
গল্পের আসর
সুবীর মজুমদার
ছোটবেলায় গরমের ছুটিতে একবার গ্রামে মামাবাড়িতে বেড়াতে গেছি। সারাটা দিন বেজায় গরম থাকার পর সন্ধার পরও গরমের হাত থেকে রেহাই নেই। তাই বাড়ির উঠোনে শীতল পাটি পেতে আমরা কয়েকজন তার উপর বসে আড্ডা দিচ্ছি।
ইতোমধ্যে গ্রামের অন্যান্য ছেলে-বুড়োরাও এসে হাজির হয়েছে এবং উঠোনে পেতে রাখা শীতল পাটির উপরে বসে আড্ডা জমাতে শুরু করেছে। তখনকার দিনে গ্রামে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। কুপির আলোই ছিল একমাত্র সম্বল। কুপির আলোতে সবটা আলোকিত হতোও না। কিন্তু তাতে কি? ঐ আলোতেই জমাটি আড্ডা চলেছে।
যে যার মতো একে অপরের সাথে গল্প করে চলেছে। এমন সময়ে মামা প্রস্তাব করলেন, ভূতের গল্প হোক। যে যা জানে বলুক। রাতের আলো-আঁধারীতে ভূতের গল্প জমে দারুণ। তার প্রস্তাব সকলে মেনে নিল।
সবাই একে-একে ভূতের গল্প বলে চলল। কেউ বলল, সে নিজে অন্ধকারের মধ্যে ছায়ার মতো কিছু একটা সরে যেতে দেখেছিল। কেউ বলল, সাদা কাপড় পরা বুড়ি তার পিছু নিয়েছিল। কারও গল্প শুনে ভয়-ভয় লাগল, তো কারও গল্প এতই বাজে যে শুনে সবাই হো-হো করে হেসে উঠল।
এমন সময়ে আমারই বয়সী পাড়ার একটি ছেলে বলে উঠল, "এবার আমি একটা গল্প বলতে চাই। এটা অন্যদের মত বানানো বা ভাসাভাসা ভূতের গল্প নয়, আসল ভূতের গল্প। বলা যায়, আমারই জীবনের গল্প।"
আমরা নড়ে-চড়ে বসলাম। কেউ-কেউ নাক সিঁটকে বলল, "পাকামো হচ্ছে, এটা তোর জীবনের গল্প!"
যাই হোক, গল্প শুরু হল।
"অনেক দিন আগে আমাদের গ্রামে শ্যামল সাহা নামে একটা লোক বাস করত। সে রোজ সকালে নদী পেরিয়ে পাশের গ্রামে যেত কাজ করার জন্য। আবার সন্ধ্যার পরে নদী পেরিয়ে আমাদের গ্রামে ফিরে আসতো।
একদিন কাজ সারতে-সারতে তার রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেল। নদীর পাড়ে আসতে-আসতে সে ভাবল, আজ আর মাঝি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এদিকে রাত-বিরেতে একাএকা নদীর পাড়ে আসাটাও ঠিক উপযুক্ত নয়। পাশেই একটা মড়া পোড়ানোর শ্মশান-ঘাট আছে! তবুও নদীর পাড়ে এসে সে অবাক হয়ে দেখল, একজন মাঝি বইঠা নিয়ে তার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছে!
নদীর এপারে এসে সে দেখতে পেল, একটা বাচ্চা ছেলে হাতে একটা নীল রঙের বালতি নিয়ে হাসিমুখে তার দিকেই আসছে। সে দেখে অবাক হল! ছেলেটি তার কাছে এসে বলল, " বাবু, চা খাবেন?"
শ্যামল সাহা অবাক হয়ে বলল, "এতো রাতে তুই চা নিয়ে আমার জন্যেই দাঁড়িয়ে ছিলি নাকি!?"
ছেলেটি বলল, "ভালো চা আছে। এক ভাঁড় দিই?"
শ্যামল সাহা সম্মতি জানালে ছেলেটা তাকে এক ভাঁড় চা দিল।
চা খেতে-খেতে শ্যামল সাহা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, "তোর নাম কী? কোথায় থাকিস তুই?"
ছেলেটি বলল, "আমার নাম লাল্টু। কাছেই থাকি।"
-"তা বাবা লাল্টু, তোমার গায়ের রঙ এত ফেকাসে লাগছে কেন!? তোমার পা-দুটো দেখি তো উল্টো দিকে ঘোরানো নয়তো!"
ছেলেটি তার পা দেখাল, না উল্টো দিকে ঘোরানো নয়। শ্যামল সাহা আস্বস্ত হল। তারপর দু'জনে কথা বলতে-বলতে বাড়ির দিকে ফিরতে লাগলো।
কিছু দূরে আসার পর দু'জনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে। শ্যামল সাহা বলল, "তা বাবা লাল্টু, আমি তোমাকে তোমার পা দেখাতে বললাম। তুমি তো আমার পা দেখতে চাইলে না!"
লাল্টু দেখতে পেল, শ্যামল সাহার দু'খানি পা-ই পিছনদিকে ঘোরানো!
আর সে খোনা গলায় বলছে, "কী, কেমন দেখলে!?"
লাল্টু প্রচন্ড ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গেল। তার জ্ঞান আর ফিরে এল না। সে মারা গেল।"
গল্প শেষ হয়েছে। মামা এবার মুখ খুললেন,
"তোর নামই তো লাল্টু। আর এটা তোর গল্প হলে তুই এখন আমাদের মাঝে বসে কীভাবে গল্প বলছিস?!"
হঠাৎ কুপির আলো নিভে গেল। মামি তাড়াতাড়ি দেশলাই নিয়ে এসে কুপি জ্বালাতে সেই লাল্টুকে আর কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না! সবাই ভাবল, বুঝি মামার প্রশ্নের জবাব কীভাবে দেবে ভেবে না উঠতে পেরে বাতি নিভে যাওয়ার পরে সে মানে-মানে সরে পড়েছে!
পরের দিন সকালে পাশের বাড়ি থেকে একটা হৈ-হল্লা শুনে আমরা সবাই গেলাম কী ব্যাপার দেখতে! গিয়ে শুনলাম, লাল্টুর মা কেঁদে-কেটে বলছে, "গরীব মানুষ আমরা। ওর বাবাটা ছোটবেলায় মরে গেল। আমি লোকের বাড়ি কাজ করে আর ছেলেটা চা বেচে কোনমতে সংসার চালাতাম। এখন ছেলেটাও মরে গেল গো! এখন আমি কী করব!?"
খবর শুনলাম, পরশু চা বেচতে বেরিয়ে লাল্টু আর ফেরে নি! আজ সকালে খবর এসেছে, শ্মশানের কাছে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। শেয়াল-কুকুরে মৃতদেহটা খুবলে খাচ্ছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, প্রচন্ড ভয় পেয়ে তার মৃত্যু হয়েছে!
আমরা সবাই তখন এটা ভেবে অস্থির যে, কাল রাতে গল্পের আসরে তাহলে কোন্ লাল্টু এসে আমাদের গল্প শুনিয়ে গেল!
Comments