অর্ধনারীশ্বর
সায়ন গুপ্ত
১.
সামনেই কলেজের অ্যানুয়াল ফাংশান।। তাতে ব্যস্ত গোটা কলেজ।।
সিনিয়ার জুনিয়র রা হাতে হাত রেখে কাজ করে চলেছে।।
আয়োজনে যেনো কোনো ত্রুটি না থাকে।।সকলে কাজ ভাগ করে নিয়েছে।।
তবে সেকেন্ড ইয়ার বাংলা অনার্স ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছাত্রীরা যেনো একটু ম্লান।।কারন কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার ক্ষত এখনো শুকোয়নি।।
কলেজের তিনতলায় সেকেন্ড ইয়ারের একটা গ্রুপ রিহার্সাল করতে এসেছে... হঠাৎ পাশের কোনো একটা ঘর থেকে ঘুঙুরের শব্দ ভেসে আসে....
কৌতূহল বশত গ্রুপের একজন দেখতে যায়... ধীরে ধীরে কিসের এক অমোঘ আকর্ষণ এ এগিয়ে যায় সে.. যে আওয়াজ টা আস্তে শোনাচ্ছিলো ধীরে ধীরে জোরালো হয়ে ওঠে...
দরজার কাছে গিয়ে থমকে যায় সে... আস্তে আস্তে দরজাটা ফাক করে যা দেখে তাতে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়... প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে ওঠে জ্ঞান হারায় সে....
বাকিরা ছুটে আসে... দেখে তিথি মাটিতে পড়ে আছে... চোখে মুখে জল দেওয়ার কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফেরে... জ্ঞান ফেরার পর তিথি যা বলে তাতে সকলের চক্ষু কপালে ওঠার জোগাড়... সকলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে...
কলেজে কাজ করতে করতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।। তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে... একে একে সকলে প্রায় বেরিয়ে পরেছে।।
পুরো কলেজ টা যেনো খা.... খা করছে...
বেরোনোর আগে একবার ওয়াশ রুম যায়... কলেজের টয়লেট একেবারে শেষ প্রান্তে থাকায় গা ছমছম করতে থাকে রুদ্রর....ফেরার সময় পেছন থেকে কার যেনো গলার স্বর ভেসে ওঠে... এই কন্ঠস্বর তার অত্যন্ত পরিচিত... ভয়ে হাত পা তার অবশ হয়ে ওঠে.. চলার শক্তি টুকোও যেনো সে হারিয়ে ফেলে.... একজোড়া ছায়ামূর্তি যেনো তাকে পেছন থেকে অনুসরণ করতে থাকে....
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর তার হঠাৎ সম্বিত ফেরে দীপের ডাকে...
কি রে এখানে কি করছিস?? চল এবার বেরোতে হবে তো...
দীপ কে দেখে রুদ্র যেনো প্রাণ ফিরে পায়.....
কলেজ থেকে বেরিয়ে গোটা ঘটনাটা দীপ কে জানায় রুদ্র... দীপ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে সে এরকম অনেক কিছুই শুনছে বেশ কিছুদিন ধরে... কলেজে ব্যাপার টা জানাতে হবে....
পরের দিন দুপুরের দিকে কলেজে শোরগোল পরে যায়...
বাংলা ডিপার্টমেন্ট এর আদিত্য স্যার নাকি লাইব্রেরি তে বই নিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান...
জ্ঞান ফিরতে তিনি জানান দুপুরের দিকে লাইব্রেরিতে যখন তিনি যান লাইব্রেরি পুরো ফাঁকা ছিলো.. হঠাৎ পেছনের দেওয়ালে ভেসে ওঠে দুটো ছায়ামূর্তি... তার সমস্ত গায়ে যেনো কাটা দিয়ে ওঠে... এরপর পেছনে ঘুরে তিনি যা দেখেন তাতেই তিনি জ্ঞান হারান...
দুদিন পর সোমা ম্যাম এর সাথেও এক ই ঘটনা ঘটে।। রিহার্সাল শেষ হওয়ার পর তিনি যখন রূমে একা ছিলেন হঠাৎ ঘুঙুরের শব্দে চমকে উঠে পেছনে তাকান তিনি.... ঘটনার আকস্মিকতায় তিনিও জ্ঞান হারান...
এরপর কলেজে সকলের মুখে মুখে ওই একটা টপিক ই চলতে থাকে.....
২.
ঘুঙুরের শব্দে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেলো কমলেশ বাবুর।। তিনি ছুটে গেলেন তার ছেলে কৃষ্ণেন্দুর ঘরের দিকে।। ঘরের বাইরে এসে তার মেজাজ সপ্তমে পৌছোলো। যথারীতি ছেলের কান্ড দেখে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাওয়ার জোগাড়।।
কৃষ্ণেন্দু র মাকে সকাল সকাল পাঁচ কথা শুনতে হলো।।
তোমার ছেলেকে সাবধান করে দিও... আমার বাড়িতে এইসব মেয়েলিপনা চলবে না....
দূর করে দেবো একদম.. যতসব এসে জুটেছে....
রবিবার কোথায় শান্তিতে একটু ঘুমোবো তার আর উপায় নেই... গজগজ করতে করতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান তিনি।।
কমলেশ বাবু বেরিয়ে যেতে ঘরে ঢোকেন মানসী দেবী... দেখেন তাদের একমাত্র ছেলে নৃত্যরত... ওনার কাছেই কৃষ্ণেন্দুর নাচের হাতেখড়ি...
মানসী দেবী অবাক দৃষ্টি তে চেয়ে রয়েছেন তার ছেলের দিকে... সে যেনো নিজেকে পুরো সমর্পণ করেছে... নাচে জন্ম... নাচে মৃত্যু.... তা তা থৈ থৈ.....
বিয়ের আগে নাচ ই ছিলো মানসী দেবীর ধ্যান জ্ঞান...এখন ছেলের মধ্যে ই নিজেকে খুঁজে বেড়ান তিনি....
ছেলেটা ছোটো থেকেই শরীরে পুরুষ কিন্তু হৃদয়ে নারী.. কমলেশ বাবু তাই ছেলেকে সহ্য করতে পারেনা...
কিন্তু মানসী দেবী ছেলেকে বাধা দেননি... এ তো কোনো অন্যায় নয়... সমকামিতা কোনো পাপ নয়...
মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন তিনি...
ছেলেকে নিয়ে হাসাহাসি হয় বলে অনেক কে মন থেকে ত্যাগ করেছেন তিনি...
মা ছাড়াও কৃষ্ণেন্দুকে আর একজন সাপোর্ট করে.. সে হলো তার হৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ.. তার কলেজের একমাত্র বন্ধু ঋতুরাজ... তার কাছে নিজেকে সপেঁ দিয়েছে কৃষ্ণেন্দু....
ঋতুরাজ তাকে ভালোবেসে কৃষ্ণা বলে ডাকে... তার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে...
এর জন্য প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে হয় তাদের. .. দাদা-বৌদি বলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে... এমনকী তৃতীয় লিঙ্গ কিনা সেই নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে...
তামাশা ঠাট্টা টিটকিরিতে কৃষ্ণেন্দু র জীবন যেনো দূর্বিষহ হয়ে ওঠে...
সে মাঝে মাঝে মনে করে এ জীবন আর রাখবে না.. তখনই তার জীবনে আশার আলো সঞ্চার করে ঋতুরাজ।। তার সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয়... নিজের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখে তার কৃষ্ণা কে...
তারা দুজনেই সেকেন্ড ইয়ার বাংলা অনার্স।। গত বছর কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রথম তাদের সাক্ষাৎ হয়।
কৃষ্ণেন্দুর নাচ মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলো ঋতুরাজ...
নাচ দেখতে দেখতে কৃষ্ণেন্দুর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো সে... শ্রী কৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে... ভ্রমর কই ও গিয়া......
নিজের ভালোবাসা উজার করে দিয়েছিলো সে কৃষ্ণা কে....
সমাজ তাদের ছোটো চোখে দেখলেও তাদের প্রেম রাধা কৃষ্ণের মতই পবিত্র ছিলো।। তারা ছিলো এক আত্মা এক প্রাণ...
বড়ো হওয়ার সাথে সাথে বাড়িতে বাবার দুর্ব্যবহার কৃষ্ণেন্দু কে খুব আঘাত করে।। আঘাত এর মাত্রা দিন দিন বাড়তে বাড়তে সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে যায় সেদিন যেদিন তার বাবা যা নয় তাই বলে তাকে চূড়ান্ত অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দেন আর তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় ঘুঙুর টা ভেঙে দেন....
অপমানে লজ্জায় আহত দুটি প্রাণ একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে বসেছিলো কলেজের হল ঘরটিতে।। ইতিমধ্যে তা দেখে কলেজের প্রিন্সিপাল কে ডেকে আনে রুদ্র, তিথি আর দীপ....
প্রিন্সিপাল এর কাছ থেকে সহানুভূতি র পরিবর্তে জোটে অপমান, কটুক্তি... পাশ থেকে আদিত্য স্যার সোমা ম্যাম এর উস্কানিমূলক মন্তব্য যেনো আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।। এরপর প্রিন্সিপাল যা বলেন ওদের কাছে সেটা ধারনার বাইরে... শোনো তোমরা বরং তৃতীয় লিঙ্গের জন্য যেসব বিশেষ কলেজ গুলো আছে সেগুলোতে অ্যাপলাই করো... এই কলেজ তোমাদের জন্য নয়. .. তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ছুটে বেরিয়ে যায় কৃষ্ণেন্দু আর তার পেছন পেছন ঋতুরাজ....
ওইদিন ই বিকেলের দিকে ওই রিহার্সাল রুম থেকে পাশাপাশি দুজনের ঝুলন্ত দেহ মেলে.......
৩.
এরপর থেকেই শুরু হয় কলেজে বিভিন্ন উপদ্রব।। ঘটনা গুলো বিচার করে দেখা যায় যে বা যারা ওদের মিলনের পথে বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে বা যারা ওদের পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে কটুক্তি করেছে তারাই ওদেরকে একসাথে দেখেছে....
প্রত্যেক কেই ওরা দেখা দিয়ে যেনো বোঝাতে চেয়েছে "সমকামিতা"কোনো অপরাধ নয়।। তারা কোনো অপরাধ করেনি বরং যারা ওদের ঘৃণা র চোখে দেখে তারাই অপরাধি.......
আজ ১২ ই জুন।। কলেজের অ্যানুয়াল প্রোগ্রাম।।
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার মূহুর্তে সকলকে অবাক করে প্রিন্সিপাল এসে মঞ্চে দাড়ান... সাথে আদিত্য স্যার সোমা ম্যাম ,দীপ ,তিথি, রুদ্র আর ও অনেকে.... সকলে শোকপ্রকাশ করে দুই বিদেহীর প্রতি... ক্ষমা প্রার্থনা করে সকলে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য....
এরপর অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার মুহূর্তে চারিদিকের আলো যখন বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ করে মঞ্চের পর্দা টা যেনো কেঁপে ওঠে....চারিদিকে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়...
মঞ্চে আলো পড়ার পর সকলে দেখে চমকে ওঠে মঞ্চ আলো করে আবির্ভূত হয়েছে দুই অশরীরী।।উপস্থিত সকলের চোখে তখন জল।।দূরে বসে আছেন মানসী দেবী আর কমলেশ বাবু।।তাদের চোখেও আনন্দাশ্রু।।সারা হলরুম করতালিতে ফেটে পড়ছে।।সকলের কানে বাজছে একটাই গান
নাচে জন্ম...নাচে মৃত্যু...পাছে পাছে তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ... তা তা থৈ থৈ....
কি আনন্দ... কি আনন্দ... কি আনন্দ দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ........
ধীরে ধীরে দুই অশরীরী র ছায়ামূর্তি আবছা হতে হতে কোথায় যেনো একাত্ম হয়ে যায়.....
Comments