top of page
Search

বিশেষ সংখ্যা ।। ভয় ভৌতিকে ।। অনিরুদ্ধ মজুমদার


নরকের দ্বার

অনিরুদ্ধ মজুমদার


মন ভালো নেই অবিনাশের। থেকে থেকেই একটা চাপা অস্বস্তি মনের ভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছে। কিন্তু অস্বস্তিটা যে কি এবং কেন অবিনাশের মনে এভাবে দানা বাঁধছে তা অবশ্য বুঝতে পারছে না ছেলেটা। কিছু একটা চেপে বসে আছে বুকের ওপর। পাক খেয়ে পিণ্ডটা গলা দিয়ে উপরে উঠতে চাইছে ক্রমশ। ঢোক গিলছে অনিমেশ। জল খেয়েছে। মাঝে একবার ছাদে গিয়ে পায়চারি করল। নাহ্, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। খচখচানিটা বন্ধ হওয়ার নামই নেই। তাও যদি মন খারাপের উৎসটা জানা যেত তবুও একটা কিছু করা সম্ভব হত। কিন্তু হঠাৎ করে মন বিষন্ন হতে যাবে কেন? অবিনাশের রোখ চেপে গেল। কেন এমন হবে তার সাথে?


এখন ইন্টারনেটের যুগ। গুগলের দৌলতে সবই হাতের নাগালে। অবিনাশও সে পথ ধরল। প্রথমেই মোবাইলে এক দফা সার্চ করে নিল। মন খারাপ কেন হয়? লিখতেই গুগল একটা লম্বা ফিরিস্তি অবিনাশের সামনে তুলে ধরল। এ তো মেঘ না চাইতে জল! অবিনাশ শুধু জানতে চেয়েছিল মন খারাপের কারণ। গুগল কিন্তু তা দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি। রোগের উপশমও দিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য পড়তে পড়তে অবিনাশের মনে হল সে নিজেই একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবে অচিরেই। মনে মনেই হাসল অবিনাশ। আবার সেই মন! কিন্তু এখন তার মন হাসছে। যাক, বাঁচা গেল।


এক প্রস্থ গবেষণা চালিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে চা বানাল অনিমেষ। একার সংসার। নিজেকেই হাত পুড়িয়ে সব করতে হয়। না করলে অন্নপূর্ণা ড্রামেই থাকবেন। বেরোনো তো দূর, উকিও দেবেন না। অবিনাশের মা অবশ্য ছেলের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। বাধ সাধছে অবিনাশই। একটু স্বাধীন ভাবে বাচার সুযোগটা কোনও মতেই হাতছাড়া করতে নারাজ অবিনাশ। ওর বদ্ধমূল ধারণা, বিয়ে মানেই পরাধীনতার কঠিন শৃঙ্খলে সারা জীবনের মতো আবদ্ধ হয়ে যাওয়া। তখন কী আর বাই উঠলে কটক যাওয়া সম্ভব হবে? কেন যাচ্ছ, কোথায় যাচ্ছ, কী দরকার যাওয়ার, সঙ্গে কে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি না না বিধ প্রশ্নে জেরবার হতে হবে। রাহুলের বিয়ের পর অবিনাশের মনে এই ধারণার শিকড়টা আরও পাকা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অবিনাশ জানে, আজ নয় কাল এই শৃঙ্খল মালা হয়ে তার গলে পড়বেই।


এবার অবিনাশের মা অধীর হয়ে উঠেছে। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এই দার্জিলিং ট্যুরটাই তার কুমারত্ব জীবনের যাত্রা। এবার তাকে কৌমার্য ব্রত ভাঙতেই হবে। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে উচু পদে চাকরি করে অবিনাশ। কালে কালে বয়সও নেহাত কম হয়নি। অবিনাশও অনেক ভেবে দেখল, নাহ্, মায়ের কথাটা এবার মেনেই নেবে। মায়েরও বয়স হয়েছে। মফস্বলের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় যখন হাজার স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাটে উঠল অবিনাশ, তখন অনেক বার মা'কে বলেছিল তার সাথে চলে আসতে। রাজি হননি অবিনাশের মা সরলা দেবী। অনেক করে সে বুঝিয়ে ছিল মা'কে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।

শৃষে ছলছল চোখে সরলাদেবী ছেলেকে বলেছিলেন, "বাপ ঠাকুরদার ভিটে শূন্য রাখতে নেই খোকা। তুই যা। এবার তোর একটা বিয়ে হলে শান্তিতে মরতে পারি। স্বর্গে গিয়ে তোদের দেখব।"


সেই শুরু। তারপর থেকে এই তিন বছর দিনে তিনবার করে ছেলেকে বিয়ের কথা মনে করিয়ে যাচ্ছেন সরলা দেবী। কাজের অযুহাতে অনেক কষ্টে এতদিন আটকে রেখেছে অবিনাশ। আর বোধ হয় সম্ভব হবে না। এসব ভাবতে ভাবতে আবারও সেই মন খারাপটা যে কোন ফাক তালে সুরসুর করে ঢুকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসেছে বুঝতেও পারেনি অবিনাশ।


মনের ব্যামো বড়ই জটিল। দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। এর একটাই উপায়, অবিনাশ ফোনটা নিয়ে রাহুলের নম্বরে আঙুলটা ছোঁয়ালো। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল সুমিষ্ট একটা মেয়েলি গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের দু'কলি। মাঝপথেই রাহুলের গম্ভীর গলা পেল অবিনাশ। গানটা ভালো লাগছিল ওর। রসভঙ্গ করল রাহুল।


বিরক্ত হয়ে অবিনাশ বলল, "আর একটু পর ফোনটা তুলতে পারলি না? গানটা মনে ধরেছিল বেশ।"

অবিনাশ বলল, "তাহলে রেখে দিচ্ছি। তুই গানই শোন।"

এমন উত্তর প্রত্যাশা করেনি অবিনাশ। খানিক থতমত খেয়ে বলল, "না না। রেগে যাচ্ছিস কেন। মজা করছিলাম একটু। বল কী করছিস?"


ওপার থেকে রাহুল যা বলল, তা অনেকটা এরকম, সেও অবিনাশকে ফোন করতেই যাচ্ছিল। বিকেল থেকেই মনটা ভালো নেই তার।


রাহুলের কথায় বিস্ময়ের অন্ত রইল না অবিনাশের। বলে কী? তারও মন খারাপ? এ কি ছোয়াচে রোগ নাকি? অবিনাশ অবশ্য তার মন খারাপের কথা ভেঙে কিছু বলল না। তবে একটু অবাক না হয়ে পারল না। একথা সে কথায় তখন বিষয়টা অবশ্য ধামাচাপা পড়ে গেল।


পরদিন অবিনাশ আর রাহুল যাবে দার্জিলিং। নিছকই ভ্রমণ। আর টুকটাক কিছু তথ্য সংগ্রহ করাই উদ্দেশ্য। মোট পাচ দিনের ট্যুর। দুই বন্ধুর এই আজব এক খেয়াল। রাহুলই এই বাতিকটা অবিনাশের মধ্যে একরকম ঢুকিয়ে দিয়েছিল। রাহুল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপনা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ঘটনার তদন্ত সূত্রে অবিনাশের সঙ্গে তার পরিচয়। সম্পর্ক ক্রমে মজবুত হয়ে ওঠে। তুমি ছেড়ে তুইতে আসতে বেশি সময় লাগেনি।


রাহুল একদিন বলল, "চল ঘুরে আসি। পাহাড়ে যাব কিন্তু।"


প্রস্তাবটা মন্দ নয়। রাজি হয়ে গেল অবিনাশ। সেই শুরু। আজ দু'বছরের বেশি হয়ে গেল এদিক ওদিক মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে যায় দুই বন্ধু। তবে পাহাড়েই যায় ওরা। এই অভিযানের আগে রাহুল একটা শর্ত দিয়েছিল। ঠিক একটা নয়, শর্ত ছিল দুটি। প্রথমত, অন্য কাউকে এই অভিযানে সঙ্গে নেওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, পাহাড় ছাড়া অন্য কোথাও নৈব নৈব চ।

এতেও আপত্তি ছিল না অবিনাশের। পাহাড় তার বরাবরের পছন্দ। আর অন্য কাকে আর সঙ্গে নেবে অবিনাশ? কিন্তু ভ্রমণের পাশাপাশি আরও একটা উদ্দেশ্য অবশ্য ওদের ছিল। সেটাও রাহুলের অনুপ্ররেণাই বলা যেতে পারে। তবে সে বিষয়টা এখন থাক।


এবার দার্জিলিং যাচ্ছে অবিনাশরা। দূর রাজ্যের পাহাড় পর্বত এ ক'বছরে অনেক দেখেছে ওরা। কিন্তু ঘরের পাশের দার্জিলিং দেখা হয়নি। তাই এবার সেখানে যাওয়ার মনস্থির করেছে ওরা। রাতে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে যাত্রা শুরু হল ওদের। পরদিন ভোরে নিউ জলপাইগুড়ি। বর্ষার সময়। এখন তুলনামূলক ভ্রমণ পিপাসুদের আনাগোনা কম। দুই-ই একদম পাহাড়ের জন্য আদর্শ।


এনজেপি স্টেশনে নেমে গরম চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে রাহুল বলল, "ম্যালের কাছাকাছি কোনও হোটেল নেব বুঝলি। সার্কিট হাউজটা না করে দে।"

অবাক হয়ে অবিনাশ বলল, "সে কি! আগে বললি না কেন? এখন, এখানে এসে সার্কিট হাউজ ছেড়ে দেব? ভেবেছিলাম...."

অবিনাশ গাইগুই করে আরও কিছু হয়তো বলত। মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিল রাহুল।

-"শোন, সার্কিট হাউজ অনেকটা দূরে। নির্জন জায়গায়। সেখান থেকে রোজ দু'বেলা এক কিলোমিটার হেঁটে ম্যালে যাওয়া সম্ভব না। তাই ম্যালে থাকাই শ্রেয়।"

অকাট্য যুক্তি। এরপর আর বেশি কিছু বলা চলে না। তাও মৃদু আপত্তি করতে গিয়েছিল অবিনাশ। কিন্তু তার আপত্তি ধোপে টিকল না। অগত্যা রাহুলের পাশাপাশি শেয়ারের গাড়িতে উঠে বসল।

চার ঘণ্টা একে বেকে পাহাড়ি পথে উঠতে থাকল ওদের গাড়ি। বাইরেটা অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঠাসা। বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে পাহাড়ি নাম না জানা গুল্মলতার ঝোপে ফুটে থাকা থোকা থোকা ফুল গুলো। কখনও আবার মাঝে মাঝেই গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে মেঘ ঢুকে মুখের ওপর তার পেলব হাতের স্পর্শ বুলিয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে অসীম শূন্যে। স্বর্গীয় অনুভূতির চেয়ে এ কম কিছু নয় অবিনাশের কাছে।

রাহুলের অবশ্য এসবে মন নেই। সে কোন এক তিব্বতী লামার বই খুলে বসে আছে। এত বেরসিক ছেলে আগে দেখেনি অবিনাশ। এখন অবশ্য রাহুলের এই আচরন গুলো গা সওয়া হয়ে গিয়েছে অবিনাশের।


এমজি রোডের নীচে ওদের নামিয়ে দিল গাড়ি। তারপর ম্যালে গিয়ে এদিক ওদিক চক্কর কেটে একটা হোটেলও পছন্দ হয়ে গেল। হোটেলটা ম্যালের একদম ওপরেই। বাইরে থেকে দেখে সেটাকে ঠিক হোটেল বলে মনে হয় না। নীচে একটা কিউরিও শপ। বিভিন্ন রকমের বিভৎস মুখোশ, থাঙ্কা, রকমারি ঝলমলে পাথরের মালা, ক্ষুদে মানুষের করোটির মালা ঝুলছে দোকানের সামনে। ভিতরটা অন্ধকার। বাইরে থেকে দোকানের ভিতরের প্রায় কিছুই দেখা যায় না। বাইরে ঝোলানো ভয়ঙ্কর সব মুখোশ দেখে সেগুলোর দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল অবিনাশরা। ওদের ওভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই সম্ভবত দোকান থেকে বেরিয়ে আসে একটা লোক।


-"কিছু লাগবে বাবুসাব?"


লোকটার কথায় চমকে ওঠে দু'জন। বলি রেখার প্রবল আধিক্যে মুখটা প্রায় ঢেকে গিয়েছে। আলাদা করে খুজে নিতে হয় চোখ, নাক, ঠোট। অথচ বেটে খাটো বেশ বলিষ্ট চেহারা। মুখের সঙ্গে চেহারার কোনও মিল নেই। মুখ দেখে লোকটার বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। কেউ যেন মনের আনন্দে তার সারা মুখে কাটাকুটি খেলেছে। লোকটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। অবিনাশ বুঝল, এভাবে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হয়নি ওদের। একটু অপ্রস্তুত হয়ে অবিনাশ বলল, "আমরা আসলে হোটেল খুজছিলাম। এখানে কোনও ভালো হোটেল আছে?"


লোকটার অবিন্যস্ত ছেড়া মুখটায় একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল। তার ছোট ছোট চোখ দুটো যেন আরও ক্ষুদ্র লাগছে এখন। মাথাটা হালকা নাড়িয়ে লোকটি বলল, "আছে তো। এখানেই আছে।"


"এখানে বলতে?" প্রশ্ন করল রাহুল।


ওর প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে "আইয়ে" বলে লোকটি আবার পিছন ফিরে দোকানে ঢুকে গেল। অবিনাশরাও কতকটা সম্মোহিতের মতোই লোকটিকে অনুসরণ করতে লাগল।


দোকানটা বেশ পুরনো। তার গঠনশৈলী, রঙ, সাজসজ্জা দেখেই তা বোঝা যায়। দোকানটা প্রাচীন মূর্তি এবং না না রকম জিনিসে ঠাসা। সে সব মূর্তির ভয়ঙ্কর সব চেহারা। অদ্ভূত তাদের শরীরি বিভঙ্গ, অসাধারণ মুদ্রা।

-"এ সব কিসের মূর্তি?"

অবিনাশের প্রশ্নে মুখ ঘোরাল লোকটা। তারপর বলল, "ওগুলো আমাদের ভগবানের মূর্তি বাবু।"

বলে কী লোকটা? এরা ভগবান? অবিনাশ ভাবল, এই সব মূর্তি দেখে ভক্তি তো দূরস্থান, উপরন্তু রীতিমতো ভয় জাগছে। এদের দেখে ঠাকুমার ঝুলির রাক্ষসের কথা মনে পড়ে গেল অবিনাশের।

দোকানটার পিছনে কাঠের ছোট সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই দৃশ্যটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। এখানে সার দিয়ে বেশ কয়েকটা ঘর চোখে পড়ল ওদের। আর ঠিক সামনেই একটা খোলা জায়গা। অনেকটা খোলা ঝুল বারান্দার মতো। তবে এটা বারান্দা নয়, দোকানের ছাদ সম্ভবত। এখানে দাড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়তো স্পষ্ট দেখা যেত যদি বর্ষা না হয়ে এটা শীতকাল হত। অবিনাশের মনটা তেতো হয়ে গেল। এত কাছে এসেও কাঞ্চনজঙ্ঘা ফসকে গেল?

একটা টেবিলের সামনে দাড়াল লোকটা। অপর প্রান্তে মাঝ বয়সী তারই মতো একজন বসে আছে। নেপালি ভাষায় দু'জনের মধ্যে কিছু কথা হল। বুঝল না অবিনাশরা। তাপরই হন্তদন্ত হয়ে বসে থাকা লোকটা একটা ঘর খুলে দিল। মন্দ না ঘরখানা। দু'জন দিব্যি আরামে থেকে যাবে। আর রাতে শোয়াটুকু ছাড়া ঘরে থাকছেই বা কে?

রাহুল বলল, "ঘর তো খাসা। তা বাপু দক্ষিণা কত?"

লোকটি হাত কচলে যা বলল তাতে ওদের চক্ষু চড়ক গাছ। ম্যালের ওপরে এত কম ভাড়া কল্পাও করতে পারেনি অবিনাশরা। তা সত্ত্বেও রাহুল দামদর শুরু করল। শেষে দুই রফই একটা রফায় এল।

অবিনাশকে একটা খোঁচা মেরে মুখ টিপে হেসে রাহুল বলল, "বুঝলি না, ওটা একটু করতে হয়। দামদর করা বাঙালির ধর্ম। না করলে সে বস্তু ভোগে লাগে না।"

লাগেজ বলতে দু'টো পিঠের ব্যাগ। সেগুলো রেখে দু'কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে রাহুল বলল, "আজ কী করবি বল?"

অবিনাশ ভ্রুটা ঈষৎ কুচকে বলল, "যা ওয়েদার বেশি দূরে না যাওয়াই ভালো। তার চেয়ে কাছেপিঠে কোথাও ঘোরা যাক।"


ঠোঁট উল্টে মাথাটা খুব ধীরে বেশ কয়েকবার ওপর নীচে নাড়াল রাহুল। তারপর হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে জরো করে ঠোটের ওপর রেখে টেনে টেনে বলল, "ভাবছিলাম একবার মহাকাল মন্দিরটা ঘুরে আসব।"

কথাটা যেন অবিনাশকে নয়, নিজেকেই বলল সে।

বিরক্ত হয়ে অবিনাশ বলল, "কী? কোথায় যাবি? জোরে বল। কিসব কাল, মন্দির বলছিস?"


এবার রাহুল বলল, "কাল নয়। ওটা মহাকাল। মহাকাল মন্দিরের নাম শুনিসনি?"


অবোধের মতো চোখ গোল গোল করে দু'পাশে মাথা নাড়াল অবিনাশ।

রাহুল কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় দরজায় টোকা মারার শব্দ। বিছানায় বসেই হাক দিল সে। চায়ের প্লেট নিয়ে হাসি মুখে ঘরে ঢুকল সেই দোকানের লোকটা। রাহুল একটা পেয়ালা তুলে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, "বাহ্। খাসা। তো বাপু তোমার নামটা তো জানা হয়নি। কি নাম তোমার?"

কাচুমাচু মুখ করে সে বলল, "বিনয় তামাং বাবু।" ভাবটা এমন যেন, নাম বলাটা খুব গর্হিত কাজের সামিল।

রাহুল বলল, "তা বিনয় মহাকাল মন্দির চেনো?"

এবার লোকটা একগাল হেসে প্রায় গড়াগড়ি খায় আর কি। অবিনাশ ভাবল, যার শরীরে এত বিনয়, তার নামকরণকারীর জীবন সার্থক।

হাসিটা একটু চেপে বিনয় বলল, "আমাদের ভগবান আছে। জানব না কেন? খুব জানি। আপনারা যাবেন?"

রাহুল আড় চোখে একবার অবিনাশের দিকে চেয়ে বলল, "হুম। ইচ্ছা আছে। ঠিক আছে তুমি এখন এস।"

বিনয় চলে যেতেই রাহুল বলল, "দেখেছিস একটা গেয়ো ভূতও জানে আর তুই মহাকাল মন্দিরের নামই শুনিসনি। ছ্যা ছ্যা।"


অবিনাশ খানিক অবাক হয়ে ভাবল এতে খামোখা ভর্ৎসনার কী আছে? বিনয় স্থানীয়। সে তো জানবেই। মুখে অবশ্য বলল, "মহাকালে কিছু আছে নাকি বলতো?"

গম্ভীর হল রাহুলের মুখ। কপালে বলিরেখার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে সে বলল, "দুটো হিসেব কিছুতেই মিলছে না রে অবিনাশ!"


-"হিসেব! কী হিসেব?"


বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রাহুল বলল, "অবজার্ভেটরি হিলে আগে একটা বৌদ্ধমঠ ছিল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে সিকিমের পেডং মঠের একটি শাখা হিসেবে এটি তৈরী হয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গোর্খাদের আক্রমণে এই মঠ ধ্বংস হয়। পরে সংস্কার করা হয় ঠিকই কিন্তু ১৮৭৮-’৭৯-তে মঠটি স্থানান্তরিত হয়ে ভুটিয়াবস্তি এলাকায় চলে যায়। প্রশ্ন হল কেন? আর একটা সুরঙ্গ। সেটাই বা ওখানে কেন?"


শেষের কথা দুটো এত আস্তে বলল রাহুল, যে অবিনাশ ঠিক শুনতেও পেল না।


সে বলল, "চল তাহলে ঘুরেই আসি। তোর মনের অন্ধকার কিছুটা দূর হোক।"

কথাটা যে রাহুলের মনে ধরেছে তা বুঝতে পারল অবিনাশ। কথা না বাড়িয়ে ঝটপট তৈরী হয়ে নিল দু'জন। তারপর ম্যাল পেরিয়ে ডান দিকের অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের কোল ঘেসে এগিয়ে গেল ওরা। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর একটা ছোট তোরণ। তার ওপারে খাড়া রাস্তা ওপরে সোজা উঠেই ফের ডান দিকে বেকে গিয়েছে। তোরণটা দেখে ঠিক ভক্তি হল না অবিনাশের। পাড়ার ছোট মন্দিরও অনেক বেশি সুন্দর গোছানো হয়। তোরণের সামনে কিছু স্থানীয় মানুষ পুজোর পসরা সাজিয়ে বসে আছে। ওরা বোঝেনি এখানেই শেষ মানুষের দেখা হবে।


অবজার্ভেটরি হিলের কিছুটা চড়াই ওঠার পরই আকাশ কালো হয়ে এল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেখতে ঝেপে বৃষ্টি নামল। জনশূন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুয়াশাঘন সেই রাস্তা এতটাই মোহময়ী লাগল অবিনাশের কাছে যে, নিজের অজান্তেই শিউড়ে উঠল। সেই কুহেলিকা ভেদ করে দুই তিনটে প্রেত মূর্তি বেরিয়ে এলেও অবাক হবার কিছু নেই।


পত পত করে উড়ছে বৌদ্ধ খাদা এবং রঙ বেরঙের ছোট ছোট কাপড়ের নিশান। লম্বা দড়ি, বাশের কঞ্চিতে লাগানো সারি সারি সেই নকশা করা নিশান গুলো অবাক দৃষ্টিতে দেখছিল অবিনাশ। রাহুল বলল, "এগুলো কী জানিস?"

মাথা নাড়ল অবিনাশ।

রাহুল হেসে বলল, "বৌদ্ধরা তোর আমার থেকে অনেক বেশি ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে। ওদের ধারণা উচু পাহাড়ে বা বাড়ির ছাদে এই মন্ত্রপূত থাঙ্কা ওড়ালে প্রেত ভয় থেকে নিস্তার মেলে। দেখ প্রতিটা থাঙ্কায় মন্ত্র লেখা আছে।"


রাহুলের কথা শুনে আরও মনযোগ দিয়ে সেই উড়ন্ত থাঙ্কা গুলোকে দেখতে ওপরে উঠতে লাগল অবিনাশ।


আর পাচটা সাধারণ হিন্দু দেবতাদের যে মন্দির দেখতে অভ্যস্ত অবিনাশরা, এটা ঠিক তেমন নয়। গম্বুজাকৃতি মন্দিরে আলাদা কোনও গর্ভগৃহ নেই। জাকজমকেরও বড় অভাব। একেবারেই সাদামাটা ছোট মন্দির।

সামনের দু-তিন ধাপ সিড়ি উঠে মন্দিরের সামনে গিয়ে যখন ওরা পৌঁছল তখন হাতঘড়ি বলছে বারবেলা অতিক্রান্ত হয়েছে বহুক্ষণ। তবে পরিবেশ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। কালো মেঘটা আরও জমাট বেধেছে। মন্দিরের ভিতরে যেন সেই অন্ধকারটা মিশকালো কোনও জন্তুর মতো কুণ্ডুলী পাকিয়ে বসে আছে। গা টা আবার শিউড়ে উঠল অবিনাশের।

গর্ভগৃহে কোনও আলো নেই। কয়েকটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে তাতেই যতটুকু আলো হচ্ছে তাতেই অবিনাশ দেখল, ঘরের পিছনের দেওয়ালে তিনটে পর পর ডিম্বাকৃতি শিলা খণ্ড গাথা আছে। মাঝেরটা একটু বড়। পাশের দুটো তুলনামূলক ছোট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শিলা খণ্ডের নীচের অংশটা বেদীর মধ্যে প্রোথিত। আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করে অভিভূত হয়ে গেল অবিনাশ। মূর্তি তিনটিই আগাগোড়া সোনায় মোড়া। পিচঢালা সেই অন্ধকারে সোনার ওপর প্রদীপের আলো পড়ে অসম্ভব একটা মায়াবী অলৌকিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। গোগ্রাসে ভয় মিশ্রিত সেই সৌন্দর্য সম্মোহিতের মতো চেটেপুটে উপভোগ করছিল অবিনাশ। ডান দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল। একটা লোক অন্ধকারের মধ্যে বসে অছে। আর মিটমিট করে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। বাইরে থেকে হঠাৎ করে অন্ধকার ঘরে ঢুকে লোকটিকে দেখতে পায়নি ওরা। এখন অন্ধকার অনেকটা চোখ সওয়া হয়ে যেতে লোকটিকে দেখা গেল।


লোকটার বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ পঞ্চান্ন। পেশিবহুল মজবুত শরীর। পরণে উজ্জ্বল কমলা আর গাঢ় মেরুন রঙের জোব্বা মতো কিছু একটা জড়ানো। মাথা মসৃণ করে কামানো। তার মানে এ কোনও লামা! কিন্তু হিন্দু মন্দিরে লামার কাজ কী? এতক্ষণে অবিনাশ দেখল, চুপ করে বসে নেই লামা। অনবরত তার ঠোট দুটো নড়ছে। সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে রাখা একটা বড় ব্রোঞ্জের পাত্রে মদ ঢেলে চলেছেন। খুব সম্ভবত রাম। এই পুজোর অর্থ বা তাৎপর্য কিছুই বোধগম্য হল না অবিনাশের। উল্টে পাহাড়ের এত ওপরে এই নির্জন অন্ধকার মন্দিরে লামার এই অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে গা ভার হয়ে গেল তার।

রাহুল কিন্তু খুব মনোযোগ দিয়ে লামাকে পর্যবেক্ষণ করছে। লামাটিও ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়া আছে। অবিনাশ ওর জামাটা ধরে একটা হাল্কা টান মেরে চাপা গলায় বলল, "চল এবার। আমার ঠিক গতিক সুবিধার লাগছে না।"

রাহুল তার কোনও জবাব না দিয়ে হাতের মুদ্রায় বসতে বলল অবিনাশকে। তারপরই দুম করে লামার উদ্দেশে বলল, "কোন সাধনা করছেন?"

লামাটি বেশ কিছুক্ষণ রাহুলের দিকে চেয়ে থাকল। সে চোখের দৃষ্টি বর্নণাতিত। অবিনিশের মনে হল কুতকুতে দুটো চোখ যেন মুহূর্তে মশালের মতো জ্বলে উঠেই দপ করে নিভে গেল।

তারপর একটা রাইটিং প্যাডের পাতায় খসখস করে কীসব লিখে রাহুলের দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর হাসি মুখে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাতটা ওপরে তুলল।

কাগজটায় এক ঝলক চোখ বুলিয়ে উঠে গেল রাহুল। তারপর মন্দির থেকে সোজা বেরিয়ে নীচে নামার পথ ধরল। কী হচ্ছে কিছুই বুঝল না অবিনাশ। এক পলকে লামাকে দেখে সেও রাহুলের পিছন পিছন চলতে লাগল। লামাটি কিন্তু তখনও বিড়বিড় করে চলেছে।

মন্দির থেকে বেশ খানিকটা দূরে এসে উত্তেজিত হয়ে অবিনাশ বলল, "কী হল আমাকেও কিছু বলবি তো? তুই কী করে বুঝলি ও...ও সাধনা করছে? বৌদ্ধ লামা হিন্দু মন্দিরে কীসের সাধনা করবে? আর তোকে কী লিখে দিল?"

রাহুল পিছন ফিরে লামার দেওয়া কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "এখন আর কিছু নয়। সব কথা নীচে গিয়ে।"

অবিনাশ দেখল লাল কালির পেন্সিলে পাকা হিন্দিতে দুটো লাইন লেখা কাগজটায়। প্রথমটা- "তুমহারা অন্ত নিকট" আর দ্বিতীয়টা- "কাল শাম কো ঘুম মনাস্ট্রি"। কাগজের শেষে লেখা "বড়া লামা"।

একটা জিনিস অবিনাশ বুঝল, ইনি ঘুম মনাস্ট্রির বড় মানে প্রধান লামা। আর তিনি কাল সন্ধ্যায় সেখানে ওদের যেতে বলেছেন। কিন্তু প্রথম লাইনটার অর্থ কিছুই উদ্ধার করতে পারল না অবিনাশ।


চড়াই ওঠা যতটা কষ্টকর নামা ততটাই সহজ। ঢালু রাস্তা নিজেই একরকম জোর করে নামিয়ে দেবে। শুধু দেহের ভারসাম্যটা ধরে রাখতে হয়। দ্রুত নীচে নেমে ম্যালের একটা বেঞ্চে আয়েস করে বসল দু'জন। তারপর অবিনাশের দিকে ফিরে বলল, "তোর সব প্রশ্নের উত্তর এখনই আমার কাছে নেই। তবে লামাটি তন্ত্র সাধনা করছিল সেটা স্পষ্ট। বৌদ্ধরা আমাদের থেকেও অনেক বেশি এক্সপার্ট এসব ক্ষেত্রে। আর ওদের তান্ত্রিক ক্রিয়া মারাত্মক ফলপ্রদ। আমাদের ওই পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা ভণ্ডামি ওরা করে না। কিন্তু কোন মার্গের উপাসনা উনি করছিলেন বা ওঁর আরাধ্য দেব বা দেবী কে সেটা বুঝতে পারলাম না।"

কথা শেষ করে উদাস চোখে সামনের পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইল রাহুল। অবিনাশ এ সুযোগে বলল, "আর এই 'অন্ত্'? কার মৃত্যুর কথা বলছেন উনি?"


রাহুল একটা বিষন্প হাসি হেসে বলল, "কাগজটা যখন আমাকে দিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই মৃত্যর বিষয়টাও আমাকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু কবে, কোথায় আর কখন আমার ঘাড়ে নেমে আসবে সেই কালদণ্ড?"

নিজের মৃত্যু সময় ঘণিয়ে এসেছে দেখেও একটা মানুষ এত স্বাভাবিক কী করে থাকতে পারে বুঝল না অবিনাশ। তবে কী এই লেখা দেখে গভীর আঘাত লেগেছে ওর মনে? কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিবেশটা কেমন ভারী হয়ে গেল। অবিনাশ ভাবল, আজ মন্দিরে না গেলেই হত। তারপর প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলল, "আজ কী খাবি বল? হুইস্কি না স্কচ?"

রাহুল অন্যমনস্ক হয়ে বলল, "রাম।"


ম্যাল সংলগ্ন বাজার ঘুরে টুকটাক কেনাকাটা করে একটা পানশালায় বসল ওরা। অ্যান্টিক জিনিসের প্রতি অবিনাশের একটা অদ্ভূত টান আছে বরাবর। আর এখানে তো অ্যান্টিকের ভাণ্ডার। প্রতিটা কিউরিও শপে থরে থরে সাজানো অ্যান্টিক বস্তু। তার মধ্যে থেকেই বেছে বেছে একটা মূর্তি পছন্দ করেছিল অবিনাশ। পাচ ইঞ্চির মতো লম্বা ব্রোঞ্জের একটা মূর্তি। দেখতে সেই রাক্ষসের মতো। তবে এটা নারী মূর্তি। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, মূর্তিটা উগ্রতারা। দামও অনেক কম। লাফিয়ে উঠল অবিনাশ। এত কম দামে এমন সুক্ষ নিপুন কারিগরি আর মিলবে না। মূর্তিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে রাহুল অবশ্য বলল, "এটা নিস না। আমার ঠিক ভালো লাগছে না।"

অবিনাশ মুখটা বিকৃত করে বলল, "কী বলছিস? এত সুন্দর মূর্তি এত কম দামে পাচ্ছি নেব না? না, না বাধা দিস না।"

আরও দু-এক বার মৃদু আপত্তি কলেছিল রাহুল। অবিনাশ ওর কোনও কথাই কানে নেয়নি।

পানশালাটা মোটামোটি ফাঁকাই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকজন। ওরা কোনার দিকে একটা টেবিল দখল করল। তারপর রাহুলের জন্য রাম আর অবিনাশ নিজের জন্য হুইস্কি অর্ডার করে বলল, "মূর্তিটা কিনতে না করছিলি কেন বলতো?"

সিসারেট ধরিয়ে তাতে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, "ওটা বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবীর। তবে দোকানদার একটা ভুল বলেছে। মূর্তির গঠন দেখে মনে হচ্ছে ওটা উগ্রতারা নয়, নীল সরস্বতী হবে।"


হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে অবিনাশ বলল, "ধুর ধুর। নীল-লাল-হলুদ, তারা, সরস্বতী যাই হোক তাতে কী এসে গেল? মোদ্দা কথা এত সুক্ষ্ম কারুকার্যের একটা আর্ট অব পিস ঘরে রাখলে একটা বেশ ইয়ে ইয়ে ব্যাপার হবে। আর সেটাই আমার কাছে মূল কথা।"


অবিনাশের কথার কোনও উত্তর দিল না রাহুল। শুধু হেসে বলল, "দেখ কী হয়!"


পানশালা থেকে ওদের হোটেল দেখা যায়। মদ্যপানটা একটু বেশিই হয়েছে। ভেজা স্যাতস্যাতে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মৌজটা উপভোগ করতে করতে খানিক টলতে টলতে ওরা ম্যালের ঠিক মাঝখানে এসে দাড়াল। ম্যাল তখন জনশূন্য। দোকান গুলোও বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর কুয়াশার দাপটে হাত দুই দূরের ছবিও অস্পষ্ট, আবছা।

রাহুল বলল, "কী রে হোটেলে যাবি নাকি এখানে একটু থাকবি?"

অবাক হয়ে অবিনাশ বলল, "তুই বলছিস এ কথা! মঠ, মন্দির, তন্ত্র মন্ত্র, ভূত, প্রেত ছাড়া আর কিছু  বুঝিস? কবে থেকে এত প্রকৃতি প্রেমী হয়ে উঠলি? বেশ দেরীতে হলেও শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। চল বসা যাক।" বলেই বন্ধুর পিঠে একটা চাপড় মেরে এগিয়ে গেল অবিনাশ।

খাদের ধারে ঝাউ গাছের নীচে একটা বেঞ্চে বসল ওরা। পরিবেশ এতটাই নিস্তব্ধ যে নিজেদের হৃদস্পন্দন নিজেরাই শুনতে পেল। চুপ করে বসে প্রকৃতির অদ্ভুত খেলা দেখছিল ওরা। একটার পর একটা মেঘ ভেসে এসে দূরের পাহাড়, গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে। আবার দেখতে দেখতে জল শূন্য সেই মেঘ ভেসে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। অন্য কোনখানে। কতক্ষণ এভাবে ওরা বসে মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি দেখছিল খেয়াল নেই। আচমকা একটা ধরা গলার প্রশ্নে চমকে উঠল দু'জনেই। কখন কুয়াশার চাদর ছিড়ে একটা লোক ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি ওরা।


আপাদ মস্তক কালো চাদরে ঢাকা শীর্ণকায় লোকটা। মনে হয় যেন হারের ওপরেই চাদরটা জড়ানো। চোখ দুটো দেখে নেপালি বা টিবেটিয়ান মনে হয় না। এতো বাঙালি!

লোকটা ভাঙা গলায় বলল, "বাবুসাব ও জিনিসটা নেবেন না। ও জিনিসটা ভালো নয়। ওটা দিয়ে আসুন।"


কোন জিনিস? কাকে দেবে? জিনিসটাই বা কার কাছে আছে? লোকটা বলতে কী চাইছে? বাকরুদ্ধ অবস্থায় লোকটির দিকে চেয়ে থাকল ওরা। রাহুল আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই অবশ্য ফের কুয়াশায় মিলিয়ে গেল লোকটা।

রাহুল বলল, "কী ব্যাপার বলতো? কিছু বুঝলি?"


অবিনাশ চুপ। ভ্রু কুচকে এক ভাবে লোকটা যেদিকে গেল সেদিকেই তাকিয়ে আছে।

আবার রাহুল বলল, "কীরে কী ভাবছিস?"

এবার অবিনাশের মুখ খুলল। কাটা কাটা ভাবে বলল, "লোকটা কী বলল? কোন জিনিসের কথা বলল?"

-"ও কিছু না। এত রাতে এই বৃষ্টিতে কোন সুস্থ মানুষটা আছে এখানে? চল উঠি।"

নেশার ঘোর কেটে গিয়েছে অবিনাশের। সে বেশ দৃঢ় সুরে বলল, "রাহুল, লোকটা পাগোল না। একে আমি চিনি।"


-"তুই চিনিস! কে লোকটা?"


-"হুম। আলবাত চিনি। আমার চোখ আর কান এতটা বেইমানি করবে না। কিন্তু কোথায় দেখেছি সেটা পেটে এসেও মাথায় উঠছে না।"


অবিনাশ দুঁদে গোয়েন্দা। এতটা ভুল যে তার হবে না সেটা ভালো মতোই জানে রাহুল। এখন না মনে পড়লেও নেশা কাটলে ঠিক মনে পড়বে। এক রকম টেনে অবিনাশকে হোটেলে নিয়ে গেল রাহুল।


হোটেলের নীচে দোকানটার একটা পাল্লা খোলাই ছিল। দোকান দিয়েই হোটেলে ঢুকতে হয়, তাই এই ব্যবস্থা। সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিনয় তামাঙের গলা পেল ওরা। খোলা জায়গাটায় বিনয় আর একজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। অবিনাশদের দেখে উত্তেজিত হয়ে বিনয় বলল, "এই তো বাবু একটু আগে আপনাদের খোঁজে একজন এসেছিল। আপনারা পুলিশ?"


হতবাক বিস্ময়ে নিজেদের মুখ চাওয়াচায়ি করল অবিনাশ আর রাহুল। বিনয়ের তো জানার কথা নয়। হোটেলের রেজিস্টার বুকেও নিজেদের কোনও পরিচয় দেয়নি ওরা। পেশার জায়গায় শুধু চাকরি লিখেছে। পরিচয় পত্র হিসেবে দিয়েছে ভোটার কার্ড। তবে লোকটা জানল কী করে?


রাহুল একটু গলাটা ঝেড়ে অবিনাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, "ও পুলিশের লোক। কিন্তু তুমি কী করে জানলে?"


রাহুলের কথা শেষ হতে না হতেই পাশের লোকটির উদ্দেশে বিনয় বলল, "দেখলি। আমি বলেছিলাম না।" তারপর উত্তেজনার বশে আধা বাংলা আধা হিন্দিতে বিনয় যা বলল তা অনেকটা এরকম, আজ সন্ধ্যা থেকে দু'বার অবিনাশের খোজে একটি লোক হোটেলে ঢু মেরেছিল। তিন বারের বেলা বিনয়ের প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে লোকটি বলেছে, এই হোটেলে যে পুলিশ বাবু আছেন তার সামনে খুব বড় বিপদ। তিনি নাকি ওকে চেনেন বলেও দাবি করেছে লোকটা। এর বেশি কিছু সে আর বলেনি। হোটেলে মোট চারটে ঘরে লোক আছে। সব ঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়েছে বিনয়। কিন্তু পুলিশে কেউ চাকরি করে না। বাকি ছিল অবিনাশরাই।


রাহুল জিজ্ঞাসা করল, "তা বিনয় তুমি লোকটিকে চেনো? স্থানীয় কেউ? ওর চেহারা তোমার মনে আছে? মানে কেমন দেখতে?"


বিনয়ের মুখের সেই হাসির রেশটা উধাও হয়ে গিয়েছে। সেখানে জমা হয়েছে এক রাশ ভয়। সেই ভয় মেশানো সুরে বিনয় বলল, "সেই চেহারা ভোলার নয় বাবু। লোকটার মুখটা যেন পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে। শীর্ণ কঙ্কাল সার চেহারা। কিন্তু লোকটার চোখ দুটো অসম্ভব জীবন্ত। ভাটার আগুনের মতো ধিক ধিক করে জ্বলছিল সেগুলো। আমি....আমি হলপ করে বলতে পারি বাবু ও.... ও মানুষ নয়। প্রেত ছিল।"


পাহাড়ি মানুষ গুলো এমনই। এআ সহজ সরল মানুষ গুলোকে বোকা বানানো ভয় দেখানো খুবই সহজ। আর কথা বাড়াল না রাহুল। রাতের খাবার তাদের ঘরে দিয়ে দিতে বলে অবিনাশকে নিয়ে বিদায় নিল। তবে খচখচানি একটা তার মনেও থেকে গেল। মিথ্যা বিনয় বলছে না সেটা পরিষ্কার। তবে লোকটা কে ছিল? আর সে এখানেই বা অবিনাশের খোঁজ পেল কী করে?


ঘরময় পায়চারি করছে অবিনাশ। রাহুল তাকে বুঝিয়েছে, অস্বাভাবিক কিছুই নেই এখানে। হয়তো ওকে সত্যি চেনে। সকালে ম্যালে দেখেছে। তাই এসেছিল। কিন্তু অবিনাশের এক গোঁ। রাতে ম্যালের সেই লোকের সঙ্গে হোটেলে যে এসেছিল তার চেহারার কোনও ফারাক নেই। আর লোকটিকে সে চেনে।


এক সময় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় রাহুল। একে রামের নেশা তার ওপর ঠাণ্ডা মিঠে আবহাওয়া। কখন চোখ বুজে এসেছিল রাহুল বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙল একটা প্রবল ঝাকুনিতে। ধরমর করে উঠে বসতে গিয়ে তার মুখের ওপর অবিনাশের গম্ভীর মুখ দেখে আঁতকে ওঠে রাহুল।


চোখ কচলাতে কচলাতে রাহুল বলল, "কী রে এত রাতে এরকম ধাক্কধাক্কি করছিস কেন? কী হয়েছে?"


সিগারেটে টান দিতে দিতে থমথমে গলায় অবিনাশ বলল, "উঠে বোস। আগে চোখে মুখে জল দিয়ে আয়। কারণ যা বলব তা শোনার ধৈর্য্য থাকতে হবে।"


রাহুলও একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, "ঠিক আছি। বল কী হয়েছে?"


অবিনাশ সিগারেটের শেষ অংশটা ছাইদানে গুজে দিয়ে বলল, "শোন তবে। মাস আটেক আগে জোড়াসাঁকো এলাকায় একটা খুনের তদন্তের ভার আসে গোয়েন্দা বিভাগের ওপর। স্থানীয় থানার পুলিশ কিনারা করতে পারেনি। আমি নিজেই গিয়েছিলাম সরেজমিনে দেখতে। অদ্ভুত খুন। চার তলার ফ্ল্যাটের দরজা ভিতর থেকে লক। জানালার গ্রিল ইনট্যাক্ট আছে। অথচ ভিতরে রক্তাক্ত দুটো দেহ পড়ে আছে। স্বামী স্ত্রী দু'জনকেই নৃসংশ ভাবে খুন করা হয়। গলায নলি ছিন্নভিন্ন। এক দু'বার নয়। যেভাবে গলা দুটো হা হয়ে আছে তাতে স্পষ্ট খুনি বেশ কয়েক বার অস্ত্র চালিয়েছে গলায়। তীব্র আক্রোশ বশেই খুন। স্থানীয় থানা সন্দেহ বশেই ফ্ল্যাটের কেয়ায টেকারকে আটক করেছিল। লোকটি আমাকে বার বার বলেছিল সে নির্দোষ। সে খুন করেনি। তাও তাকেই শেষে গ্রেফতার করা হয়। অথচ লোকটির বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ বা মোটিভ পাওয়া যায়নি। আর একদিন লালবাজার লকআপে...."


বলে থামল অবিনাশ। রাহুল ব্যাগ্র সুরে বলল, "তারপর কী হল?"


আর একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার পাশে দাড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ বলল, "সেও খুন হল। এক ভাবে। গলা কাটা অবস্থায় তার দেহ পাওয়া যায়। তার নাম ছিল বিশু পাল।"


তারপর আচমকা রাহুলের দিকে ফিরে সে আবার বলল, "আজ যে লোকটা হোটেলে এসেছিল, ম্যালে দেখা দিয়েছিল সে আর কেউ নয়, সে বিশু পাল।"

অবিনাশের কথায় বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল রাহুলের। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না প্রথমটা। তারপর কাপা গলায় বলল, "তুই সিওর? মানে কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?"


জানালা থেকে মুখ ফিরিতে অবিনাশ ঠোটের কোনে একটা তির্যক হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, "ভুলে যাস না, আমি পেশায় গোয়েন্দা। তবে প্রথমে আমিও একটু ধোকা খেয়েছিলাম বৈকি! তবে এখন একেবারেই কনফর্ম। উহু, এক চেহারা, এক কণ্ঠস্বর। এ বিশু না হয়ে যেতেই পারে না। কিন্তু খটকাটা অন্য জায়গায়। বিশু মারা গেছে আজ প্রায় আট মাস। আমি নিজে ওর বডি রিলিজের অর্ডারে সাইন করেছি! সে আজ এই দার্জিলিংয়ে এল কী করে? হাউ ইজ ইট পসিবল?"


-"না সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়।"


চমকে উঠে অবিনাশ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে হাথ দেখিয়ে থামতে বলে রাহুল বলল, "তিব্বতিরা বিশ্বাস করে, মৃত ব্যক্তিদের আত্মা বড় কোনও বিপদের আগেই কাছের মানুষদের সাবধান করে দেয়। এক্ষেত্রেও তেমনই কিছু ঘটেছে বলে আমার ধারণা। লোকটার মৃত্যু হয়েছে ঠিকই কিন্তু মৃত্যুর আগে তোর প্রতি কোনও কারণ বশত ওর একটা মমত্ব বোধ জন্মে ছিল। সেটা কেন, তা বলতে পারব না। আর সেই টানেই সে তোকে সাবধান করে দিতে এই দার্জিলিং এসেছিল। এবার প্রশ্নটা হল, তোর সামনে কী বিপদ হতে চলেছে বা হতে পারে?"


দু'জনেই চুপ। ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। নিস্তব্ধ চরাচর। গোটা দার্জিলিং শহরটাই যেন রাতারিতি প্রেতপুরীতে পরিণত হয়েছে। চিন্তা করে কী আর বিপদকে রোখা সম্ভব? তবুও অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। ভারী হয়ে ওঠা পরিবেশটা একটু হাল্কা করতে অবিনাশ বলল, "যাক একটা ইচ্ছা আমার পূর্ণ হল। সাক্ষাৎ ভৃত এসে আমাকে দর্শন দিয়ে গেল। আরও একটা দিকে নিশ্চিন্ত। বিপদ দু'জনেরই। সকালে লামা তোকে বলেছে, রাতে ভূত আমাকে বলল।" বলেই জোরে হেসে উঠল অবিনাশ।

রাহুল কিন্তু গম্ভীর। সে থমথমে গলায় বলল, "দুটোই যদি তোর জন্য হয়! মানে লামা যদি তোর কথাই বলতে চায়?"


হাসিটা মিলিয়ে গেল অবিনাশের মুখ থেকে। তারপর জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, "তা কী করে হবে? লামা তো কাগজটা তোকে দিয়েছিল। আর..."


কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল অবিনাশ। কপালটা কুচকে গিয়েছে তার। রাহুল একটু হেসে বলল, "বল থামলি কেন? আচ্ছা আমি বলছি। 'ওই জিনিসটা' তোকে ফেরত দিয়ে দিতে বলেছিল বিশুর আত্মা। এমন কোন জিনিস তোর কাছে আছে?"


-"কী আছে এমন আমার কাছে?"

-"আছে। তারা মূর্তি।"


উত্তেজিত স্বরে অবিনাশ বলল, "তাই যদি হবে, সে তো বিকালে কেনা। সকালে লামা তবে বলবে কেমন করে?"

-"শোন অবিনাশ ভাগ্যের ফের একেই বলে। তুই মূর্তিটা কিনবি সেটা না জানলেও লামা বুঝতে পেরেছিল কোনও একটা অসুবিধা তোর আসছে। আর সে কারণেই হয়তো তিনি সাবধান করে দিয়ে ছিলেন।"


কার্যত ফুৎকারে রাহুলের কথা উড়িয়ে দিয়ে অবিনাশ বলল, "একটা চার-পাচ ইঞ্চির মূর্তি মানুষকে বিপদে ফেলতে পারে, এটা হাস্যকর। আর যদি বিপদে পরি তখন দেখা যাবে।"


সকালে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে খোলা জায়গাটায় এসে দাড়াল অবিনাশ। সারা রাত বৃষ্টির পর আকাশ এখন ক্লান্ত। তবে মেঘ আছে। দূরে ঘণ কুয়াবৃত পাহাড়রাজিকে স্বর্গ বলে ভ্রম হয়। দেখতে দেখতে দু-একটা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মেঘের ভেলা ভাসতে ভাসতে একেবারে অবিনাশের মুখের ওপর দিয়ে চলে গেল। সেই ঠাণ্ডা স্পর্শে শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল ওর। অবিনাশ ভাবল, এমন নৈসর্গিক পরিবেশে মৃত্যুও পরম সুহৃদ। আসুক না সে। ক্ষতি নেই।


এতটাই তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে কখন রাহুল ওর পছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি অবিনাশ। পিঠের ওপর আলতো হাতের স্পর্শে চমকে পিছনে ঘুরল।


-"ওহ্, তুই!"


-"কেন, তুই কী অন্য কারও আশা করছিলি?"


বলেই হেসে ওঠে রাহুল। রীতিমতো তাড়া দিয়ে বলল, "নে চল এবার। বেরোবি তো নাকি এখানেই বসে কাটিয়ে দিবি?"


এক চুমুকে চা'টুকু শেষ করে অবিনাশ বলল, "হুম সে তো বেরোব। কিন্তু যাবি কোথায় কিছু  ঠিক করেছিস?"


-"কাছাকাছি কিছু মনাস্ট্রি, চা বাগান, চিড়িয়াখানা, সিস্টার নিবেদিতার বাড়ি। অনেক কিছু আছে। একটা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যাব। আরও একটা জায়গায় যেতে হবে।"


শেষের বাক্যটা এতটাই আস্তে বলল রাহুল, মনে হল যেন, সেটা অবিনাশকে আদতে ও বলতে চায়নি। কিন্তু তা কানে গিয়েছে অবিনাশের। একটু অবাক হয়ে সে বলল, "আর কোথায় যাবি?"


-"সেই দোকানে, যেখান থেকে তুই গতকাল মূর্তিটা কিনেছিলি। একবার দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলতে হবে।"


কোনও আপত্তি করল না অবিনাশ। তার মনেও একটা খটকা দানা বেধেছে। একটা মূর্তিকে নিয়ে এত রহস্য কেন জট পাকাচ্ছে? এর পিছনের কারণ জানার জন্য সেও ছটফট করছিল বৈকি। এখন রাহুলের কথায় দ্বিগুণ উৎসাহে অবিনাশ বলল, "তবে আগে সেখানেই চল। ওই দোকান থেকেই যাত্রা শুরু হোক।"



দোকানটা বেশ বড়। আশপাশের অন্যান্য দোকানের তুলনায় বেশ সাজানো গোছানো। পালিশ করা কাঠের মেঝে, দেওয়ালে থাকে থাকে সাজানো সব অ্যান্টিক জিনিস। গতকালের মতো আজও খুব একটা খদ্দের নেই দোকানটায়। দু-এক জন টুকটাক জিনিস দেখছে। কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল ওরা। একজন মাঝ বয়সি মাথায় গোর্খা টুপি পরা ভদ্রলোক বসেছিলেন ক্যাশে। সেই যে দোকানের মালিক তা বুঝতে অসুবিধা হল না অবিনাশদের। কোনও ভূমিকা না করেই লোকটিকে রাহুল সরাসরি প্রশ্ন করল, "এই মূর্তিটা আপনি কোথায় পেয়েছিলেন?"


আচমকা এমন প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে লোকটি প্রথমে রাহুল পরে মূর্তির দিকে চেয়ে বলল, "মূর্তি কোথায় পেয়েছিলাম তা জেনে আপনার কী? এসব অত্যন্ত গোপনীয়। আমরা এগুলো ডিজক্লোজ করি না।"


প্রায় এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে দমের অভাবে হাপাতে লাগল লোকটা। প্রয়োজনের একটু অতিরিক্ত কথাই বলল না লোকটা? তার মধ্যে চাপা একটা উত্তেজনাও দৃষ্টি এড়াল না অবিনাশের। সোজা আঙুলে এই ঘি উঠবে না। রাহুলকে সরিয়ে এবার ক্যাশ কাউন্টারের সামনে গিয়ে পেট থেকে পরিচয়পত্র বের করে লোকটার সামনে রাখল অবিনাশ। তারপর বলল, "এবার কী বলবেন? নাকি...."


অবিনাশের কথা শেষ হওয়ার আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। কোনও রকমে কাউন্টারের বাইরে এসে লোকটা বলল, "আসুন আমার সাথে। আমি সব বলছি আপনাদের।"


লোকটাকে অনুসরণ করে দোকানের এক কোনে রাখা সিড়ি দিয়ে উঠে আর একটা ঘরে ঢুকল ওরা। ঘরটা আয়তনে এবং উচ্চতায়ও যথেষ্ট ছোট। সোজা হয়ে দাড়ানো সম্ভব না। ঘরে ঢুকে বেতের চেয়ারে বসে পড়ল তিন জনেই।


এ ঘরে দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। দুপুরের দিকে মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন হয় তার, সেকারণেই ঘরটা বানানো হয়েছে বলে জানাল লোকটা। অবিনাশ বলল, "এবার তবে আসল কথায় আসা যাক? মূর্তিটা আপনি পেলেন কোথায়?"


প্রশ্নটা সরাসরি হলেও উত্তরটা সহজে এল না। মানে প্রথমে একটু ভনীতা করলেন দোকানের মালিক। তারপর যা বললেন তাতে রক্ত জল হয়ে গেল অবিনাশদের। গল্পটা এরকম, বর্তমানে এই কিউরিও শপের মালিক দিলকুশ থাপা। দোকানটা প্রথম থেকেই তার ছিল না। স্থানীয় একজনের থেকে বছর পাচেক আগে এটি কিনেছিলেন দিলকুশ। একেবারে জলের দরে পেয়েছিলেন। তার কারণ অবশ্য দোকানটা পুড়ে গিয়েছিল। যাইহোক দোকান আবার নতুন করে তৈরী করায় দিলকুশ। এই ঘরটাও তখনই তৈরী করা হয়েছে। নতুন দোকান বেশ ভালোই চলছিল। সমস্যা হল তিন মাসের মাথায় গিয়ে। আচমকা শর্ট সার্কিট হয়ে যায় দোকানে। জিনিসপত্র তো দূর দিলকুশ এবং দোকানের অন্য কর্মচারীদেরও বাচার আশা ছিল না। সেবার আগুন লাগতে লাগতেও লাগেনি। খুব ভাগ্য জোরে বেচে গিয়েছিল সেবার দিলকুশরা। কিন্তু সেই শুরু। এরপর থেকে কিছু না কিছু গণ্ডগোল প্রায় রোজ লেগে থাকত। কোনদিন কোনও দামী জিনিস ভাঙছে, কোনদিন দোকানের ভিতর এত বাজে গন্ধে ভরে যেত যে খদ্দের থাকত না। কখনও আবার কর্মচারীদের আচমকা শরীর খারাপ হয়ে যেত। দোকান থেকে বেরোলে আবার সব ঠিক। পরিস্থিতি এমন হয়ে যেতে থাকল যে রোজ একটা আতঙ্ক নিয়ে দোকান খুলত দিলকুশ। আজ আবার কী হয়, এই ভয়ে ব্যবসা ক্রমে লাটে ওঠার জোগাড়। শেষে এক লামাকে দোকানে নিয়ে আসল দিলকুশ। সে অনেকক্ষণ ধরে দোকান ঘুরে দেখে একটা মূর্তি দেখিয়ে বলেছিল এটার জন্যই সব অনিষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মূর্তি কোনও মনাস্ট্রি নিতে রাজি হয়নি। আর এতটাই সুক্ষ্ম কাজ যে বিনা পয়সায় মূর্তি ছাড়তেও মন চায়নি দিলকুশের।


একদিন এক খদ্দের বেশ চড়া দামেই মূর্তিটা কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু দিন দুই বাদে ফের লোকটি এসে একরকম জোর করে মূর্তি ফেরত দিয়ে গেল। এমনকি টাকাও ফেরত নিল না। এরপর অবশ্য অনেকেই মূর্তিটা পছন্দ করেছিল। দাম শুনে পিছিয়ে যায় সকলেই। বাধ্য হয়ে মূর্তির দাম কমিয়ে দিয়েছিল দিলকুশ। তারপর অবিনাশদের কাছে মূর্তিটা বিক্রি করেছে সে।


গল্প শুনে রাহুল বলল, "সবই তো বুঝলাম। কিন্তু মূর্তিটা আপনি পেলেন কোথা থেকে?"


মাথাটা ঝুকিয়ে দিলকুশ বলল, "আমি মূর্তিটা কিনিনি বাবু। এটা এখানেই ছিল। মনে হয় আগের মালিকের এটা।"


অবিনাশ বলল, "সে কী করে হয়? তার তো দোকান পুড়ে গেছিল? এটা যদি এখানেই থাকত তবে তা অক্ষত থাকল কী ভাবে?"


অবাক বিস্ময়ে দিশকুশ বলল, "তা জানি না বাবু। কিন্তু ও জিনিস এখানেই ছিল।"


এবার রাহুল বলল, "বেশ আগের মালিকের নাম ঠিকানা নিশ্চই আছে আপনার কাছে। সেটা দিন। আমরা তায থেকেই জেনে নেব।"


রাহুলের কথা শুনে হাসল লোকটি। এই প্রথম তার মুখে হাসি দেখা গেল। কাষ্ঠ হাসি হেসে দালকুশ বলল, "নাম ঠিকানা আমি দিচ্ছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনও লাভ নেই বাবু। অগের মালিক বা তার পরিবার কেউই বেচে নেই। ওর ভায়ের থেকে আমি দোকানটা কিনেছিলাম। সেও তারপর কোথায় চলে গেল! অনেক খোঁজ করেছিলাম আমিও। কিছুই জানতে পারিনি।"


নীচে নেমে আগের মালিকের ঠিকানা দিল দিলকুশ। হিলকার্ট রোডের সেই ঠিকানায় গিয়ে জানা গেল সত্যি কথাই বলেছিল দিলকুশ। তবে এই মূর্তির সম্পর্কে কে তাদের বলতে পারে? চক বাজারে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ওরা দু'জনেই আকাশ পাতাল ভাবছিল। কীভাবে এর রহস্য জানা সম্ভব? রাহুল বলল, "এখানে টিবেটিয়ান মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলে হয় একবার। ওরা যদি কিছু বলতে পারে!"


হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া অন্য উপায় নেই অবিনাশের। লাগলে তুক, না লাগলে তাক। সে বলল, "চল দেখি কোনও সুরাহা হয় কিনা।"


এমজি রোডের মোড় থেকে ম্যালের রাস্তার বিপরীত দিকের রাস্তাটা ধরে কিছু দূর গেলেই ডান হাতে টিবেটিয়ান মিউজিয়াম। কাচের দরজা খুলে উকি মেরে অবিনাশ দেখল খা খা করছে গোটা মিউজিয়াম। একটা লোকও নেই। শুধু ঘরের এক কোনে চেয়ার টেবিল নিয়ে একটি সুশ্রী মেয়ে বসে আছে। ভিতরে ঢুকে তো ওদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। বিভিন্ন জিনিসের মডেল, পাথর-পিতল-ব্রোঞ্জের মূর্তি, বড় বড় বিভৎস সব ছবি, মুখোশে ঠাসা মিউজিয়াম কক্ষ। তবে বেশ সুন্দর পরিপটি করে সাজানো। হাল্কা আলোয় কেমন একটা আলো-আধারি মায়াবী পরিবেশ তৈরী হয়েছে। হাল্কা একটা পোড়া গন্ধও নাকে এল ওদের। অনেকটা শুকনো ডাল পাতা পুড়লে যেমন গন্ধ হয়। এদিক ওদিক খানিক ঘুরে সেই মেয়েটির সামনে গিয়ে দাড়াল ওরা। মেয়টি মুখ তুলতে রাহুল বলল, "আচ্ছা এখানে কেউ আছেন যার সাথে কথা বলা যায়? আসলে আমাদের কাছে একটা জিনিস আছে। মনে হয় সেটা তিব্বতের। সেই বিষয়ে একটু কথা বলার ছিল।"


মেয়েটা কিছুক্ষণ ওদের দু'জনকেই বেশ ভালো মতো দেখল। তারপর কোনও কথা না বলে উঠে গটগট করে পাশের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল। খানিক বাদে বেড়িয়ে এসে শুধু বলল, "ওই ঘরে চলে যান।"


অবিনাশ চাপা গলায় বলল, "বাব্বা, কী দেমাক দেখলি?" রাহুল অবশ্য কোনও জবাব দিল না। অবিনাশের কথা শুনতেই যেন পায়নি এমন ভাব করে পাষের ঘরখানায় ঢুকে গেল।


ঘরটা আয়তনে একটু ছোট। সাদা দেওয়াল। ঘরের আসবাবও সব সাদা। মাঝে একটা সোফায় বসে আছেন জোব্বা পরিহীত একজন বৌদ্ধ লামা। সব লামাকেই এক রকম লাগে অবিনাশের। আগের দিনের মতো এও হাতে জপমালা নিয়ে বিড়বিড় করছিল। ওদের দেখে হাসি মুখে ইশারায় বসতে বলে বললেন, "কী হয়েছে বলুন।"


রাহুল বলল, "একটা মূর্তি আমার বন্ধু কিনেছে। মূর্তিটা তিব্বতের বলেই মনে হয়। মূর্তিটা কোন দেবতার সেটা যদি আপনি একটু বলতেন তো খুব উপকার হয়।" মূর্তির সঙ্গে অলৌকিক ঘটনার বিষয়টি অবশ্য আগাগোড়া চেপে গেল রাহুল। কথা বলতে বলতেই মূর্তিটা ব্যাগ থেকে বেড় করে টেবিলে রাখে সে।


মূর্তিটা দেখেই মুখের ভাবভঙ্গি বদলে যায় লামার। মূর্তিটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুচকে বেশ কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে করতে আপন মনেই বলে ওঠেন, "আশ্চর্য!" তারপর ধীরে ধীরে মূর্তিটা রাহুশকে ফেরত দিয়ে বললেন, "এ মূর্তি তিব্বতের নয়। বৌদ্ধদেরও দেবী ইনি নন।"


এবার অবাক হওয়ার পালা রাহুলের। "এটা কোনও বৌদ্ধ দেবী নন! তবে ইনি কে?" আপনা থেকেই কথা গুলো বেরিয়ে আসে রাহুলের মুখ থেকে।


লামা বললেন, "না। গঠন ভঙ্গি দেখলে প্রাথমিক ভাবে বৌদ্ধ তারা বলে মনে হলেও, ইনি কোনও বৌদ্ধদের দেবী নন। তবে এর আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। এই মূর্তি হাতে নেওয়ার পর থেকেই আমি বীজ মন্ত্র ভুলে যাচ্ছিলাম। এটা....এটা একেবারেই স্বাভাবিক নয়।"


রাহুলের এবার আর বিস্ময়ের অন্ত রইল না। একটা গভীর শ্বাস টেনে হতাশার সুরে সে বলল, "তবে এর সম্পর্কে কোথায় জানতে পারব?"


লামা একটু হেসে বললেন, "আমি যতদূর বুঝতে পারছি ইনি তান্ত্রিক দেবী। তবে আর পাচটা তান্ত্রিক দেবী না। যথেষ্ট শক্তিশালী।" একটু থেমে ফের তিনি বললেন, "এর সম্পর্কে তোমাদের সঠিক তথ্য দিতে পারেন সিকিমের রুমটেক মনাস্ট্রির ষোড়শ কর্মাপা লামা। তিনি এখন ঘুম মনাস্ট্রিতে আছেন। তোমরা ওঁর সঙ্গে দেখা কর।"


মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে একেবারে চুপ মেরে গেল রাহুল। সারাদিনই একটা থমথমে মুখে ঘুরল। খেতে বসে কোনও রকম একটু নাড়াচাড়া করে উঠে গেল। অবিনাশ বার কয়েক খোচাল। তারপর হাল ছেড়ে দিল। তবে ওর মন বেশ ফুরফুরে। চিড়িয়াখানায় পাহাড়ি চার পেয়ে বন্য জন্তু, সাপ, পাখি দেখে বেজায় খুশি সে। এসব হিংস্র জন্তুর সামনে কোথায় লাগে অদৃশ্য বিপদের হাতছানি, আর কোথায় বা অলৌকিক মূর্তি রহস্য? সব ভুলে গেল অবিনাশ। তবে চিড়িয়াখানায় অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল।

ওরা সবে পাহাড়ি ছাগল, লেপার্ড, ব্ল্যাক প্যান্থর, বন বিড়াল দেখে সাপের ঘরে ঢুকেছে। সার দিয়ে কাচের ঘর। প্রতি ঘরে বিষাক্ত সব সাপ। র‍্যাটল স্নেক, ব্ল্যাক পাইথন আরও কত কী! কাচের ঘরের সামনে উৎসাহী মানুষের ভীড়। সাপ গুলোও আজ বেশ দিব্যি খোস মেজাজে আছে। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার অবিনাশরা কাছে যেতেই সাপ গুলো ভয়ে যেন কুকড়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য কোনও শক্তি যেন কড়া দ্রব্য গুণের ব্যবহারে সাপ গুলোকে বশ করে নিচ্ছে। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! সব ঘরের সামনেই এক জিনিস কেন হবে? একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করল অবিনাশ আর রাহুল। ওদের মুখ দেখে অবশ্য মনে হল কেউই এটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ।


সারাদিন এক রকম নিরুপদ্রবেই কাটল। ওই সাপের ঘটনা ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটল না। সন্ধ্যা ছ'টা নাগাদ রাহুল বলল, "চল এবার ঘুম মনাস্ট্রি। শেষ ভরসা ওটাই।"


অবিনাশ একটু অবাক হয়ে বলল, "তুই কী মিউজিয়ামের ওই লামার....."

কথা শেষ করতে পারল না অবিনাশ। তার আগেই রাহুল বলল, "প্রথমদিন মহাকাল মন্দিরের সেই লামাকে মনে আছে তোর?"


-"হ্যাঁ।"

-"তিনিই রুমটেক মনাস্ট্রির বর্তমান সর্বেসর্বা। তার আগে রুমটেক মনাস্ট্রি সম্পর্কে তোর একটা সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। মনাস্ট্রির অর্থ মঠ। যেমন রামকৃষ্ণ মঠ। তেমনই বৌদ্ধ মঠ গুলোকে মনাস্ট্রি বলে। ষোড়শ শতাব্দীতে তিব্বতি ধারায় এই মঠ তৈরি হয়। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মনাস্ট্রি হল এই রুমটেক মনাস্ট্রি। আর প্রথমটি অরুণাচলপ্রদেশে অবস্থিত। গ্যাংটক থেকে চব্বিশ কিমি দূরে। চিন তিব্বত দখল করার পর গেলওয়া কর্মাপা সম্প্রদায়ের ষোড়শ গুরু সিকিমে এসে আশ্রয় নেন। সে সময়ই এর  নির্মাণকার্য শুরু হয়। তবে এখানকার আদি গুম্ফাটি নির্মাণ করিয়ে ছিলেন নবম গুরু কর্মাপা। যা আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। রাজা চতুর্থ চোগিয়ালের বানানো মনাস্ট্রিটিও ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে। পরে তিব্বতের বিখ্যাত ছোফুক গুম্ফার অনুকরণে তৈরি হয় এই রুমটেক। এখানে পালি ভাষায় প্রচুর পুথি রয়েছে এই মঠে। অর আছে সোনার বুদ্ধ মূর্তি।"

এ পর্যন্ত বলে থামল রাহুল। একটা সিগারেট ধরিয়ে তারপর আবার বলা শুরু করল।

-"এই তিব্বতিরা বৌদ্ধ তন্ত্রে বিশেষ পারদর্শী। মূলত এই সব তিব্বতি মনাস্ট্রিতে গোপনে তন্ত্র চর্চা করেন লামারা। বলতে পারিস রুমটেক সেই তন্ত্র চর্চার পীঠস্থান। এরা পঞ্চ 'ম' কারে তারা উপাসনা করে।"


অবিনাশ বলল, "দাঁড়া, দাঁড়া। এই পঞ্চ 'ম' কারটা কী জিনিস?"


মৃদু হেসে রাহুল বলল, "মদ, মাংস, মৎস, মৈথুন এবং মুদ্রা। এই পাচটা ম। অনেক তান্ত্রিকই দেখবি মাছ, মাংস, মদ সাজিয়ে বসে বিশাল যজ্ঞ করছে। সবাই বাহবা দিচ্ছে। বাবা বাবা করে পায়ে লুটিয়ে পড়ছে। জানবি এরা সম্পূর্ণ ভণ্ড। ভেক তান্ত্রিক। তন্ত্র বলছে, এই সব কিছুই অর্থাৎ মদ, মাংস, সেক্স মানুষের দেহে সর্বদা বিদ্যমান। আমরা ষড়রিপুর দ্বারা বশিভূত। এই সব কিছু একে একে দেবীর চরণে উৎসর্গ করাই পঞ্চ'ম কার সাধনা।"

অবিনাশ একটু গম্ভীর স্বরে এবং মুখটা ততোধিক গম্ভীর করে বলল, "বুঝলাম। ক্যারি অন। তারপর চালিয়ে যা।"


রাহুল সিগারেটে দুটো লম্বা টান দিয়ে বলল, "এই তন্ত্র সাধনার জন্যই চিন তিব্বতিদের ওপর বিশেষ করে এখন যিনি প্রধান গুরু দলাই লামার ওপর ক্ষুব্ধ। অথচ দেখ চিনারাও তন্ত্র সাধনা করছে। কিন্তু ওধের দাবি তিব্বতিরা নিম্ন স্তরের তান্ত্রিক। যাক সেসব আমাদের বিষয় না। এই তিব্বতি তান্ত্রিকরা মূলত তারা উপাসক। ঋষি বশিষ্ঠের নাম নিশ্চই শুনেছিস। তিনিও তারা উপাসক ছিলেন। কিন্তু সিদ্ধি লাভ করতে পারেননি। শেষে বৌদ্ধদের থেকে পঞ্চ ম'কার সাধনা শিখে তারপর তিনি তারা উপাসনায় সিদ্ধ হন। কারণ তারা পুজো পঞ্চ ম'কার ছাড়া সম্ভব নয়। সুতরাং তন্ত্র শাস্ত্রে বৌদ্ধরা কত এগিয়ে বুঝতেই পারছিস আশা করি।তোর ওই মূর্তিটাও কোনও তান্ত্রিক দেবীর। কিন্তু এটায় আমি ডাহা ফেল করলাম রে অবিনাশ"


কথা শেষ করে মুখে একটা হতাশা ব্যঞ্জক আওয়াজ করল রাহুল।

অবিনাশ বলল, "কেন, কেন ফেল করলি কেন? কোথায় গলদ খুলে বল।"


রাহুল হতাশ সুরে বলল, "আমি ভেবেছিলাম মূর্তিটা নীল সরস্বতী মানে দেবী তারার আর এক রূপ। ওর তিনটে রূপ। উগ্র তারা, একজটা এবং নীল সরস্বতী। কিন্তু সেটা তো মিলল না। লামা তো দেখেই বলে দিলেন এটা তিব্বতিদের কোনও দেবী নয়। এখন দেখা যাক ষোড়শ কর্মাপা কী বলেন!"


ঘুম মনাস্ট্রিতে ওরা যখন পৌঁছোল তখন ঘড়ির কাটায় পৌনে সাতটার কিছু বেশি। পাহাড়ের গায়ে বেশ বড় মনাস্ট্রি। বেশ কয়েক ধাপ সিড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এল ওরা। সামনে বাধানো বিশাল উঠোনের মতো। তার একদিকে বুদ্ধ মন্দির। মন্দিরের ঠিক পাশেই দোতলা একটা বিল্ডিং। এখানেই থাকেন লামারা। বৃষ্টি বেশ জোরে নেমেছে। বড় বড় জলের ফোটা। ছাতায় সে বেগ মানছে না। ওরা প্রায় দৌড়ে খোলা জায়গাটা পার করে বিল্ডিংয়ের নীচে এসে দাড়াল।

চারদিক অন্ধকার। দূরে পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য আলো মিটমিট করে জ্বলছে। ঠিক যেন জোনাকি। ধোয়া ধোয়া বৃষ্টির মধ্যে জনশূন্য সেই মনাস্ট্রিতে দাঁড়িয়ে দূরের ওই আলো গুলোকেই আকড়ে ধরতে ইচ্ছা করল অবিনাশের। সেগুলোই যেন বাচার রসদ। অন্ধকার মৃত্যুর নামান্তর। বাচার জন্য আলো চাই। চাই জল। চাই হাওয়া। এক বিন্দু আলো, একটু হাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল ওর।


পাশের একটা ঘর থেকে খুব চাপা অথচ স্পষ্ট গুনগুন আওয়াজ আসছে। রাহুল কান খাড়া করে কিছুক্ষণ শুনল। এক জন না, ঘরে বেশ কয়েকজন আছে। যেন সমবেত ভাবে কারা এক সুরে একটা গান আওড়ে যাচ্ছে। আরও বেশ খানিক সময় সেটা মন দিয়ে শুনল রাহুল। তারপর পা টিপে এগিয়ে গেল দরজার সামনে। নিখুঁত কারুকার্যে ঠাসা কাঠের দরজা। আর পাচটা সাধারণ বাড়ির মতো নয়। বেশ উচু। দরজা দেখেই ঠাহর করা যায় ঘরটাও আয়তনে যথেষ্ট বড়। এবার গুনগুনানি অনেক স্পষ্ট। না, গান নয় এটা। কম করে সাত আট ন লোক সুর করে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। তবে ভাষা দুরূহ। কী বলছে হয়তো আন্দাজ করা যেত, কিন্তু উচ্চারণ এতটাই প্যাঁচানো যে কিছুই বোধগম্য হল না রাহুলের। যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমনই আচমকা থেমে গেল সে মন্ত্র। আবার সব নিস্তব্ধ।রাহুল এক ভাবে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজার ওপর আলতো চাপ দিল। একটা ক্যাঁচ করে শব্দ হয়ে খুলে গেল দরজাটা।


আন্দাজ ভুল হয়নি রাহুলের। ঘরে সর্বমোট আটজন। সকলেই মেঝের ওপর ছোট ছোট তাকিয়ায় চোখ বন্ধ করে সোজা হয়ে বসে আছে। সকলেরই পোশাক এক। সেই কমলা মেরুন জোব্বা। আর একজন একটু উচু একটা আসনে ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে আছেন। একে ওরা চেনে। অবিনাশ উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রাহুলের হাতের চাপে চুপ করে গেল। দু'জনেই নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে এক কোনে দাড়াল। এখানেও একটা পোড়া গন্ধ পাচ্ছে অবিনাশ। তবে এখানে গন্ধটা বেশ চড়া।


প্রধান লামা চোখ মেলে ওদের দেখে একটু হাসল। তাঁর চোখে প্রশ্রয়ের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেখে শান্ত হল রাহুলের মন। অন্যান্য লামারা একে একে বিদায় নিলে ওদের বসতে বললেন ষোড়শ কর্মাপা। বড় একটা হল ঘর। দেওয়ালে অসম্ভব সুন্দর ফুল পাতা মেঘের কারুকাজ গুলো ধীরে ধীরে ছাদের দিকে উঠে গিয়েছে। মাথার ওপর ছাদের ভিতরের অংশটাও সুন্দর রঙ করা। তবে সেখানে ফুল পাতার বদলে একটা বিরাট চক্রের মতো কিছু আকা আছে। অবিনাশ অনেকক্ষণ দেখেও কিছু বুঝতে পারল না দেখে রাহুল ফিসফিসিয়ে বলল, "ওটা যন্ত্রম।"

ঘরে আসবাব বলতে মেঝের ওপর মোটা লাল কার্পেট। আর তার ওপর ছোট ছোট গদি। অনেকটা কুশনের মতো। তবে কুশনের থেকে একটু বড়। ঘরে আর কিছুই নেই। ওরা ওই কুশনের মধ্যে দুটোয় বসলে লামা পরিষ্কার বাংলায় বললেন, "তোমাদের কথা আগে শুনব। খুব বিচলিত লাগছে। কী হয়েছে বল।"


কোথা থেকে যে শুরু করবে তা বুঝে উঠতে পারল না অবিনাশ রাহুল কেউই। এই একদিনে তাদের সঙ্গে এত কিছু ঘটে গিয়েছে যে কোনটা আগে আর কোনটা পরে বলবে বা কোন কথাটা সম্পূর্ণ গোপন করে যাবে সেটাই ঠিক করতে বেশ কিছুটা সময় চলে গেল। খানিক চিন্তা করে রাহুল বলল, "গতকাল মহাকাল মন্দিরে আপনি বলেছিলেন আমার বা আমাদের কোনও বিপদ হবে। সেটা ঠিক কী? মানে কীভাবে সেই বিপদ আসবে?"


রাহুলের কথা গুলো খুব মন দিয়ে শুনছিলেন লামা কর্মাপা। ওর কথা শেষ হয়ে গেলেও চুপ করে রাহুলের দিকেই এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন তিনি। তারপর ধীরে বললেন, "বিপদ আসবে নয়। এসে গিয়েছে। সে এখন তোমাদের সঙ্গেই আছে।"


দু'জনের মুখ একসঙ্গে হা হয়ে গেল। আচমকা বিপদ ঘটা যাওয়া আর সঙ্গে বিপদ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এক নয়। আর বিপদ কী পোষ্য নাকি যে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে? রাহুল বলল, "কেমন সেটা? একটু বিস্তারিত বলবেন?"


এবার লামা কর্মাপা যা বললেন তাতে দেহের সব রোম একসাথে খাড়া হয়ে উঠল অবিনাশদের।


শান্ত গলায় লামা বললেন, "তোমাদের সঙ্গে যে জিনিস আছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী। মায়াবীও বটে। কিন্তু সে শক্তি ধারণ করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। আর নেই বলেই সেটা তোমাদের কাছে অভিশাপ রূপে নেমে আসবে। তবে সেটা কী তা আমি জানি না। উপলব্ধি করছি যা সেটুকুই বললাম।"


লামার কথা শুনে নিজের অজান্তেই সাইড ব্যাগটায় হাত চলে গিয়েছিল রাহুলের। সম্মোহিতের মতো সে ব্যাগ থেকে এবার মূর্তিটা বের করে লামার দিকে এগিয়ে দিল। কারও মুখে রা নেই। সব নিস্তব্ধ নিশ্চল। শিরা ধমনী দিয়ে বয়ে চলা রক্ত স্রোতের আওয়াজও যেন এই মাত্র শোনা যাবে।


মূর্তিটা কিন্তু হাতে নিলেন না লামা। মূর্তি দেখতে দেখতে মুখে কৌতুকের হাসি খেলে গেল তার। রাহুল বলল, "এই মূর্তিটাই আমার বন্ধু কিনেছে। কিন্তু এটা কার মূর্তি আমরা কিছুই জানি না। দেখতে তো তিব্বতি কোনও দেবী মনে হচ্ছে। কিন্তু...."


রাহুলকে থামিয়ে দিয়ে লামা বললেন, "না তো ইনি তিব্বতি আর না তো বৌদ্ধ তন্ত্রের কোনও দেবী। তোমাদের ধর্মেও এর পুজোর প্রচলন নেই। ইনি হলেন পাতাল ভৈরবী।"


"পাতাল ভৈরবী! তিনি কে?" অস্ফুটেই অবিনাশের মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে আসে।


লামা একটু হেসে বললেন. "পাতালের অধিপতি ছিলেন মহিরাবন। তিনি এই পাতাল ভৈরবীর উপাসনা করতেন। হনুমানের হাতে বধ হয়েছিলেন মহিরাবন। অনেকে পাতাল ভৈরবীকে কালী বা তারার সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু আদতে কালী বা তারার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। ইনি সম্পূর্ণ ভিন্ন। অসুরদের পূজিতা। সেকারণে অতি ভয়ঙ্করী। সঠিক উপাচারে এর পুজো না হলে ইনি ধারকের রক্তপান করবেন। এই মূহুর্তে তোমরা এর ধারক।"


এ পর্যন্ত বলে থামল লামা। তার শেষ কথাটা শুনে শরীরের সব রক্ত নিমেশে জল হয়ে গেল অবনাশের। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর। পেটে খুব জোরে কিল মারলেও যেন গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবে না আর। পাশ থেকে রাহুল এবার বলল, "তবে আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ কী?"


একটু ভেবে লামা বলল, "মহিরাবন পাতালবাসী ছিলেন। এই দেবীও সেখানেই থাকতেন। মহিরাবনের মৃত্যুর পর দেবীকে ছয় দিনের জন্য ওপরে তুলে পুজো করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। তারপর আবার দেবী পাতালে চলে যান। মোট দু'টি স্থানে এর তিন দিন করে পুজো করেন রামচন্দ্র। একটি বর্ধমানের ক্ষীরগ্রাম। সেখানে যোগদ্যা দেবী রূপে এখনও পূজিতা হন দেবী। অন্যটি এই মহাকাল মন্দির। এখানেও ভদ্রকালী রূপে দেবীর পুজো হয় আজও। আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই জায়গাতেই দুটি সুরঙ্গ আছে। যাদের বলা হয় নরকের দ্বার।"


'নরকের দ্বার!' শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে একটা চাপা আতঙ্ক মিশ্রিত বিস্ময়, কৌতুহল ফুটে উঠল রাহুলের মুখে।


অবিনাশ এসবের কিছুই না বুঝে একবার রাহুল আর একবার লামার মুখের দিকে চাইল। দু'জনেই চুপ। লামার চেহারা কিন্তু শান্ত। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন রাহুলের দিকে। অবিনাশ বেশ কিছুক্ষণ দু'জনকে দেখে শেষে বিরক্ত হয়ে লামার উদ্দশে বললেন, "দেখুন এসব গল্প শুনিয়ে অন্তত আমাকে ভয় দেখাতে পারবেন না। আমার এই বন্ধুটি হয়তো আপনার কথা বিশ্বাস করেছে। কিন্তু দুঃখিত আমি...."


কথা শেষ করতে পারল না অবিনাশ। তার আগেই অবিনাশ যা দেখল তাতে আচ্ছা আচ্ছা সুস্থ সাহসী মানুষও ভিড়মী খেত। প্রথমটা একটু খুটিয়ে দেখার চেষ্টা করল। এর কোনও ব্যাখ্যা আদৌ সম্ভব কিনা তাই হয়তো বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু আচমকা সে দৃশ্য দেখে এবং তার যুতসই কোনও যুক্তি না পেয়ে আঁতকে উঠল সে। অবিনাশ স্পষ্ট দেখল লামার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বিশু পাল। তার মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। হাত নেড়ে ইশারায় সে যেন অবিনাশকে বলছে, 'ছেড়ে দিন বাবু। ও জিনিস ছেড়ে দিন।'


অবিনিশের চাপা আর্তনাদ শুনে রাহুল ব্যস্ত হয়ে বলল, "কী রে কী হয়েছে?"


অবিনাশ অবশ্য কিছুই বলতে পারল না। শুধু কাপা হাতটা তুলে লামার দিকে দেখাল। মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, "বিশু....বিশু!"


-"কী যা তা বলছিস? এখানে বিশু কোথায়?"


এবার রাহুলের প্রশ্নের উত্তর দিলেন লামা। হালকা হেসে বললেন, "না, ও ভুল কিছু বলছে না। সে আত্মার অতৃপ্ত। বন্দি সেই নরকের দ্বারে। আর তাই ও তোমাদের সাবধান করতে আসছে বারবার।"


কাতর গলায় অবিনাশ বলল, "তবে আমাদের মুক্তির উপায় কী?"


পাশে রাখা ফ্লাক্স থেকে গরম কোনও পানীয় গলায় ঢেলে একটু চুপ করে থেকে লামা বললেন, "এই দেবীকে কাছে টেনে যে অন্যায় তোমরা করেছ তার শাস্তি উনি দেবেন। এর হাত থেকে বাচাতে পারেন একমাত্র মহাকাল। অর্থাৎ যিনি কাল বা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করেন।"


-"কীভাবে? আর এখানে কী শিব রূপে না বুদ্ধ রূপে মহাকাল পূজিত হন?"


রাহুলের প্রশ্ন শুনে লামা কর্মাপা খানিক চিন্তা করে বললেন, "শোন, মহাকাল মন্দিরে একই সঙ্গে মহাদেব ও অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের পুজো হয়। অবজার্ভেটরি হিল-এর ওপর আগে একটি বৌদ্ধমঠ ছিল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে সিকিমের পেডং মঠের একটি শাখা হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গোর্খাদের আক্রমণে এই মঠ ধ্বংস হয়। পরে সংস্কার করা হলেও ১৮৭৮-’৭৯-তে মঠটি স্থানান্তরিত হয়ে ভুটিয়াবস্তি এলাকায়। বর্তমানে ম্যাল পাহাড়ের নীচে ভুটিয়া বৌদ্ধমঠ ও বিহারটি তার অতীত ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। মঠটি লামা মতবাদের ‘কর-মা-পা’ অনুগামীদের। পরিচালনা হয় এই ঘুম মনাস্ট্রি থেকেই। যে তিনটি সোনা বাধানো পাথর আছে, তারমধ্যে মাঝেরটা মহাকাল। একদিকে তাঁর শক্তি মহাকালী, এবং অপরদিকে মহাগৌড়ি। এখানে এই তিন দেব দেবীই তন্ত্রক্তো মতে পূজিতা। এই পাহাড়ের গায়ে একটি সুড়ঙ্গ পথ ও গুহা আছে। অনেকে মনে করে, এই সুড়ঙ্গ তিব্বতের লাসা পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে আমাদের পুথি বলছে এই সুড়ঙ্গই নরকের দ্বার। আর তা বন্ধ করা হয়েছে।"


একটু থেমে লামা বললেন, "তোমরা কাল, এই মহাকাল মন্দির সাতবার প্রদক্ষিণ করে বাশের দণ্ডের উপর না না রঙের সুতো ঝুলিয়ে পতাকার মতো উড়িয়ে দেবে। একে ‘বায়ু-ঘোটক’ বলে। মহাকাল নিশ্চয় তোমাদের রক্ষা করবেন।"


অবিনাশ হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে কাপা গলায় বলল, "আজ রাতেই যদি কিছু হয়ে যায়?"


এবার বেশ একটু জোরে হেসে উঠলেন লামা কর্মাপা। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ''ভয় নেই। আমি আছি।"


অবিনাশ হয়তো কল্পনাও করেনি তার কথাগুলো এত দ্রুত ফলে যাবে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝল না ওরা।


মনাস্ট্রি থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফেরার পথে ওরা কেউ কোনও কথা বলল না। কেবল বৃষ্টিকে সঙ্গী করে নিঃশব্দে পথ চলতে লাগল। হালকা ঝিরিঝিরি বরফ কুচির মতো বৃষ্টি। তবে খানিক আগেই যে বেশ ভারী রকম জল ঝড়েছে তা রাস্তা দেখলেই বোঝা যায়। মনাস্ট্রির ভিতরে থাকায় সেটা অনুভব করতে পারেনি অবিনাশরা। রাতও এমন কিছু হয়নি। ন'টা মানে কলকাতায় এখন সন্ধ্যা। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে গোটা পাহাড়বাসী অদৃশ্য কোনও জাদু মন্ত্রে যেন ভেজা ঠাণ্ডায় জুবুথুবু হয়ে কম্বলের নীচে ঢুকে নিরাপদ আশ্রয় বেছে নিয়েছে। অবিনাশের মনে হল, দূরের ওই শৈল শৃঙ্গ গুলো যেন বহুদিনের ক্ষুধার্ত। ওই উচু পাথুরে চিরস্থবির জড় বস্তু গুলোতে এই অন্ধকার, এই অবিরাম জল স্রোত যেন নিঃশব্দেই প্রাণের সঞ্চার করেছে। এই পাণ্ডব বর্জিত স্থানে এইমাত্র ওই হিংস্রতা তাদের গ্রাস করে নিলে বিন্দুমাত্র অবাক হওয়ার কিছু নেই। দু'টো কুতকুতে চোখ যেন তাদের অনুসরণ করে চলেছে। সকালে যে রূপ দেখে মন মুগ্ধ হয়ে যায়, অন্ধকারেই তা বিভৎস দেখায়।


হোটেলে ঢুকে কোনরকমে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিল ওরা। আজও গরম ভাত আর বন মোরগের ঝোল। বন মোরগ ঠিক এখানে মেলে না। একটু নিচে কার্শিয়াং থেকে আনতে হয়। এই খবর অবশ্য নিছক মজার ছলে বিনয় তামাং-ই দিয়েছিল ওদের। আর সেটাই কার্যত লুফে নেয় অবিনাশ। প্রথম দিনই বিনয়কে সে সাফ বলে দিয়েছিল, যতদিন ওরা অন্তত আছে বন মোরগের ব্যবস্থাটা রাখতে। বিনয় অবশ্য বিনা দ্বন্দ্বে বিনয়ের সঙ্গেই সে প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল। লোকটার রান্নার হাতও বেশ চমৎকার। মনটা ভালো হয়ে গেল অবিনাশের।


দু'পেগ হুইস্কি বানিয়ে রাহুলের দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে অবিনাশ বলল, "কী মনে হয় তোর?"


হালকা চুমুক দিয়ে রাহুল বলল, "কিসের কী মনে হবে?"


-"আরে আজ যা হল। ওই...ওই লামার কথা তোর কী বিশ্বাস হয়?"


-"কেন তোর হয় না?"


-"না, ঠিক তা নয়। তবে লোকটার চোখ দুটোয় অসম্ভব একটা তেজ আছে। কেমন ভয়, সম্ভ্রম দুই-ই জাগে। কিন্তু...."


ব্যস্ত হয়ে রাহুল বলল, "কিন্তু কী?"


একটু ভেবে অবিনাশ বলল, "ধর, যদি আজ রাতে বিপদ আসে তবে উনি কী করতে পারবেন? শুধুই সান্ত্বনা দিলেন?"


এ প্রশ্নের উত্তর রাহুলের কাছেও নেই। তার মনও এ বিষয়ে সন্দেহাতীত নয়। কতকটা নিজেকে এবং অবিনাশকে আশ্বস্ত করার জন্যই আমতা আমতা করে সে বলল, "উনি যখন বলেছেন, বিশ্বাস রাখা উচিত আমাদের। তার বেশি আর কিই বা করার আছে?"


রাত তখন ঠিক কত তার আন্দাজ পাওয়া মুশকিল। ঠুক ঠুক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল অবিনাশের। কাঠের মেঝের ওপর দিয়ে ক্র‍্যাচ হাতে হাঁটলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমনই। শব্দটা কোথা থেকে আসছে প্রথমটা ঘুম জরানো মেজাজে বুঝতে পারল না। আর একটু কান পেতে শুনল অবিনাশ। আওয়াজটা যেন আরও স্পষ্ট হল এবার। অবিনাশের মনে হল কেউ যেন ধাপে ধাপে সিড়ি ভেঙে লম্বা বারান্দা পেরিয়ে তাদের ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে। অবিনাশ গোয়েন্দা। ওর অবজার্ভেশন ক্ষমতাটাও বেশ প্রখর। তার কান ফাকি দেওয়া সম্ভব নয়। খাটে বসেই মানুষটার একটা প্রাথমিক রেখচিত্র আঁকতে থাকল সে।


অবিনাশ বুঝল, প্রথমত ব্যক্তিটি খোড়া। ক্র‍্যাচ বগলদাবা করে সিড়ি দিয়ে উঠতে তার বেশ কষ্টই হয়েছে। এখনও তার রেশ স্পষ্ট। সমতল মেঝেতেও হাপাচ্ছে মানুষটা। কিন্তু হাপানিটা স্বাভাবিক না। বাঁশি হাওয়ায় নাড়ালে তার ছিদ্রপথ দিয়ে এলোমেলো হাওয়া ঢুকলে যেমন একটা ফ্যাস ফ্যাস আওয়াজ হয়, ওর হাপানিটাও তেমনই। আর এখানেই অবিনাশ বুঝল এ কোনও পুরুষ। মহিলার স্বরে এমন ঝাঁঝ থাকবে না।


বেশ খানিক্ষণ চুপচাপ লোকটার হেঁটে যাওয়া বেশ মন দিয়ে শুনল অবিনাশ। আওয়াজটা ধীরে ধীরে ওদের ঘর পেরিয়ে খোলা জায়গায় গিয়ে থেমেছে। কিন্তু ক্র‍্যাচ হাতে এত রাতে হোটেলে আসল কে? অবিনাশ যতদূর জানে, ওরা ছাড়া বাকি যে চারটে ঘরে লোক আছে তাদের মধ্যে কেউ ক্র‍্যাচ ব্যবহার করে না। হোটেলের কোনও কর্মীও খোড়া নয়। তবে ইনি কে? আর এত রাতে হোটেলেই বা আসার কারণ কী? তবে কী চোর? কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় চোরের উপদ্রবের কথা তো কই তেমন শোনা যায় না। বরং এরা অনেক বেশি বিশ্বাসী। তবুও সাবধানের মার নেই।


সাতপাচ ভাবতে ভাবতেই সন্তর্পণে দরজার পাশে গিয়ে দাড়াল অবিনাশ। লকটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে দরজায় কান পাতল সে। আর কোনও আওয়াজ পাওয়া যায় কিনা শুনতে যেতেই দরজায় ঠকঠক শব্দে চমকে ওঠে অবিনাশ। প্রথমটা মনের ভুল ভাবলেও তা ভাঙতে ওর বেশি সময় লাগল না। হ্যাঁ, ওদের দরজাতেই কেউ নক করছে! কে এত রাতে আসবে? এক বার দু'বার তিন বার। প্রথম দিকে আস্তে তারপর বেশ জোরেই আওয়াজ হতে লাগল। শেষে মনে হল প্রবল আক্রোশের বশবর্তী হয়ে দরজার ওপর কেউ যেন দেহের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে রীতিমতো ধাক্কা মারছে। দরজা না খুললে, সে যেন দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে আসবে। কাঠের দরজায় সেই প্রবল আঘাতে কেপে উঠছে গোটা ঘর। জানালার কাচগুলো পর্যন্ত থেকে থেকে ঝনঝন করে উঠছে। সেই সঙ্গে আরও একটা আওয়াজ শুনতে পেল অবিনাশ।। অস্পষ্ট গোঙানির মতো একটা চাপা শব্দ। মানুষের গলা দিয়ে এমন ভয়ঙ্কর আওয়াজ বেড়োতে পারে, তা জানা ছিল না ওর। ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে অবিনাশ। পা দুটো যেন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে। দেহের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আর তার হাতে নেই। দরজায় প্রবল আঘাতের শব্দে বিছানার ওপর উঠে বসেছে রাহুলও। কিন্তু দরজা খোলার সাহস ওদের কারও হল না। বেশ কিছুক্ষণ এমন তাণ্ডবের পর আচমকাই আওয়াজটা থেমে গেল। তারপরও কিছু সময় মোহাচ্ছন্ন অবস্থাতেই বসে রইল ওরা।

অবিনাশ ঘরের আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলতে যাচ্ছিল কিন্তু বারণ করল রাহুল। অন্য সময় হলে হয়তো রাহুলের কথা শুনত না অবিনাশ। তবে আজ সেটা হল না। দরজা থেকে সরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল সে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কাচের জানলা বেয়ে সর্পীল গতিতে একেবেকে নেমে আসছে জলের ধারা।


মাথার মধ্যে সব যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে অবিনাশের। তার যুক্তিবাদী মন কোনও কিছুরই সদুত্তর আজ দিতে ব্যর্থ। ওর পাশেই গম্ভীর মুখে বসে আছে রাহুলও। একটু আগেই যা ঘটে গেল তার ব্যাখ্যা কী হতে পারে? কে এসে তাদের ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকতে চেয়েছিল? চোরই যদি হবে, সে কী এভাবে সবাইকে জাগিয়ে চুরি করবে? আর কেনই বা সে হঠাৎ করে রণে ভঙ্গ দিল? প্রশ্ন অনেক ঘুরপাক খাচ্ছে রাহুলের মনে। উত্তর অবশ্য কিছুই এল না। রাহুল একবার ভাবল, বিনয়কে ফোন করলে কেমন হয়? কিন্তু মোবাইল হাতে নেওয়ার পরক্ষণে কী একটা চিন্তা করে বলল, "আচ্ছা অবিনাশ, আওয়াজ হোটেলের আর কেউ পেল না কেন? অন্য বোর্ডারের কথা বাদ দিলেও বিনয় কোথায় গেল?"


অবিনাশ মাথা নিচু করে বসেছিল। সেভাবেই সে বলল, "আর কেউ পায়নি তুই নিশ্চিত হলি কী করে?"


-"কারণ পেলে কেউ না কেউ দরজা খুলত। হোটেলে কম করে ছ'জন কর্মী আছে। তারা সকলেই রাতে রান্নঘরে শোয়। বিনয়ও ওপরেই থাকে। একটা হুলস্থূল কাণ্ড ঘটে যেত এতক্ষণে। অথচ সব নীরব। কেউ কিছু জানতেই পারল না!"


এই অসম্ভব কঠিন একটা সময়ে দাঁড়িয়েও ছেলেটা এতকিছু চিন্তা করে ফেলেছে? ওর মনের জোর আর শক্তির তারিফ না করে পারল না অবিনাশ। সত্যিই তো! এই কথা গুলো তার মাথায় আগে আসেনি কেন? তার মানে যা ঘটেছে আর যা ঘটছে ওরা দু'জন ছাড়া আর কেউ জানে না বা উপলব্ধি করতে পারছে না?


অবিনাশ বলল, "এমনও তো হতে পারে হোটেলের কর্মীরাও জড়িত এই ঘটনার সঙ্গে। ভয় দেখিয়ে লুঠ করার পরিকল্পনা?"


রাহুল সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে হেসে বলল, "ধুর ধুর। তাহলে আমরা কেন টার্গেট হব? বিনয় জানে তুই পুলিশ। জেনে শুনে ও এ ভুল করবে না। আর বাকি বোর্ডারদের কেউ একজনও কেন বেড়োল না? না রে অবিনাশ বিষয়টা এত সহজ নয়। বড়ই গোলমেলে।"


বাকি রাত জেগে বসেই কাটিয়ে দিল ওরা। ঘুম এল না আর। রাতে বৃষ্টির বেগ আরও বাড়ল। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার উন্মত্ত দাপাদাপি। কাচের জানালা দিয়ে মাঝে মাঝেই আলোর ঝলকানি ঘরে ঢুকছে। সেই এক ঝলক আলোতেই প্রকৃতির প্রলয় রূপ দেখে বিস্মিত হয়ে গেল ওরা। পাহাড়ের গায়ে ঝাউ বন প্রবল বেগে তখন মাথা দোলাতে শুরু করেছে। কোথাও মড়মড় শব্দ করে কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড় হল অবিনাশের। তাও এক সময় শান্ত হয়ে গেল।সকালে ঝকঝে আকাশ, নাম না জানা বন্য পাখির কলতান, হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে পাহাড়ি ধুতরার মাথা দোলানো দেখে আগের রাতের নারকীয় সে ঘটনাকে নিছক দুঃস্বপ্ন বলেই ভুল হয়। জীবনের এতগুলো বসন্ত পার করে এসে অবিনাশ আজ বুঝল, আলো শুধু অন্ধকার নয়, মনের মধ্যে জমাটবাধা ভয়কেও অনেক সহজে উড়িয়ে দিতে পারে। প্রকৃতির মাঝে এই অফুরান প্রাণশক্তিকে চেটেপুটে গায়ে মেখে নিতে চাইল সে। রাহুল কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর ক্লান্ত শরীরটা একপাশে কাত করে দিয়ে বাইরে খোলা জায়গাটায় এসে দাড়াল অবিনাশ। সামনের ঝাউ পাইন গাছের ফাক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে পাখিগুলো। বাংলাদেশের পাখির মতো তাদের স্বর সুমিষ্ট নয় ঠিকই। রুক্ষ আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়েই হয়তো স্বরে কাঠিন্য চলে এসেছে। তা হোক, এখন সেই কর্কশ স্বরই মনে হচ্ছে অনেক বেশি আপন। আত্মার পরমাত্মীয়। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই পাতার ফাঁকে, ঝোপের মধ্যে পাখিদের লুকোচুরি খেলা, খুনসুটি দেখে এক সময় ঘরে চলে এল অবিনাশ। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল ওর। ঘরে ঢুকে অবিনাশ দেখল রাহুল একেবারে স্নান সেরে ফিটফাট হয়ে চায়ের কাপটা হাতে তুলেছে সবে। অবিনাশকে দেখে কাপে চুমুক দিয়ে বলল, "এই তো, কোথায় ছিলি? যাই হোক, যা তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে।"


অন্য কাপটা আলগোছে তুলে নিয়ে অবিনাশ বলল, "এত সকালে কোথায় যাবি আবার?"


রাহুল একটা তুড়ি মেরে দু'আঙুলের মাঝে ধরা সিগারেটের বাড়ন্ত ছাইটা টুক করে অ্যাস্ট্রেতে ফেলে বলল, "মহাকাল মন্দিরে। এর মধ্যেই ভুলে মেরেদিলি? যা জলদি সেরে নে।"


একটু লজ্জিত মুখে জিভ কেটে অবিনাশ বলল, "ওহ্। দশ মিনিট ওনলি।"


ওরা ম্যাল পেরিয়ে মহাকাল মার্কেটে ঢুকতেই বদলে গেল আবহাত্তয়া। হঠাৎ কালো মেঘে ছেয়ে গেল গোটা এলাকা। বর্ষাকালে এটাই পাহাড়ের রীতি। এই রোদ তো চোখের পলকে মেঘ উড়ে এসে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আকাশের ভরসায় বর্ষাতি ছাড়া বেড়োলেই বিপদ। সে ভুল অবশ্য অবিনাশরা করেনি। রেনকোট নিয়েই বেরিয়েছিল ওরা। মাথার ওপর কালো ছায়া ঘনিয়েছে দেখেই সেগুলো ঝটপট পরে নিল ওরা। তারপর ধীর পায়ে চড়াই উঠতে লাগল।


মহাকাল মন্দিরে আজ তুলনামূলক ভীড় আছে। আগের দিনের মতো শুনসান না। বেশ কয়েকজন লামাও চোখে পড়ল অবিনাশদের। কয়েকজন লামা মন্দিরের সামনে বসে এক মনে মন্ত্র জপ করছেন। দু-এক জন একটা ছোট মতো ঘরে প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন। অবিনাশ কৌতুহলবশত এগিয়ে গেল ঘরটার দিকে। ছোট্ট একটা ঘর। একদিক পুরো খোলা। সেখান দিয়েই ঢুকতে হয়। ঘরের তিন দিকের দেওয়ালে থাক থাক করা আছে। আর সেই প্রতিটি থাকে ছোট বড় মাঝারি আকারের অসংখ্য পিতলের প্রদীপ। সে গুলো ঠিক আমাদের বাংলার মতো নয়। দেখতে অনেকটা মোমদানীর মতো। তবে তেল নয়, অবিনাশ দেখল সব প্রদীপেই ভর্তি করে মাখন দেওয়া আছে। মোমবাতির মতোই সেই মাখনের মাঝখানে একটা সলতে উচু হয়ে জ্বলছে। এত প্রদীপ একসঙ্গে জ্বলতে আগে দেখেনি। দীপাবলিতে আগে অবিনাশের বাবা দোতলা বাড়ি মোমবাতি দিয়ে সাজাতেন। বাবার কাছে সেটা ছিল পরম আনন্দের ক্ষণ। ছোট বেলায় অবিনাশ চুপ করে দেখত, ওর বাবা মোমবাতি গুলো পরম যত্নে ধাপে ধাপে একতলা, দোতলার বারান্দা, ছাদে সাজতেন। আর অবিনাশ একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সেগুলো ধরিয়ে দিত। সে আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অবিনাশের বাবার মৃত্যর অনেক আগে থেকেই অবশ্য মোমবাতির বাজার দখল করে নিয়েছিল টুনি লাইট। ওদের বাড়িতেও এখন টুনি লাইটের চেন ঝোলানো হয়।


আজ এখানে এত প্রদীপ একসাথে জ্বলতে দেখে বাবার কথা মনে পড়ে গেল অবিনাশের। ওর অজান্তেই চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠল অবিনাশের। এমন সময় কাধের ওপর হাতের চাপে চমকে পিছনে তাকাল অবিনাশ। কখন রাহুল এসে ওর পিছনে দাড়িয়েছে খেয়ালই করেনি। হাপাতে হাপাতে বলল, "ওহ্, তুই। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।"


রাহুল প্রত্যুত্তরে হেসে বলল, "চল লামা কর্মাপা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।"



গর্ভগৃহে স্থানীয় কয়েকজন পুজো করছিল। অবিনাশ দেখল, এখানে নিজের পুজো সকলে নিজেই করছেন। একজন পুরহিত অবশ্য বসে আছেন। কিন্তু তার পোশাক-আশাক দেখলে বোঝা দায় যে, সে আদতে পুরোহিত। সাধারণ প্যান্ট শার্ট পরণে। মাথায় নেপালি টুপি। এক নাগারে সুর করে মন্ত্র আওড়ে যাচ্ছেন শুধু। আর মাঝে মাঝে আড় চোখে প্রনামীর থালাটা দেখে নিচ্ছেন। হাসি পেল অবিনাশের। ধর্মের নামে ব্যবসা এ দেশে প্রচলিত প্রতারণা। তবে এখনও এ মন্দিরে ব্যবসায়ীরা ঘাঁটি গাড়তে পারেনি তাই রক্ষে। না হলে এই শান্ত ধ্যানগম্ভীর পরিবেশ কবে উধাও হয়ে পাণ্ডা দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে যেত।


লামা কর্মাপা ওদের দেখে হেসে ইশারায় বসতে বললেন। তারপর পূণ্যার্থীরা একে একে বিদায় নিলে লামা বললেন, "মহাকালের আদি-অন্ত কিছুই নেই। এক একটা দিন, মাস, বছর ক্রমশ মহাকালের গহ্বরে বিলীন হয়ে যায়। আজ যা বর্তমান, কাল তা অতীত। যা ঘটছে বা যা ঘটে গেছে ভাল হোক বা মন্দ, মহাকালের তাতে কোনও হেলদোল নেই। সে দর্শক, কেবলই দর্শক, সাক্ষীস্বরূপ। তিনি সময়, যুগ ও কালের উর্দ্ধে। শোন,

এই প্রকৃতিতে সুখ যেমন আছে, দুঃখও আছে। আর সুখের সঙ্গে দুঃখকে যে যত নির্লিপ্ত ভাবে গ্রহণ করতে পারবে সেই তো এই জীবন সংগ্রামে জয়ী হবে।"


বলে একটু থামলেন লামা। তারপর আবার বললেন, "বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে, বিশেষত তিব্বতী ঐতিহ্যবাহী টাংমি (পূর্ব-এশীয় গুহ্য বৌদ্ধধর্ম) এবং সিংগনে (জাপানি গুহ্য বৌদ্ধধর্ম) ধর্ম্মপাল নামক সংরক্ষক দেবতা হিসাবেও দেখা যায় মহাকালকে। তিনি চীনে দ্যহেইতিয়ান এবং জাপানে দ্যইকোকুতেন নামে পরিচিত। শিখধর্মেও মহাকালকে মায়ার অধীশ্বর কাল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।"


রাহুল বলল, "তারমানে দুঃখটাও আমাদের মেনে নিতে হবে? আপনি যে বলেছিলেন এর প্রতিকার সম্ভব!"


লামা ডান হাতে ধরা জপ মালাটা মাথায় এবং দুই চোখে ঠেকিয়ে পাশে রেখে বললেন, "জীবনে চলার পথে নিজেদের অজান্তেই আমরা অনেক ভুল করি। সেসব ভুলের জন্যই আমাদের জীবনে দুঃখ নেমে আসে। আর তা আমাদের ভোগ করতেই হবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির নিয়মকে সম্পূর্ণ বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রলয় নেমে আসবে। তোমরাও ভুল করেছ। তার খেসারত দিতে হবেই। আমি কিছুটা খণ্ডাতে পারি বটে। কিন্তু...."


"কিন্তু কী বলুন!" এবার চাপা গলায় বলল অবিনাশ।


লামা আগের মতোই শান্ত গলায় বলল, "তোমাদের প্রাণ বাচলেও, তোমাদের কোনও এক প্রিয় জনের মৃত্যু  নিশ্চিত। সেই বলি কি তোমরা দিতে পারবে?"


হঠাৎ করেই সব যেন নিশ্চুপ স্তব্ধ হয়ে গেল। লামা বলতে কী চাইছে? নিজের কোনও প্রিয়জনকে হত্যা করতে হবে? এ কী করে সম্ভব?


পাথরের মতো নিশ্চল নিস্পন্দ ভাবে বসে থাকল অবিনাশরা। এখনও ওদের কান লামার কথাটা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। অবিনাশের সপ্রতিভ মুখটা যেন দপ করে নিভে গিয়েছে। শেষে ইতস্তত কুণ্ঠিত ভাবে রাহল বলল, "এটা আপনি কী বলছেন? আমরা নিজেরা বাচার জন্য প্রিয়জনদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব? এ অসম্ভব। তার চেয়ে আমার মৃত্যুই শ্রেয়।"


লামা হেসে বললেন, "তুমি চাইলেই তো মৃত্যু হবে না। যাই হোক তোমরা সিদ্ধান্ত নাও কী করবে। আমি তোমাদের মঙ্গলার্থে মহাকালের সামনে সহস্র নাম জপ করেছি। আশা করি বড় কোনও বিপদ তোমাদের হবে না। কিন্তু দেবী এবং তার অনুচরদের শান্ত করতে বলি তোমাদের দিতেই হবে। না হলে ইনি পিছু ছাড়বেন না। এটাই দৃঢ় স্থূল বাস্তব।"


কথা শেষ করে ওদের হাতে একটা করে লাল নীল হলুদ সবুজ না না রঙের সুতো বেধে দিল লামা। বেশিক্ষণ সেখানে আর অপেক্ষা করল না অবিনাশরা। মন্দির থেকে বেরিয়ে জুতোর ফিতে বাধতে বাধতে অবিনাশ বলল, "এ সবের পাল্লায় পড়া মানে সুস্থ শরীর ব্যস্ত করা। খামোখা ভয় খাইয়ে দিয়েছিল দেখলি কেমন!"


রাহুল গম্ভীর মুখে শুধু বলল, "হুম।" তারপর ব্যস্ত হয়ে বলল, "আচ্ছা একটা কাজ করা যায় না?"


অবিনাশ অবাক হয়ে বলল, "কী? আবার কী করবি?"


রাহুল এবার দ্বিগুণ উৎসাহে বলল, "লামা বলেছিল মনে আছে, একমাত্র দু'জায়গায় এই দেবীর পুজো হয়। এক বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামে আর দুই এই মহাকাল মন্দিরে। আর এই দু'জায়গাতেই রয়েছে দুটো সুরঙ্গ পথ। মানে ওই নরকের দ্বার। চল সেটা একবার খুজে দেখি। যদি মেলে তো মূর্তিও ওখানেই রেখে দেওয়া যাবে। আর নরকের দ্বারও চাক্ষুষ করা যাবে। কী বলিস?"


রাহুলের কথায় প্রবল দোটানায় পড়ে গেল অবিনাশ। একদিকে ভয় অন্যদিকে অজানাকে জানার চরম উৎকণ্ঠা। শেষে মানসিক দ্বন্দ্বে অবশ্য কৌতুহলই জয়ী হল। ভয়কে তফাতে রেখে সুরঙ্গ খুজতে শুরু করল দু'জনে। প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে অবজার্ভেটরি হিলে তন্য তন্য করে ছানবিন ছালাল ওরা। কিন্তু সুরঙ্গের কোনও হদিশ মিলল না। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে একটা বড় পাথরের ওপর বসে হাপাতে লাগল অবিনাশ। এদিকটা সম্ভবত মন্দিরের পিছন। অনেকটা নির্জন। গাছে, পাতায়, পাথরের ওপর টুপটাপ বৃষ্টির ফোটা পড়ার স্পষ্ট আওয়াজ কানে আসছে। এক নাগাড়ে বৃষ্টির জেরে কাদা শ্যাওলা মিলেমিশে একটা উৎকট পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে গোটা অবজার্ভেটরি হিলের ওপরটা। তার মধ্যে কোথায় সুরঙ্গ? আর সে সুরঙ্গ যদি কোনও কালে থেকেও থাকে তবে তার অস্তিত্ব এই একবিংশ শতাব্দীতে জীবাষ্মে রূপান্তরিত হয়েছে। অবিনাশ বলল, "এই বৃষ্টিতে ঘোরাঘুরি বেকার। তার চেয়ে এই নির্জন জায়গায় এক ফাকে মূর্তিটা রেখে দিয়ে কেটে পরি চল।"


রাহুল একটু নিমরাজি ভঙ্গিতে বলল, "বেশ তবে। ওই পাথরটার ওপরেই রেখে দে মূর্তিটা।"


মূর্তিটা রেখে হোটেলে চলে এল অবিনাশরা। দুপুরে আজ ওরা হোটেলেই খাবে ঠিক করেছে। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলের দিকে বেরোবে। হোটেলে ফেরার পথেই অবিনাশ দেখল, পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। মেঘ কেটে গিয়েছে। ঝকঝকে পরিস্কার আকাশ। মিঠে রোদে ঝলমল করছে চারদিক। প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা দেখে বিস্ময় জাগে বৈকি!

হোটেলের নীচে দোকানের সামনেই বিনয় তামাঙের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সম্ভবত বৃষ্টি থেমে রোদ উঠেছে দেখেই বিনয় দোকানের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। একে টানা বৃষ্টিতে স্যাতস্যাতে পরিবেশ, তার ওপর হিমেল হাওয়ায় একটা বিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছে। ওদের দেখে এক গাল হেসে বিনয় বলল, "লাঞ্চ করবেন বাবু?"


অবিনাশ গম্ভীর হয়ে বলল, "ইচ্ছা তো তেমনই ছিল। আচ্ছা বিনয় কাল রাতে তুমি কোথায় ছিলে?"


আচমকা এমন প্রশ্নের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না বিনয় তামাঙ। একটু থতমত খেয়ে বলল, "কেন বাবু ঘরে! আপনাদের একটা ঘর পরেই তো আমার ঘর।"


অবিনাশ এবার আরও গম্ভীর হয়ে চোখ দুটো ছোট করে ঠিক পুলিশি কায়দায় প্রশ্ন করল, "ঘরে ছিলে? রাতে কোনও আওয়াজ পাওনি?"


বিনয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে। ফ্যাকাশে মুখে ঢোক গিলে বলল, "কী আওয়াজ বাবু?"


রাহুল বলল, "এই ধরো কোনও কিছু ভেঙে পড়া বা দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ। এমন কিছু শুনেছ?"


মাথাটা ঝুকিয়ে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বিনয় বলল, "আসলে বাবু রাতে একটু দারু খাওয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু খুব জোরে আওয়াজ হলে নিশ্চয় শুনতে পেতাম। কাল তেমন তো কিছু শুনিনি!"


আজও মিথ্যা বলছে না বিনয়। সারাদিন এরা যে পরিমাণ হারভাঙা খাটে তাতে ঠাণ্ডায় রাতে ছেলে মেয়ে বুড়ো সকলেই দেশী মদের আশ্রয় নেয়। এটাই ওদের আমোদ প্রমোদের অন্যতম উপাদান। আর বাঙালিদের মতো সেটা জাহির করতে কোনও ভনীতা বা কুণ্ঠা বোধও করে না ওরা। সহজ কথা সরল ভাবে বলতে আপত্তি কোথায়?


রাহুল একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, "বেশ। আচ্ছা বিনয় তোমাদের এখানে লামারা সত্যি কী অনেক কিছু জানেন? মানুষকে দেখে বলতে পারেন কী হবে না হবে?"


বিনয় এবার শ্রদ্ধা ভক্তির মিশেলে একেবারে গদগদ হয়ে উঠল। দু'হাত একসাথে অনেকটা নমস্কারের ভঙ্গিতে মুঠো করে বলল, "ওনারা সব পারেন বাবু। ভালো খারাপ সব করতে পারেন। খুব শক্তি ওদের। মরা মানুষের খুলিতে চা খান। যমন্তক জানেন বাবু? ন'টা মাথা চৌত্রিশটা হাত! তিব্বতি লামারা ওর পুজো করেন।"


রাহুল শুধু "হুম" বলে দুকানের ভিতরে ঢুকে গেল।


সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অবিনাশ বলল, "তোর কী মনে হয় ওই লামা সত্যি কথা বলছে? তুই তো বৌদ্ধ তন্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করিস। কী ভাবছিস বলতো?"


ঘরের লকটা খুলে রাহুল বলল, "সেখানেই তো খটকাটা লাগছে। আমি যতদূর জানি উচ্চমার্গের তন্ত্র সাধক এই লামাদের কথা বিফল হওয়ার নয়।"


অবাক হয়ে অবিনাশ বলল, "বৌদ্ধরা তো বুদ্ধের উপাসক। অহিংসবাদী। সেখানে তন্ত্র মন্ত্র কোত্থেকে এল? ব্যাপারটা কী বলতো?"


অবিনাশের হাত থেকে আধ খাওয়া সিগারেটটা ছো মেরে নিয়ে রাহুল বলল, "শোন তবে। বৌদ্ধতন্ত্রগ্রন্থ সাধনমালায় উড্ডিয়ান (ধারণা করা হয় বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রাম), (অসমের) কামাখ্যা, সিরিহট্ট (বর্তমানের শ্রীহট্ট) ও পূর্ণগিরি এই চারটি তন্ত্রের মুখ্য পীঠস্থান বলে উল্লেখ আছে, যেগুলো বৌদ্ধদেবী বজ্রযোগিনীর পূজার জন্য বিখ্যাত ছিলো। তাছাড়া নালন্দা, বিক্রমশিলা, সারনাথ, ওদন্তপুরী, জগদ্দল ইত্যাতি প্রাচীন বৌদ্ধ বিদ্যাপীঠগুলোতে বজ্রযানের অনুশীলন হত বলেও জানা যায়। এই সকল স্থানে তান্ত্রিক বজ্রযানের উৎপত্তি হয়েছিল। বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবদেবীর সাধনার কথা গুহ্যসমাজতন্ত্রে উল্লিখিত আছে। এই তন্ত্র রচনায় অসঙ্গের কিছু হাত ছিল বলে অনুমান করা হয়। অসঙ্গ খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের লোক। তিব্বতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিতের মতে তন্ত্র সাধনার উৎপত্তি অনেক আগেই হয়েছিল। কিন্তু প্রায় তিনশ বছর তা সুপ্ত অবস্থায় ছিল এবং গোপনভাবে গুরুশিষ্যপরম্পরায় চলত। পাল-রাজত্বের সময় সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা তা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অষ্টম শতাব্দীতে বজ্রযানের বিশেষ শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল এবং খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রবলভাবে তা চলেছিল। কিন্তু ত্রয়োদশ শতকের আদিতে মুসলমান-আক্রমণের কারণে অনেক বৌদ্ধ মঠ ও বিদ্যাপীঠ ধ্বংস হয়। এরপর থেকেই বজ্রযান ভারতে নিষ্প্রভ হয়ে যায় এবং কিছুকাল পরে বিলুপ্ত হয়। বজ্রযানের অনুসারীরা হয় হিন্দু সমাজে মিলে গিয়েছিল, নয় মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। চৈতন্যদেবের আমলে আবার অনেকে বৈষ্ণব ধর্ম নেয়।"


রাহুলকে মাঝপথে আটকে অবিনাশ বলল, "তার মানে আমাদের যে সব সাধকরা তন্ত্র সাধনা করেন সেগুলো কী?"


ছাইদানে সিগারেটটা গুজে রাহুল বলল, "তন্ত্র একটাই। সেটা বৌদ্ধরা প্রথম হাতে কলমে করে দেখায়। আমরা ওদের কাছে শিশু। বৌদ্ধ গুহ্যসমাজতন্ত্রে মুদ্রা, মাংস ও মৈথুনকে সাধনার অঙ্গ বলা হয়েছে। যুগনদ্ধ বা নারীপুরুষের সম্মিলিত মিথুনমূর্তির দ্বারা বুদ্ধগণ, বোধিসত্ত্বগণ ও তাঁদের শক্তিসমূহ উপস্থাপিত হতে শুরু করেন। অনঙ্গবজ্রের প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধি গ্রন্থে মিথুনতত্ত্ব ও মহামুদ্রাতত্ত্ব বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। হিন্দু ধর্মে এর কোনও প্রামাণ্য তথ্য বা বই আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।"


একটু থেমে রাহুল বলল, "বৌদ্ধ-তন্ত্রের বিপুল প্রসার ঘটেছিলো মহাচীনে– অর্থাৎ বিহার-বঙ্গ-আসামের কিছু অঞ্চল এবং নেপাল-তিব্বত-ভুটান প্রভৃতি অঞ্চলে। ফলে এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধা কিছু কিছু দেবী বৌদ্ধ-তন্ত্রে স্থান পেয়েছিলেন, তাঁরাই সম্ভবত বৌদ্ধতন্ত্রের মারফতে হিন্দু-তন্ত্রেও দেবী বলে গৃহীতা এবং স্বীকৃতা হয়েছেন। তারা বা উগ্রতারা বা একজটা দেবী মূলত তিব্বতের দেবী। পর্ণশবরী দেবীও এভাবে বৌদ্ধ-তন্ত্র থেকেই এসেছেন। হিন্দু-তন্ত্রে বর্ণিত ষটচক্রের অধিষ্ঠাত্রী ডাকিনী, হাকিনী, লাকিনী, রাকিণী, শাকিনী দেবীগণের সবাই না হলেও কেউ কেউ মহাচীনাঞ্চল থেকে এসেছেন। সুতরাং বুঝতেই পারছিস বৌদ্ধতন্ত্রের কতটা ব্যাপ্তি।"


চুপ করে বিছানায় এক পা ঝুলিয়ে বসে আছে অবিনাশ। চোখের দৃষ্টি উদাস। জানালা দিয়ে দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রাহুলের কথা গুলো ওর মনের মধ্যে প্রতিধ্বনি করে চলেছে অবিরাম। লামার কথাও তবে কী বাস্তবে ঘটতে পারে? সেভাবেই বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আপন মনেই অবিনাশ বলল, "তবে লামার কথাও অক্ষরে অক্ষরে মিলবে। আমাদের ক্ষতি না হলেও আমাদের প্রিয়জনদের সামনে এখন ঘোর বিপদ। আমার আর কে আছে?"


কথাটা বলেই লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে উদ্বিগ্ন চোখে রাহুলের দিকে তাকাল অবিনাশ।


-"কী হল তোর আবার?"


রাহুলের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে সটান মোবাইলটা বের করে কাউকে একটা ফোন করল অবিনাশ।


-"কোথায় থাকো? কখন থেকে ফোন করছি! সব ঠিকঠাক আছে তো?"

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল অবিনাশ। রাহুলের বুঝতে অসুবিধা হল না, অবিনাশ ওর মাকে ফোন করেছে। কথা বলে কিছুটা শান্ত হয়ে বসে সিগারেট ধরাল অবিনাশ। এখন ওকে বেশ হালকা লাগছে।


রাহুল বলল, "সব ঠিক আছে তো?"


হালকা চালেই অবিনাশ বলল, "হ্যাঁ। এবার শান্তি। মা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনও নিকট জনের কথা আমার মনে পড়ছে না। সুতরাং নো চিন্তা। তুইও বউকে ফোন করে নে।"


অবিনাশের কথায় জোরে হেসে উঠল রাহুল। ওর অট্টহাসি দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার জোগাড় অবিনাশের। হাসির দমক কিছুটা কমলে রাহুল বলল, "চিন্তা নেই। কারও কিচ্ছু হবে না। আমি সব ঠিক করে দেব। কী রে আমার ওপর ভরসা আছে তো?"


এর উত্তর ঠিক কী হতে পারে বা এক্ষেত্রে কী বলা উচিত ভেবে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল অবিনাশ। শেষের কথা দুটো নিছক ইয়ার্কি করে বলেনি ছেলেটা। বেশ জোর দিয়ে ও কথা গুলো বলেছে। চরম আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়েছে রাহুলের শেষ কথাটায়। এমনিতেও রাহুল বাজে কথা কথা বলার ছেলে নয় তা অবিনাশ বিলক্ষণ জানে। আর এই জটিল এবং ততোধিক কঠিন পরিস্থিতিতে তো নয়ই। মুখে কিছু না বলে মুণ্ডুটা শুধু ওপর নিচে একবার নাড়াল অবিনাশ।


দার্জিলিং সফরের বাকি চারটে দিন বেশ আরামেই কাটাল ওরা। বৃষ্টি অবশ্য এ কদিনে এক ঘণ্টার জন্যও পিছন ছাড়েনি। তবে অন্য অলৌকিক উৎপাত আর হয়নি। সারাদিন পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করে রাতে পানশালায় বসে আকণ্ঠ মদ্যপান। প্রকৃতির অসম্ভব খামখেয়ালীপনা। বুনো ফুলের গন্ধ। পাহাড়ের গায়ে এদিক ওদিক উচ্ছল ঝরনার উপচে পড়া যৌবন। হুইস্কির গ্লাস হাতে পড়ন্ত বিকেলে মেঘের সাম্রাজ্যে আস্তে আস্তে ডুবে যাওয়া। সব মিলিয়ে কোথায় তন্ত্র মন্ত্র মূর্তি রহস্য প্রেত অলৌকিক কাণ্ড, সব স্রেফ ভুলে মেরে দিল অবিনাশ। মাঝে একদিন ভোরের দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘাও উকি দিয়ে গেল। শ্বেত শুভ্র শৃঙ্গের ওপর কেউ যেন আলতো করে সোনালী রঙের রেখা বুলিয়ে দিয়েছে। বেশিক্ষণ নয়। মিনিট দুয়েক। আর সেই সময়টা অবিনাশের মনে হল নরক নয়, এ যেন সাক্ষাৎ স্বর্গ।

একদিন নেপাল বর্ডার, মিরিখ ঘুরে এল অবিনাশরা। ফেরার পথে রাহুল বলল, "ভূত যখন আমাদের হোটেল বয়ে এসেছিল তখন আমরা একবার ভুতেদের আড্ডায় ঢু মারলে কেমন হয়?"


কথার মানে না বুঝে অবিনাশ বলল, "সে আবার কেমন?" তারপর গাড়ির ড্রাইভার ছেলেটিকে বলল, "ইহা পর কোই ভূতিয়া জাগা হ্যায় কেয়া?"


ড্রাইভার ছেলেটির নাম প্রেম। নেপালি ছেলে। বেশ হাসিখুশি চনমনে স্বভাব। এখানকার লোকেরা এমনিতেই ফর্সা। বারো মাস প্রাকৃতিক এসি-তে থাকার দরুণই বোধহয় চামরার কোষ গুলো পুড়ে যাওয়ার কোনও ভয় নেই। নেপালিরা সাধারণত বেটে হয় তিব্বতী বা ভূটিয়াদের তুলনায়। কিন্তু গায়ের জোর অনেক বেশি। প্রেম অবিনাশের কথায় একগাল হেসে বলল, "নেহি সাব। এখানে কোনও ভূত নেই।"


অবিনাশ কটাক্ষপূর্ণ দৃষ্টিতে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, "শুন লিয়া? কোই ভূত নেহি হ্যায়। দেয়ার হ্যাজ নো ঘোস্ট।"


রাহুল হেসে প্রেমকে বলল, "আচ্ছা ডাও হিলেও ভূত নেই বলছ?"


এবার প্রেম একটু থমকাল। ভেবে বলল, "অনেকে বলে ওখানে ভূত দেখেছে সাব।"


একটা জিনিস অবিনাশ লক্ষ্য করে দেখেছে এরা কথা কম বলে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও উচ্চারণ করে না। অন্তত পর্যটকদের সাথে তো নয়ই। বাঙালিরা যেমন, চেনা-অচেনা, পরিচিত-অপরিচিত কোনও কিছুরই ধার ধারে না। শুধু মওকার অপেক্ষা। কেউ একটা পাশ থেকে বলেছে কি ব্যাস মুখ চালু। এক প্রশ্নের চোদ্দ লাইনের উত্তর না দিলে যেন তারা শান্তি পায় না। এরা কিন্তু ঠিক তার বিপরীত। যেচে কথা না বললে সারা রাস্তা বোবার মতোই থাকবে। মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলবে না। বিরক্ত হয়ে অবিনাশ বলল, "এই যে বললে ভূত নেই। আবার বলছ আছে। বলি হচ্ছেটা কী? আর এই ডাওহিলই বা কোথায়? তুমি কি দেখেছ সেখানে কিছু?"


একসাথে এত প্রশ্ন আশা করেনি প্রেম। সে বুদ্ধিমান। বাঙালি বাবুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ভয়েই হোক বা অনিচ্ছাতেই হোক সে মুখে কুলুপ এটে স্টিয়ারিং ধরে ঠায় বসে রইল। উত্তর দিল রাহুল। ও সংক্ষেপে অবিনাশকে যা বলল তা এরকম-


কার্শিয়াংয়ের একটা জায়গা আছে বা বলা ভালো একটা রাস্তা হল ডাওহিল। ভিক্টোরিয়া বা ওরম গোছের কিছু একটা স্কুল সেখানে আছে। আর ভূতের রমরমা সেই স্কুলকে ঘিরেই। পরিস্থিতি ক্রমশ এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে বর্তমানে ভূতের দল নাকি স্কুল ছেড়ে আশপাশের এলাকারও দখল নিতে শুরু করেছে। রাতে না না রকম প্যারানর্মাল ক্রিয়াকলাপ ঘটতেও দেখা যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে সকালেও তেনাদের দেখা যেতে পারে।


এ পর্যন্ত বলে থামল রাহুল। আর তক্ষুণি ফস করে প্রেম বলে উঠল, "আমি কখনও দেখিনি। ওই রোডে তো আমাদের যাওয়া আসা করতেই হয় সাব। ভূতের ভয় পেলে কি চলবে?"


অবিনাশ তার স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর সুরে বলল, "তা আমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে পার?"


নিঃশব্দে শুধু সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল প্রেম। তা দেখে অবিনাশ বলল, "বেশ। পরশু তো আমাদের ফেরার টিকিট। তাহলে কাল সকালে যাওয়া যাক। সকাল আটটায় বেরোব। কী বলিস রে?"


রাহুল বলল, "একদম। কোনও সমস্যা নেই। ভূতের দেখা না পেলেও আপত্তি নেই। অ্যাডভেঞ্চারটাই আসল। আর জানিস তো কার্শিয়াং আরও একটা কারণে বিখ্যাত?"


-"কি কারণ?"


রাহুল সিগারেটটা ধরিয়ে জানালার কাচটা একটু নামিয়ে বলল, "অর্কিড। না না রকম অর্কিডের চাষ হয় সেখানে। কার্শিয়াংয়ের অর্কিড বিদেশেও রপ্তানি হয়। যদিও অর্কিডের সিজন এটা না। সুতরাং ফুল দেখতে পাবি না।"

মিরিখ থেকে ফিরে বিকেলে চক বাজার ঘুরে দেখল অবিনাশরা। না না রকমের শীতের পোশাক, জুতো, ছাতা, ঘর সাজানোর জিনিসের পাশাপাশি হরেক কিসিমের তিব্বতী, চাইনিজ খাবার দোকানের ছড়াছড়ি। মোমো, চাউমিন, চিলি চিকেনই কত রকমের! অধিকাংশ দোকানই সামলাচ্ছে নেপালি মেয়েরা। এগুলো ঠিক দোকানও নয়, সবই অস্থায়ী ছাউনি। ধর্মতলার নিউমার্কেটে ফুটের দোকান যেমন হয়, ঠিক তেমন। সুতরাং জিনিসও সস্তা। ভীরও বেশি। দুই প্লেট করে মোমো খেয়ে, একটা মাফলার কিনে হোটেলে ফিরল অবিনাশরা।


বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে নাড়াতে নাড়াতে অবিনাশ বলল, "আহ্, কী অপূর্ব লাগছে বাইরেটা দ্যাখ। ত্রয়োদশীর চাঁদ উঠেছে। আচ্ছা কাল কী আমাদের ভূত দর্শন হবে?"


সিগারেটে দুটো সুখ টান দিয়ে রাহুল বলল, "হলে অবাক হব না। এখানে এসে পর্যন্ত ভূত দর্শনই তো হচ্ছে। তবে কাল না হলেও তোর হতাশ হওয়ার দরকার নেই। আমি মরলে তোকে দর্শন দেব।"


বলেই হাসতে লাগল রাহুল। ব্যাজার মুখ করে অবিনাশ বলল, "নে নে আর মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না। শুয়ে পড়।"



এমনিতেই ভোরে ওঠা অভ্যাস অবিনাশের। ধারাবাহিক প্রাতভ্রমণ বা যোগ ব্যায়ামের কোনও বাতিক না থাকলেও ভোরের হাওয়াটা ওর বেশ ভালো লাগে। কোলাহল নেই, ঝামেলা নেই, অশান্তি নেই, হাজারো চিন্তার ভীড় নেই, বসের কচকচানি নেই, মোবাইলে ফোন আসা নেই। নিশ্চিন্ত নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতির সঙ্গে দু'দণ্ড সুখালাপ করার এ সুযোগটা ছাড়তে চায় না অবিনাশ। কলেজে পড়ার সময় সুদেষ্ণা ওকে বলেছিল, "অবিনাশদা, তুমি তো কবিতা লিখতে পার। ওসব রসায়নের রহস্য তোমার জন্য নয়। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে নীল আকাশ, সবুজ মাঠ, সাদা শালুক। ওদের কাছে যাও।"

বেশ কথা বলত মেয়েটি। অবিনাশের ভালো লাগত। সুদেষ্ণার মুখে একটা মায়া ছিল। যেটা প্রবল ভাবে অবিনাশকে আকর্ষণ করত। একদিন ওকে কলেজে না দেখতে পেলে অবিনাশের ভেতরটা ছটফট করত। কোনও কিছুতেই সেদিন মন বসত না ওর। সেবার সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট বেরিয়েছে। এবারও অবিনাশ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। সুদেষ্ণা এসে বলল, "বাহ্, অবিনাশদা হ্যাট্রিক করতেই হবে। খাওয়াবে কবে বল?"


অবিনাশেরও খুশির মেজাজ। বলল, "চল ক্যান্টিনে। কী খাবি?"


সুদেষ্ণা একটু করুণ গলাতেই বলল, "আজ থাক অবিনাশদা। অন্যদিন হবে। তুমি ভালো থেকো।"


সেই অন্যদিনটা আর আসেনি অবিনাশের জীবনে। দু'দিন বাদে সে জানতে পারল সুদেষ্ণা আত্মহত্যা করেছে। ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মৃতদেহ মিলেছে। বুকের কোনে চিনচিন করে উঠেছিল অবিনাশের। কাদতে ও পারে না। ঈশ্বর যদি সেই ক্ষমতা দিত, তবে অনেকটা হালকা হতে পারত অবিনাশ।


আজ এত বছর পরও সুদেষ্ণার কথা ভুলতে পারেনি অবিনাশ। ভোরের কুয়াশা ঘেরা এই ঠাণ্ডা আমেজে শরীর শীতল হলে সুদেষ্ণাকে আরও বেশি মনে পড়ে অবিনাশের। বা হাতের চেটোর পিছন দিকটা দিয়ে চোখের কোনটা একটু ডলে ঘরে এল অবিনাশ। রাহুল প্রায় তৈরী।

রাহুলকে দেখে চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেল অবিনাশ। ঠিক সময়ে ঘড়ি ধরে আটটায় হোটেলের বাইরে হর্নের আওয়াজ শুনে নেমে এল ওরা। গাড়িতে উঠে অবিনাশ বলশ, "ভেরি পাংচুয়াল। বহুত আচ্ছা।"


সামনের আসনে অবিনাশ। পিছনে রাহুল। সকালে কিছুক্ষণ রোদের দেখা মিলেছিল। আবার যে কে সেই। প্রথমে টিপটিপ করে শুরু হয়েছিল এখন থেকে থেকেই মুষল ধারে বৃষ্টি নামছে। পাহাড়ের বৃষ্টিটাও কিন্তু অদ্ভুত। এখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সামনে দুই হাত দূরেই বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুক্ষণ হয়ে আবার থেমে গেল। এক নাগারে কয়েক ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা বৃষ্টি খুব হয়। মিনিট দুয়েক অন্তর বৃষ্টি নামে। ভাসা মেঘের বৃষ্টি।


গাড়ির জানালা গুলো বন্ধ করা আছে। একটু ফাঁক থাকলেই মেঘ ঢুকে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। হোটেলের জানালা খুলে রেখে একবার খুব শিক্ষা হয়েছে অবিনাশের। ডাও হিলের রাস্তায় এসে অবশ্য জানালা বন্ধ করে রাখতে ইচ্ছা হল না ওদের।


কার্শিয়াং উচ্চতা ১৪৫৮ মিটার। দার্জিলিং থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে। কার্শিয়াংয়ের স্থানীয় নাম অবশ্য খার্সাং, লেপচা ভাষায় যার অর্থ ‘সাদা অর্কিডের দেশ’। মন মাতানো প্রকৃতির রূপ। আশপাশের শান্ত সুস্থিরতার মাঝেই গোটা এলাকাকে কুয়াশার মতো করেই আগলে রেখেছে এক মায়াবী রহস্যময়তা। এই সকালেও গা ছমছমে পরিবেশ। যদিও সকাল দুপুর বিকেল আলাদা করা অসম্ভব। প্রকৃতির রূপ এবং আশপাশের পরিবেশ দেখে তো আন্দাজ করাও মুশকিল। ঘড়ি না দেখলে ভ্রম হয়। রাস্তার এক পাশে খাড়া উচু পাহার। অন্যদিকে গভীর খাদ। আর এই দুটিকেই দৃষ্টির অন্তরালে রেখেছে বড় বড় পাইন গাছ। গাছ বললে অবশ্য মিথ্যা বলা হয়। মহিরূহ কথাটাই এদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই সব গাছের বয়স কত তারও কোনও ঠিক নেই। এই সব গাছের গায়ে শ্যাওলা বা ফার্নের মতো পরজীবী উদ্ভিদরা নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠেছে। আর এরাই একত্রে এলাকাকে যতটা সম্ভব অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখতে সচেষ্ট।


মুগ্ধ হয়ে কুয়াশা ঘেরা অন্ধকার সেই সব মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বনস্পতিদের দিকে তাকিয়ে ছিল অবিনাশ। এক সময় হাত তুলে প্রেমকে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়িটা খাদের বিপরীতে এক ধারে দাড় করিয়ে তিন জনেই নেমে পড়ল। এবার গাড়ির শব্দটা থেমে যেতে নির্জনতা আরও যেন প্রকট হয়ে উঠল। ওরা তিনজন ছাড়া আর কোনও জনমনিষ্যি দূর-দূরান্ত পর্যন্ত চোখে পড়ে না। একটা বুনো পাখি কোথাও তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে উঠল। নিস্তব্ধ পরিবেশে সেই শিস এ গাছ ও গাছ, পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি করে উঠল।


নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রেম বলল, "সাবজি, ডাওহিল থেকে ফরেস্ট অফিস পর্যন্ত এই রাস্তাকে ডেথ রোড বলে। এখানে কাঠ কাঠতে এসে অনেকে মুণ্ডুহীন একটা অবয়ব দেখতে পায়। অনেকেই দেখেছে বাবু।"


রাহুল সিগারেট জ্বালাতে গিয়েও কী একটা ভেবে প্রেমের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর আপন মনেই বলল, "এই মুণ্ডুহীন ভূতের জনক কে জানিস?"


অবিনাশ একটু চমকে উঠে বলল, "মানে? ভূতের বাবা!"


সিগারেট ধরিয়ে ধোয়ার কয়েকটা রিং ছেড়ে রাহুল বলল, "ইয়েস। 1858 সালে জন ক্যুইডর প্রথম হেড লেস হর্সম্যানের তত্ত্ব সামনে এনেছিলেন। গল্প উপন্যাসের বই লিখে অবশ্য নয়। ছবি এঁকে। মুণ্ডুহীন একজন ব্রিটিশ বা ফরাসি লোক ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন। সেই থেকে শুরু। পরে ইংরাজি সিনেমাও হয়েছে।"


অবিনাশ মুখের অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে বলল, "বাব্বা! ইহা পর বিদেশি ভূত ভি হ্যায়?"


প্রশ্নটা যে প্রেমকে করা হয়েছে তা সে বুঝতে পেরেছে। তবে উত্তরটা কী হওয়া উচিত বা কী বললে এই বাঙালি বাবু আশ্বস্ত হবেন তা বুঝতে একটু সময় লাগল ওর। তারপর বোকার মতোই বলল, "নেহি সাবজি। ইহা পর সব দেশি লোগ হ্যায়। ভূত ভি ইসি জাগাহ্ কা। লেকিন উও যো স্কুল দিখাই দে রহি হ্যায় আপকো, উহা পর ভি কুছ হ্যায়। লেকিন উ ক্যায়া হ্যায় মালুম নেহি সাব।"


পাহাড়ি ছেলের সরলতা দেখে মায়া হল রাহুলের। এরা কথার মারপ্যাচ বোঝে না। তাই এদের ঠকানোও সহজ। হয়তো ঘা খায় বলেই চুপ করে থাকে। আজ ছেলেটা যত স্বাভাবিক, গতকাল তার কিছু শতাংশও ছিল না। আরষ্ঠ ভাবটা অনেক কেটেছে ওর। রাহুল বলল, "এখানে তো কিছুই দেখলাম না। চল তাহলে স্কুলেই যাওয়া যাক। যদি কিছু দখা যায়।"


স্কুল কাছেই। পাহাড়ের গায়ে কিছুটা সমতল ভূমির ওপর বড় দোতলা স্কুল বাড়ি। এখানে সব স্কুল অফিস এমনকি বড় বাংলো গুলো একই ধাচে গড়া। ছাদ টিনের চালের দুপাশে ঢালু। তুষারপাত বা বৃষ্টির কারণেই এ ব্যবস্থা। বরফ বা বৃষ্টির জল জমে থাকার কোনও উপায় নেই। গড়িয়ে নীচে পরে যাবে। স্কুলের নাম ভিক্টোরিয়া বয়েজ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আগে গোটা স্কুল বাড়িটা কাঠের ছিল। এখন পাকা হয়েছে। স্কুল বাড়ির সামনে ছোট্ট একফালি সবুজ জমি। ছাত্রদের খেলার জায়গা। তবে স্কুল খোলা না বন্ধ তা অবশ্য বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। খোলা থাকলেও একজন ছাত্রকেও বাইরে দেখা গেল না। খ্রিস্টান মিশনারি আদর্শের এই সব স্কুলে নিয়মানুবর্তিতা কঠোর ভাবে পালিত হয়। সুতরাং ক্লাস চলাকালীন ছাত্রদের বাইরে ঘোরাফেরা একেবারেই চলে না।


অবিনাশ বলল, "স্কুল ছুটি নাকি? ভিতরে যাওয়া যাবে না?"


রাহুল এর মধ্যেই গেটের সামনে গিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। অবিনাশও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। স্কুলের একজন নিরাপত্তারক্ষীর সাথে কথা বলছিল রাহুল। প্রথমে সে কিছুতেই রাজি হয়নি গেট খুলে অপরিচিত দুজনকে ঢুকতে দিতে। আর সত্যিই তো স্কুলে ঢোকার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনও কারণও তাদের নেই। না তো তারা কোনও ছাত্রের অভিভাবক। ভূত দেখতে এসেছি বললে তো আর স্কুলে ঢুকতে দেওয়া যায় না। উল্টে পাগল ভেবে মারতে আসবে। শেষে অনেক তদ্বির তদরাক করায় গেট খুলল নিরাপত্তারক্ষীটি।


রাহুল বলল, তার এক আত্মীয়ের ছেলেকে ভর্তি করাতে চায়। তাই একটু খোঁজ খবর নিতে এসেছে। ওর কথা যে বৃদ্ধ নিরাপত্তা কর্মীটি যে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করল না, তা ওর চোখের চাহনী দেখেই বুঝল অবিনাশ। সন্দেহের নজরেই দুজনকে দেখছে বৃদ্ধ। দেখছে বলা ভুল। রীতিমতো মাপছে ওদের।


একথা সেকথার পর বৃদ্ধ খানিক স্বাভাবিক হলে অবিনাশ বলল, "আচ্ছা এখানে শুনেছি কিছু অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটে! সেটা কি সত্যি?"


চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বৃদ্ধ বলল, "সে কথা বলবেন না বাবু। ওই কারণেই তো ছাত্র ভর্তি হয় না। খুব কম।"


গেটের পাশেই একটা ছোট ঘর। ঘরের এক দিকে ছোট চৌকি। আর এক দিকে একটা স্টোভ, কয়েকটা বাসন আর একটা বড় প্লাস্টিকের কলসি। স্কুল বাড়ির দিকে ঘরের দেওয়ালে একটা ছোট খোপ মতো আছে। ঘুলঘুলির থেকে একটু বড়। বৃদ্ধের ঘরখনা এতটাই ছোট যে ওই খোপটাকে ঠিক জানালা বলা যায় না। সেখানে চোখ রাখলে অবশ্য মাঠ সমেত গোটা স্কুল স্পষ্ট দেখা যায়।

স্টোভে চায়ের জল চাপিয়ে বৃদ্ধ বলল, "আজ পচিশ বছর এখানে আছি। এই স্কুলের ওপর একটা মায়া জন্মে গেছে বাবু। তাই ছেড়ে যেতে পারি না। না হলে কবে চলে যেতাম।" বলে হাসতে লাগল সে।


রাহুল বলল, "কেন চলে যেতে কেন?"


একটু অবাক হয়ে আবার পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বৃদ্ধ বলল, "এখানে রাতে অনেক কিছু ঘটে বাবু। আপনারা জানেন না। আপনাদের জানার কথাও নয়। মোবাইলে আর কত জানবেন? শুনুন, এই স্কুল এক ইংরেজ সাহেব তৈরী করেছিলেন। কিন্তু স্কুল চালু হওয়ার পর একদিন তিনি হঠাৎ আত্মহত্যা করেন। ওই যে দেখছেন দোতলার বারান্দার শেষ ঘরটা। ওখানেই থাকতেন সাহেব। ওটাই ছিল ওর অফিস। বড্ড ভালোবাসতেন এই স্কুলটাকে, এখানকার প্রত্যেক ছাত্রকে। অর্ধেক দিন রাতে বাংলোতেও ফিরতেন না। একদিন সকালে ওই ঘরেই ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। ওই সাহেবের আত্মা এখনও রোজ রাতে আসে বাবু। স্কুলে হেঁটে চলে বেড়ায়।"


চায়ে চুমুক দিয়ে অবিনাশ বলল, "তা তোমার ভয় করে না?"


হেসে বৃদ্ধ বলল, "মিথ্যা বলব না, প্রথম প্রথম ভয় লাগত বাবু। রাত হলেই না না রকম আওয়াজ শোনা যেত স্কুলের ভিতর থেকে। মনে হত কেউ যেন সিড়ি দিয়ে হেঁটে উঠছে আবার নামছে। স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যারকেও বলেছিলাম। কেউ বিশ্বাস করেনি। এখন আর ভয় করে না। সাহেব কোনদিন কারও ক্ষতি করেনি।"


এই নির্জন কুয়াশা ঢাকা অন্ধকারে বসে বৃদ্ধর কথা গুলো শুনে অবিনাশের মনে হচ্ছিল, প্রাচীন কোনও ঋষি যেন ঝরঝর করে মহাকাব্যের ধারাভাষ্য করে চলেছেন আপন মনে।


এ কথার কোনও শেষ নেই। এ ব্যাখ্যার কোনও দৃঢ় যুক্তি নেই। কথার পিঠে কথা চাপিয়ে রূপ নিয়েছে গল্পের। আকার নিয়েছে অলৌকিকতার, রহস্যের, ভয়ের।


স্কুল গেটের বাইরে এসে আরও একবার পিছন ফিরে দেখল রাহুল। তারপর গাড়িতে উঠে বলল, "কিছু জিনিস আড়ালে থাকাই ভালো। সব কিছু প্রকাশ্যে চলে এলে মজাটা নষ্ট হয়ে যায়। কী বলিস? চল ফেরা যাক।"


অবিনাশ কী বুঝল কে জানে। ফস করে বলল, "ঠিক। সাদা অর্কিডের মাঝে ঘুমিয়ে থাক ওরা। মনে থাক প্রিয়জনরা।"



কার্শিয়াং থেকে ফিরে রাহুলের আচরণে বিস্তর গড়মিল লক্ষ্য করল অবিনাশ। হঠাৎ করে অবিনাশকে বলল, "আমার একটা বিশেষ কাজ আছে। রাতে পানশালায় দেখা হবে। ন'টা মনে রাখিস। বাই।" বলেই ওকে নামিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। এরকম তো সচরাচর করে না রাহুল! ঘুরতে এসে এই শেষ বেলায় কী এমন কাজ থাকতে পারে যা অবিনাশকে বলা যেত না? মুখে অবশ্য কিছু বলল না অবিনাশ। তবে মনে খচখচানিটা থেকেই গেল। কিন্তু জোর করে তো আর যাওয়া যায় না, যেখানে ওর উপস্থিতিটা অন্য জন স্পষ্ট অপছন্দের তালিকায় ফেলে দিয়েছে। অগত্যা হাত নেড়ে রাহুলকে বিদায় করে ম্যালের পাশ দিয়ে উদ্দেশ্য হীন ভাবে সোজা হাঁটতে লাগল অবিনাশ। মহাকাল মন্দিরের চড়াই পথটা বা দিকে রেখে সোজা রাস্তাটা ধরল অবিনাশ। ডান দিকে খাদ বা দিকে অবজার্ভেটরি হিল সোজা আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তাটা আরও ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। কিছুদূর এগিয়ে বা দিকে একটা পেল্লায় সাদা বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়াল অবিনাশ। বড় লোহার গেটের কিছুটা অংশ মরচে পড়ে গিয়েছে। বুনো লাল ঝুমকো ফুলের একটা লতা বেশ জাকিয়ে বসেছে সেই গেটের মাথায়। বাড়িটা দোতলা। কাঠের ছাদ ঢালু হয়ে দুপাশে নেমে গিয়েছে সমান্তরাল ভাবে। বাড়ি এবং গেটের মাঝখানেও বেশ কিছুটা জায়গা। বোঝাই যাচ্ছে এক সময় বেশ সুন্দর সাজানো ছিল এই জায়গাটা। হয়তো বাগানের সখ ছিল বাড়ির মালিকের। সেখানে নিজের হাতে ফুলের গাছ লাগাতেন তিনি। বিকেলের পরন্ত রোদে এই বাগানে বসেই দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকতেন আনমনে। এখনও কিছু গাছ অবশ্য সেই স্মৃতি বহণ করে চলেছে এখনও। বাকিটা জংলা গাছের ঝোপে ঢেকে গিয়েছে। তবে বাড়ির মালিক যে এককালে বেশ সৌখিন লোক ছিলেন, খাদের ধারে সেই বাড়িই তার সাক্ষ্য বহণ করে চলেছে। কিন্তু বাড়িটা কার? ভালো করে এবার গেটের দুপাশটা দেখল। যদি কোনও ফলক থেকে থাকে। ওর ডান দিকের বুনো লতার ঝোপটা একটু সরাতেই চমকে উঠল অবিনাশ। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না অবিনাশ। শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা আছে 'সি. আর. দাশ'। তার ঠিক নীচে লেখা আছে 1925 সালের 16 জুন এই বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। এখন বাড়িটি সরকার সংগ্রহশালা করেছে। তেমন একটা ফলকও আছে। তবে বাড়ির হাল এবং গেটে বড় মরচে ধরা তালা দেখে ভারাক্রান্ত বিষন্ন মনে ফিরতি পথ ধরল অবিনাশ।


ম্যালে খানিক চরকিপাক কেটে পানশালায় এসে বসল অবিনাশ। এখন সবে পাঁচটা। রাহুল বলেছিল ন'টা নাগাদ আসবে। এখনও ঢের দেরী। কিন্তু অবিনাশ একাই বা কী করবে? তার চেয়ে গ্লাস হাতে দিব্যি সময় কেটে যাবে। গত দু'দিনের তুলনায় আজ পানশালা ভর্তি। প্রায় সবকটি টেবিলেই লোক আছে। কম বয়সি ছেলে মেয়েরাই বেশি। সকলের হাতে সোনালী তরলের গ্লাস। মুখে হাসি। কথা বলছে চাপা স্বরে। কোলাহল একেবারেই নেই। মনেও হচ্ছে না এত লোক এখানে বসে আছে। হালকা একটা সুর বাজছে। মনে হচ্ছে অনেক দূরে কেউ বসে নিবিষ্ট চিত্তে যেন বাশি বাজাচ্ছে। ওদের দেখে ভালো লাগল অবিনাশের। হালকা দু-তিন বার সিপ করে সিগারেট ধরালো। বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। দুপুর বা বিকেলে আজ অনেকটা ছাড় দিয়েছিল। এবার তা সুদে আসলে উশুল করে নিতে চাইছে প্রকৃতি। অবিনাশের পাশে কাচের জানালার ওপর বৃষ্টির জলধারা আপন খেয়ালে অদ্ভুত দুর্বোধ্য এক মানচিত্র আঁকতে আঁকতে নীচে নেমে যাচ্ছে। অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকেও তার শুরু বা শেষ কোনটাই বুঝতে পারল না অবিনাশ। প্রায় দু'পেগ হুইস্কি শেষ করতে যাবে এমন সময় প্রায় ঝড়ের গতিতে পানশালার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল রাহুল। সোজা অবিনাশের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে দু'পেগ রামের অর্ডার করে দিল।

রাহুলকে দেখে কেমন একটা অস্বস্তি হল অবিনাশের। এই কয়েক ঘণ্টায় আমূল বদলে গিয়েছে ছেলেটা! অন্তত ওর চেহারাটা। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজে চুপসে গিয়েছে। চুল এলোমেলো। চোখ দুটো টকটকে লাল। মুখ একেবারে যেন রক্ত শূন্য ফ্যাকাশে। সাদা হয়ে গিয়েছে।


অবিনাশ কপালে ভাজ ফেলে বলল, "কী রে কী হয়েছে তোর? আর এরকম ভিজলি কী করে? গাড়িতেই তো গেলি!"


রাহুল অবশ্য সহজ গলায় বলল, "আর বলিস না। ফেরার সময় মাঝপথে গাড়িটা বিগড়ে গেল। আমিও স্নান করে গেলাম। ও কিছু হবে না। তুই এখানে থাকবি আমি জানতাম তাই সোজা এখানেই এলাম।"


প্রায় ঢকঢক করেই এক পেগ রাম সাবার করে দিল রাহুল। ওর ধারণা, না ধারণা নয় বদ্ধমূল বিশ্বাস অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা লাগার হাত থেকে বাচতে একটাই উপায়, একটাই ওষুধ, সেটা রাম। ওর ওষুধ খাওয়া হলে অবিনাশ বলল, "তুই গেছিলি কোথায়? কী এমন তোর জরুরি কাজ ছিল বলবি?"


রাহুল একটু কী ভেবে বলল, "সিগারেট দে।"


সিগারেটে দুটো লম্বা টান দিয়ে রাহুল বলল, "সে এমন কোনও ব্যাপার নয়। হিমালয়ান মাউন্টেরিং ইনস্টিটিউট ছাড়িয়ে একটা পুরণো গুম্ফা আছে। সেখানেই গিয়েছিলাম একটা পুথির খোঁজে। কিন্তু কাজ হল না।"


-"পুথি পেলি না?"


রাহুল বোধহয় কোনও চিন্তা করছিল। অবিনাশের প্রশ্নে মনো জগৎ থেকে বাস্তবে এসে একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, "হুঁ? নাহ্, ঠিক তা নয়। যাওয়া হল না আসলে।"


অবাক হয়ে অবিনাশ বলল, "মানে? যাওয়া হল না মানে?"


দ্বিতীয় পেগটা শেষ করে ঠক করে গ্লাসটা রেখে রাহুল বলল, "হুম। পৌঁছতে পারিনি। বাদ দে। ওসব এখন বলে লাভ নেই। বল তুই কী করলি?"


অবিনাশ আর ঘাটালো না। এমনিতেই রাহুল একটু খামখেয়ালী গোছের। তার মধ্যে ওর আবার এসব পুথি পত্রের ওপর বিশেষ ঝোঁক। বেচারা হয়তো পুথিটা পায়নি। তাই মনমরা হয়ে আছে। এসব ভেবে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ির প্রসঙ্গ তুলল অবিনাশ। সব শুনে রাহুলও একটু আহা উহু করল বটে কিন্তু ওর মধ্যে সেই ছটফটে ভাবটা যেন একেবারেই উধাও হয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারল অবিনাশ। যতই এটা উপলব্ধি করল অবিনাশ, ততই ওর মধ্যে অস্বস্তির ভাবটা যেন ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল।


দার্জিলিং থেকে এনজেপি পর্যন্ত গোটা রাস্তায় একটা কথাও বলেনি রাহুল। রাত থেকেই একেবারে চুপচাপ। ওর মুখের ফ্যাকাশে ভাবটাও মোছেনি। কেমন উদাস চোখে সব সময় তাকিয়ে আছে। আরও একটা জিনিস এই মাত্র অবিনাশ খেয়াল করল গত দিনের জামা কাপড় গুলোই ফের পরেছে রাহুল। এটা ওর স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। এবার অবিনাশ একরকম বাধ্য হয়েই প্রশ্ন করল, "কী ব্যাপার বল তো? কাল রাতে কী জামাটাও ছাড়িসনি? তোকে তো একটা জামা দ্বিতীয় দিন আর ব্যবহার করতে দেখিনি! আজ কী হল?"


রাহুল একবার নিজের জামাটা দেখে হেসে বলল, "তেমন কিছু না। ট্রেনেই তো থাকব। নতুন জামা ভেঙে কী হবে আর? ফিরে গিয়ে এটাকেও বিদায় দেব একেবারে।"


আর কোনও কথা হল না। ট্রেনেও সেই যে উপরের বার্থে উঠে গেল রাহুল আর নামলই না। কম্বলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে শুয়ে থাকল। কার্শিয়াং থেকে ফেরা অবধি একের পর এক রাহুলের অস্বাভাবিক আচরণে হতবাক অবিনাশ। তবে কী কোনও কারণে অবিনাশকে এড়িয়ে যেতে ছাইছে রাহুল? সংস্পর্শে থাকতে চাইছে না? তারই বা কী কারণ থাকতে পারে? নীচের বার্থে বসে অবিনাশ মনে মনে ঠিক করে নিল, আর নয়। রাহুলের সঙ্গে এই শেষ। সে যদি মনে করে থাকে অবিনাশের কেনা মূর্তির জন্য ওর বা ওর পরিবারের ওপর বিপদ আসতে পারে তবে সেখান থেকে চুপচাপ সরে আসাই শ্রেয়। নিজের ভুলের জন্য অন্য কাউকে বিপদে ফেলতে অবিনাশের মন সায় দিল না। দাত চেপে মনকে শক্ত করল অবিনাশ। তারপর দরজার সামনে গিয়ে সিগারেট ধরাল।


রাতের অন্ধকার চিরে হু হু করে ছুটছে ট্রেন। ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী শুয়ে পড়েছে। দরজার সামের আলোটা ছাড়া গোটা কামরায় একটিও আলো জ্বলছে না আর। অবিনাশ দেখল, ওরা পাহাড় ছাড়লেও বৃষ্টি ওদের পিছু ছাড়েনি। দক্ষিণ আকাশে আলোর ঝলক দেখা মিলছিল অনেক্ষণ ধরেই। এবার নামল বৃষ্টি। সে বেগ যেন পাহাড়ের বৃষ্টিকেও হার মানায়। দরজা বন্ধ করে ভিতরে আসতে যাবে এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল অবিনাশের। রাহুলের স্ত্রী অপর্ণার নামটা মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠতে একটু অবাক হল অবিনাশ। এত রাতে অপর্ণা কেন ওকে ফোন করছে? তবে কী কোনও....


ফোন ধরে কাপা গলায় কোনরকমে "হ্যালো" বলল অবিনাশ।


ওপাশে অপর্ণার গলা স্বাভাবিক। একটু উত্তেজিত স্বরে সে বলল, "অবিনাশ দা তোমার বন্ধুটি কোথায়? তার তো দু'দিন ধরে কোনও পাত্তাই নেই। পাহাড়ে গিয়ে বউকে ভুলে গেল নাকি? বাড়িতে কী ফিরবে না?"


দাম্পত্য কলহ যে কী বিষম বস্তু তা হারে হারে টের পেল অবিনাশ। এক ধারে কথা গুলো বলে দম নেওয়ার জন্য থামল অপর্ণা। তবে রাগটা অপর্ণার ছদ্ম তা স্পষ্ট। হয়তো রাহুলের সাথে কথা হয়নি তাই চিন্তার বশে ওকে ফোন করেছে। কিন্তু এই পরাস্থিতি আগে কখনও আসেনি। অবিনাশ প্রথমটা বুঝে উঠতে পারল না কী বলবে। তারপর আমতা আমতা করে বলল, "রাহুলকে ফোন করেছিলে?"


ফোনের ওপার থেকে উত্তর এল, "হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার। কিন্তু সুইচড অফ বলছে। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে বিরক্ত করলাম।"


অবিনাশ হেসে বলল, "না না বিরক্তর কিছু নেই। রাহুল ঘুমিয়ে পড়েছে। ফোনে হয়তো চার্জ নেই। আমরা সকালেই শিয়ালদা পৌঁছে যাব। চিন্তা করো না।"


অবিনাশের কথায় আশ্বস্ত হল অপর্ণা। চাপা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হেসে বলল, "বেশ বেশ। আপনি আছেন যখন আমার চিন্তা নেই। সাবধানে আসুন আপনারা। রাখি অবিনাশ দা।"


অবিনাশ একটু হেসে ফোনটা পকেটে চালান করে নিজের বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত দু'চোখ বেয়ে ঘুম নেমে আসতে বেশি সময় লাগল না অবিনাশের।



শিয়ালদহ স্টেশনে দার্জিলিং মেল যখন ঢুকল ভোরের আলো তখনও ঠিক মতো ফোটেনি। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গিয়েছে ওদের ট্রেন। আড়মোড়া ভেঙে অবিনাশ বলল, "চা খাবি?"


হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে রাহুল কতটা নিজের মনেই বলল, "সাড়ে পাঁচটা। নাহ্। তুই খেয়ে নে। আমি বেরোলাম।"


কথা শেষ করে প্রত্যুত্তরের কোনও আশা না করেই হনহন করে স্টেশনের বাইরের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থামল। আবার পিছনে ফিরে এসে বলল, "শোন, আমার একটা উপকার করবি? আমার ব্যাগটা একটু বাড়িতে পৌঁছে দিবি?"


অবাক হয়ে অবিনাশ বলল, "মানে? তুই কোথায় যাচ্ছিস এখন?"


হেসে রাহুল বলল, "একটা কাজ আছে। একটু দূরে যেতে হবে।"


রাগ ক্ষোভ বিরক্তি সবকটি অভিব্যক্তি এবার একসাথে ঝড়ে পড়ল অবিনাশের চোখে মুখে। গত দু'দিন ধরে রাহুলের এই অস্বাভাবিক আচরণ সত্যিই অসহ্য হয়ে উঠেছে অবিনাশের। অনেক কষ্টে শান্ত গলায় সে বলল, "এখন বাড়ি না গিয়ে কী এমন কাজে যাচ্ছিস তুই? আর অপর্ণা তোর চিন্তা করছে। আমাকে ফোন করেছিল। একবার অন্তত ফোনে কথা বলে নে।" বলে নিজের মোবাইল থেকে অপর্ণাকে ফোন করতে যাবে অবিনাশ, বাধা দিল রাহুল।


-"না, এখন ওকে কিছু বলিস না। এত সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস ওর নেই। খুব চিন্তা করবে। তার চেয়ে একটু বেলা হলে সব জেনে যাবে। তুই শুধু ব্যাগটা পৌঁছে দিস। চললাম।"


শেষ কথাটা বলে একটু হাসল রাহুল। তারপর হাত নেড়ে আগের মতোই দ্রুত পায়ে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল।

স্টেশনের বাইরে এই ভোরেও লোক গিজগিজ করছে। বেশিরভাগই মুটে মজুর শ্রেণি। ঠেলাওয়ালাদের হাকা-হাকি ডাকা-ডাকিতে গম গম করছে গোটা স্টেশন চত্বর। শহর কলকাতার এ রূপ আগে দেখেনি অবিনাশ। প্রতি মুহূর্তে বদলাচ্ছে এ শহর। জীবিকা, উপার্জনের জন্যও যে নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ আছে তাও জানা ছিল না অবিনাশের। কাচা সবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, কী নেই সেখানে? রীতিমতো স্টশনের ওপরেই বাজার বসে গিয়েছে। বেলা গড়াতে শুরু করলে এই বাজারও আস্তে আস্তে গায়েব হয়ে যাবে। গরম চায়ের ভাড়ে চুমুক দিতে দিতে এই সবই দেখছিল অবিনাশ। ট্যাক্সি নিয়ে যখন বাড়ি ফিরল তখন ঘড়িতে ছ'টার কিছু বেশি বাজে। জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে সবকিছু  শুরু থেকে একবার ঝালিয়ে নিতে চাইল অবিনাশ। মৃত মানুষ কী ফিরে আসতে পারে? কলকাতার জনবহুল এলাকায় দশ তলার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসে সবকিছুই ভাওতা মনে হল অবিনাশের। কিন্তু বিশু পাল? এতটা ধোকা খাবে ওর চোখ কান! অতিরিক্ত নেশায় সবই বাস্তব, সবই সম্ভব। এই জনস্রোত, এই আলোঝলমলে ব্যস্ত শহরে কোথায় বিশু পাল আর কোথায় নরকের দ্বার? পরিবেশ এবং পরিস্থিতি যুক্তিবাদী মনকেও দুর্বল করে দেয়। তার প্রমাণ পেয়েছে অবিনাশ। নিজের মনেই হেসে উঠল সে। দু'চোখের পাতা কখন বুজে এসেছিল জানে না অবিনাশ। মোবাইলের রিং টোনে ধরমর করে উঠে বসল অবিনাশ। সুধীরের ফোন!


এত ভোরে সুধীরের কী প্রয়োজন পড়ল আবার? বাড়িতে ফিরতে দেরী নেই, অফিস থেকে ফোন চলে আসবে। বড় বাবুর মুখাপেক্ষি হয়ে থাকা পুলিশ কর্মীদের একটা বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মুখটা বিকৃত করে ফোন ধরে তীব্র বিরক্তি সূচক ভঙ্গিতে অবিনাশ বলল, "কী ব্যাপার, কী হয়েছে?"


ওপারে একটু চুপ করে থেকে ভয়ে ভয়ে সুধীর বলল, "একটা খারাপ খবর আছে স্যার।"


এবার স্পষ্টতই খেকিয়ে উঠে অবিনাশ বলল, "কোন দিন ভালো খবর শুনিয়েছো? নাও এবার ভনীতা ছেড়ে বল কী হয়েছে?"


সুধীর এবার একটু গম্ভীর হয়ে আমতা আমতা করে বলল, "স্যার আপনার বন্ধু মানে রাহুল চ্যাটার্জি ইজ নো মোর। মানে মারা গেছেন। মানে অ্যাক্সিডেন্ট।"


এসব খবরে চট করে ভেঙে পড়ার ছেলে নয় অবিনাশ। কারও মৃত্যু বা বিপদের খবর ওকে বিচলিত করে না। বরং এসব ক্ষেত্রে ও আরও বেশি শান্ত গম্ভীর হয়ে যায়। পেশার তাগিদে সারাদিনই না না রকম বিষয় ঘাটতে ঘাটতে শক্ত হয়ে গিয়েছে অবিনাশ। তাই সুধীরের কথা শুনে প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগল না অবিনাশের। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল, "আই সি! ডিটেইলসে বল।"


অবিনাশের মুড পরিবর্তন হয়েছে বুঝে সুধীর সাহস করে বলল, "স্যার আপনি যদি একবার লালবাজার আসতেন খুব ভালো হত।"


"ওকে। উইদিন টেন মিনিটস। আমি আসছি।" বলেই ফোনটা কেটে দিল অবিনাশ।


সোফা ছেড়ে উঠে কোনরকমে পোশাক বদলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল অবিনাশ। নিজেই বরাবর ড্রাইভ করে। ওর মতে ড্রাইভার থাকলে প্রাইভেসি নষ্ট হয়। অন্য কেউ তদন্তের ব্যাপারে ঘুণাক্ষরে টের পায় সেটা কোনও মতেই চায় না অবিনাশ।


ওর ফ্ল্যাট থেকে লালবাজার বেশি দূরে না। তাছাড়া এত সকালে কলকাতার রাস্তায় ট্রাফিক অত থাকে না। যা গাড়ি চলছে সবই ব্যক্তিগত। গণপরিবহণের সময় এখনও আসেনি। দশ মিনিটের মধ্যে নিজের কেবিনে ঢুকে এক গ্লাস জল খেয়ে বেয়ারাকে চা আনতে বলে অবিনাশ সুধীরের দিকে তাকিয়ে বলল, "কী হয়েছে থরোলি বলে যাও। আর অপর্ণা মানে রাহুলের স্ত্রীকে খবর দেওয়া হয়েছে?"


ঘরে অবিনাশ আর সুধীর ছাড়াও ডিসি (ক্রাইম) সুনীল কুমার আছেন। খবরটা প্রথম ডেপুটি কমিশনারের কাছেই আসে। সেই অবিনাশকে না পেয়ে সুধীরকে জানায়। বড় টেবিলের এক কোনায় অবিনাশ বসে আছে। উল্টো দিকে সুধীর আর সুনীল কুমার দুটো চেয়ারে বসে আছেন। প্রশ্নটা সুধীরকে করলেও উত্তর এল সুনীল কুমারের কাছ থেকে। অবিনাশের কথা শেষ হলে ডিসি ক্রাইম বললেন, "আসলে গত কাল দার্জিলিং থেকে আমার কাছে ফোন আসে। একটা বডি খাদ থেকে উদ্ধার হয়েছে। কলকাতার লোক। ওখানকার পুলিশের ধারণা গত পরশু দিন ঘটনাটা ঘটেছে স্যার। ওয়েদার খারাপ থাকায় প্রথমে ট্রেস করা যায়নি। পরে ক্রেন দিয়ে বডি সমেত গাড়ি খাদ থেকে তোলা হয়। পার্সে আইডি কার্ড মিলেছিল তাই রক্ষে। তাই দেখে বডি সনাক্ত করে লালবাজারে জানায় ওখানকার পুলিশ।"


সুনীল কুমারের কথা শেষ হলে সুধীর বলল, "হ্যাঁ, স্যার ওর স্ত্রীকে খবর দেওয়া হয়েছে।"


দু'জনেই এবার চুপ করল। একবার সুধীর আর একবার সুনীল কুমারের দিকে তাকিয়ে মাথাটা বুকের ওপর ঝুকিয়ে নির্জিবের মতো বসে থাকল অবিনাশ। মাথাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে ওর। সুনীল কুমার যা বলল তা অবিনাশের কাছে বিশ্বাসযোগ্য একেবারেই নয়। কী করে সম্ভব? রাহুল আজ তার সাথেই কলকাতায় ফিরেছে। তবে পরশু তার.....। না না, এ হতেই পারে না। কোথাও তো একটা ভুল হচ্ছেই। অবিনাশের মাথার সব শিরা উপশিরা গুলো জট পাকিয়ে গিয়েছে।


"স্যার, স্যার শুনছেন?"

সুধীরের প্রশ্নে চমকে তাকাল অবিনাশ।


সুধীর একটু হাফ ছেড়ে বলল, "স্যার শরীর খারাপ লাগছে? আমরা কী এখন তবে আসব?"


অবিনাশ আরও একটু জল খেয়ে কাপা হাতে গ্লাসটা টেবিলে রেখে সুনীল কুমারের উদ্দেশে বলল, "আচ্ছা গাড়ি খাদে পড়ে গেছিল বলছ। তাহলে ড্রাইভারের কী হল? তার বডি কী পাওয়া গেছে?"


সুনীল কুমার বলল, "হ্যাঁ স্যার। স্থানীয় ছেলে। নাম প্রেম থাপা। এই ফাইলে সব আছে। আপনি একটু বিশ্রাম করুন। আমরা পরে আসব স্যার।" কথা শেষ করে একটা ফাইল অবিনাশের দিকে এগিয়ে দিল সুনীল কুমার। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে ফের বলল, "স্যার একটা কথা বলব?"


অবিনাশ মুখ না তুলেই মাথাটা ওপর নীচে নাড়াল।


সুনীল কুমার বললেন, "স্যার আপনিও তো ওর সাথেই ছিলেন। আপনি কিছু মানে জানতে পারেন নি?"


এবার মুখ তুলে অবিনাশ তাকাল সুনীল কুমারের দিকে। শুকিয়ে যেন কুচকে গিয়েছে অবিনাশের মুখটা। গলা দিয়ে ওর আওয়াজ বেড়োতে চাইছে না। একরকম জোর করে অবিনাশ বলল, "আমি....আমি তো মানে.... রাহুল তো আমার সাথেই ফিরল। তবে সে কে?"


এতটাই অসংলগ্ন এবং শেষের কথা গুলো এত আস্তে প্রায় বিড়বিড় করে অবিনাশ বলল যে সুনীল কুমার তার সিকি ভাগও বুঝল না। বন্ধুর মৃত্যু সংবাদে অবিনাশ চরম মানসিক আঘাত পেয়েছে ভেবে ওরাও আর ঘাটাল না। স্যালুট ঠুকে দু'জনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

অবিনাশ স্থানুর মতো কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকল। দেহ মন দুই-ই অবসন্ন বিপর্যস্ত। মূত্যুর খবর তার কাছে নতুন কিছু নয়। রাহুলের খবরটা প্রথম শুনেও খুব একটা বিচলিত হয়নি অবিনাশ। কিন্তু এবার তার ভয় করতে লাগল। ভয়টা ঠিক কিসের তা অবিনাশ জানে না। কিন্তু তার শরীরের ভিতর যেন একটা বরফের মতো ঠাণ্ডা জীব সর্পিল গতিতে ওঠা নামা করছে ক্রমশ। এখন তার করণীয় কী? কোথা থেকে কী সব হয়ে যাচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। তবে সুনীল কুমার যে মিথ্যা বলছে না তা জলের মতো পরিস্কার অবিনাশের কাছে। কার্শিয়াং যাওয়ার দিন ওদের গাড়ির ড্রাইভার প্রেমই ছিল। তা সুনীলের জানা সম্ভব নয়। সুতরাং দুর্ঘটনা বাস্তবেই ঘটেছে। আর তা যদি হয়ে থাকে তবে রাহুল কী করে তার সাথে গোটা দুটৌ দিন থাকল? তার মানে সে রাহুল ছিল না! এসি ঘরে বসেও সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে অবিনাশের। দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে পুলিশের গাড়িতেই বাড়ি ফিরল অবিনাশ। কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা বেড রুমে ঢুকে দেখল রাহুলের ব্যাগটা সেখানে আছে কিনা। হ্যাঁ, আছে। মাঝারি সাইজের পিঠ ব্যাগটা তার ব্যাগের পাশেই রয়েছে। ব্যাগটার নীচের দিকে লেগে থাকা কাদা এখন শুকিয়ে গিয়েছে। কাপা হাতে ব্যাগটা খুলল অবিনাশ। ওপরের প্রথম চেনটা খুলতেই এক তারা কাগজ এল তার হাতে। ডায়েরির ছেড়া দুটো পাতা ভাজ করে কোনরকমে সব জিনিসের ওপরে চেপে ঢোকানো ছিল। চেন খুলতেই সেটা বেরিয়ে এসেছে। কাগজ হাতে নিয়ে খাটে বসে পড়ল অবিনাশ। খুব তাড়াহুড়োয় রাহুল কিছু লিখে রেখেছিল। আর লেখাটা যে অবিনাশের উদ্দশ্যে তা প্রথম লাইনেই স্পষ্ট। রাহুল লিখেছে-


অবিনাশ, যা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যা হবে সব সত্যি। মনে কোনও সন্দেহ রাখিস না। এর মধ্যে এতটুকু জল নেই। আমার হাতে আর বেশি সময়ও নেই। তোর সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। হলেও এসব বলা তখন সম্ভব নয়। অভিশাপ কী ভয়ানক হতে পারে এবং তার চেহারা কত হিংস্র তা লিখে বোঝাতে আমি ব্যর্থ। তবে এটুকু বলতে পারি, যে ভুল আমরা করেছি, যে অভিশাপকে আমরা আমাদের জীবনে স্বেচ্ছায় আমন্ত্রণ জানিয়েছি তার ফল আমাদের ভোগ করতেই হবে। এর হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। আজ আমি যাচ্ছি। কাল তুই যাবি। কিন্তু যেতে তোকে হবেই। মূর্তির অভিশাপ তাড়া করে বেড়াবে তোকে। তাকে বেশিদিন আটকে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। প্রিয়জনকে আমরা ছাড়তে পারিনি। এবার মূর্তির সেই দেবী আমাদের কাউকে ছাড়বে না। এখন শুধুই প্রতীক্ষা। চরম বাস্তবের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকা। নরকের দ্বার আজ আবার উন্মুক্ত।


58 views0 comments

Comments


bottom of page