নিকষপ্রেমী
রিয়া ভট্টাচার্য
নিকষ অন্ধকারের চাদর ঢেকে ফেলেছে সম্পূর্ণ চরাচর, বাতাসের শনশন শব্দ ও মুহূর্মুহু বাজের গর্জন ছাড়া চারিদিকে আর কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই৷
হাতের থলিটাকে বুকে চেপে প্রাণপনে হাঁটছে লোকটা, যেভাবেই হোক পেরিয়ে যেতে হবে জঙ্গলের রাস্তাটুকু। তারপরে আর কোনো বিপদ নেই।
শেষ ট্রেনটা স্টেশনে ঢুকতে বড্ড দেরী করে ফেলেছে৷ যখন সে নামলো আকাশের মুখ ভার। স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাগুলো বেশিরভাগই সরে পড়েছে, যারা রয়েছে তারা এই পরিবেশে কোনোমতেই জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে যেতে রাজি নয়। কিন্তু তাকে যে যেতে হবেই! জঙ্গল পেরিয়ে আর একটু এগিয়ে গেলেই পড়বে ছোট্ট গ্রামটা। গ্রামের মোড়ল হরেকৃষ্ণ মণ্ডলের হাতে থলিটা তুলে দিতে পারলেই তার শান্তি। হরেকৃষ্ণ মণ্ডলের মেয়ে ঝিমলি বড্ড অসুস্থ, জবাব দিয়ে দিয়েছেন পাড়ার ডাক্তার। তার প্রাণভোমরা লুকিয়ে রয়েছে এই থলিতে। তারজন্যই জীবন বিপন্ন করে তারাপীঠের শ্মশানে ছুটে গিয়েছিল লোকটা। ঝিমলির জন্য সে সবকিছু করতে পারে। আর এতটা পথ এসে শুধুমাত্র মেঘের জন্য সে থেমে যাবে তা কি আদৌ হতে পারে! যদি আজ রাতেই কিছু হয়ে যায় ঝিমলির! না না, এ হতে পারে না। তাকে যেতেই হবে, যেভাবে হোক মোড়লের হাতে তুলে দিতে হবে থলিটা। ঝিমলির কিছু হলে তার মাকে কিকরে মুখ দেখাবে সে! নিজের মেয়ের জন্য আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তাকে বেছেছিলেন তিনি, তখন ঝিমলির কতটুকুই বা বয়স! তাঁর বিশ্বাস কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেবে না সে। কোথাকার কোন বেজন্মা কীট, মরে গিয়েও কুরে কুরে খাচ্ছে মেয়েটাকে... তার হাত থেকে উদ্ধার করতেই হবে ঝিমলিকে!
লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে থলিটা বুকে চেপে পথ হাঁটে লোকটা। অনেক হয়েছে, আর ওই বুভুক্ষু প্রেতটাকে জিততে দেবেনা সে৷ নিজের হাতে যাকে খুন করে পুঁতে দিয়েছিল জঙ্গলে তারজন্য ভয় কিসের! বেঁচে থেকেই যে কিছু করতে পারেনি, মৃত্যুর পরে সে কিই বা করবে! আবার তাকে ঝিমলির জীবন থেকে নির্মমভাবে উপড়ে ফেলবে সে! ঝিমলি একান্ত তার, আর কারো নয়!
জঙ্গলের রাস্তাটায় আসতে আসতেই বৃষ্টি নামলো চারিদিক অন্ধ করে। এমন বৃষ্টি এর আগে দেখেনি লোকটা, ধারালো ফলা যেন কেটে বসে যাচ্ছে চামড়ায়। টর্চের আলো ঝাপসা মনে হচ্ছে, এই বুঝি নিভেই গেলো!
সত্যি সত্যিই অর্ধেক পথ আসতে আসতেই নিভে গেলো টর্চখানা৷ গতকালই নতুন ব্যাটারি ভরেছে সে, এরমধ্যে টর্চ নেভার কথা নয়, তবুও হলো'টা কী! বারকয়েক টর্চটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জ্বালাবার চেষ্টা করে সে, তারপর বিরক্ত হয়ে আছড়ে ফেলে পথের ধারে। অন্ধকার আর প্রবল বৃষ্টিতে এখন একহাত দূরের জিনিসই স্পষ্ট করে দেখা যায় না, এতক্ষণ তবু টর্চটা ছিলো, এখন রীতিমতো হাতড়ে পথ হাঁটতে হচ্ছে তাকে। এবড়োখেবড়ো গ্রামীণ রাস্তা, হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে সে৷
জঙ্গল ফুরিয়ে আসার আগেই প্রবল হাওয়ার তোড়ে পথের ধারে ছিটকে পড়লো লোকটা। বুকে চাপা থলিটা কোনদিকে গিয়ে পড়লো কে জানে! হাতে ভর দিয়ে কোনোক্রমে উঠতে গিয়ে লোকটা দেখলো তার দিকে এগিয়ে আসছে খুন হওয়া মানুষটার লাশ, কবন্ধ! এখানেই কি পুঁতেছিলো তাকে, মনে করতে পারে না সে! বরং সাক্ষাৎ মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে হা পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার, জড়িয়ে যায় কথা।
" আ আমায় ছে ছেড়ে দাও, আ আমি ভুল করেছি। ঝিমলিকে তুমি নিয়ে যাও, আমায় ছেড়ে দাও। আমি আর আসবো না তোমাদের মাঝে...!"
কথা শেষ করার সুযোগ পায় না লোকটা, তার আগেই কট করে একটা শব্দে বিপরীত দিকে ঘুরে যায় তার মাথাটা, মুখ থেকে চলকে আসে রক্ত! মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পড়তে লোকটা দেখতে পায়, তার সামনে স্থির হয়ে আছে মুণ্ডহীন দেহটা। কবন্ধদের যে উত্তর দেওয়ার উপায় নেই!
* * *
মোড়ল হরেকৃষ্ণ মণ্ডলের বাড়িতে কান্নার রোল উঠেছে, খিঁচুনি হচ্ছে ঝিমলির। দেহটা পাক দিয়ে উঠছে আবার ধপ করে পড়ে যাচ্ছে বিছানায়, সেইসঙ্গে অনর্গল ভুল বকে চলেছে সে৷ বাড়ির দাওয়ায় বসে প্রবল বৃষ্টির দিকে চেয়ে রয়েছে হরেকৃষ্ণ মণ্ডল, এতক্ষণে তো এসে পড়ার কথা সুবীরের, ব্যাটা গেলো কই!
নিজের একমাত্র কন্যা ঝিমলি চালচুলোহীন অরণ্যর প্রেমে পড়ায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন তিনি। গ্রামের মোড়লের একটা সামাজিক সম্মান আছে, সেই সম্মানে কিনা কালি ছড়াবে তাঁর একমাত্র সন্তান! কখনোই না!
গ্রামেরই ছেলে সুবীরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন ঠিক করেছিলেন ঝিমলির মা, তাদের অনেক জমি জায়গা, গরু - মহিষ। সেসব ছেড়ে এক অনাথ ছেলের সঙ্গে শহরে চলে যাবে মেয়ে, বাবা মা মেনেই বা নেয় কিকরে! অগত্যা তলব করা হলো অরণ্যকে।
তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়েই ফেরত পাঠাতে চেয়েছিলেন হরেকৃষ্ণ মণ্ডল। কিন্তু ছেলের এক রা, যাই হয়ে যাক কিছুতেই সে ছাড়বে না ঝিমলিকে। কথা কাটাকাটি চলতে চলতে সুবীর যে কাটারি বসিয়ে দেবে তার গলায় ভাবতে পারেননি তিনি। যখন অনুধাবন করলেন, তখন আর করার নেই কিছুই! ধড় থেকে মুণ্ড আলাদা হয়ে ছিটকে পড়েছে জঙ্গলের পাশের বাঁওড়ে, রক্তে ভিজে গিয়েছে মাটি। কোনোমতে দেহটাকে জঙ্গলে পুঁতে রক্ত পরিস্কার করে ফিরেছিলেন তাঁরা, কাটারিটাও ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল বাঁওড়ে। কেউ খুঁজে পায়নি। এতো গেলো পূর্ণিমার কথা। দিন যত গিয়েছে ঝিমলির অবস্থার তত অবনতি হয়েছে। হঠাৎ খিঁচুনি, ভুল বকা সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জ্বর। কোনো ডাক্তারই কিচ্ছু করতে পারেনি। অগত্যা সুবীরই ভরসা। তার জানা কোন গুণীনবাবা বাস করেন তারাপীঠে, তাঁর দেওয়া বিভূতিতে নাকি অনেকেই ভালো হয়ে যায়। সেইজন্যই তাকে শহরে পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ছেলেটা গেলো কই!
ঘরের ভেতর মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের মর্মন্তুদ আর্তনাদ আর স্ত্রীর কান্নার শব্দে মন ভারী হয়ে উঠছিলো হরেকৃষ্ণ মণ্ডলের। কিচ্ছু করার নেই তাঁর, অর্থবল - লোকবল বড়োই মামুলি মনে হচ্ছে। অশরীরী ছোবল বসিয়েছে তাঁর দুর্বলতম স্থানে, যার চিকিৎসা কোনোমতেই সম্ভব নয়।
বিভৎসভাবে কাঁপতে কাঁপতে একসময় স্থির হয়ে যায় ঝিমলির দেহ, বৃষ্টিও থেমে গিয়েছে ততক্ষণে। সদ্যমৃতার শিয়রের কাছে জানলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ধোঁয়াশাঘেরা কবন্ধ অবয়ব। প্রেমিকা যন্ত্রণাময় মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে উল্লাসে ফেটে পড়ছে নাকি বিধ্বস্ত হচ্ছে যন্ত্রণায়...কেজানে!
(সমাপ্ত)
Comments