top of page
Search
agantukpotrika

বিশেষ সংখ্যা ।। ভয় ভৌতিকে ।। বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় 


অজানা বদ্বীপে সে থাকে


বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় 



                    (১)


আমি একজন ভ্লগার,মানে ভিডিও ব্লগার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াই এবং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিজের ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করি। যখন হাজার-হাজার ভিউস এবং শয়ে-শয়ে কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাই, তখন মনে হয় যে আমার এই ভ্রমণের ভিডিও বানানো সার্থক। 


সাম্প্রতিক অতিমারি আবহে বেড়ানোতে কিছু বাধার সৃষ্টি হয়েছে। ভিন রাজ্যে বেড়ানোর উপায় এখন নেই। তাই কাছে পিঠের মধ্যে ঠিক করলাম যে সুন্দরবনের ওপর একটা ভিডিও করলে কেমন হয়? তবে ওই লঞ্চে করে যেতে যেতে আশেপাশের বনভূমির ভিডিও করলে সেই ভিডিও তেমন জমবে না৷ যেতে হবে দ্বীপের ভেতর। একদম পায়ে হেঁটে। তবেই তো সেই রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের ভাবটা জাগিয়ে ফেলতে পারব ভিডিওতে। 



সুন্দরবন ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে প্রথমে পৌঁছলাম গদখালি। গদখালিতে গিয়ে কাউকেই রাজি করাতে পারলাম না। অগত্যা সজনেখালিতে গেলাম লঞ্চে করে৷ সৌভাগ্যক্রমে সেখানে একটি ছেলের সাথে আলাপ হল। নাম নিতাই। নিতাইয়ের বয়স বেশি নয়, চব্বিশ-পঁচিশ হবে। তার নিজস্ব ডিঙি নৌকো আছে। তাকে নিজের পরিকল্পনার কথা বললাম। একটি নির্জন দ্বীপে বেড়ানোর ভিডিও করতে চাই। নিতাই রাজি হল৷ সে নাকি একটা ছোট্ট দ্বীপের কথা জানে, যেখানে দ্বীপের ভেতরে একটা ডোবার মধ্যে প্রচুর পারশে মাছ আছে। আমি চাইলে সেখানে সে আমায় নিয়ে যেতে পারে। আমি সানন্দে তার প্রস্তাবে রাজি হলাম। পরের দিনই অন্ধকার থাকতে থাকতে আমরা রওনা দিলাম। 



বহু নদীর বাঁক পেরিয়ে এবং বেশ কিছু বনভূমিতে আচ্ছাদিত দ্বীপ পেরিয়ে যখন এই বদ্বীপের গোলকধাঁধায় প্রায় হারিয়ে গেছি বলে মনে হচ্ছে, ঠিক সেই সময় একটা জমির পাড়ের কাছে এসে ডিঙি দাঁড় করাল নিতাই।  সংক্ষেপে বলল, "নামুন।"



আমি ডিঙি থেকে নেমে ভিডিও ক্যামেরা চালু করলাম। বলতে শুরু করলাম, "বন্ধুরা, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সুন্দরবনের এক অজানা দ্বীপে নেমেছি আমরা। চারপাশে সুন্দরী আর গরান গাছের অতুলনীয় বন্য সৌন্দর্য। নদীর পাড়ের ঘোলা জল আর থিকথিকে আঠালো কাদা মাড়িয়ে আমরা এবার ঢুকছি বনের মধ্যে। গাছগুলো আমাদের আলিঙ্গন করার জন্য অপেক্ষা করছে। যেন সুন্দরবনের জঙ্গলে স্বাগত জানাচ্ছে!"



এবার ক্যামেরা ঘোরালাম নিতাইয়ের দিকে। আবার বলতে শুরু করলাম, "আমার সাথে আছে নিতাই। নিতাই স্থানীয় ছেলে। একদম ভয়ডরহীন। সে সুন্দরবনের বিভিন্ন অজানা দ্বীপে ঘুরে বেড়ায় মাছ ধরার জন্য। আজকে আমি নিতাই এর সাথে এসেছি এই দ্বীপে মাছ ধরার অভিযান করতে। নিতাই বলেছে, এই দ্বীপের মধ্যে নাকি একটা ছোটখাটো ডোবা আছে। সেই ডোবায় নাকি পারশে মাছ ভর্তি। দেখা যাক নিতাইয়ের তথ্য কতটা সঠিক। 



আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ইতিমধ্যেই নিতাই আমাদের সাথে ডিঙিটাকে বেঁধে ফেলেছে একটা মোটা গাছের ডালের সাথে। এবার আমরা যাব জঙ্গলের ভেতরে। যাব সেই ডোবায় যেখানে মাছেরা খেলা করছে কাদা জলে।"



ক্যামেরা অন রেখে আমি আর নিতাই প্রবেশ করলাম গাছ-গাছালির মধ্যে দিয়ে। নিতাইয়ের হাতে ধরা একটা ব্যাগ, গোটানো জাল এবং আরও কিছু জিনিসপত্র। আমি এই মুহূর্তে নিতাইয়ের পেছন পেছন চলেছি। ভিডিওতে কথা না বলে এক হাতে ভিডিও সচল রেখেছি, অন্য হাতে গাছপালা সরাচ্ছি। 



এমন সময়ে নিতাই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। আমায় হাত দেখিয়ে চাপা স্বরে বলল, "থামুন। সামনে বিপদ!"



কিসের আবার বিপদ? ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ঠিক সেই সময় একটা খসখস শব্দ শুনতে পেলাম। সামনে একটা অস্বস্তিকর থপ থপ শব্দ শুনতে পেলাম। কিসের এই শব্দ? দুজনেই আতঙ্কিত হৃদয়ে অপেক্ষা করছি। নিতাই আস্তে আস্তে পিছিয়ে এল আমার কাছে। রুদ্ধশ্বাস কিছু মুহূর্ত। তারপর আস্তে আস্তে শব্দটা মিলিয়ে গেল। 



নিতাই একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, "বাঘ নয়। সম্ভবত, গোসাপ হবে। অথবা..."



আমি ভয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম, "অথবা?"



নিতাই উত্তর দিল, "কামটও হতে পারে!"



দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। শেষে নিস্তব্ধতা ভেঙে নিতাই বলল, "চলুন, এগোনো যাক।"



আমরা দুজনেই খুব সাবধানে সামনের দিকে এগোলাম। কয়েক পা এগোতেই ডোবাটা দেখা গেল। ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে একটা ধূসর রঙের সাপের মতো এঁকেবেঁকে সেটা ছড়িয়ে আছে বদ্বীপ জুড়ে। নিতাই পা টিপে টিপে চলে গেল একদম ডোবাটার ধারে। আমি ভিডিও ক্যামেরাটা আবার তুলে ধরলাম সামনের দিকে। নিতাই জালটা খুলে ঝপাং করে জলের দিকে ফেলল। তারপর জালটি দুহাতে নিয়ে এগোতে লাগল সামনের দিকে। কিছুক্ষণ জলের মধ্যে আস্তে আস্তে হাঁটার পরে, সে পাড়ে চলে এল। মুঠো করা জালটা কাদামাটির ওপর উপুড় করতেই বেরিয়ে এল বেশ কয়েকটা পারশে মাছ। একটা বাগদা চিংড়িও চোখে পড়ল। মাছগুলো কুড়িয়ে ব্যাগ ভর্তি করতে লাগল সে। আমি পুরো ব্যাপারটা ক্যামেরাবন্দী করলাম। 



এরপর নিতাই বলল, "চলুন, ডোবার আরও ভেতর দিকটায় যাওয়া যাক। ওখানে জল আরও গভীর। আরও মাছ পাব।"



নিতাইয়ের কথা শুনে আমরা আরও ভেতর দিকে গেলাম। একটা জায়গা দেখে নিতাই আস্তে আস্তে জলে নামল। হাত ছড়িয়ে সবে সে জালটাকে দুহাতে ধরেছে, এমন সময় নিতাইয়ের পেছনদিকের জলে কেমন একটা অদ্ভুত ভুস-ভুস করে শব্দ হল। তার পরের মুহূর্তেই নিতাই আর্তনাদ করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনের দিকের জলে। জলের মধ্যে সাঁতরে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মনে হল, জলের ভেতর কিছুতে যেন তার পা কামড়ে ধরেছে। একবার কোনও রকমে সে উঠে দাঁড়িয়ে পাড়ের দিকে আসবার চেষ্টা করল। কিন্তু পরক্ষণেই ভয়ঙ্কর বীভৎস দুটো হাত পেছন থেকে উঠে এসে তার কোমর জড়িয়ে ধরল। ওই কাদামাখা হাত মানুষ বা কোনও প্রাণীর হতে পারে না। আমার হাতের পাঞ্জার প্রায় দ্বিগুণ ওই হাত! হাতের বড় বড় বাঁকানো নখগুলো যেন যে কোনও পশুর মাংসকে ফালাফালা করে দিতে পারে। 


আমি ক্যামেরা ফেলে নিতাইকে বাঁচাবার জন্য দৌড়ে গেলাম। কিন্তু দেরী হয়ে গিয়েছে। সেই ভয়ঙ্কর হাতদুটো নিতাইকে পেছন থেকে জাপটে ধরে আবার টেনে নিয়ে গেল জলের নিচে। সমস্ত জলের নিচটা যেন তোলপাড় হতে লাগল৷ বুদবুদ উঠতে লাগল। আমি পাগলের মতো নিতাইয়ের নাম ধরে চেঁচাতে লাগলাম। তারপর কয়েক মিনিট পরে আস্তে আস্তে সব শান্ত হয়ে হল৷ আমি কী করব যখন বুঝতে পারছি না, তখন নিতাইয়ের ডুবে যাওয়া অংশের জলের রং বদলে যেতে লাগল। ধূসর থেকে সেই জলের রঙ হল কালচে লাল! ওই লাল রঙ আর কিছুর হতে পারে না। ওই লাল রঙ নিতাইয়ের রক্তের!



এর পরের মুহূর্তে যা ঘটতে চলেছিল, সেটা যদি জানতাম, তাহলে এতক্ষণ ওই ডোবার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। জলের ওপর ভেসে উঠল একটা মুখ। অমন বীভৎস মুখ আমি আর দেখেছি বলে মনে হয় না। ধূসর রঙের রক্তহীন মুখ। চোখগুলো কুমীরের চোখের মতোই ভয় ধরানো। মানুষের মতো নাক, যদিও সেটা লম্বা ও বাঁকানো। সরু ছুরির ডগার মতো অসংখ্য ছুঁচালো দাঁত। এটা কোনও জীবিত প্রাণীর মুখ হতেই পারে না। এটা নির্ঘাত জলপিশাচ বা জলের অপদেবতার মুখ! 



প্রবল ভয়ে আমি পিছোতে লাগলাম। আর সেই প্রাণীটা একটা অপার্থিব গর্জন করতে করতে পাড়ের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আস্তে আস্তে প্রকট হতে লাগল তার কালচে সবুজ রঙের শয়তানী শরীর। 



আমি ক্যামেরা নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়তে লাগলাম। চোখে-মুখে গাছের পাতা, ডাল ঝাপটার মতো লাগছে৷ হয়তো কেটেও যাচ্ছে। কিন্তু আমার এখন সেসব দেখার সময় নেই। প্রাণটা বাঁচাতে হবে। যেভাবেই হোক ডিঙিটার কাছে পৌঁছতে হবে। 



কিন্তু আমার ভাবনার সাথে পরবর্তী ঘটনা মিলল না। কিছু গাছ ভেঙে পড়েছিল জমির ওপর। তাদের অর্ধেক ভাঙা কাণ্ড ছুরি ফলার মতো যেন উঁচু হতে দাঁড়িয়ে ছিল মাটিতে। তেমনই একটা কাণ্ডে পা বেকায়দায় লেগে পড়ে গেলাম মাটিতে। মাথাটা তীব্রবেগে গিয়ে লাগল অন্য একটা গাছের গুঁড়িতে। চারদিক কেমন অন্ধকার হয়ে এল। বুঝতে পারলাম যে জ্ঞান হারাচ্ছি। 



                       (২)


প্রথমে চোখ পিটপিট করে তাকাতেই চারপাশের আবছা পরিবেশটা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে এল। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ল আর শিউড়ে উঠলাম। নিতাইয়ের জন্য বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। আর সেই ভয়ঙ্কর জলের অপদেবতাটা গেল কোথায়? চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম যে আমি নদীর পাড়ে শুয়ে আছি! আমি তো বনের মধ্যে  পড়ে গিয়েছিলাম। তাহলে এখানে এই নদীর পাড়ে এলাম কি করে? ভিজে কাদায় ভর করে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। 



এই সময় আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। জঙ্গলে রাত নেমেছে। মাথার ওপর ঝুলে আছে সাবলীল বক্রতায় চাঁদের অংশ। কিন্তু এই রাতের বেলায় আমি সবকিছু স্পষ্ট দেখছি কী ভাবে? মাথায় আঘাত লেগে কি আমার নাইট ভিশন তৈরী হল নাকি? কথাটা ভেবে হাসি পেয়ে গেল। 



এটাও লক্ষ্য করলাম আমার অবস্থান থেকে বেশ কিছুটা দূরে পাড়ের কাছে পড়ে একটা ডিঙি। আরে এটা সেই নিতাইয়ের ডিঙিটাই তো! টলমল পায়ে এগিয়ে গেলাম ডিঙিটার দিকে। ডিঙিটার কাছে আসতেই আতঙ্কে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ ডিঙিতে ঠিক দুটো জিনিস যত্ন করে রাখা আছে। প্রথমটা কাদামাটি মাখা আমার ভিডিও ক্যামেরাটা। আর দ্বিতীয়টা একটা কাটা মাথা। কাটা মাথাটা আর কারও নয়! সেটা... সেটা আমারই!



সেই সময় ডিঙির চারপাশে ভুস-ভুস করে জলে শব্দ হতে লাগল। জলের অপদেবতা কি আমার অশরীরী রূপের সাথে আলাপ করতে এল?

14 views0 comments

Comments


bottom of page