top of page
Search

বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ও বোধোদয় -২ ( প্রবন্ধ )


বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ও বোধোদয়


তপন তরফদার


পর্ব - ২



বর্ণপরিচয় প্রথম পর্যায় আদিতম ধ্বনি, আদি স্বরধনি অ দিয়ে এবং একটি ব্যঞ্জনবর্ণ জ সমাবিষ্ট করে, (অজ) অর্থাৎ দুটি ধ্বনির সংযোগে শুরু করলেন প্রথম পর্যায়ে। অভিধান এর মত বর্ণানুক্রম শৃঙ্খলা (alphabetic order ) পুরোপুরি বজায় রাখলেন। বিদ্যাসাগর সতর্ক করছেন, শব্দের অর্থশিক্ষা নয়, ধ্বনি শিক্ষাই সুশিক্ষাই প্রাধান্য পাবে। তাই সুর করে অক্ষরগুলি উচ্চারণ করে তারপরে অক্ষর জুড়ে শব্দটি উচ্চারণ করবে ঐ সুরের অংশ হিসাবে। এই ভাবে যে মাত্রা বা সময় লাগবে, সেই দৈর্ঘ্যের একই প্রক্রিয়া পরের শব্দটি পঠনে বা শিখলে পুনরাবর্তন ঘটবে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে দুই বা ততোধিক বিভিন্ন স্বরবর্ণ যৌগের মিশ্রন করেছেন। তৃতীয় পর্যায়ে স্বর-যোগের ন্যায় ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে অনুস্বর(ং) বিসর্গ(ঃ) চন্দ্রবিন্দু (ঁ) যোগ করে শব্দ রচনার উদাহরণ দিয়েছন। চতুর্থ পর্যায়ে বর্ণ বিশেষে উ ঊ ঋ যোগের বিশেষ উদাহরণ দিয়েছেন। দুই, তিনের, চার অক্ষরের বিভিন্ন শব্দে। এরপর তিনি শব্দ ধরে পাঠ চালু করে শিশুর নতুন ভাব রাজ্যে প্রবেশ করান।



একাধিক শব্দ একসঙ্গে পাঠ অর্থাৎ শব্দ ধরে পাঠ করে নান্দনিক গদ্যের সূচনা করেছেন। দুই, তিন, চার, পাঁচ অক্ষরের সমন্বয়ে সৃষ্ট বিভিন্ন শিশু পরিচিত শব্দ বিন্যাসে এমন ভাবে করেছেন যা শিশুর জীবনে পরিচিত। পরপর তেরটি পাঠ তিনি সৃষ্টি করেছেন। প্রথম পাঠ বিশেষণ বিশেষ্য আর বাকি আটটি পাঠ ক্রিয়া সংযোগে। বাক্যগুলিকে ধীরে ধীরে বড় করা হয়েছে। দুটি শব্দ থেকে ছটি শব্দ পর্যন্ত বাক্য। শিশুর অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখে রচনা। আদেশ-নির্দেশ মূলক, বিবৃতিমূলক, উপদেশমূলক, বর্ণনামূলক, নিষেধমূলক, শংসামূলক, নীতিমূলক বাক্য। প্রধানত সরল বাক্য এবং বর্তমানকাল ও ভবিষ্যৎ কালের কথা। মনে রাখতে হবে এই পর্যায়ের শেষ পাঠে (১৩শ) তিনটি বাক্যাংশ ব্যবহার করে যৌগিক বাক্যের বিবরণ দিয়েছেন। এরপর তিনি বাক্য ধরে পাঠের ব্যবস্থা করেছেন। অনেকগুলি বাক্যে একটি বক্তব্য প্রকাশ করতে শেখানো হয়েছে। ১৪শ পাঠে ঠিক সময় পড়তে বসা। ১৫শ পাঠে সঠিক সময়ে পড়তে যাওয়া। ১৬শ পাঠে পড়তে বসে গোলমাল না করা। ১৭শ পাঠে বাড়ি ফেরার পথে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার না করা। ১৮শ পাঠে কোন বিশেষ ছেলের পড়তে না আসাকে বিষয় করা হয়েছে। প্রত্যেকটি পাঠে আলোচনায় একটি অনুচ্ছেদ আছে। ১৯শ এবং ২০শ এই দুটি পাঠে গোপাল, রাখাল দুটি ভিন্ন বিপরীত চরিত্রের বালকের কথা তুলে ধরা হয়েছে। গোপাল ভালো, রাখাল খারাপ ছেলে। প্রথম ছটি এবং দ্বিতীয়টি পাঁচটি অনুচ্ছেদে রচিত ভালো-মন্দ চরিত্র। বর্ণনার পর শেষ অনুচ্ছেদে ভাল বা মন্দ চরিত্র সম্পর্কে বর্ণনার পর প্রতিক্ষেত্রে সৎ হতেই উপদেশ দিয়েছেন। প্রতিটি রচনায় আনুষঙ্গিক অনুচ্ছেদ সৃষ্টি করে বক্তব্য জুড়ে একটি মূল বক্তব্য মনে করিয়ে দিয়েছেন। পড়ুয়া আসলে নিজেকে খুঁজে পায় ফলে একটি ধ্রুপদী সত্য চিরকালের জন্য তার মনোলোকে আলোচিত হয়। ফলস্বরূপ বারবার পড়তে সবারই ভালো লাগে।




১৮৫৫ সালে রচিত বোধোদয। বিদ্যাসাগর বাস্তব জগতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই মনে করতেন প্রথমে অবিদ্যা আয়ত্ব করে শিক্ষা অর্জন করতে হবে। বিদ্যাসাগর পরিচিত ছিলেন সমকালীন সমাজের কুৎসিত আচার বিচারের সঙ্গে। শিক্ষা থাকলেও শুধু ব্যবহার করে নিজের সংকীর্ণ স্বার্থে। বেশকিছু বিশেষ স্বভাবের মানুষ নির্বিকারভাবে সচ্ছন্দে অসৎ জীবন যাপন করে। যার অবধারিত কুফল বর্তায় পরিবারে, সমাজে এমন কি দেশের আইনের উপরও। তাই বিদ্যাসাগরের সিদ্ধান্ত ছিল শিক্ষা জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে অবিদ্যা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। কারণ অর্জিত জ্ঞান যদি উপযুক্ত বোধ সঠিকভাবে চালিত না হয় সেই জ্ঞানের প্রয়োগ ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। যা সমাজে অহরহ ঘটছে। স্কুল থেকে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি অতি অবশ্যই শিক্ষায় প্রয়োজন অবিদ্যা । তাই রচনা করলেন বোধোদয়।

বোধোদয় কেন। বোধ কথাটা এসেছে বুধ থেকে। বুধ মানে জানা, জ্ঞান বাড়ানো। কিন্তু জ্ঞান আর বোধ কখনই এক নয়। জ্ঞান বিচ্ছিন্ন আকারে থাকে, কিন্তু তা যখন সমাজের সমগ্রতার সাথে সংশ্লিষ্ট হয় তখন বোধ-এর অংশ হয়। আমাদের রামায়ণ,মহাভারত ওই বোধ যুক্তি দিয়ে বোধ জাগ্রত করে। শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে বুঝিয়ে দেন এখানে প্রয়োজন ন্যায়বোধ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে কৌরব দের হারানো। বিখ্যাত লেখক উইলি ডুরান্ট, তাঁর হিস্টোরি অব ফিলোজোফি গ্রন্থে লিখেছেন, আমাদের জ্ঞানই আমাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারে যদি বোধ না জাগ্রত হয়। সুতরাং বোধ (wisdom) ও জ্ঞান (knowledge) মানবসভ্যতায় উভয় উভয়ের পরিপূরক।

( ক্রমশ...)


আগের পর্ব -



39 views0 comments

Commentaires


bottom of page