top of page
Search

বিশেষ সংখ্যা ।। ভয় ভৌতিকে ।। পল্লব হালদার


মাশরুম 


পল্লব হালদার



"আজ আমার ডাইরি লেখার শেষদিন। জানি না কত শত বছর ধরে লিখছি!! লিখতে লিখতে আজ বড়ই ক্লান্ত!! আর ভালো লাগছে না!! কি পেয়েছি অমর হয়ে? কি পেয়েছি সমস্ত রোগব্যাধি মুক্ত জীবন পেয়ে???


এর থেকে মৃত্যু যে অনেক মধুর!!অনেক উপভোগ্য....



নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে হাতে ধরা ডাইরিটা সজোরে মাটির মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে বিকাশ মন্ডল।।



৫০০ বছর আগে, 


৮০ বছর হলো ভারতে ইংরেজ শাসন কায়েম হয়েছে....



জমিদার বাড়ির একমাত্র ছেলে বিকাশ মন্ডল কৈশোর থেকে বড়ই বেপরোয়া। বাবা ছিলেন তৎকালীন সুন্দরবনের জমিদার। বাবা মায়ের অনাবশ্যক আদরে মানুষ হতে হতে বিকাশ জীবনের মূলধারা থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে।। জীবন ছোট হতে হতে মদ আর নারীতে আঁটকে যায়।



জীবনও প্রতিশোধ নিতে দেরী করে নি। বিকাশ মন্ডলের যৌবন শেষ হওয়ার অনেক আগেই তাকে অজস্র রোগ জ্বরাগ্রস্থ বৃদ্ধে পরিণত করে। ততদিনে নিজের পিতামাতার বিয়োগ হয়েছে। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাংসারিক সমস্ত চাপ তার মাথায় এসে পড়ে।


এই সবকিছু বড়ই চাপের মনে হতে থাকে। জীবন হাঁসফাঁস করতে থাকে। 


একটু সুস্থতা আর নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের জন্য বিকাশ জমিদারি ছাড়বে মনস্থির করে ফেলে।।।


হয়তো প্রকৃতির কোলেই সে পাবে বাকি জীবনের জন্য বেঁচে থাকার রসদ।।।।



নিজের জমিদারির একেবারে শেষপ্রান্তে হাজির হয় বিকাশ। সুন্দরবনের গাছগাছালি আর কলকল শব্দে বয়ে যাওয়া মাতলা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে। জীবনের হারানো সৌন্দর্যকে নতুনভাবে খুঁজতে থাকে বিকাশ।।


দিন-রাত প্রকৃতির কোলে কাটাতে থাকে সে।।


এখন শরীরটা অনেকটা ঝরঝরে, মাথার উপর থাকা চাপটাও বেশ হাল্কা বোধ হয় বিকাশের।। মনে হতে থাকে এটাইতো জীবন।। 



এইরকম এক অমাবস্যার রাতে মাতলা নদীর কিনারায় বসে একমনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিল বিকাশ। এই রাতের অন্ধকার এখন বড়ই ভালো লাগে তার। চারিদিকে কেমন অদ্ভুত নিশ্চুপ।


কেবল রাতজাগা পাখি আর বন্য পশুর ডাক মনে করিয়ে দেয় সে এখানে একা নয়।


হঠাৎ তাকে অবাক করে সামনে নদীর ওপারের অন্ধকার ভেদ করে বহুদূর থেকে কাঁশি ঘন্টার আওয়াজ তার কানে ভেসে আসে।।


বিস্ময়ে ভয়ে হতবাক হয়ে যায় সে। এও কি সম্ভব??


যতদূর চোখ যায় কেবল জলরাশি ছাড়া আর কিছুতো দেখায় যায় না। তবে এই কাঁশি ঘন্টার আওয়াজ কোথা থেকে???


মাথাটা গুলিয়ে ওঠে বিকাশের!! সে কি ঠিক শুনছে??


না কি তার অসুস্থ শরীরের ভ্রম???


ধীরেধীরে সেই আওয়াজ তীব্রতর হয়ে ওঠে।। অজানা ভয়ে হাত পা আড়ষ্ট হয়ে আসে বিকাশের।


নানান চিন্তা ও দুশ্চিন্তা করতে করতে সে নদীর চড়ায় ঘুমিয়ে পড়ে।।।।



সকালে এক প্রজার ডাকে তার ঘুম ভাঙে। বেচারা হয়তো সকালে নদীতে মাছ ধরতে বেড়িয়েছিল।


নিজেদের জমিদারকে এইভাবে দেখবে সে হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি।।


"রাজাবাবু! কি হয়েছে আপনার? আপনি এখানে শুয়ে কেন??"


তার গলায় উদ্বিগ্নের ছাপ সুস্পষ্ট।।।।


ধরমরিয়ে উঠে পড়ে বিকাশ।। নিজের বোকামির জন্য বিরক্ত হয় সে। তাড়াতাড়ি উঠে নিজের বাগানবাড়ির উদ্যেশে রহনা দেয় সে।।।


সারাদিন কেমন ঘোরের মধ্যে কাটে বিকাশের।


সন্ধ্যায় সে চন্ডীতলায় উপস্থিত হয়।।


তখনকার সময়ে চন্ডীতলায় সন্ধ্যা আসর বসতো।


নিজেদের জমিদারকে এমন সময় এখানে দেখে সবাই তটস্থ হয়ে ওঠে। 


একটা বসার জায়গা দিয়ে সবাই বিকাশকে ঘিরে বসে।


নানান আলাপ আলোচনার পর বিকাশ গতকাল রাতের সেই কাঁশি ঘন্টার আওয়াজের প্রসঙ্গটা তোলে।


অবাক হয়ে বিকাশ লক্ষ্য করে কথাটা শোনার পরে সবার চোখে মুখে কেমন যেন আতঙ্কের ছাপ।


কেমন যেন সবাই কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।


শেষে বিকাশের জেদাজেদিতে গ্রামের সব থেকে বয়স্ক হরিসাধান হালদার বলতে শুরু করেন,


"শুনুন রাজাবাবু! আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের আপনার বাবার আমলের ঘটনা! তখন আমাদের এই অঞ্চলের ত্রাস হয়ে দাঁড়ায় কালীডাকাত। কুখ্যাত জলদস্যুদের সর্দার ছিল সে। এই নদীতে তখন মাছধরা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। 


কালী ডাকাত শুধু লুটপাট করে ক্ষান্ত থাকতো না।


লুটপাটের সাথে নির্বিচারে সে খুন করতো। লুটপাট করার পরে জেলেদের নৌকা কেড়ে নিতো। তারপর সেইসব হতভাগ্য জেলেদের মাথা কেটে নিয়ে সেই মাথা এই নদীর চড়ায় ফেলে যেতো। মানুষ খুন করার মধ্যে কালী একরকম তৃপ্তি উপলব্ধি করতো।


কতো হতভাগ্য জেলে যে কালী ডাকাতের বলি হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। শেষে একপ্রকার ভয়ে আমরা নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।


কিন্তু কি করবো রাজাবাবু? নদী আমাদের মা! নদীই আমাদের একমাত্র জীবিকার রসদ। নদীতে মাছ না ধরলে আমরা খাবো কি??


শেষে আমরা আপনার বাবার কাছে যাই! কালী ডাকাতের একটা বিহিত না করলে চলছিল না!


আপনার বাবা অত্যন্ত প্রজাবৎসল ছিলেন। তিনি আমাদের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ ইংরেজ সেনাদের সাথে যোগাযোগ করে কালীডাকাতদের আক্রমণ করেন। বন্দুকের জোরের কাছে কি গায়ের জোর চলে???


কালীডাকাতের দলের অনেক দস্যু তৎক্ষণাৎ মারা যায়। কালীডাকাত সমেত অবশিষ্ট সৈন্য ওই "বিষ দ্বীপে" পালিয়ে যায়। দ্বীপটা ওদের ঘাঁটি ছিল।


ওখানে ওর একটা মন্দির ছিল যেখানে ও ডাকাতকালী প্রতিষ্ঠা করেছিলো। প্রতি অমাবস্যায় পুজো দিতো সে। তাছাড়া কালী নিজেদের নিরাপত্তার জন্য একটা গোপন সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল ওই দ্বীপে। বিপদের সময় লুকিয়ে থাকার জন্য।


ইংরেজ সেনা আর আপনার বাবার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে কালীডাকাত তার দল নিয়ে ওই সুড়ঙ্গে আশ্রয় নেয়। বাইরে থেকে একজন সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ করে দেয়। আপনার বাবা যখন সেই সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ করা দস্যুটিকে ধরে তখন তার শেষ অবস্থা।


বুকে গুলি লেগেছিল। কোথায় কালীডাকাতরা লুকিয়ে আছে তা জানার আগে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আর সেই দস্যুর মৃত্যুর সাথেসাথে সুড়ঙ্গের হদিশ চিরতরে হারিয়ে যায়। ওই সুড়ঙ্গে বন্ধ হয়ে জল খাদ্যের অভাবে কালীডাকাত চিরতরে হারিয়ে যায়। সুন্দরবনের ইতিহাস থেকে কালী ডাকাতের কুখ্যাত অধ্যায় চিরতরে বিলীন হয়ে যায়।।



৫ বছর আগে হঠাৎ আমাদের এখানে একদিন ভূমিকম্প হয়। তারপর থেকে ওই দ্বীপ থেকে প্রতি অমাবস্যায় রাতে কাঁশি ঘন্টার আওয়াজ আসতে শুরু করে।


ভয়ে আমরা অমাবস্যায় নদীর চড়ার দিকে যাওয়া বন্ধ করে দি।"



রেগে যায় বিকাশ! 


"কি সব বলছো? হয়তো কালীডাকাত বা তার দলবল কোনোভাবে ওই সুড়ঙ্গ থেকে মুক্তি পেয়েছে আর তারাই পুজো দিচ্ছে! তোমরা সব কিছুর মধ্যে ভৌতিক ব্যাপারটা কেন দেখ?"


হরিসাধান ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,


"রাজাবাবু! আপনি হয়তো আমার কথাটা মন দিয়ে শোনেন নি! ওই দ্বীপের নাম "বিষ দ্বীপ" এমনি হয় নি।


ওই গোটা দ্বীপটা কেবল একরকমের গাছের জঙ্গল!


"বিষগাছ"! যার জন্য ওখানে অন্য কোনো গাছ বাঁচে না! কোনো পশু পাখি থাকে না!ওখানে নদীর জল ভয়ানক বিষাক্ত! কোনো মাছ জন্মায় না! ওই জল পান করা মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে বুকে টেনে আনা।


ওই দ্বীপে কারোর পক্ষে একটা রাত কাটানোও প্রায় অসম্ভব! কালীডাকাতের দল ওখানে পুজো দিয়েই রাতে দ্বীপ ছেড়ে চলে যেত।ওই বিষাক্ত পরিবেশে  ওই দস্যুদল এতগুলো বছর কাটানো অসম্ভব!


তাছাড়া কালীডাকাতের দলের সব সদস্যরা ছিল ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে। তাদের পক্ষে এতবছর বাঁচা অসম্ভব!" ওরা যদিও কোনোভাবে বেঁচে থাকতো, তাহলে অবশ্যই কারোর চোখে পড়তো!"


এক নিঃশ্বাসে প্রৌঢ় কথাগুলি শেষ করে....



ভয়ানক চিন্তায় পড়ে বিকাশ!!!


রাতে খুব একটা ভালো ঘুম হয় না। আজ শরীরটাও বড় খারাপ লাগছে। বুকের ব্যাথাটা আবারও বেড়েছে। তবে বিকাশের ধমনীতে বয়ে চলা রক্ত বলছে,


"বিকাশ এই বিষদ্বীপের রহস্য তোকেই উন্মোচন করতে হবে! করতেই হবে....


পরেরদিন খুব ভোরে একটা ডিঙি নিয়ে বিকাশ একাই বেড়িয়ে পরে বিষদ্বীপের উদ্যেশে।


অনেকক্ষণ ডিঙি চালানোর পরে দূরে একটা সবুজ রঙের দ্বীপ চোখে পরে বিকাশের। 


যখন সে দ্বীপে পৌঁছায় তখন সূর্য মাঝ আকাশে।


দ্বীপটা বড়ই অদ্ভুত। দেখলেই বোঝা যায় এই দ্বীপে প্রানের চিহ্ন নেই।দ্বীপসংলগ্ন সমস্ত নদীর জল লাল। চারিদিক কেমন যেন অদ্ভুত নিশ্চুপ। এক অপূর্ব মাদকতাপূর্ণ গন্ধ চারিদিক ঘিরে রয়েছে। তার রক্তে রন্ধেরন্ধে নেশা ছড়িয়ে পড়ে।


চোখটা ঘুমে জড়িয়ে আসে বিকাশের। 


কোনোরকমে টলতে টলতে সামনের দিকে এগোতে থাকে সে। যখন বিকাশ সেই মন্দিরে পৌঁছায় তখন প্রায় সে অচৈতন্য। অর্ধজাগ্রত অবস্থায় সে দেখে একটি সম্পূর্ণ ভগ্ন দেউল। যার মধ্যে এক ভয়াল দর্শনধারী কালীমূর্তি! এটাই হয়তো ডাকাতকালীর মূর্তি। কি ভয়ানক দেবীর রূপ! দেখলেই ভয় লাগে!তবে তাকে বেশী অবাক করে দেবীর পায়ে টাটকা ফুল, সিঁদুর লেপা। তবে কি কোনো জীবিত মানুষ এই দ্বীপে আছে????



বিকাশের চিন্তা সুদূরপ্রসারী হয় না। তার আগেই সে সামনে একজনকে দেখে আঁতকে ওঠে।


এ কাকে দেখছে?? একজন মানুষ এতো শীর্ণকায় এতো প্রাচীন হতে পারে???


মাথা ভর্তি একরাশ সাদা ধপধপে চুল! মুখের ঘন সাদা দাঁড়ি তাকে প্রাচীন বটবৃক্ষের ন্যায় রূপ দিয়েছে।


কিন্তু তার চোখদুটো বড়ই অদ্ভুত! কি দীপ্তি!


দেখলেই বোঝা যায় বয়স হলেও সামনের লোকটি সম্পূর্ণ নীরোগ।


"কে আপনি? এখানে কেন? জানেন না! এই দ্বীপে মানুষের যাতায়াত নিষিদ্ধ! এখুনি ফিরে যান!"


কি ভয়ানক লোকটির কন্ঠ! বিকাশের মনে হলো সে বধির হয়ে যাবে! তার থেকে বড় ব্যাপার, সে উপলব্ধি করলো সে নিজের উপর ধীরেধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে!



যখন জ্ঞান ফিরলো তখন বিকাশ আবিষ্কার করলো সে একটি স্যাঁতস্যাঁতে সুড়ঙ্গের মধ্যে মাটির মেঝেতে শুয়ে!


তাকে ঘিরে রয়েছে ৮ জন সেই পূর্ব-দর্শিত ন্যায় প্রাচীন বয়স্ক লোক! সত্যি এদের দেখলে এদের বয়স আন্দাজ করা অসম্ভব! ১০০ ও হতে পারে আবার ১০০০ ও হতে পারে! কে জানে??


ধরমরিয়ে উঠে বসে বিকাশ! শরীরটা বড়ই ক্লান্ত,অবসন্ন! বুকের ব্যাথাটা এখন অসহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিকাশের মনে হতে লাগলো বুকের হৃৎপিন্ডটা এখুনি বুক থেকে ছিঁড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসবে।।


যন্ত্রনায় মুখটা বিকৃত হয়ে যায় বিকাশের! 


"এখন কেমন আছেন রাজাবাবু?"


সেই ভয়ানক গুরুগম্ভীর আওয়াজটা সামনের দিক থেকে ভেসে এলো!


সুড়ঙ্গের প্রদীপের আবছা আলোতে সেই প্রথম দেখা লোকটিকে আবারও দেখলো বিকাশ!!!


"খুব কষ্ট হচ্ছে! বুকের ব্যাথাটা আর সহ্য করতে পাচ্ছি না! মনে হচ্ছে এখুনি মারা যাবো!"


নিজের অজান্তে যন্ত্রনাক্লিষ্ট গলায় চেঁচিয়ে ওঠে বিকাশ।


সামনের লোকটি আরেক প্রাচীন লোকটিকে কিছু নির্দেশ দিলেন।


লোকটি সুড়ঙ্গের অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল, কিছুসময় পরে হাতে একটি মাটির পাত্রে কিছু তরল এনে বিকাশকে পান করার নির্দেশ দিলো।


বিকাশ কোনো দ্বিধা মনে না রেখে তৎক্ষণাৎ সেই তরল পান করে নিলো।


হা ঈশ্বর! একি ভয়ানক চমৎকার! নিমিষে বিকাশের শরীরের সমস্ত কষ্ট, সমস্ত রোগ, সমস্ত দুর্বলতা এক লহমায় বিদায় নিলো। নিজেকে আঠারো বছরের প্রাণবন্ত যুবক মনে হতে লাগলো। মনে হতে লাগলো এখন গায়ের জোরে কয়েকটি হাতিও মেরে ফেলতে পারে।


কিছুসময় পরে সেই লোকটি বিকাশের পাশে বসে, তারপর নিজেই বলতে শুরু করে,


"রাজাবাবু!আমি হলাম কালী,কালীডাকাত! আপনার বাবা যাকে এই সুড়ঙ্গে বন্দি করেছিলেন!


উনি ভেবেছিলেন বন্দি অবস্থায় বিনা খাদ্যে, বিনা পানীয়তে আমাদের মৃত্যু ঘটবে। আমরাও তাই ভেবেছিলাম। কারণ সুড়ঙ্গের দুদিকই বন্ধ ছিল। যেটা বাইরে থেকে না খুললে আমাদের নিস্তার পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু ডাকাতকালীর ইচ্ছা হয়তো অন্যরকম ছিল।



বন্দি অবস্থায় আমাদের ২ দিন ২ রাত বিনা খাদ্যে, বিনা পানীয়তে কাটলো, সঙ্গে এখানকার বিষাক্ত বাতাসে আমরা তখন মৃতপ্রায়। খিদে আর তেষ্টায় আমাদের বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম।


তখন অনেকটা নেশার ঘোরে এই সুড়ঙ্গের মাটির দেওয়ালে কয়েকটি মাশরুম ফুটেছিল তাই সবাই মিলে ভাগ করে খেলাম। বললে বিশ্বাস করবেন না রাজাবাবু! তৎক্ষণাৎ আমাদের শরীর থেকে সমস্ত কষ্ট, সমস্ত ব্যাথা,ক্ষুদা, তৃষ্ণা নিমিষে গায়েব হয়ে গেলো। সেই শুরু তারপর থেকে প্রতিদিন আমরা ওই মাশরুম খেয়ে চলেছি। আপনি এখুনি যেটা খেলেন সেটা ওই মাশরুমের রস! এই মাশরুম আমাদের অফুরন্ত জীবনীশক্তির রহস্য। জানিনা আমরা কত বছর জীবিত আছি। তবে এটুকু জানি আমাদের কোনোদিন মৃত্যু হবে না। ওই মাশরুম আমাদের অমর করেছে। এই সুড়ঙ্গের স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে এই মাশরুম জন্মায়ও অফুরন্ত! এই মাশরুমই এখন আমাদের ক্ষুদা,তৃষ্ণা নিবারণ করে!!!


তবে একটাই অসুবিধা ছিল আমরা এই সুড়ঙ্গের অন্ধকারের মধ্যে কতকাল আঁটকে ছিলাম, তা বলতে পারবো না। সেটা ১০০ বছর হতে পারে আবার ১০০০ বছরও হতে পারে। কিন্তু বেশকিছুদিন আগে হঠাৎ এখানে ভূমিকম্প হয় আর তাতেই আমাদের সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা ফাটল দেখা দেয়।


আমরা এখন ওই ফাটল দিয়ে বাইরে যায়। অমাবস্যায় মাকে পুজো দিয়ে আবারও আমরা ১ মাসের জন্য এই সুড়ঙ্গে ঢুকে যায়। এখন অন্ধকারই ভালো লাগে। আমরা কেউ বাইরে বেরোয় না। আজ একটি বিশেষ দরকারে বেরিয়ে ছিলাম তাই আপনাকে দেখলাম। 



খোঁজ নিয়ে জানলাম, আপনি আমাদের রাজাবাবু!"


কালীডাকাত চুপ করলো!



বিকাশ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো,


"তবে হিমালয়ের সাধুদের নিয়ে শোনা গল্পগুলি তাহলে মিথ্যা নয়? তাদেরও ওই দীর্ঘ নীরোগ জীবনের রহস্য কি এইরকম মাশরুম? কে জানে?"


হঠাৎ ই বিকাশের চোখটা এক আশায় দপ করে জ্বলে ওঠে। তবে কি তার রোগমুক্তি দীর্ঘজীবন সম্ভব?


কালীডাকাত হয়তো বিকাশের মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিল, হেঁসে বললো,


"রাজাবাবু! আপনি থেকে যান! আমি কথা দিচ্ছি আপনি নীরোগ হয়ে অমর হয়ে যাবেন। যুগের পর যুগ বেঁচে থাকবেন। বেঁচে থাকার আনন্দে আপনি মশগুল হয়ে থাকবেন। কি বলেন?"


এটাই তো চেয়েছিল বিকাশ, নীরোগ দীর্ঘজীবন।


তাছাড়া অমরত্বের লোভ কার না নেই? স্বয়ং দেবতা থেকে অসুর সবাই যেখানে অমরত্বের জন্য পাগল সেখানে সে তো সামান্য মানুষ।


নিঃসঙ্কোচে বিকাশ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।



হায় রে বিধাতা সেদিন যদি জানতো সে কি ভয়ানক ভুল করছে।



কালীডাকাতের চোখটা দপ করে জ্বলে ওঠে, মুখে কুটিল হাঁসি ছড়িয়ে পড়ে। হয়তো বাবার উপর প্রতিশোধ স্পিহা ছেলের উপর বর্তাতে পারার আনন্দে।


সে শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় বিকাশকে উদ্যেশে বলে ওঠে,


"তবে রাজাবাবু! আপনাকেও একটা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে যে! আপনাকে কথা দিতে হবে এই সুড়ঙ্গের বাইরে আপনি কোনোদিন পা দেবেন না। অনন্তকাল ধরে এই সুড়ঙ্গের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখবেন....


আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কালীডাকাত।


কিন্তু তার আগেই বিকাশ তাকে হাত নেড়ে থামতে বলে। সে যে রাজি সেটা কালীডাকাতকে বুঝিয়ে দেয়।



সেই শেষ। শেষ বিকাশের স্বাধীনতা, শেষ বিকাশের ভালোলাগার,শেষ বিকাশের হাঁসার।সুড়ঙ্গের অন্ধকার এখন তার সঙ্গী।  শতশত বছর এইভাবে থাকতে থাকতে সে ক্লান্ত। এখন সে মৃত্যুপ্রত্যাশী। মৃত্যু তার কাছে অনেক মধুর,অনেক সুখের মনে হয়।



নিজের ছুঁড়ে ফেলা ডাইরিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বিকাশ।


তার চোখে জল। এই জল তার ৫০০ বছর বেঁচে থাকার আনন্দে নয়, এই জল তার মৃত্যু না হওয়ার দুঃখে........



(সমাপ্ত)

 
 
 

Comentarios


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page