top of page
Search

বিশেষ সংখ্যা ।। ভয় ভৌতিকে ।। দেবেশ মজুমদার


পুনর্জন্ম


দেবেশ মজুমদার



আজও ভুলতে পারিনি সেই বিশেষ রাতের কথা। অফিস কলিগ ইন্দ্রর বিয়েতে বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ করেছে। অতএব যেতেই হবে। ছবি তোলা আমার নেশা তাই ক্যামেরা কাঁধে দুপুরেই ক্লাস শেষে আমার মোটর বাইকে চেপে রওনা দিলাম আঝাপুরের উদ্দেশ্যে। রাতেই বাড়ি ফিরতে হবে। তাই সকাল সকাল খাওয়া দাওয়া করে বেড়িয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু আচমকা এক পরিচিত বন্ধুর সাথে দীর্ঘদিন পরে দেখা। ফলে গল্প গুজবে এর মধ্যে কোথা দিয়ে যে ঘড়ির কাঁটা এগারোটারা ঘরে ঢুকলো খেয়াল থাকলে না!

আর দেরী করা ঠিক হবে না ইন্দ্রর কাছে বিদায় নিয়ে বেরতে বেরতে রাত সাড়ে এগারোটা হয়ে গেল। গ্রামের রাস্তা ছেড়ে মাঠে যাবার সমান্তরালা রাস্তায় যখন নামলাম তখন রাত বারোটা বেজে গেছে। তারায় ভরা আকাশে পাণ্ডুর চাঁদ। মাঠ এবং গ্রামের গাছপালা ঘরবাড়ী সবই কেমন যেন ছায়া ছায়া রহস্যময়। দক্ষিণে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। পথ যেন শেষ হয়না আর। একঘন্টা হয়ে গেলে অথচ এখন মেন রোডে উঠতেই পারিনি। ভুল রাস্তায় চলে যাচ্ছিনা তো? ভিতরে ভিতরে ঘেমে উঠেছি। রাস্তায় কাওকেই দেখা যাচ্ছে না। ঘন অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। রাস্তার একপাশে বাইক থামিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। যদি কাওকে পাওয়া যায় তো জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে ঠিক রাস্তা ধরে আমি যাচ্ছি কি না? সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ফেলতেই আচমকা অন্ধকারে ভেদ করে একজন লোকের উদয় হল। লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা ন্যশনাল হাই ওয়ে’টা কত দূর?” 

মুখে উত্তর না দিয়ে ইশারায় হাত তুলে দেখালো। আমি বাইকে স্টার্ট দিলাম। আরো পনেরো মিনিট যাবার পরে চোখে পড়ল একটা চৌমাথা। কোনদিকে যাব ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না। লোকটি কি তাহলে আমাকে ভুল পথ দেখালো? এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়। দিনের বেলায় যখন এসেছিলাম তখন হাই ওয়ে ছেড়ে আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম ইন্দ্রের বাড়ি। অথচ দেড় ঘন্টা হয়ে গেল এখনও গ্রামের পথ ছেড়ে আমি জাতীয় সড়কে উঠতে পাড়লাম না? কাছা কাছি কাওকে দেখা যাচ্ছে না। ঝুপসি অন্ধকার চারিদিকে ছেয়ে আছে। অগত্যা বাঁদিকের পথ দিয়ে গ্রামের দিকেই এগোতে থাকি। যদি কারও দেখা পাই জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে। মিনিট দশেক হাঁটার পরও কাওকে দেখতে পেলাম না। শুনশান রাস্তা। দু-একটা কুকুরের ডাক কানে এলো। বাঁশ বাগানের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে রাস্তায় আলপনা কাটছিল। আর একটু এগোতেই আচমকা ঘন অন্ধকারে ছেয়েগেল চারিদিক। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাইক থামিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষন করে বুঝতে পারলাম একটা বিশাল বট গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমি। অনেকটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বটগাছটা। ডালপালা ছড়িয়ে আস্ত একটা এলাকাকে গিলে নিয়েছে গাছটা। একফোঁটা চাঁদের আলোও ভেদ করতে পারছে না গাছের মধ্যে দিয়ে। আচমকা দু-জোড়া শুকুন গাছের মাথা থেকে ঝটপট ডানা ঝাপটিয়ে মাথার ওপরে ঘুরপাক খেতে লাগলো। আর গাছে থেকে ভেসে এল অদ্ভুত ট্যাঁ-ট্যাঁ আওয়াজ।

বুকটা এবার সত্যিই দুরু দুরু করে উঠলো। নিজেকে ভীষণ অসাড় মনে হচ্ছিল। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ বট গাছের ডালে কিছু ঝুলছে মনে হল। ঠিক মানুষের মতো অবয়ব। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না। ভালো করে দেখার জন্য ক্যামেরার ফ্লাস্‌টা অন করে দিলাম সাটার টিপে। ঝলসে উঠলো আলো। আর সেই আলোতে রাস্তার ওপরে ঝুলে থাকা বটগাছটার ডালে যা দেখলাম তাতে আমার দেহের সব শক্তি যেন উবে গেল একেবারে। থরথর করে কেঁপে উঠলো পা দুটো। দেখলাম সেই ডালে ঝুলছে ফাঁস লাগিয়ে এক গৃহবধূ। নীল শাড়ি পরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হালকা হাওয়ায় চুলগুলো উড়ছে। এ মুখ আমার খুব চেনা। মনে করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু মনে পড়ছিল না।

**

আচমকা আমার সব কথা মনে পড়ে গেল। এই তো আমার রীনা। রীনাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম আমি। বিয়ের পর মিঠাপুর গ্রামে থাকতাম আমরা। বেশ সুখেই কাটছিল দিনগুলো। সকালে মাঠের কাজে যেতাম আমি। বেলায় রীনা গিয়ে আমাকে জলখাবার দিয়ে আসত। দুপুরে বাড়ি ফিরলে সাজিয়ে গুছিয়ে খেতে দিত । আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা ছিল না। একে অপরের সঙ্গে বেশ সুখেই ছিলাম আমরা। কিন্তু বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেও আমাদের কোন ছেলেপুলে হল না। সবাই রীনাকে বাজা বলত। এমনকি আমার মা’ও অনেক কথা শোনাত রীনাকে। একদিন সব সহ্যের বাঁধ ভাঙ্গল। একদিন সকালে উঠে দেখি রীনা নেই। তারপর যখন ওকে খুঁজে পেলাম তখন সব শেষ। রীনাকে ছাড়া আমিও থাকতে পারছিলাম না। সব সময় ওর কথা মনে পড়ত। হতাশা গ্রাস করেছিল আমাকে। তারপর একদিন জমিতে কীটনাশক ছড়াতে গিয়ে বেশ খানিকটা খেয়ে ফেললাম...।  

আমাদের বাড়ির পিছনদিকেই এই বটগাছটার নীচে আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি। তাহলে কি আমার পুনর্জন্ম হয়েছ? ভাবতে ভাবতে জ্ঞান হারালাম আমি।

সমাপ্ত।

 
 
 

Comentarios


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page