top of page
Search

বিশেষ সংখ্যা ।। ভয় ভৌতিকে ।। রিম্পি সরকার


অভিশাপ নাকি ষড়যন্ত্র ?


রিম্পি সরকার



আজ সকাল বেলা বাজারে গেছিলাম। বাজার করে ফেরার পথে আমার এক পুরোনো ছাত্রের সাথে দেখা হলো। ভালো নাম একটা থাকলেও ওকে বাপন বলেই ডাকতাম। ওর মা ও সাথে ছিলো। প্রায় বছর চারেক আগে ওকে শেষ পড়াতে গেছিলাম। তারপর আমি চাকরি পেয়ে যাওয়ায় ওকে আর পড়াতে পারিনি। ছেলেটি ছাত্র হিসেবে খুব ই ভালো ছিলো। মনে মনে হিসেব করে দেখলাম ইতিমধ্যে ওর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়ার কথা। তাই সবার আগে পড়াশোনা কেমন চলছে সেটাই জিজ্ঞেস করলাম। বাপন একটু দোনোমোনো করে ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। যেন বুঝতেই পারছে না আমাকে কি উত্তর দেবে। 



আমি একটু অবাক হলাম। ব্যাপার কি! বাপন কে ছাত্র হিসেবে ব্রিলিয়ান্ট বললে কম বলা হবে। তাহলে পড়াশোনা কেমন চলছে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না কেন? সমস্যা টা কি! ফেল করার তো প্রশ্ন ই ওঠে না। তাহলে কি নম্বর কম পেয়েছে বলে আমাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছে? সেটা হওয়ার সম্ভাবনা যদিও কম, তাও বললাম, "আরে নম্বর কম বেশি কোনো ব্যাপার না। ওরকম হয়েই থাকে। তা কোন কলেজে ভর্তি হলে?" এটা বলার পর এবার কাকিমা, মানে বাপনের মা বললেন, "অভি আমাদের বাড়ি তে একদিন এসো। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।" একটু ভেবে বললাম, "আচ্ছা কাকিমা যাবো একদিন।"



বাপন কে অনেকদিন পড়িয়েছি আমি। কাকু ও কাকিমার সাথে আমার সম্পর্ক বেশ ভালো ছিলো। কাকিমা আমাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতো। আমি পড়াতে গেলেই প্রচুর গল্প করতো আমার সাথে। একটা ছুটির দিন বিকেলের দিকে গেলাম বাপন দের বাড়ি। কাকিমা আমায় পেয়ে যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। টুকটাক কথাবার্তার পর কাকিমা বললো, 



"অভি তোমাকে আজ সব বলবো। তুমি তো জানো না এই চার বছরে কি কি ঘটে গেছে আমাদের জীবনের উপর দিয়ে। শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। তাও তোমাকে বলবো।"



এইটুকু বলে কাকিমা একটু দম নিয়ে নিলো। যেন নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে অনেক বড় কোনো রহস্য উদঘাটনের জন্য। তারপর আবার শুরু করলো –



"তুমি বাপন কে যে বছর শেষ পড়ালে, সেই বছর ও খুব ভাল রেজাল্ট করেছিল। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে আমি তোমাকে ফোন করে জানিয়েছিলাম। তারপর ও ক্লাস নাইনে উঠলো। নতুন কোচিং ক্লাসে ভর্তি হলো। স্কুল, কোচিং সব জায়গায় একাই যেতো। পড়াশোনা ঠিক ই চলছিলো। এরমধ্যে একদিন তোমার কাকু বাড়ি ফিরে আমাকে ডেকে বললো রাস্তায় নাকি একটা মোবাইল ফোন কুড়িয়ে পেয়েছে। আমি যদিও রাস্তায় অন্যের পড়ে থাকা জিনিস নেওয়া পছন্দ করি না, কিন্তু তোমার কাকু কে সেটা বলতে পারলাম না কারণ জানোই তো উনি কেমন মেজাজের মানুষ। তাও বললাম, "অন্যের জিনিস বাড়ি নিয়ে আসা ঠিক না। " তোমার কাকু বললো, "আরে দেখো না, কত দামী মোবাইল। ঐ জন্যই ফেলে চলে আসতে পারলাম না।"


আমি আর কিছু বললাম না। মোবাইল টা টেবিলের উপর রেখে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তোমার কাকু ও কিছু পরে ভুলে গেলেন মোবাইলের কথা। 



এর কিছুদিন পর একদিন দুপুর বেলা হঠাৎ দেখি মোবাইল টা বেজে উঠলো। তোমার কাকু অফিসে, বাপন স্কুলে। আমি রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে ঘরে গিয়ে দেখি মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে। 



লেখা রয়েছে "বাপনের মামা আসছে"। 



তার ঠিক চার-পাঁচ মিনিট পর দেখলাম আমার দাদা আমাদের বাড়ির কলিং বেল টা বাজাচ্ছে। আমি ভাবলাম বাপনের বাবা মেসেজ টা পাঠিয়েছে। রাতে তোমার কাকু কে বললাম, "মোবাইল টা তে যখন নতুন সিম ভরে নিয়েছ, তাহলে সেটা সাথে করে অফিস নিয়ে যাচ্ছ না কেন?"


তোমার কাকু একটু অবাক হয়ে বললো, "কে বললো আমি মোবাইলে সিম ভরেছি?"


আমি বললাম, "তাহলে আজ মেসেজ পাঠালে যে!" বলে তোমার কাকু কে মোবাইল টা এনে দেখাতে যাবো, দেখলাম মোবাইলে কোনো মেসেজ নেই। আমি একটু অবাক হলেও ভাবলাম দেখতে ভুল করেছি তাহলে তাড়াহুড়ো তে। 



এর বেশ কিছুদিন পর একদিন দুপুরে আবার একটা মেসেজ এলো। লেখা রয়েছে, "বাপন স্কুলে আজ খুব মার খেয়েছে।"


আমার মাথায় কিছু ঢুকলো না। বাপন বাড়ি ফিরলে দেখলাম সত্যি ঠোট টা কেটে গেছে আর চোখ মুখ ফোলা। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে। বললো বন্ধুদের সাথে তর্কাতর্কি করে করতে হাতাহাতি হয়ে গেছে। ওকে কিছু বললাম না। রাতে আবার তোমার কাকু কে  মেসেজ দেখাতে গিয়ে দেখলাম আগের দিনের মতোই কিছু নেই। এবার তোমার কাকু দেখলাম বেশ অবাক হয়েছে। তাও রাত হয়ে গেছিল বলে আর কিছু বললো না। 



এরপর একমাস ধরে যখনই কেউ আমাদের বাড়িতে এসেছে বা কোনো ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো ঘটার আগেই অদ্ভুত ভাবে মোবাইলে একটা মেসেজ চলে এসেছে। এক ছুটির দিনে এই রকম ই একটা মেসেজ তোমার কাকুর চোখে ও পড়েছে। সেদিন লেখা ছিলো, "তোমার বাবার খুব খারাপ অবস্থা।" মেসেজ টা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম আমার বাপের বাড়ি। শুনলাম সত্যিই বাবার খুব শরীর খারাপ। আবার যখন তোমার কাকু মেসেজ টা দেখতে গেল, তখন দেখা গেল মোবাইলে কোনো মেসেজ ই নেই। তোমার কাকু এবার বেশ কৌতুহল নিয়েই মোবাইল টা খুলে দেখার চেষ্টা করলো ভেতরে কিসের সিম লাগানো। মোবাইল টা খোলার পর আমরা তাজ্জব বনে গেলাম যখন দেখলাম যে মোবাইল টা তে সিম তো দূর, কোনো ব্যাটারী পর্যন্ত নেই। তাহলে চলছিলো কি করে সেটা এতদিন ধরে?!



কাকিমা বললেন, "অভি, তোমার কাকু ভয় পেয়ে মোবাইল টাকে সুইচ অফ করে দিলেন। কিন্তু তার কয়েক সেকেন্ড পরেই ওটা আবার নিজে থেকে অন হয়ে গেল। যতবার অফ করা হলো, ততবার ওটা একা একা অন হয়ে যাচ্ছিল। তোমার কাকু পরের দিন মোবাইল টা অফিস যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দিলেন। বাড়ি ফিরে বললেন, "যাক বাঁচা গেল।" পরদিন সকাল বেলা দেখা গেল মোবাইল টা টেবিলের উপর যেমন ছিলো, ঠিক তেমন ই রয়েছে। একটা মেসেজ ভেসে রয়েছে স্ক্রিনে "মুক্তি পাওয়া অত সহজ না"! আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম আরো। ভয়ে ঘুম আসতো না রাতে একদিন ও। 



এর ঠিক দু সপ্তাহের মাথায় ঐরকম ই একটা মেসেজ এলো। লেখা ছিলো "বাপনের মামা আত্মহত্যা করবে আজকে"। লেখা টা দেখে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লাম মেঝের উপর। তারপর অন্য একটা মোবাইল দিয়ে আমার বাপের বাড়িতে ফোন করলাম। কেউ ফোন টা ধরছিলো না। ফোন বেজে বেজে কেটে গেল। আবার রিং করলাম। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ টা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। এবার আমার বৌদি ফোন টা ধরে বললো, "মনা তোর দাদা আর নেই" একথা বলে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। আমি কোনো কথা বাড়ালাম না। তোমার কাকু কে অফিসে ফোন করে সব টা বললাম আর বললাম যে আমি বাপের বাড়ি যাচ্ছি। আমার বাপের বাড়ি বেশি দূর না। একটা অটো করেই চলে যাওয়া যায়। চোখে জল নিয়ে ছুটতে ছুটতে যখন ওই বাড়ি পৌছালাম, তখন দেখলাম আমার দাদার শরীর টা মাটি তে শোয়ানো। বৌদি আমাকে দেখে আমার বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ে খুব কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, "মনা তোর দাদা গলায় দড়ি দিয়েছে। আমাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা কোনো অশান্তি ছিলো না। কেন যে ও এই কাজ করলো বুঝতে পারছি না। আমার সব শেষ হয়ে গেল।"



তারপর একটু শান্ত হয়ে বৌদি বললো, "সেদিন তোদের বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই ও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছিল। একা একা থাকতো। কারুর সাথে তেমন কথা বলতো না। শুধু মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলতো 


"কালো ছায়া। কালো ছায়া। বাপন টা এখনো ছোটো।" আমি দু - একবার শোনার পর একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম কি হয়েছে। ও এড়িয়ে গেছিলো। আমিও তারপর ভুলে গেছিলাম ব্যাপার টা। আর আজ এই ঘটনা।"



কাকিমা বললো, "এরপর দাদার দাহ কার্য শেষ করে বাড়ি ফিরে এলাম। তোমার কাকু ও সাথে ছিলো। 



বেশ কিছুদিন সব শান্ত ছিলো। একদিন দেখলাম আমাদের বাড়ির গেটের কাছে একটা কুকুর মরে পড়ে রয়েছে। দেখে মনে হলো গাড়ি চাপা পড়েনি। অন্য কোনোভাবে মারা গেছে। আরেকদিন দেখলাম একটা বিড়াল একই ভাবে মরে পড়ে রয়েছে গেটের কাছে। দেখতে দেখতে বাড়ির চারপাশ টা কেমন থমথমে হয়ে গেল কিছু দিনের মধ্যে। এরপর কুকুর বিড়াল তো দূর, কোনো কাকপক্ষী কেও আর বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখা যেতো না। বাড়ির ভেতরে দিনের বেলাতেও কেমন যেন গা ছমছমে একটা ভাব থাকতো সবসময়। আর অদ্ভুত একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়াতো বাড়ির ভেতরে। 



একদিন বাপন স্কুলে যাওয়ার জন্য আমাকে 'মা আসছি' বলে বাড়ি থেকে বেরলো। তার পাঁচ মিনিট পরেই দেখলাম বাপন ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ঢুকলো। ঢুকে বললো, "মা, কে যেন ঢিল ছুঁড়ছে"। আমি বললাম, "ধ্যাত, কি যে বলিস!" বলে ভাবলাম কি জানি পাড়ার কোনো বদমাশ ছেলে আবার আমার ছেলের পেছনে লাগছে কি না। তাই ওর সাথে আমিও বেরলাম ওকে স্কুলের বাস অবধি পৌছে দেওয়ার জন্য। আমি রস্তায় বেড়িয়েই আমার শাড়ির আঁচল টা ওর মাথায় ধরে বললাম, "দ্যাখ, কেউ ঢিল মারছে না।" ওকে বাসে তুলে দিয়ে ফেরার পথে দেখলাম আমার শাড়ির আঁচলের বেশ কিছু জায়গা ছিড়ে ছিড়ে গেছে। শুধু তাই না, আমার দুই হাতের উপরের অংশ ছড়ে গিয়ে রক্ত পড়ছে। বাপন যখন বাড়ি ফিরলো তখন দেখলাম ওর স্কুলের ইউনিফর্মের পিঠের কাছে ঐ একই রকম ছিড়ে ছিড়ে গেছে। বেশ কিছুদিন এই একই ঘটনা চলতে থাকলো। বাপন এতই ভয় পেয়ে গেছিল যে প্রায় রোজ ই স্কুলে না যাওয়ার বায়না ধরতো। আমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে স্কুলে পাঠাতাম। তারপর ওর ভয়ের মাত্রা এমন ই ছাড়িয়ে গেল যে আর কিছুতেই ওকে স্কুলে পাঠাতে পারতাম না। 



দিনের পর দিন অ্যাবসেন্ট হওয়ার কারণে বাড়িতে চিঠি আসলো স্কুল থেকে। কি উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না। তোমার কাকু একদিন বাপনের স্কুলে গেল। কোনোমতে এই অজুহাত দিয়ে এলো যে বাড়ি তে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে তাই বাপন আপাতত কিছুদিন স্কুলে আসবে না। ওনারা সেটা মেনে নিলেন। 



এরপর একটা মেসেজ এলো একদিন ঐ কুড়িয়ে পাওয়া ফোনে, "ঠাকুর পুজো বন্ধ করতে হবে এই বাড়ি তে নাহলে কেউ শান্তি পাবে না।" সেটা ছিলো শ্রাবণ মাসের প্রথম সোমবার। বাপনের ঘর টা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখলাম ওর ঘরের জানালার বাইরের দিকে একটা শিব ঠাকুরের ছবি এসে আটকে আছে। ছবি টা তে কোথাও কোনো ছেড়া ফাটা ছিলো না। একদম নিখুঁত একটা শিব ঠাকুরের ছবি। সেটা কিভাবে বা কোথা থেকে এলো কিছুই বুঝলাম না। বাপনের জানালার বাইরেই বা সেটা এসে কি করে আটকে ছিল সেটাও ঠিক মাথায় এলো না। 



যাইহোক, ছবিটা কে অনেক কায়দা করে জানালা দিয়ে ঘরে নিয়ে এলাম। তারপর বাড়ির পরিস্থিতির কথা ভেবে খুব ভক্তি শ্রদ্ধার সাথে ঠাকুরের আসনে বসিয়ে ছবি টা কে পুজো করলাম। ভাবলাম হয়তো ভগবানের আশীর্বাদ এসে পড়েছে আমাদের মাথার উপরে। সেই দিন টা ভালোয় ভালোয় কাটলো। পরের দিন সকাল বেলা ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখলাম শিব ঠাকুরের ছবি টা নেই। নেই মানে একেবারে উধাও। অনেক খোঁজ করলাম। কোথাও পেলাম না। মন টা খারাপ হয়ে গেল। 



কাকিমা একটু থেমে বললো, "আমার দাদার মৃত্যুর পর আমি ভেবেছিলাম যে যদিও একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের জীবনে, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে এটা তখন বুঝতে পারিনি যে ওটা সবে শুরু ছিলো। আরো অনেক কিছু ঘটা বাকি ছিলো তখনো। যে ঘটনা গুলো এতদিন আমাদের বাড়ির বাইরে ঘটছিলো, সেগুলো এখন আমাদের বাড়ির ভেতরে ঘটতে শুরু করলো। 



অনেকদিন কোনো মেসেজ আসছিলো না সেই কুড়িয়ে পাওয়া মোবাইলে। আমরা ভেবেছিলাম সব শান্ত হয়ে গেছে। একদিন রাতে আমরা তিনজন খেতে বসেছি ডাইনিং রুমে। খাবার থালা গুলো টেবিলের ওপরে সাজিয়ে রাখছিলাম পরপর। এরপর তরকারির বাটি টা আনতে পেছন ফিরেছিলাম। হঠাৎ কেন জানি না আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো এবং চট করে কি ভেবে মাথা টা নামিয়ে নিলাম। তার কয়েক সেকেন্ড পরে টের পেলাম আমার পেছন থেকে কিছু একটা ছুটে এসে আমার সামনের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে গেল। মাথা তুলে দেখলাম টেবিলের তিনটে থালার মধ্যে থেকে একটা থালা নিচে পড়ে আছে। তোমার কাকু আর বাপন দেখলাম হা করে তাকিয়ে আছে সামনের দেওয়ালের দিকে। আমি থালা টা তুলে রাখলাম টেবিলে। তার কিছুক্ষণ পর আরো একটা, তারপর আরো একটা থালা একই ভাবে কেউ যেন গায়ের জোরে ছুড়ে মারতে লাগলো সামনের দেওয়াল লক্ষ্য করে। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে ঘর টা লন্ডভন্ড হয়ে গেল। আমরা ভয়ে আতঙ্কে বোবা হয়ে গেলাম। শুধু তাই না, এই ঘটনা প্রত্যেক দিন হতে থাকলো সকাল বিকেল। আমরা তিনজন এরপর থেকে আর ডাইনিং রুমে খেতে বসতাম না একসাথে। আলাদা আলাদা খাবারের থালা নিয়ে হাতে করে খেয়ে আসতাম।



অভি তুমি একটু চলো আমার সাথে ডাইনিং রুমে।"



আমি ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখলাম সমস্ত ডাইনিং রুমটার চারটে দেওয়াল জুড়ে অজস্র দাগ। স্পষ্ট জিনিসপত্র ছুড়ে মারার দাগ দেওয়াল গুলোতে। এরপর কাকিমা আবার বলতে শুরু করলো। 



"একদিন রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। ঘর থেকে বাপন 'মা, ওমা' করে কিছু একটা বলছিলো আমাকে। কিন্তু আমি মশলা বাটার আওয়াজে ওর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। তাই বললাম 'কি বলবি, এসে বলে যা। শুনতে পাচ্ছি না'। বাপন দেখলাম আসছিলো রান্নাঘরের দিকে। তার আগের দিন নতুন গ্যাস সিলিন্ডার ডেলিভারি দিয়ে গেছে। ওটা রান্নাঘরের দরজার পাশেই রাখা ছিলো। বাপন রান্নাঘরের দরজার সামনে পা দিতেই ভর্তি সিলিন্ডার টা হুড়মুড় করে প্রায় ওর পায়ের উপর পড়ে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস ও চট করে সরিয়ে নিয়েছিল পা টা তক্ষুনি। নাহলে পা টা ভেঙেই যেতো আমার ছেলের। 



এর দু'দিন পর ঘরের আলমারি টা আমি একটু গোছাচ্ছিলাম। তোমার কাকু বসে টিভি দেখছিলো। কাজ শেষে আমি বাথরুমে যাওয়ার জন্য যেই ঘরের বাইরে বেরতে গেছি, অত বড় ভারী আলমারি টা কাত হয়ে পড়ে গেল আড়াআড়ি ভাবে দরজার সামনে। এমন ভাবে আটকে গেল দরজার সামনে টা যে বেরনোর কোনো উপায় রইলো না। তারপর প্রায় এক ঘন্টা ধরে ধরাধরি করে তোমার কাকু আর আমি আলমারি টা সোজা করলাম আবার। 



দিনের পর দিন ঘরের ভেতরের পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হয়ে উঠছিলো যে নিজেদের অসহায় লাগতে শুরু করেছিলো। 



এর মাঝে একদিন তোমার কাকু অফিস যাওয়ার সময় ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলো লাইনের উপরে। আশেপাশের লোকেরা বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। আশেপাশের সবাই ভেবেছিলো পা পিছলে গেছে বোধ হয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে আমায় বলেছিলো যে, এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো কেউ যেন পেছন থেকে জোরে একটা ধাক্কা মারলো। 



আমার সাথেও রোজ ই কিছু না কিছু ঘটনা ঘটেই চলছিলো। প্রায় প্রত্যেক দিন ই হয় মুখে গরম তেল ছিটে আসছিলো, নয়তো বটি তে হাত কেটে যাচ্ছিলো। যতোই সাবধানে কাজ করি না কেন, একটা দিও ও এমন যায়নি যেদিন রান্নাঘরে কোনো ঘটনা ঘটেনি আমার সাথে। 



রাতের বেলা বাড়ির সব আলো বন্ধ করার পর মনে হতো কেউ যেন মাথার পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, গভীর নিঃশ্বাস! কখনো মাঝ রাতে এক ঘুমের পর মনে হতো বুকের উপর টা ভারী হয়ে আছে, যেন কেউ চেপে বসে আছে। বেশির ভাগ দিন ই ভোরের দিকে হাত পা গুলো কেমন যেন খিচুনি ধরতো থেকে থেকে। এটা শুধু একা আমার সাথে না, বাপন আর তোমার কাকুর সাথেও হয়েছে। বেশি রাতে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ঘরের দিকে আসতে আসতে মনে হয়েছে কেউ অনুসরণ করছে। ঘর পর্যন্ত এসে যেন দরজার পাশে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। বাপন যে কতদিন রাতে ঘুমের মধ্যে কেঁদে কেঁদে উঠেছে তা গুনে শেষ করতে পারবো না। কতদিন যে তোমার কাকুর গোঙানির আওয়াজ পেয়েছি মাঝ রাতে আর আমি ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠেছি! 



একদিন খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর সাথে এইসব কিছু নিয়ে আলোচনা করতে করতে কেঁদে ফেলেছিলাম। সে আমার এই বিপদের কথা শুনে এক ওঝার ঠিকানা দেয় আমাকে। 



"ওঝার ঠিকানা পাওয়ার পর আর দেরি করলাম না। সেদিনই চলে গেলাম ঐ ঠিকানা ধরে। বাপন কে রেখে এলাম আমার বাপের বাড়ি তে। পলতায় ওঝার বাড়ি। তোমার কাকু ও আমি সেখানে পৌছে দেখলাম ওটা একটা পীরের দরগা। বাইরে কিছু লোক বসেছিলো। মোস্তাফা বাবা -র নাম বলতেই একজন ভেতরে গেলেন। তার কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন। 



প্রায় আধ ঘন্টা পর যখন লোকের ভীড় অনেক টা কমে গেছিলো, তখন আমাদের ডাক পড়লো। ঘরের ভেতরে পা রাখতেই একজন চিৎকার করে উঠলো, "না, ভেতরে আসবি না। ওখানেই দাঁড়া!" আমরা তটস্থ হয় দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর আবার আলখাল্লা পড়া লোক টা বলে উঠলেন, "কালো কালো অনেক গুলো ছায়া দেখতে পাচ্ছি তোদের পেছনে। সাথে করে নিয়ে এসেছিস আমার পবিত্র স্থানে। কিন্তু কোনো ভয় নেই। আমি আছি। তিনবার জোরে নিঃশ্বাস নে, তারপর ছেড়ে দিয়ে ঘরে ঢোক।"



আমরা তাই করলাম। তারপর ধীরে ধীরে ঘরে পা রাখলাম। পীরের ঘরে পা রাখতেই মনে হলো আমাদের শরীরের বোঝা যেন একেবারে কম হয়ে গেল। বেশ ফুরফুরে লাগছিলো মাথা টা। 



মোস্তাফা বাবার সামনে বসলাম আমরা। উনি বললেন, "এক এক করে সব বলে যা।" এই বলে উনি চোখ বন্ধ করলেন। আমি এখনো পর্যন্ত যা যা হয়েছে সব বললাম। উনি চোখ বন্ধ করে সব শুনলেন তারপর আরো কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিজের মনে কিসব বিড়বিড় করলেন। তারপর চোখ খুলে বললেন, "অনেক দেরি করে ফেলেছিস তোরা এখানে আসতে। আরো আগে আসলে তোর দাদা মরতো না। তবে এখুনি যেতে হবে আমাকে তোদের বাড়ি। নিয়ে চল আমাকে।"



আমরা গাড়ি নিয়েই গেছিলাম। ফিরতে বেশি সময় লাগলো না। যখন বাড়ি ফিরলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মোস্তাফা বাবা গাড়ি থেকে নেমেই আমাদের বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো আর মাঝে মাঝে মাটির কাছে নাক নিয়ে কিসের যেন গন্ধ শোকার চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎ বললো, "লাশের গন্ধ পাচ্ছি।" বলেই হন হন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। যে ঘরে টেবিলের উপর মোবাইল রাখা ছিলো সেই ঘরে ঢুকে চারিদিকে দেখতে লাগলো। আমি হঠাৎ আওয়াজ পেলাম ঐ কুড়িয়ে পাওয়া মোবাইল টা বাজছে। টেবিলের কাছে গিয়ে মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখলাম একটা মেসেজ ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে, "ওরে ওঝা, তুই আগে নিজের ঘর সামলা।" আমি দেখলাম মোস্তাফা বাবার মুখ নিমেষে কালো হয়ে গেল যেন উনি কিছু আন্দাজ করেছেন। উনি বললেন, "আমার বাড়ি তে ফিরিয়ে নিয়ে চল আমাকে এখুনি!" সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী নিয়ে ছুটলাম ওঝার বাড়ি। গিয়ে দেখলাম যেখানে পীরের দরগা টা ছিলো, সেখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ভাগ্য ভালো ভেতরে কোনো লোক ছিলো না। আমরা দেখলাম রাগে পীরের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। উনি আমাদের এরপর বললেন, "মাফ কর। তোদের কোনো সাহায্য করতে পারবো না আমি। জাত শয়তানের পাল্লায় পড়েছিস তোরা!"



ওনার চোখ মুখের হাল দেখে আমরা আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। ফিরে এলাম মনের ভেতর একরাশ দলা পাকানো ভয় নিয়ে। বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিলাম। কিন্তু খোঁজ করা থামাইনি। এমন কাউকে খুঁজে চললাম যে আমাদের এই বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারে। 



একটার পর একটা দিন চলে যাচ্ছিলো। আমার বাপনের চেহারার মধ্যে একটা অসুস্থতা ফুটে উঠছিলো দিনে দিনে যেন কেউ ওর জীবনী শক্তি টা ভেতর থেকে আস্তে আস্তে নিংড়ে নিচ্ছে। ওর আচার আচরনের মধ্যে কেমন একটা অস্বাভাবিক ভাব ফুটে উঠছিলো। খাবার খেতো না ঠিক করে, ঘুমাতো না ঠিক করে। সারাক্ষণ শুধু একা একা নিজের মনে বিড়বিড় করতো। কতো ডাক্তার দেখালাম বাপন কে। কিন্তু কোনো ডাক্তার ই রোগ টা কি সেটা বলতে পারলো না। আর সারাতেও পারলো না। 



বাড়ির ছাদে বেশিরভাগ দিন ই দেখতাম অনেক পাখি মরে পড়ে রয়েছে। কখনো কাক, কখনো শালিক আবার কখনো চড়াই। অনেক দিন মাঝ রাতে খচখচ আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখতাম সারা রান্নাঘরের মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাখির পালক, চামড়া, হাড়। তোমাকে কি বলবো অভি, ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতো। গরমের দিনেও কাঁপুনি ধরতো সারা গায়ে। 



একদিন মাঝ রাতে চুক্ চুক্ করে একটা আওয়াজ শুনে ঘুম টা ভেঙে গেল। আওয়াজ টা যেন একেবারে আমার মাথার পাশ থেকে আসছে। শুনে মনে হলো বেড়ালে বাটি থেকে দুধ চেটে খেলে যেমন আওয়াজ হয়, ঠিক তেমন। আমি উঠে লাইট জ্বালানোর জন্য সুইচ বোর্ডের দিকে হাত বাড়ালাম। কিন্তু কিছুতেই লাইটের সুইচ টা খুঁজে পেলাম না। তখন পাশে রাখা টর্চ টা হাতে নিয়ে জ্বালালাম। আমার ঐ পাশে সাধারণত বাপন শোয়। টর্চ জ্বালিয়ে যে দৃশ্য টা আমার চোখে পড়লো, সেটা দেখে আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত ভয়ে কেঁপে উঠলো থরথর করে। দেখলাম, একটা ধোঁয়ার মতো কালো ছায়া বাপনের কপালের উপর ঝুঁকে পড়ে ওর কপাল টা চাটছে। যেন আমার ছেলের সমস্ত প্রাণ টা শুষে নিচ্ছে। তাতেই ঐ আওয়াজ টা হচ্ছে। চর্চের আলো পড়তেই কালো ছায়া টা উধাও হয়ে গেল। আমি সারারাত বাপন কে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলাম। এক সেকেন্ডের জন্য ও দু চোখের পাতা এক করতে পারিনি আতঙ্কে।