রাত এগারোটার পর........
মৌপর্না আচার্য্য
নতুন ফ্ল্যাটে এসে সব ঘর গুলো ভালো করে দেখতে লাগল স্মিতা। ফ্ল্যাট এজেন্ট ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করল - কি সব ঠিক আছে তো?
একটু হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করল ফ্ল্যাট এজেন্ট।
হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে বলে স্মিতা। সবই ঠিক আছে তবে জলের একটু সমস্যা হতে পারে মাঝেমধ্যে মাথা নারতে নারতে বেলে ফ্ল্যাট এজেন্ট । আপনি চিন্তা করবেন না নিচে দারোয়ানকে বললে সে প্লাম্বার ডেকে দেবে বুঝতেই তো পাচ্ছেন সদ্য রিনোভেট হল কি না....
ঠিক আছে তবে কোন কিছু সমস্যা হলে আপনি দারোয়ানকে বলতে পারেন সে আপনাকে সাহায্য করবে। হ্যাঁ ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই তাছাড়া আপনার নাম্বার তো আছেই - উত্তর দিল স্মিতা। ফ্ল্যাট এজেন্ট চলে যাচ্ছিলো ঠিক এমন সময় হঠাৎ করে সে আবার পিছু ঘুরে স্মীতাকে একটু গম্ভীর স্বরে বলল - দিদিমণি যা দরকার 11 মধ্যেই কিন্তু সারবেন এগারোটার পর একদম রুমের বাইরে বেরোবেন না। স্মিতা হঠাৎ কৌতুহলী হয়ে ওঠে এবং জিজ্ঞাসা করে , কেন বলুনতো 11 টার পরে বেড়ানো যাবে না? ফ্ল্যাট এজেন্ট আবার মিশুকে মুখে বলে ওঠে ওই এগারোটার পর আমরা লিফট অন রাখি না তাই আর কি।স্মিতা একটু অবাক হয়েই বলে ফ্ল্যাটে তো যেকোনো কারণে সমস্যা হতে পারে!! ফ্ল্যাট এজেন্ট একটু হেসে বলেন, এতে সমস্যা তেমন কারোর হয় না সকলেই মানিয়ে নিয়েছে। আপনি কয়েকদিন থাকুন সব বুঝে যাবেন এই বলে ফ্ল্যাট এজেন্ট হাসতে হাসতে চলে যায়।
এরপর স্মিতা চলে যায় ফ্রেস হতে। ছোটবেলায় বাবা মা হারানো স্মিতা দাদু দিদার কাছে বড় হয়েছে। ছোটবেলা তার খুব একটা ভালো কাটেনি। কাজের সূত্রে শহরে আসা, ভালো ফ্ল্যাট বাড়ি কিনতে চাইলেও দামে পেরে ওঠে না স্মিতা তাই আর কি মূল কলকাতা শহরের থেকে একটু পিছিয়ে এসে কেনা এই ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটটা তেমন একটা পছন্দসই না হলেও স্মিতা ঠিক মানিয়ে নেবে।আগাগোড়াই স্মিতার মানানসই এর এক দারুন ক্ষমতা আছে। তবে স্মিতার নিজের ঘরের ব্যালকনিটা বেশ লেগেছে। তাই বিকেলে এককাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে তার মনে পড়ে যায় ফ্ল্যাট এজেন্টের কথাগুলো। তবে একটা জিনিস নিয়ে সে হঠাৎ ভাবতে থাকে।ফ্ল্যাটের সবকটা ফ্লোরের বিষয়ে বললেও 5th ফ্লোরের কথা কিছুই বললেন না তিনি। হয়ত ভুলে গেছেন এজেন্ট, এসব নিয়ে বেশি কিছু না ভেবে সে উঠে পড়ে মনে পড়ে সব গুছিয়ে নিয়ে আজ তাড়াতাড়ি ঘুমতে হবে তাকে কাল সকালে আবার অফিস।এই ভেবে কফি মাগটা হাতে নিয়ে যেই সে ঘড়ের দিকে যেতে যাবে হঠাৎ যেন তার মনে হল পাঁচতলার ব্যালকনি থেকে একটা বাচ্চা দৌড়ে গেল ভালো করে দেখতেই সে আর কিছু দেখতে পায় না।তবে হ্যাঁ এই ব্যালকনিটা বড্ড নোংরা অনেক শুকনো পাতা ও ধুলো-ময়লা পড়ে আছে যেন কতকাল এই ব্যালকনিতে কোন মানুষের পা পড়েনি। ব্যালকনির মালিক যেন কত স্মৃতি জমা করে গেছে এইখানে।আর এত কিছুর মধ্যেই এই ব্যালকনিটা শুধু পরিতক্ত নয় ভয়ানক বটে কারণ একে দেখলে মনে হয় এক কালে যেন আগুনে পুড়েছে এখন তাকে একটু ঘষে মেজে সুন্দর করা হয়েছে। হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাতাস আবার স্মিতাকে মনে করিয়ে দিল অফিসের কথা।কিছু কাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়ে স্মিতা। পর দিন রাত আটটা নাগাদ সে অপর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ঢুকছিল ফ্ল্যাটে ।হঠাৎ যেন তার মনে হলো পাঁচতলার ব্যালকনিতে একটা ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার দিকে হাত নাড়ছে। অন্যমনস্ক হয়েছিল তখন সে ভালোভাবে চশমার কাঁচ দুটো মুছে উপরের দিকে তাকাতেই সব যেমন কি তেমন কেউই নেই সেখানে সে হয়তো ভুল দেখেছে এই ভাবতে ভাবতে ঘরের চাবি টা খুলল।এরপর ফ্রেশ হয়ে এসে জল খেতে যাবে ঠিক এমন সময় হঠাৎ দরজার বেল বেজে ওঠে সে বোতলটা রেখে দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলতেই দেখে একটি মেয়ে হাতে একটি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে থেকি মেয়েটি বলে -নমষ্কার। আমার নাম বিদীপ্তা, আমি ওই কোনার ঘরে থাকি।
স্মিতাও নমষ্কার করতেই, মেয়েটা আবার একগাল হেসে বলে কি আমায় ভেতরে আসতে বলবে না? স্মিতা বলে হ্যা,হ্যা আসো। স্মিতা একটু শান্ত স্বভাবের, অত একটা মিশুকেও নয় তবে বিদীপ্তাকে দেখে তার বেশ ভালোই লাগল।স্মিতা বিদীপ্তাকে সোফায় বসতে বলে।সোফায় বসে বিদীপ্তা একবার চারপাশটা দেখে নিয়ে বলে ও তুমি বুঝি একাই থাক!! স্মিতা একটু হেসে বলে হ্যা।ততক্ষনে সে দুজনের জন্য কফি নিয়ে এসেছে। বিদীপ্তা তাকে জিজ্ঞেস করে তোমার কি ভয় লাগে না স্মিতা?স্মিতা বলে একদমই না।আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? তুমি কি আর্মি?স্মিতা বুঝতেই পারে সে সাউথ কোরিয়ার ফেমাস ব্যান্ড বি.টি.এস এর কথা বলছে। যারা বি.টি.এস পছন্দ করে তাদেরকে আর্মি বলে। মাথা নেড়ে না বলে স্মিতা।বিদীপ্তা বলে আমার বি.টি.এস ব্যান্ডটা খুব ভালো লাগে, আমার খুব ওদের সাথে দেখা করার ইচ্ছে ছিল তবে তা আর হল কোথায়!!!একটু গম্ভীর সুরে বলে বিদীপ্তা।স্মিতা কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় বিদীপ্তা বলে - তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো এখানে? না তেমন একটা না বলে স্মিতা। ফ্ল্যাট এজেন্ট তোমাকে সব বলেছে আশা করি এই ঘরের নীচের ঘরে থাকত রিমি আর ওর মা।ওরা খুব ভালো ছিল।বাচ্চাটিকে আমি খুব স্নেহ করতাম তবে একদিন ওর বাবা এসে সব তছনছ করে দিল। আর সেদিনই সব শেষ হয়ে গেল।ওর কথায় একটা আলাদা দুঃখ'ই যেন দেখতে পাচ্ছিল স্মিতা।স্মিতা জিজ্ঞেস করে কেন এমনটা কেন হল? সাইকো ছিল লোকটা ওর ভয়েই রিমি আর রিমির মা এখানে চলে এসেছিল সেদিন ও নিজের সাথে রিমি আর রিমির মা'কে নিতে এসেছিল কিন্তু ওরা যেতে না চাওয়ায় সব শেষ করে দিল ওই সাইকো। থাক এসব......... আচ্ছা আজ তবে উঠি দেড়ি হলে দিদি আবার চিন্তা করবে। এতক্ষণে স্মিতা জানতে পারল বিদীপ্তার একটা দিদি আছে। বিদীপ্তা চলে যেতে স্মিতা আর দেরি করে না জলদিই কাজ সেরে শুয়ে পরে সে।পরদিন স্মিতার অফিসে একটা পার্টি ছিল। একটু ড্রিংক করার কারণে পার্টি সেরে আসতে দেড়ি হয় স্মিতার। মেইন গেট খুলে ফ্ল্যাটের ভেতরে যখন সে ঢোকে তখন রাত প্রায় ১১টা। ফ্ল্যাট এজেন্ট তাকে বলেছিল রাত ১১ টার পর যেন লিফট না ব্যাবহার করে এবং ঘরের বাইরেও যেন না বেড়োয়। তবে তা সব ভুলে স্মিতা লিফটে ওঠে। স্মিতার রুমটি 6থ ফ্লোরে, তবে লিফট থেমে যায় 5থ ফ্লোরে। ড্রিংক করে থাকার কারণে সে ভাবে হয়ত তার ফ্লোর এসে গেছে। সে নেমে একটু অবাক হয়ে যায় কারণ যে ফ্লোর সে দেখে গেছে তার সাথে এর যেন কোনো মিল নেই।তবে সে বেশি একটা না ভেবে রুমের দড়জা খুলতে যাবে এমন সময় তার যেন মনে হয় রুমের দড়জা আগে থেকেই খোলা ছিল হালকা ধাক্কা দিতেই দড়জাটা পুরো খুলে যায়। সে দেখে কাল যে ছোট মেয়েটিকে সে দেখেছিল সেই মেয়েটি সোফার ওপর বসে পা দুলাচ্ছে।দেওয়াল ঘড়িতে রাত ১১টা বেজে দশ। রান্না ঘর থেকে বাচ্চাটার মা খাবার নিয়ে তাকে খাওয়াতে যাচ্ছে,প্রথম গ্রাসটা মুখে তুলতে যাবে এমন সময় কলিং বেল টা বেজে উঠল। দড়জা খুলে মহিলা যেন কোন অপ্রত্যাশিত ব্যাক্তি কে দেখেছে তাই সে যেন ঘরে ঢুকতে দিতে চায় না লোকটিকে তবে লোকটি দড়জা ধাক্কা দিতেই মহিলা ছিটকে মেঝেতে পরে যায়। লোকটি বেশ মধ্য বয়ষ্ক, চুলটা উস্কোখুস্কো, মুখটাও ভারি অদ্ভুত কেমন যেন সাইকোদের মতন। ঘার নীচু করে মহিলা র হাত টেনে কি যেন বলছে। মহিলা নিশ্চুপভাবে কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল অঝোরে কাঁদতে থাকে। লোকটি এবার মাথায় হাত দিয়ে সোফায় ধপ করে বসে। বাচ্চা মেয়েটি এসব দেখে ভয়ে কেঁদে চলেছে। এবার লোকটা হঠাৎ করে উঠতেই বাচ্চা মেয়েটিকে টানতে টানতে নিয়ে যায় ব্যালকনিতে। পেছনে বাচ্চাটির মা'ও দৌড়ে যায় কিন্তু লোকটি তাকে জোরে ধাক্কা মারতে মহিলাটির মাথা দেওয়ালে লাগে এবং মহিলা কিছুক্ষণের জন্য অসার হয়ে পড়ে থাকে।এদিকে লোকটি নিঃহৃদয় এর মতন ছোট্ট বাচ্চাটিকে পাঁচতলার ব্যালকনি থেকে নিচে ফেলে দেয়।ইতিমধ্যে বাচ্চাটির মায়ের কিছুটা হুশ ফিরে আসে। তবে ততক্ষনে অনেক দেড়ি হয়ে যায় বাচ্চাটি পাঁচতলায় বেলকনি থেকে পড়ে মারা যায়। লোকটি এটুকুতে শান্ত হয় না সে বাচ্চাটির মা কেও জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেয়। নিজে জ্বলতে থাকলেও ব্যালকনির দিকে কোনোরকমে ছুটে আসে মহিলা শুধু তার মেয়েকে শেষবারেরমতো দেখবে বলে। ধীরে ধীরে ব্যালকনিও জ্বলে ওঠে।স্মিতা হঠাৎ দেখে বিদীপ্তা এসেছে এখানে সে ড্রয়িং রুমে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভেতরের ঘরে ঢোকে। ঢুকেই এমনভাবে আগুনে জ্বলতে থাকা একটা দেহ দেখে কিছু বুঝতে পারে না সে ভয়ে পুলিশকে ফোন করতে যাবে এমন সময় সেই লোকটি পিছন থেকে এসে তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সেও মারা যায় । তিন-তিনটি খুন করার পর লোকটি এমন ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় যেন কিছুই হয়নি, সে যেন কিছুই যানে না।
এবার যেন সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে স্মিতার কাছে,মাথাটা কেমন ব্যাথা ব্যাথা করছে তার। এরপর চোখ খুলতে সে নিজেকে নিজের ঘরের মেঝেতে পায়।আজ রবিবার তার অফিস নেই স্নান সেরে এই বিষয়ে ভাবছিল,কি দেখেছিল সে কাল রাতে ওটা কি সত্যি না স্বপ্ন কি ছিল ওটা!!! আর যদি সত্যিই হয় তবে দুদিন আগে যে তার সাথে দেখা করতে এসেছিল তবে কে সে?আর বেশি কিছু না ভেবে স্মিতা ওর ফ্লোরের কোনার ঘরটায় চলে যায়। গিয়ে দড়জায় কলিং বেল বাজাতেই একটা মেয়ে দড়জা খোলে। সে ভালোভাবে দেখে নিয়ে একবার ভাবে এত বিদীপ্তা নয় !! আর কিছু না ভেবে সে বলে আমি স্মিতা আপনাদের ফ্লোরেই থাকি একটু বিদীপ্তার সাথে দেখা করা যাবে?
কথাটা শুনে মেয়েটি হকচকিয়ে ওঠে। স্মিতাকে ঘরে আসতে বলে সোফায় বসতে বলে মেয়েটি, তারপর বলে আমার নাম সমর্পিতা, আমি বিদীপ্তা'র দিদি। তবে তুমি বিদীপ্তাকে কি করে চিনলে?
স্মিতা বলে দুদিন আগে ও আমার রুমে এসেছিল। একথা শোনা মাত্র সমর্পিতার চোখ বিষ্ফারিত হয়ে যায়। সে বলে এটা কি করে সম্ভব আজ দুবছর হল বিদীপ্তা নেই বলে দেওয়ালে রাখা একটা ফটোর দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে সমর্পিতা। স্মিতার ছবিটাতে চোখ পড়তেই সে যেন সেখানেই স্থির হয়ে যায়।
Ashadharan likhechhis Mouparna.