরা?
স্নান সেরে বেরিয়ে দেখল, চারটে মিসড্ কল।একটা টেক্সট।বিনোদ'রা জাগুলিয়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে টেক্সট করেছে। এয়ারপোর্ট ১ নম্বরে দাঁড়াবে।ঠিক আছে, হাতে এখনও দু'ঘণ্টা সময়।ও খাবার দিতে বলল ইন্টারকমে।একটু তাড়াতাড়ি যাওয়ার দরকার।যদি কিছু হয়ে থাকে বিনোদদের চেষ্টায়।
বিনোদের আসাটা পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা।ও যে আসছে সেটা রু'এর বাবার মুখে শুনলো অনুপ।নম্বর নিয়ে কল করলো।বাড়িতে যাওয়া রিস্কের হয়ে যেত বলে গাড়িটা ওদের ওখানে ছেড়ে দিতে বলে ট্রেন ধরেছিল।ট্রেনে ফিরতে ফিরতে ফোনে সবটাই বলে দিয়েছিল।ওরা চেষ্টা করবে,জানিয়েছিল।
এয়ারপোর্ট ১ নম্বরে স্টিয়ারিং সামলালো ও নিজেই।একটু হেল্দী হয়েছে বিনোদ।ওর বৌ অনুপকে দেখে হাসল,
-- ভালো আছেন?
-- চলছে,বৌদি।আপনি?
-- হ্যাঁ,আছি।তা,কিছু হলো?
-- সে তো আপনারা বলবেন,আমি সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।
-- ধুর মশাই!কেমন পুরুষ মানুষ আপনি?এত ভাবে নাকি কেউ?প্রপোজ করেছিলেন কিভাবে?
-- তখন ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল।এখন পরিস্থিতিটা এতই জটিল…
-- কিস্যু জটিল না।রু এর মনে এখনও আপনিই বসে আছেন।কথা তুলতেই যেভাবে উঠে পালালো,তাতে পরিষ্কার, ও আপনার অনুভব কারো সাথেই শেয়ার করতে চায় না।ওর বাবা-মা তো বললেন,ও বিয়ের কথায়ও সায় দেয়নি।সবটাই ক্লিয়ার,শুধু আপনিই বুঝতে চাইছেন না।
গাড়ি দাঁড় করালো অনুপ।বোর্ডিং'এর জন্য এখনও মিনিট ত্রিশেক সময় পাওয়া যাবে।ওরা নেমে গেলে একটু ডানদিকে এগিয়ে গাড়ি পার্ক করে ফেরত এল।হঠাৎ একটা কথা মাথায় এল!
-- আপনাদের কারো কাছে ওর নম্বর নেই?
-- আছে তো!ইস! ভুলেই গেছি।নিন, আমি দিচ্ছি।
নম্বরটা নোট করতে হাত কাঁপছে অনুপের।দেখে হেসে ফেলল বিনোদ,
-- তুই গেছিস।এত বড়ো একটা কোম্পানির ওউনারের যদি একটা নম্বর নোট করতে এভাবে হাত কাঁপে…
খিলখিল করে হেসে উঠল বিনোদের বৌ।দুষ্টুমি ভাসছে চোখে।
-- প্রেমের প্রসঙ্গে সব পুরুষ মানুষের অবস্থাই এক।
-- আমাকে বোলো না, আমি যথেষ্টই স্টেডি ছিলাম।
-- রাখো রাখো!ছোড়দার ভয়ে তো কলেজই এলে না একমাস।বীরপুরুষ!
-- আহা!তোমার বাবাকে কে বলল?
-- হ্যাঁ!আর বলেই যেভাবে পালালে সেভাবে কাউকে কোনদিন পালাতে দেখিনি আমি।নেহাত হ্যান্ডসাম, গর্জিয়াস ইকোনমিক সেটলমেন্ট ছিল,নইলে বাড়িতে রাজি হতো?পার্সোনালিটি দরকার মশাই!
-- সে তো অনুপের যথেষ্টই আছে।তাহলে কেন যে…
-- অনুপদা অহেতুক ভয় পাচ্ছেন।একবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সব ঠিক হয়ে যাবে।আর, এখন তো ফোন নম্বর পেলেন।টেক্সট করবেন।ভুলেও যেন কল করে বসবেন না!
-- আমি কি সেটাও করতে পারবো?
পাতলা বিষাদের চাদর জড়ানো গলায় বলে উঠলো অনুপ।চা নিলো ওরা কাউন্টার থেকে।এবার বোর্ডিং।একাই লড়তে হবে ওকে।লড়াইটাই যে ওর।
-- আসি রে!ভালো থাকিস।কল করিস।পৌঁছে জানিয়ে দেব।আমরা সাথে আছি তোর,চিন্তা নেই,দেখি কদ্দূর করতে পারি!
ওরা ভেতরে ঢুকলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল অনুপ।একবার অফিসে ঢুঁ মারতে হবে।কাজেরা মুখ বের করে রেখেছে ক্ষুধার্ত কচ্ছপের মতো।কেন যে ঘিরে ফেলে অবসন্নতা! গাড়ি স্টার্ট করলো ও।ডানদিকে টার্ণ নিলেই কর্মজগত আর,খুঁজে ফেরা জীবনের মানে।
Comentários