top of page
Search
agantukpotrika

বিশেষ সংখ্যা ।। ভয় ভৌতিকে ।। অনন্যা দাস মণ্ডল


কায়াহীনের কর্তব্য


অনন্যা দাস মণ্ডল


 

“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে!

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে!!”


- এই প্লিজ ! এই নেকু নেকু গানগুলো গাস না তো!

- তুই গানের কি বুঝিস? ঐ মাথা দুলিয়ে ভেঁড়ার মত চেঁচানো টা মোটেই গান না।

- ধুস ! এই প্যানপ্যানে গান শুনলে ঘুম ধরে যায়।

- তোদের দোষ নেই। পাশ্চাত্যকে নকল করতে গিয়ে, আপন সংস্কৃতিকে ভুলে গেছিস। কাজী নজরুল ইসলাম, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এনাদের মর্ম তোরা বুঝবি না।


চলন্ত ট্রেনের মধ্যে অনীক এবং শর্মিষ্ঠার বাকবিতন্ডা চরমে। সৃষ্টি, সৌপর্ণ, কৌস্তব পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে, অতি কষ্টে দুজনকে শান্ত করতে সক্ষম হয়। পাঁচজনেই হরিহর আত্মা, ওদের যত তাড়াতাড়ি মনোমালিন্য হয়, ঠিক তত তাড়াতাড়ি আবার মিটিয়েও যায়। প্রত্যেকেই উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এক বছর আগে পাঁচ জনে পাড়ি দিয়েছিল বড় শহরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। বিষয় এবং কক্ষ এক হওয়ায় বন্ধুত্ব হয়েছিল স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই।


বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিন ছুটি ঘোষিত হয়েছে, সুবর্ণ সুযোগ। পঞ্চপান্ডব বেরিয়েছে পাহাড় ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। প্রস্তাবটা ছিল কৌস্তবের । সে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানতে পারে এক নাম না জানা পাহাড়ের কথা। যেখানে রয়েছে বেশকিছু মূল্যবান ঔষধি গুন সম্পন্ন গাছগাছালি । এখান থেকে প্রায় বারো ঘন্টা ট্রেনে, তারপর পাঁচ ঘন্টা আঞ্চলিক কোন যানবাহনে, এরপর পায়ে হেঁটে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা। একবার পৌঁছে যেতে পারলেই পাহাড়ের শীর্ষে অধিষ্ঠান করে, প্রকৃতির রসাস্বাদন এবং ঐ ঔষুধি গাছ গুলিকে খোঁজার প্রচেষ্টায়, বেশ রোমাঞ্চকর কাটতে চলেছে দিনগুলি।


ট্রেন যখন গন্তব্যে পৌঁছাল তখন বেলা এগারোটা। স্টেশনটা একেবারে ছিমছাম। একটি টিকিট ঘর, শৌচালয় ছাড়া, আপ-ডাউনের দুটি রেললাইন ও তাদের ব্যবহারের জন্য দুই প্ল্যাটফর্ম। টিকিট কাউন্টারের পাশ দিয়েই নেমে গেছে একটি মোরাম রাস্তা। স্টেশন একেবারে ধু ধু মাঠ । সম্ভবত পঞ্চপান্ডব ব্যতীত কেউই এই স্টেশনে নামেনি। অনীক এবং কৌস্তব এগিয়ে যায় টিকিট কাউন্টারের উদ্দেশ্যে। তথ্য আহরণের পর কৌস্তব জানায়, “শোন, লোকাল লোকেরা ট্রেন মারফত খুব একটা যাতায়াত করে না। দিনে মাত্র দুটি ট্রেন আপডাউন করায়, তাদের যাতায়াতের মাধ্যম মূলত সড়কপথ। এখন সমস্যা হচ্ছে ট্রেন দুই ঘন্টা লেট হওয়ায় , একটাও ভ্যান রিক্সা নেই। অতএব দুই কিলোমিটার এগারো নম্বর বাসে চড়ে পৌঁছাতে হবে মূল সড়কে”।


দুই প্রান্তে জংলি ছোট-বড় গাছ, মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলেছে একটি মোরাম রাস্তা, পরিবেশ নয়নাভিরাম। ভাগ্যক্রমে কিছু দূর হাঁটার পরেই আগমন ঘটে একটি ভ্যান রিক্সার। যার সাহায্যে সড়কপথের কিনারে পৌঁছাতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। ভ্যান চালকের তথ্য অনুযায়ী, তাদের গন্তব্য স্থল অত্যন্ত দুর্গম। মূল সড়ক পথ থেকে বামদিকে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে একটি বাজার। সেখান থেকেই কাক ভোরে একটি এবং বেলা সাড়ে বারোটায় একটি ট্রেকার যায়। যাদের গন্তব্য অবশ্য রিংচা গ্রাম। যা এই পাহাড়ের পাদদেশ অতিক্রম করেই পৌঁছাতে হয়। ভ্যান চালক সময় মতো তাদের ট্রেকারে বসিয়েও দেয় । ওরা বাজার থেকে বেশকিছু খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে নেয়। কৌস্তব একটি সিগারেটের বিনিময়ে ট্রেকার চালকের সঙ্গে খোস গল্প জোড়ে । ট্রেকার চালক যেই মুহূর্তে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হয়, পরমুহুর্তেই মুখটি বজ্র কঠিন হয়ে ওঠে। তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেন ঐ পাহাড়ে যেতে। ঐ পাহাড়কে তাঁরা অপবিত্র বলে মনে করেন। পাহাড়টিকে কেন্দ্র করে প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার এলাকা একেবারে জনমানব শূন্য। জায়গাটি তাঁর দুই পুরুষ পূর্ব থেকেই পরিত্যক্ত। পাহাড়েটির শীর্ষে ছিল একটি কটেজ। যেখানে নির্মমভাবে একটি পরিবারকে হত্যা করা হয়। লোকমুখে প্রচলিত এই পাহাড় নাকি বর্তমানে সেই আত্মাদের বাসস্থান। এর আগে যারাই এই পাহাড়ে উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই ফিরে আসেনি। অথবা ফিরে এলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। চিন্তিত মুখে কৌস্তব ট্রেকারের পিছনে বন্ধুদের পাশে এসে বসে পড়ে।


ট্রেকার যখন পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছায়, তখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। ট্রেকার চালক কৌস্তবকে উদ্দেশ্য করে পুনরায় সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন-

- বাবুজি একবার ফিরসে সোচ লিজিয়ে!

- টেনশন মাত লিজিয়ে হামলোগ আপনা খায়াল রাখেঙ্গে।

- হামারে সাথ আপলোগ রিংচা চালিয়ে! ছোটাসা গাঁও হ্যা, পার বহোত সুন্দর হ্যা।

- জারুর জায়েঙ্গে, পার ইঁহাপে হামারা কুচ কাম হ্যা।

- জেসি আপকি মার্জি ! চালতে হে বাবুজি। উপারওয়ালে নে চাহা তো ফির মুলাকাত হোগি।

- জারুর জারুর! নামাস্তে।


ট্রেকারটি দৃষ্টির অগোচর হতেই কৌস্তব প্রশ্নবানে বিদ্ধ হয়। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক ঘটনা সে বন্ধুদের জানায়। অপ্রত্যাশিত ভাবেই প্রত্যেকেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। বিজ্ঞানের যুগে কেউই এসব ভিত্তিহীন কথাকে প্রশ্রয় দেয় না। স্থির হয় পরেরদিন কাক ভোরে শুরু হবে তাদের পাহাড় অভিযান। প্রবাহমান নদীর তীরে রান্না-খাওয়ার পর্ব সাঙ্গ করে, দুটি তাঁবু মধ্যেই সকলে শুয়ে পড়ে। সারা দিনের ক্লান্তিতে নিদ্রাদেবী চোখে ভর করতে বিন্দুমাত্র সময় নেয় না।


রাত তখন দুটো। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে, অনীক তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসে। অনতি দূরেই হালকা হয়ে, ফেরার সময় দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় পাহাড়ের দিকে। কুয়াশাবৃত পাহাড়, চারিদিক অস্বাভাবিক রকমের শান্ত, বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। হঠাৎই একটা রাতচরা পাখির শব্দে চমকে ওঠে। ঠিক যেন তার মাথার উপর দিয়েই উড়ে গেল। দূরে কোথাও একটি বন্যজন্তু হুউউউউ শব্দে ডেকে উঠল। গা-টা ছমছম করে উঠল অনীকের। পাহাড়ের শিখরে যেন একটি আগুনের হলকা দেখতে পেল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে কেউ যেন খুব দূর থেকে ওকে প্রত্যক্ষ করছে। কিন্তু এই পাহাড় তো পরিত্যক্ত! তাহলে? চোখ দুটো ভালো করে কচলে আবার তাকালো না! তেমন কিছুই তো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না! মৃদু হেসে , মনে মনে ভাবল হয়তো মনের ভুল। বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল তাই তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়ল।


পরিত্যক্ত পাহাড়ে আগাছা পরিষ্কার করতে করতে শিখরে পৌঁছাতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে ওদের। ফেরার সময় দ্রুত অবতরণের জন্য গাছ গুলি চিহ্নিতকরণে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। শিখরে পৌঁছেই পাথরের উপর শরীর এলিয়ে দেয় পাঁচজনে। অংক অনুযায়ী যে পাহাড় চড়তে চার ঘন্টা লাগার কথা, সেখানে প্রায় ছয় ঘন্টা কেটে যায়। উপরন্তু কিছুটা ওঠার পরেই, হঠাৎ এক বৃদ্ধ তাদের সম্মুখে পথ আগলে দাঁড়ায়। বৃদ্ধটি খর্বাকার, কৃষ্ণবর্ণ, শীর্ণকায়, চোখ দুটো একেবারে কোটরে ঢোকা, কাঁচাপাকা লম্বা দাড়ি, অবিন্যস্ত লম্বা চুল কাঁধের উপর যত্রতত্র ছড়িয়ে। মুখ দেখে সঠিক বয়স আন্দাজ করা না গেলেও, শারীরিক কাঠামো এবং সামনে ঝুঁকে চলার প্রবৃত্তি দেখে বৃদ্ধ বলেই মনে হচ্ছিল। পরনে একটি আলখাল্লা পোশাক, হাতে একটি গাছের অদ্ভুত শুকনো ডাল। যার হাতলের উপরের অংশটা গোলাকার এবং সবুজ রঙের ছিল । তাকে দেখে সকলেই আঁতকে ওঠেছিল। বৃদ্ধটি হাত-পা নেড়ে পাহাড়ি ভাষায় কিছু বলছিল। যার অর্থোদ্ধার সম্ভব না হলেও, এটুকু বোধগম্য হয়েছিল, যে উনি এই পাহাড় থেকে নেমে যেতে বলছিলেন। শিখরের দিকে তাকিয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছু একটা দেখে, দ্রুত পাহাড় থেকে নেমে যেতে শুরু করেন। অথচ ওরা উপরের দিকে তাকিয়েও কিছু খুঁজে পায় নি।


একটু ধাতস্থ হয়ে প্রথমেই নিজেদের অস্থায়ী বাসস্থানটি তৈরি করে ফেলে সৌপর্ণ এবং সৃষ্টি। এরপর ঔষধি জরিবুটি খোঁজার উদ্দেশ্যে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে শুরু করে ওরা। সত্যিই এই পাহাড় দুষ্প্রাপ্য গাছের সম্ভার। এমন অনেক জরিবুটির দর্শন মেলে, যার নাম শুনলেও চক্ষু সার্থকের সৌভাগ্য এই প্রথম। জায়গা গুলি ওরা চিহ্নিত করে রাখে। কয়েকটি গাছ অবশ্য সংগ্রহও করে। একসময় একটি ভগ্নপ্রায় কটেজ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটু ইতস্তত করে প্রবেশ করে কটেজ টির ভিতর। দরজা জানালা এক সময় বর্তমান থাকলেও, আজ তা নিশ্চিহ্ন। দেওয়াল গুলি পাথরের তৈরি হওয়ায়, হয়তো এখনও টিকে আছে। কাঠের ফ্রেম করা ছাতের অধিকাংশই ভেঙ্গে গিয়েছে। যেখান থেকে পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়। ভিতরে পা রাখার সাথে সাথে সকলেরই একটু উষ্ণতা অনুভূত হয়।


সৃষ্টি:- ভাই এখানটা বেশ গরম রে, তাঁবুতে থাকার প্ল্যান ক্যানসেল করে এখানেই শিফট হয়ে যাই চল!

অনীক:- তোর মাথা খারাপ? খোলা আকাশের নীচে থাকবো বলে এসেছি শহরের কংক্রিট ছেড়ে।

শর্মিষ্ঠা:- হ্যাঁ তাঁবুতে থাকার মজাই আলাদা।

সৌপর্ণ:- এই বাড়িটা যারা বানিয়েছিল, ভাব তো কত সুন্দর জায়গায় থাকতো!


এদিকে কৌস্তব গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে কটেজের আরো অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সূর্যদেব সবে আস্তে চলে গেছে । মনে মনে ভাবে কটেজটা যখন সত্যিই এখানে আছে, তাহলে কি ট্রেকার চালকের কথাগুলোও সত্যি? ঐ বৃদ্ধিই বা কেন ঐভাবে পথ আগলে দাঁড়ালো? চিন্তার জাল ছিন্ন হয় একটি বাচ্চার হাসির শব্দে। পরিত্যক্ত এই বাড়িতে বাচ্চা? কি করে সম্ভব? শব্দটা আসছে দক্ষিণ দিকের ঘরের ভেতর থেকে। দৌড়ে যেতেই মনে হলো কে যেন জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেল। কিন্তু জানালার কাছে যেতে কাউকেই দেখতে পেল না। মনের ভুল ভেবে যখন ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে, আবার কিছু টুকরো শব্দ কানে আসে। এবার কৌস্তবের বেশ ভয় লাগে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা হাত তার কাধে স্পর্শ করতেই আঁতকে ওঠে কৌস্তব

- আরে আমি, আমি ! ভয় পেলি নাকি?

- ওহ সৌপর্ণ! আসলে একটু অন্যমনস্ক ছিলাম।

- চল ফেরা যাক।

- হুম !

- এই ফেরার আগের দিন আমরা এখানে থাকবো, কি বলিস ?

- ধুর এই পড়ো বাড়িতে কে থাকবে ?

- আমরা সবাই সেই আলোচনাই করছিলাম এতক্ষণ। কেন তোর আপত্তি কিসের?

- সে ভাবা যাবে, এখন চল তো!

**

রাত তখন বেশ গভীর, একটা কটু গন্ধে সৌপর্ণের ঘুমটা ভেঙে গেল। বোটকা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে। উঠে বসে দেখে, পাশেই অনীক এবং কৌস্তব নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। মনে মনে ভাবে কি করে ঘুমাচ্ছে রে বাবা? ওদের কি ঘ্রাণশক্তি বলে কিছু নেই? এদিকে গন্ধটা যেন উত্তরোত্তর তীব্র হয়ে উঠছে। সে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসে। আকাশ নক্ষত্রখচিত হলেও চাঁদের দেখা নেই। চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন, এবং অদ্ভুত রকমের একটা নিস্তব্ধতা বিরাজমান। গাছগুলো যেন মূর্তিমান প্রহরী। একটা উষ্ণ বাতাস তাকে স্পর্শ করে গেল। আচমকাই একরাশ কুয়াশা এসে ঘিরে ধরেছে চারিদিক। তাঁবুর বিপরীত দিক থেকে গন্ধটা আরো তীব্র হচ্ছে। মুখটা ঘুরাতেই হাড় হিম হয়ে গেল সৌপর্ণের। অনতিদূরে একটা অবয়ব যেন তার দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার ভালো দেখা না গেলেও সেটি যে একটি নারী মূর্তি তা সুস্পষ্ট। প্রচন্ড ভয় পেলেও, নিজেকে সামলে নিয়ে, কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে “কে? কে ওখানে”? অবয়বটি নিঃশব্দে পিছনের দিকে সরতে থাকে। সৌপর্ণ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে “কে আপনি? কোথায় যাচ্ছেন? দাঁড়ান”! বলতে বলতেই নিজের অজান্তেই বেশ খানিকটা এগিয়ে আসে। এরপরেই মনে হয় যেন অবয়বটি দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সৌপর্ণও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। একটা সময়, সে দৌড়াতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎই পিছন থেকে একটা হ্যাঁচকা টানে মাটিতে পড়ে যায় সে।

কৌস্তব:- কোথায় দৌড়াচ্ছিস তুই? তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে?

সৃষ্টি:- কখন থেকে আমরা তোকে ডাকছি! শুনতে পাচ্ছিস না?

শর্মিষ্ঠা:- আরেকটু হলে কি হতো বলতো?

সৌপর্ণ:- ঐ মহিলাটা....!

অনীক:- কোন মহিলা? তাকিয়ে দেখ চারিদিকে, কেউ কোথাও নেই। এই পাহাড়ে কেউ আসে না। আমরাই পাঁচজনেই আছি এখানে।

কৌস্তব:- তুই কি স্বপ্ন দেখছিলি? স্লিপওয়াকিং রোগ আছে নাকি তোর?

সৌপর্ণ:- উফ তোরা থামবি! ঐ মহিলা এই সামনেই ছিল!

অনীক:- কেউ ছিল না! ভালো করে দেখ একবার, আর এক পা এগোলেই খাদে পড়ে যেতিস।


রাত 12:30 মিনিট

ওরা সকলেই একটা তাঁবুর ভেতরে গোল হয়ে বসে আছে। সকলের মুখেই উদ্বিগ্নতা সুস্পষ্ট। সৌপর্ণ এবং অনীকের সমস্ত কথা শুনে, কৌস্তব বিকেলের অভিজ্ঞতা এবং ট্রেকার চালকের সম্পূর্ণ বক্তব্যটা সকলকে জানায়।

অনীক:- তুই আগে জানাসনি কেন?

কৌস্তব:- আমিও তোদের মতোই মনের ভুল ভেবেছিলাম। ট্রেকার চালকের কথায় বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম নিজের গ্রামে নিয়ে গিয়ে কিছু টাকা উপার্জন করতে চায় হয়তো। তাই এসব গালগল্প দিয়েছে।

শর্মিষ্ঠা:- কিন্তু আমার আর সৃষ্টির কোন রকম নেগেটিভ অনুভূতি এখনো পর্যন্ত হয়নি। হ্যাঁ ঐ বৃদ্ধাকে দেখে একটু ভয় পেয়েছিলাম বটে।


কথাটি শেষ হবার পূর্বেই সৃষ্টি যে জায়গায় বসে ছিল ঠিক তার পিছনে তাঁবুর কাপড়ে কিভাবে যেন আগুন লেগে যায়। ওরা দ্রুত তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসে। কিছু বোধগম্য হবার পূর্বেই সম্পূর্ণ তাঁবুটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আরেকটি তাঁবু দূরত্বে থাকায় রক্ষা পায়। কিন্তু ভীত সন্ত্রস্ত পাঁচ জনে অপর তাঁবুর দিকে এগোতেই , পরিস্থিতি বদলে যায়। দমকা হাওয়ায় তাঁবুটা লন্ডভন্ড হয়ে যেতে থাকে। হাওয়ার চাপে ওদের দাঁড়িয়ে থাকা পর্যন্ত মুশকিল হয়ে পড়ে । পাঁচজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মাটি কামড়ে বসে পড়ে। হাওয়ার চাপে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে অনীক বেশ খানিকটা দূরে প্রত্যক্ষ করে সেই ছায়ামূর্তিকে। চিৎকার করে বাকিদের জানালে, ওরা একত্রে দেখে সেই নারী অবয়বকে। কেশরাশি যেন হাওয়ার তালে সাপের ফনার মত দোদুল্যমান। অবয়বটি ক্রমশ নিকটে চলে আসে। সৃষ্টি সাহস করে জিজ্ঞাসা করে “কে আপনি? কেন এমন করছেন আমাদের সঙ্গে? আমরা তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি”। সাথে সাথেই ছায়ামূর্তিটি ঘড়ঘড়ে গলায় কিছু একটা বলতে থাকে। যার অর্থোদ্ধার সম্ভব না হলেও, ঐ কণ্ঠস্বরের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যে, ওরা বিপরীতমুখী হয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করে। একসময় ওরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখনই ঘটে আর এক বিপত্তি।


ওদের পাঁচ জনের সামনে পাঁচ রকম ভয়ঙ্কর মূর্তি আবির্ভূত হয়। অনীকের সামনে আসে ধূলো-বালি-মাটি সহযোগে দলাপাকানো একটি গোলক।যার উর্ধাংশ একটি নারীর অবয়ব ধারণ করেছে। একইভাবে সৃষ্টির সামনে আবির্ভাব ঘটে একটি আগুনের গোলাকের। কৌস্তবের সামনে আসে একটি জলের গোলক। শর্মিষ্ঠার সামনে আসে একটি ঘূর্ণায়মান বাতাসের গোলক। সৌপর্ণ সামনে আসে জমাট অন্ধকারের একটি গোলক, যার মধ্যভাগ একেবারে শূন্য। পাঁচটি গোলকের ধারকই পাঁচ নারী মূর্তি। এই মূর্তিমান সাক্ষাৎ মৃত্যুর মূর্তি প্রত্যক্ষ করে, ওরা পুনরায় বিপরীতমুখী হয়ে দৌড়াতে শুরু করে, এবং পুনরায় পাঁচজনে একত্রিত হয়। ধাবমান সাক্ষাৎ মৃত্যু কাছ থেকে একত্রেই আবার দৌড় লাগায়। একসময় এসে পৌঁছায় সেই পাথরের তৈরি পুরনো কটেজটার কাছে। প্রবাহমান স্রোতের বিপরীতে প্রাণ বাঁচাতে যেরকম মানুষ খড় কুঁটোকে আশ্রয় করে, ওরাও তেমনি এই কটেজটিকে আশ্রয় করে নেয়।


পিছনে ধাবমান সেই গোলক রূপি নারীমূর্তি গুলির সাক্ষাৎ না পেয়ে , ক্ষণিকের জন্য ভেবেছিল ওরা হয়তো সুরক্ষিত। পরক্ষনেই ওদেরকে ভুল প্রমাণিত করে কটেজের চারকোনায় আবির্ভূত হয় চারমূর্তি এবং পঞ্চম জন থাকে দরজার সম্মুখে। ঐ পাঁচ অবয়ব যেন চেয়েই ছিল ওরা এই কটেজটিতে আশ্রয় নিক। গগন বিদীর্ণ অট্টহাসি সহযোগে, পাঁচ মূর্তি ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে অপর পাঁচ মূর্তির উদ্দেশ্যে। ওরা দলবদ্ধভাবে ভয়ার্ত চোখে আসন্ন ভয়ঙ্কর মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকে। হঠাৎ করেই দরজার কাছে একটি কণ্ঠস্বর শুনে, মানব এবং অবয়ব উভয় পাঁচ মূর্তিই প্রত্যক্ষ করে, যে বৃদ্ধ তাদের এখানে আসতে বাধা দিয়েছিল, দরজার সম্মুখেই তিনি দণ্ডায়মান। হাতে থাকা লাঠিটি মাটিতে ঠুকে তারস্বরে চিৎকার করে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলে চলেছেন। সাথে সাথেই ঐ অবয়ব গুলি একত্রিত হয়ে ছিটকে চলে যায় কটেজের উত্তর দিকের কোনায় এবং হুংকার দিয়ে ওঠে। উভয়পক্ষে চলতে থাকে বাকবিতণ্ডা। সেই দুর্বোধ্য ভাষার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায়

- বাধা দিও না আমাদের, কেন এসেছ তুমি এখানে? এখনি চলে যাও এখান থেকে।

- না আমি তোদের আর এই হত্যালীলা চলতে দেব না।

- এটাই ওদের যোগ্য শাস্তি। হত্যালীলার কথা তোমার মুখে মানায় না। কোথায় ছিলে সেদিন, যেদিন আমাদের হত্যালীলার সাক্ষী ছিলো কেবল মাত্র এই প্রকৃতি?

- মানছি কিছু করতে পারিনি। তাই বলে এইভাবে নিরীহ মানুষদের হত্যা করবি তোরা?

- তুমি একে হত্যা বলো, আমরা বলি প্রতিশোধ।

এই ববাকবিতন্ডর অর্থ বুঝতে পারলে, সৃষ্টিরা একটি করুণ কাহিনী উপলব্ধি করতে পারত। কাহিনীটি একটি সুখী পরিবারের, যারা জঙ্গলকে ভালোবেসে এই পাহাড়ের শীর্ষে বানিয়েছিলে একটি সখের বাড়ি। পরিবারে ছিল এক ছেলে, স্বামী হারা এক মেয়ে, মা, ছেলের স্ত্রী এবং ছেলেটির দুই কন্যা সন্তান। আয়ুর্বেদ চর্চা ছিল বংশপরম্পরায় তাদের রুজি-রুটি। তবে শহরে জীবন ছেড়ে এই জনমানবহীন পাহাড়ের শীর্ষে চিরস্থায়ী বসতি স্থাপনের একটি অন্য কারণ ছিল। বড় মেয়ে আয়ুর্বেদ শিক্ষা গ্রহণ করার পর নিতান্ত সখের বশেই, বিভিন্ন জরিবুটি একত্রিত করে। শংকর প্রজাতির জরিবুটি সৃষ্টির চেষ্টা করে এবং সাফল্যও লাভ করে। এমন কিছু জরিবুটি সৃষ্টি করে ফেলে, যা মানব শরীরের যেকোনো রোগ ব্যাধি অবিলম্বে দূর করতে এবং চিরতরে নির্মূল করতে সক্ষম। এই কথা লোকমুখে প্রচার হতেই ঘিরে ধরে শকুনের দল। কেউ টাকার লোভ দেখিয়ে আত্মসাৎ করতে চায় শংকর প্রজাতির জরিবুটি সৃষ্টির ফর্মুলা, কেউবা ঘুরিয়ে নাক দেখিয়ে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হতে চায়। কিন্তু পরিবারের বড় মেয়ে খুব ভালো করেই জানত, কিছু গাছ থেকে যেমন রোগ নিরাময় সম্ভব, তেমনি কিছু গাছ থেকে মরণব্যাধির জন্ম দেওয়া সম্ভব। মানুষের মত স্বার্থান্বেষী প্রাণী যে ভালোর থেকে মন্দের খোঁজ বেশি রাখে একথা বলা বাহুল্য। সেহেতু সে নিজেই তার সৃষ্ট সমস্ত শংকর গাছগুলি সমূলে ধ্বংস করে ফেলে। ভাবে পরবর্তীকালে পুনরায় সৃষ্টি করে, মানুষের হিতের জন্য ব্যবহৃত গাছগুলি, কোন উপযুক্ত সংস্থার হাতে তুলে দেবে। শকুনের দল গাছগুলি না পেয়ে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে, এবং পরিবারের ক্ষতি করার চক্রান্ত করে। এই ঘটনার বহু পূর্বেই তারা এই নির্জন পাহাড়ে কটেজটি বানিয়েছিল। কিন্তু আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচতে তারা নিরুপায় হয়ে এখানে এসেই আশ্রয় নেয়। শহুরে শকুনের দল বহু প্রচেষ্টাতেও তাদের সন্ধান রতে পারেনি। এইভাবে কেটে যায় দুই বছর। বড় মেয়ে পুনরায় সেই সমস্ত শংকর প্রজাতির গাছ সৃষ্টি করে, এই নির্জন পাহাড়ে বিভিন্ন প্রান্তে তাদের সযত্নে লালিত করতে থাকে। একদিন যখন মেয়েটির বাবা কর্মসংস্থানের জন্য, অন্য পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়, ঠিক তখনই একদল শকুনের আবির্ভাব ঘটে। কিভাবে যেন তারা খোঁজ পেয়ে যায় এই পরিবারটির। পাঁচটি নারীর উপর চলে অকথ্য অত্যাচার। তবুও কেউ গাছের সন্ধান ওদের দেয় না। তারপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে ওঠে। ছোট মেয়ের নিথর রক্তাক্ত দেহ দেখে দিদি, মা, পিসি এবং ঠাকুমা কান্নায় ভেঙে পড়ে । এরপর একপ্রকার বাধ্য হয়েই পরিবারের বড় মেয়েটি মানুষের হিতের জন্য ব্যবহৃত একটি জরিবুটির সন্ধান দেয়। তবুও রেহাই পায়না । বড় মেয়ের সামনে একে একে প্রত্যেককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সর্বশেষে মেয়েটিকে এই বলে হত্যা করা হয় যে, তাকে এবং তার বাবাকে মেরে এই পাহাড়ের দখল নেবে সেই শকুনের দল। তাদের বিশ্বাস মেয়েটি কেবল একটি মাত্র জরিবুটি সৃষ্টি করেনি, আরো অনেক রয়েছে তার সৃষ্টির তালিকায়। মেয়েটি মৃত্যুর পূর্বে বলে, সে বেঁচে থাকতে যেটা হতে দেয়নি, মরণের পরেও তা কখনোই হতে দেবে না। কথা মতো আজও এই পাহাড় তথা অমূল্য জরিবুটি গুলির রক্ষা করে চলেছে এই পরিবারটি।


এটুকু কথোপকথনের পর উভয় পক্ষই কিছুক্ষন মৌনব্রত পালন করে। বৃদ্ধটি অবয়ব গুলির দিকে ছলছল চোখে এগিয়ে যায়। অনতিদূরে হাঁটু মুড়ে বসে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। হাতে থাকা লাঠিটি পাশে রেখে কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে “ওরে আমি সব জানি। আমিও যে সেদিন কাজের সন্ধানে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে ঘটে একটা অ্যাক্সিডেন্ট । অত্যন্ত সংকটজনক অবস্থায় প্রথমে হসপিটাল এবং তারপর একজন সহৃদয় ব্যক্তির বাড়িতে প্রায় এক মাস কাটানোর পর আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হই। তোদের জন্য প্রাণ ছটপট করলেও কাউকেই বিশ্বাস করে ঐ পাহাড়ের সন্ধান দিতে পারিনি। নিজে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে এই পাহাড়ে ফিরে আসতে সময় লাগে প্রায় দেড় মাস। এসে যে দৃশ্য দেখি তাতে আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। এতগুলো মানুষের পচা-গলা দেহাবশেষ এবং কটু গন্ধ আমি অস্থির হয়ে উঠি। চেয়েছিলাম তোদের দেহের অন্তিম সংস্কার করতে, কিন্তু নিয়তি সেই সুযোগটাও দেয়নি”।

বৃদ্ধর কান্নায় অবয়ব গুলির রোষও কিছুটা স্তিমিত হয়। কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধটি নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলে ওঠেন, “মা রে, এরা নিতান্তই ছোট ছেলে মেয়ে । এখানে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি রে। ওদের যেতে দে”। একথা শুনেই তারা আবার ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। নিমেষের মধ্যে বিভিন্ন ছোট ছোট উদ্ভিদের সমূলে উৎপাটিত দেহাবশেষ সকলের সামনে আছড়ে পড়ে। আত্মাগুলি সমস্বরে বলে ওঠে, “কোনভাবেই নিষ্পাপ নয় এরা। আর এক শকুনের দলের এরা। এই সমস্ত জরিবুটি সংগ্রহের জন্যই এসেছিল”। কৌস্তবরা অবাক দৃষ্টিতে দেখে তাদের সংগ্রহ করা জরিবুটি গুলি তাদেরই সামনে কিভাবে জানো পড়ে আছে। আত্মা গুলি হুংকার দিয়ে বলে ওঠে “দুরভিসন্ধি নিয়েই এরা এখানে এসেছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই গাছগুলি। আমাদের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়নি ঠিকই, কিন্তু এদের জীবিত পঞ্চত্ব প্রাপ্তির ব্যবস্থা আমরা করব”।


বৃদ্ধটি অবাক হয়ে অনীকদের দিকে তাকান। ধীরে ধীরে উঠে এসে গাছগুলোর দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে রাগান্বিত স্বরে কিছু জিজ্ঞাসা করেন। কৌস্তবের আর বুঝতে বাকি নেই যে, সমস্যাটা কোথায়? সে ইশারায় বোঝাবার চেষ্টা করে যে তারা উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী । নেহাত অনুসন্ধানী মনোভাব নিয়েই এই পাহাড়ে এসেছিল। যদি কোন জরিবুটি পাওয়া যায়, যা মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়, সেই জন্য। সাহস করে ধীরে ধীরে গাছগুলি হাতে তুলে নিয়ে অবয়ব গুলির দিকে কাঁপা হাতে এগিয়ে দিয়ে আবার বলে ওঠে, “আমাদের এই গাছের প্রয়োজন নেই। আমরা কেবল কয়েক দিনের জন্য ছুটি কাটাতে এসেছিলাম। কোন ভুল করে থাকলে আমরা আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী”।


বৃদ্ধটি তাদের কথা একটু হলেও বুঝতে পারেন। ইশারায় অবিলম্বে তাদের এই পাহাড় থেকে নেমে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই অতৃপ্ত আত্মার দল রুষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের শিকারের উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঠিক সেই মুহূর্তেই বৃদ্ধটি তার হাতে থাকা দণ্ডটি সবার সামনে তুলে ধরে। অনীকরা বৃদ্ধের পিছনে এসে আশ্রয় নেয়। আত্মা গুলি বৃদ্ধটিকে পথ ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলে, বৃদ্ধটি জানায়, এইভাবে নিরীহ প্রাণ হত্যা করে সে তাদের পাপাত্মায় পরিণত হতে দেবে না। বৃদ্ধের নির্দেশে সৃষ্টিরা ততক্ষণে দৌড়াতে শুরু করেছে। বৃদ্ধ ব্যক্তিটি ভগ্নপ্রায় কটেজের মধ্যেই আত্মাগুলিকে আটকে রাখার চেষ্টা করে। ওরা ছুটতে ছুটতে কতবার যে অন্ধকারের মধ্যে পড়েছে, কার কোথায় কেটেছে, কোন জ্ঞান নেই। দিনের আলোয় যত্রতত্র ঘোরার ফলে এইটুকু ধারণা ওদের ছিল যে, কটেজ থেকে ঠিক কোন দিকে দৌড়ালে পাহাড়টির রাস্তার দিকের পাদদেশে নামা সম্ভব। মস্তিষ্কে চলছিল একটি ভাবনা এই পাহাড় থেকে যত দ্রুত সম্ভব নীচে নেমে যাওয়া। তাই প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিল ওরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। পাহাড় থেকে নামার খানিকটা আগেই তাদের মনে হয়, অসম্ভব শক্তিশালী এক প্রলয় যেন ধেয়ে আসছে তাদের পিছনে। ছোট-বড় পাথরের কোনোটা তাদের পাশ কাটিয়ে, কোনোটা তাদের আঘাত করে নীচের দিকে গড়িয়ে যেতে থাকে। গাছগুলি যেন দানবের আকার ধারণ করে। প্রচন্ড বাতাসের চাপে তাদের শাখা প্রশাখা রূপি হাত দ্বারা, যেন ওদের নাগাল পেতে চায়। মনে হয় একবার নাগালে পেলেই, প্রখর নখ দিয়ে যেন আঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে চায় ওদের দেহগুলি। ওরাও প্রতিপদক্ষেপে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে চলে প্রাণপণে । প্রত্যেকেই মনে মনে ভাবে এই বুঝি তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। বড় বড় পাথর গুলি তাদের যেন ছুঁতে গিয়েও পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। গাছের ছোট ডালপালা দ্বারা শরীরে আঁচড় লাগলেও, বড় ডালগুলি কোন মন্ত্রবলে যেন কোনক্রমেই ওদের নাগালে আনতে পারেনা। পাহাড়ের একেবারে শেষ পর্যায় এসে পথ আগলে দাঁড়ায়, সেই রুদ্রমূর্তি ধারী আত্মা গুলি। যেন আগের থেকেও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাঁচ জনের উপর। আকস্মিকভাবেই পুনরায় বৃদ্ধটি সেই সবুজরঙা দন্ড নিয়ে হাজির হয়ে যায়। কোনরকমে প্রত্যেককে রক্ষা করে পাহাড়ের নীচে নিয়ে আসে। আত্মাগুলি প্রবল আক্রোশে গর্জন করতে থাকলেও, কোনো কারণ বশত পাহাড়ের পাদদেশে নামতে পারছিল না। বৃদ্ধটি ওদের নদীর তীরে পৌঁছে দিতেই, সকলে হাতজোড় করে ধন্যবাদ জানায় । বৃদ্ধটি মৃদু হাসে। শর্মিষ্ঠা ইশারায় বৃদ্ধটিকে প্রশ্ন করে, “এই দণ্ডটিতে কোন দৈব শক্তি আছে নাকি? কিভাবে ঐ আত্মাগুলিকে আপনি প্রতিহত করলেন”? বৃদ্ধটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ এবং ইঙ্গিতে যা বললেন, তা সম্পূর্ণটা ওদের বোধগম্য না হলেও, তার অর্থ হল, এটি কোন সাধারণ দন্ড না। আসলে মেয়েটি যে জরিবুটি সৃষ্টি করেছিল, তারমধ্যে মানুষের হিতের জন্য ব্যবহৃত গাছগুলি ঐ পাহাড়ে বিদ্যমান। তবে যে গাছের দ্বারা মানুষের ক্ষতি সাধন সম্ভব, সেই সমস্ত গাছের বীজ গুলি এই দণ্ডের মধ্যে সুরক্ষিত আছে। দণ্ডটি কোন ভাবে চূর্ণ হলেই সেই সমস্ত বীজ চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে। একবার অঙ্কুরোদগম হলেই প্রাণীকুলের বিনাশের দিন আসন্ন হয়ে পড়বে। মানবকুলের রক্ষার্থেই প্রাণ দিয়েছিল সেই পরিবারের সকল নারী সদস্য । মৃত্যুর পরেও তারা কখনোই চায় না, এই বীজের অঙ্কুরোদগম হোক। তাই তারা এই দন্ডটির উপর কোন ভাবেই প্রহার করেনি। বৃদ্ধও এই দন্ডটিকে রক্ষা করে চলেছেন। উনি নদীর এক প্রান্তে আঙ্গুল নির্দেশ করলে, ওরা নিজেদের ব্যাগগুলি দেখতে পায়। ওরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌড়ায়, এবং যে যার ব্যাগ হাতে তুলে নেয়। পুনরায় ধন্যবাদ জানাতে পিছন ঘুরে দেখে, বৃদ্ধটি আলো-আঁধারি পাহাড়ি জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে আবারও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সকলে নদীর চড়ায় বসে পড়ে।


কারো মুখে কোন বাক্য নেই। পাথর প্রতিমার মত বসে থাকে। কি হল? কি হতে পারত? আজকের যুগে দাঁড়িয়ে তারা কি প্রত্যক্ষ করল? এখনো যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারে না। আকাশ সামান্য একটু পরিস্কার হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই রাস্তার বাঁকে একটি আলোর উৎস চোখে পড়ে। ওরা সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আবার কি তাহলে সেই আত্মার দল? কিন্তু ওদের ভুল প্রমাণিত করে হাজির হয় সেই আগের দিনের ট্রেকার চালকটি। গাড়ির হেডলাইটের আলো চোখে পড়তেই ওরা হাত নেড়ে প্রাণপণে ইশারা করতে থাকে। গাড়িটি ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় । ট্রাকচালক নেমে এসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বলে “আপলোগ জিন্দা হ্যায়? ভগবান কা লাখ লাখ সরকার হ্যা"। ওরা তখন কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে ছিলনা। কোন ক্রমে ট্রেকারের মধ্যে চড়ে বসে, তাদের স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করে। ট্রেকার চালকও বিশেষ কোনো প্রশ্ন না করে, এই স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। গাড়িতে আসতে আসতে হঠাৎ করেই অনীক একটা প্রশ্ন করে

- ভাইয়া আপনে কিয়া বোলাথা, ইয়ে কটেজ আপকে দাদা-পরদাদা কে টাইমসে ভিরান হ্যা?

- হাঁ বাবুজি, মেরে পারদাদাকে টাইম সে।

- ইস পাহাড়িমে কই পাগাল রেহেতা হ্যা কিয়া?

- ইস পাহাড়ি মে কোহি নেহি যাতা বাবুজি। ছোটিসি গাঁও হ্যায় হামলোগোকা। হাম সাবকো পেহেচানতে হ্যায়। কই পাগল নেহি হ্যায় ইহাপে।


অনীক চুপ করে গেলেও, মনেমনে হিসেব মেলাতে অক্ষম হয়। তিন পুরুষ আগে মানে অনেকটা সময়। বৃদ্ধ ইশারায় যা বললেন তাতে বোঝা গিয়েছিল ওটা ওনার পরিবার। উনি জীবিত থাকাকালীন বাকিদের হত্যা করা হলেও, বৃদ্ধ এখনো পর্যন্ত কীভাবে বেঁচে আছেন? কালের নিয়মে তার তো বেঁচে থাকার কথা না। অনীকের প্রশ্ন শুনে, কৌস্তব-সৌপর্ণ-শর্মিষ্ঠা-সৃষ্টি সকলের মনেই এই একই অংক এবং একই প্রশ্ন ভিড় জমিয়েছিল। অনীকের মনে পড়ে বৃদ্ধ বলেছিলেন, “এসে যে দৃশ্য দেখি তাতে আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়”। “চেয়েছিলাম তোদের দেহের অন্তিম সংস্কার করতে, কিন্তু নিয়তি সেই সুযোগটাও দেয়নি”।

সৃষ্টি মনে মনে ভাবে, আত্মারগুলির আগে, এই বৃদ্ধ মানুষটি কিভাবে এত দ্রুত পাহাড় থেকে নেমে এলেন?

কৌস্তব মনে মনে ভাবে, বৃদ্ধটি কিভাবে ওদের এতগুলো ব্যাগ নদীর তীরে পৌঁছে দিলেন? এবং কখনই বা নামালেন।

সৌপর্ণ মনে মনে ভাবল, “আত্মা গুলি যখন আমাদের আক্রমণ করে, আমরা তো একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে না হয় বৃদ্ধটি স্বয়ং বাঁচালেন। কিন্তু বাকিদের উপর আত্মা গুলি যদি আক্রমণ করতো"?

শর্মিষ্ঠা হঠাৎ করে বলে ওঠে “ঐ বৃদ্ধ যদি আমার সামনে এসে প্রতিরোধ না করত, আমি এতক্ষণ আগুনে ঝলসে যেতাম রে”। কথাটি শেষ হওয়ার পূর্বেই, সকলে সমস্বরে বলে ওঠে, “আমাকেও তো ....”! বাক্যটা কেউই সম্পূর্ণ করতে পারেনা। কেবল পঞ্চ পাণ্ডবের বিস্ফোরিত দৃষ্টি বলে দেয়, তাদের প্রত্যেককেই রক্ষা কর্তা এক এবং অভিন্ন। ওদের শিরদাঁড়ার দিয়ে আবারও একটা হিমেল স্রোত খেলে গেল। বর্তমানে যেখানে সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে উদ্যত মানুষ। সেখানে এমনও কেউ কেউ আছেন, যাদের ঠিক মানুষ না বলা গেলেও, যুগযুগান্তর ধরে তারা সৃষ্টিকে রক্ষার্থে নিজেদেরকে কর্তব্যে আজও অবিচল।


(সমাপ্ত)

127 views0 comments

Comments


bottom of page