ভূতের প্রতিশোধ
সুদীপ ঘোষাল
আমাদের বাড়ির সামনে সরকারি একটা সুপার মার্কেট আছে। সেখানে কেউ বসে গোল হয়ে তাস খেলে আবার কেউ বা আড্ডা মারে কেউবা গল্প-গুজব করে । আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। আমরা 15 জন একসাথে বসে ওখানে ক্লাবের মত আড্ডা গুজব করতাম। এক একজন এক এক দিন গল্প বলতো। সে গল্প গুলো আমরা শুনতাম।
আমাকে একদিন ধরল তোমাকে একটা ভূতের গল্প বলতে হবে। আমি বললাম ভূতের গল্প সত্যি হয় না কি। ওরা বলছে, হ্যাঁ হয় অনেকের অভিজ্ঞতা আছে তোমার কি কোন অভিজ্ঞতা আছে। থাকলে বলো। আমি দেখলাম এরা বললেও হয়তো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু না বলেও থাকতে পারলাম না আমি। ভূতের গল্প বলার পরিবেশ পেয়ে আমি বলতে শুরু করলাম আমার কাহিনী, মানুষ মরে প্রেতযোনি প্রাপ্ত হলে সে ভূত-পেত্নী হয়ে জন্ম নেয়। আর পশুপাখি এরাও কিন্তু প্রাপ্ত হতে পারে প্রেতযোনী।এই ধারণা কিন্তু আমার একদমই ছিল না।
একবার একটা কুকুর একটা গাইগরুকে কামড়ে দিয়েছিল। কুকুরটা পাগল ছিল। গাঁয়ের গরুটা দু'মাসের মধ্যে মরে গেল। সবাই গ্রামের ঠিক করল কুকুরটাকে পিটিয়ে মারা হবে। তার দলে আমিও ছিলাম। স্বভাবতই পুরনো পুজো বাড়িতে দরজায় একটু ফাঁক রেখে লাঠি নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে থাকল। কুকুরটা যেই দরজা দরজার ফাঁকে মাথা গলিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, সেই সময় দরজাটা বন্ধ করে দিল একজন। আর সবাই লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগলো। তাকে নির্মম ভাবে মারা হলো। আমিও হয়তো কয়েক ঘা দিয়েছিলাম।
আর এই কয়েক ঘা দেওয়াই হল আমার কাল। আমি ক্রমশ রাতে ভয় পেতে শুরু করলাম। একদিন স্বপ্ন দেখলাম অনেকগুলো কুকুর আমাকে ধাওয়া করেছে। আর আমি ছুটতে ছুটতে ছুটতে একটা গভীর নদীর মধ্যে পড়ে গেছি।।
আমি সাঁতার জানি না। নদীতে তলিয়ে যাচ্ছি আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙে ঘুম ভেঙে উঠে দেখলাম, প্রচন্ড ঘেমে গেছি আমি। কিছুক্ষণ বসে থাকলাম নিঃশ্বাস নিলাম তারপর আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে জল খেলাম।
আমাদের বাড়িতে কোনদিনই কোন কুকুর ছিল না হঠাৎ সকালে উঠে দেখি একটা কুকুর জিব বের করে হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছে।
আগেই স্বপ্ন দেখেছি এমনিতে ভয় আছে তারপর আবার দাঁত বের করায় কুকুর দেখে আরো ভয় পেয়ে গেলাম। আমি বললাম যা এখান থেকে যা। দিনের বেলা দুপুর 12:00 সে হ্যায় করতে করতে গরম রোদে কোথায় যে চলে গেল আর দেখতে পেলাম না। আমি নিশ্চিন্ত হলাম কুকুরটা পালিয়ে গেছে তারপর একটা ভাতঘুম দিলাম।
ভাতঘুম যাওয়ার সময় একটা স্বপ্ন দেখলাম একশটা কুকুর আমাকে তেড়ে আসছে এবং আমাকে তাড়া করেছে। আমি কিছুতেই পা ওঠাতে পারছিনা। উঠছেনা কুকুরগুলো, আমার সারা শরীর কামড়ে খামচে একদম রক্তাক্ত করে দিল। আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমার এমনিতে শরীর ভালো নয়। গ্যাস হয়ে যায়। সেই জন্য তো মানুষ স্বপ্ন দেখে। এই বলে আমি স্বপ্ন টাকা উড়িয়ে দিতে চাইলাম। তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে বাইরে এসে বসলাম ক্রমশ সন্ধ্যা হলো সন্ধ্যার পরে আমরা মার্কেটে বেড়াতে যাই। মার্কেটে বেড়াতে এসে দেখতে পেলাম একটা কুকুর আমার পিছু নিয়েছে সেই কুকুরটা দাঁত বের করে জিব বারকরে হ্যাঁ হ্যাঁ করতে করতে আমার পিছন পিছন আসছে।
আজকে অমাবস্যা তাওবা ভূতচতুর্দশী। আজকের দিনেও কুকুরটা পিছু নিয়েছে আস্তে আস্তে দেখলাম অনেকগুলো কুকুর আমার পিছনে দাঁড়িয়ে গেছে। আশেপাশে কেউ কোথাও নেই। অন্ধকার ঘড়িতে আটটা দশ হয়ে গেছে মার্কেটে কেউ নেই। আমার খুব ভয় পেতে লাগলো। আস্তে আস্তে কুকুরের সংখ্যা কিন্তু বাড়তেই থাকল। প্রায় স্বপ্নে দেখা সেই একশটা কুকুরের মত হয়ে গেল। আমি চিৎকার করতে শুরু করলাম। কিন্তু কেউ কোথাও নেই কি করবো আমি আমি বুঝতে পারলাম না।
একটা লোক হাঁটছিল। সে প্রত্যেকদিন হাঁটে।তার কাছে গিয়ে ভয়ে আমি জড়িয়ে ধরে বললাম দাদা একটু ধরো না। কি হলো, ওই দেখুন কতগুলো কুকুর আমাকে তাড়া করেছে। ওই কুকুর আমি দেখছি।দাদা বললেন, একটা কুকুরও নেই। দাদা বললেন আপনার মাথা খারাপ হয়েছে কিংবা গ্যাস হয়েছে। যান গ্যাসের ওষুধ বাড়ি গিয়ে খেয়ে নিন।
আমি তার কথা শুনে বাড়ির পথে হাঁটা লাগালাম। কিন্তু দাদা চলে যাওয়ার পরেই আবার দেখলাম কুকুরগুলো ধাওয়া করেছে।। একটা কুকুর বড় হতে শুরু করলো বড় হতেও তো একদম গরুর মত হয়ে গেল।কুকুর গরু হলো কি করে। গরুটা যেই আমি তাড়া করতে গেলাম গরুটা ছোট্ট একটা বিড়াল হয়ে গেল।বিড়াল টা থেকে আবার একটা ছোট্ট ইঁদূর হয়ে গেল। কিন্তু আমার পায়ের কাছে এসে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। আমি পা দিয়ে তাকে তাড়াবার চেষ্টা করলাম। সে সরাসরি উঠে আমার বুকের কাছে চলে এলো।।
তারপর আমার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল।
কোনরকমে তাকে ফেলে দিয়ে আমি বাড়ির দিকে ছুট লাগালাম। ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করলাম। দরজা বন্ধ করে দিয়ে যখন বসে হাঁপাচ্ছি তখন মা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে এত হাসছো কেন?
আমি বললাম, কিছু হয়নি এমনি বসে আছি আমি এত ছুটেছিলাম, শরীরচর্চা করলাম সেজন্য হাঁপানি লেগেছে ।
এ কথা বললে তো কেউ বিশ্বাস করবে না তাই আমি ব্যাপারটা চেপে গেলাম।
তারপর দরজা খুলে ছাদে গেলাম। ছাদে গিয়ে ভাবলাম একটু হাওয়া খেলে হয়তো ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে। সেই দাদা হাঁটছিলেন মার্কেটে তিনি তো বললেন কোন কিছুই নেই, তাহলে আমারই হয়তো ভুল। আমার এই ভ্রমের জন্যই হয়তো বারবার আমি এটা দেখছি। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ ও বটে। আমাকে হয়তো ডাক্তার দেখাতে হবে। এই ভেবে আমি ছাদে ঘোরাঘুরি করছি। দেখলাম পিছনে একটা কুকুর আমার সাথে ঘোরাঘুরি করছে। সেই দাঁত বার করে জিভ বার করে একই রকম হ্যাঁ হ্যাঁ করছে।
ছাদের কুকুরটা আবার ধীরে ধীরে বড় গরুর মত হয়ে গেল। সাদা গরু আমি দেখে বসে পড়লাম। আবার দেখলাম গরুটা আবার একটা সাদা বিড়াল হয়ে গেল। বিড়ালটা আবার ইঁদুর হয়ে গেল। আমার বুকের উপর উঠে বললো আমি শুয়ে পড়লাম।
আবার আমার বুকের ভিতর ঘোরাফেরা করতে লাগলো। মনে হচ্ছে যেন কামড়ে দেবে। কিন্তু সে কামড়াচ্ছে না। কিন্তু আমার ভয়ে হাত পা হিম হয়ে গেল। তারপর আমার জ্ঞান ছিল না। আমার জ্ঞান ফিরল যখন তখন অনেক লোক আমাকে ঘিরে আছে। অনেক পরে যখন খাওয়ার সময় হয়েছে মা ডাকছেন, তখন সবাই ধরাধরি করে আমাকে বিছানায় নিয়ে গেছে। মা ডেকেছেন লোকগুলিকে নিশ্চয়। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি,আর সবকিছু জানতে পারি। মা বলেন, কি হয়েছে তোর। কালকে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিবি।
পরেরদিন কাউকে না বলে আমি ডাক্তারখানায় না গিয়ে, গেলাম এক পুরোহিতের বাড়ি। সেই পুরোহিত আমাকে পরামর্শ দিলেন কাঁদের পাড়ে একটা বট গাছের তলায় অপদেবতাদের আত্মা অপসারিত করা হয়।
তুমি সেখানে যাবে সেখানে আমি পুজো করবো পুজো করার পর যখন আমি কাটারির কোপ মারব।
মারার সঙ্গে সঙ্গে তোমার বাড়ির গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে পড়বে। আর সেই ডাল ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রেতাত্মা দূর হবে।
তারপর সারাদিন আমি জমানো টাকা দিয়ে সমস্ত কিছু কেনাকাটা করলাম ফর্দমত। বাড়িতে কিছু না বলে তারপরের দিন পুরোহিতকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় সেই কাঁদর পাড়ে বটতলার নিচে গেলাম। সেখানে পুরোহিত পুজো শুরু করলো আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে যেন সারা অঙ্গে ইঁদুর খেলে বেড়াচ্ছে। তবুও আমি সাহসে ভর করে বসে থাকলাম। সঙ্গে পুরোহিত আছে। পুরোহিত মন্ত্র বলছেন," হর পাপং হর ক্লেশং হর শোকং হরাসুখম্। হর রোগং হর ক্ষোভং হর মারীং হরপ্রিয়ে।।"আমার সাহস বেড়ে গেল। মন্ত্র বলতে বলতে তিনি মাটিতে মারলেন কাটারি দিয়ে কোপ মাটিতে।। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা অঙ্গে যেন সাহসের সঞ্চার হল।
পুরোহিত বলল আর কোন ভয় নেই। যদি বাড়ি গিয়ে দেখো তোমার গাছের কোন একটা ডাল ভেঙে পড়েছে তাহলে এই আত্মা অপসারিত হয়েছে। তা না হলে আবার তোমাকে আরেকদিন অমাবস্যার সময় পুজো করতে হবে। আর 15 দিন দুর্ভোগ হবে।
এই দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে আবার। বাড়ি গিয়ে দেখো আজকে। মাকে জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারবে। তখন বাড়ি এলাম রাত বারোটা বাজে। মা বললেন কোথায় ছিলি এতক্ষণ। আমি বললাম আশ্চর্য কিছু হয়েছে আমাদের বাড়িতে।
মা বললেন, তোর বাবা যে গাছটা লাগিয়ে গিয়েছিলেন সেই গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। আজকে ঝড়ে হঠাৎ রাতে। একটা ঝড় এলো আর ঝড়ে ভেঙে পড়ল ডাল। আমি মনে মনে ভাবলাম যাক বাঁচা গেল।
তারপর থেকে আর কোনদিন কুকুরের উপদ্রব হয়নি আমার উপরে। তা আমি আর কোনদিন কোন প্রাণী বা প্রাণী হত্যা করব না প্রতিজ্ঞা করলাম। কুকুর কেন একটা পোকা পর্যন্ত আমার পায়ের চাপে যেন না পড়ে। সাবধানে চলি এখন।
শ্রোতারা সকলেই বলল,ঠিক ঠিক পশুপাখি মারা উচিত নয়। আমরাও কেউ মারব না কোনোদিন। তোমার গল্প শুনে ভয় পেলাম খুব।
আমি বললাম, গল্পই মনে করো। তা না হলে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে না...
Comments