রুদালী
রিয়া মিত্র
নাভালির জঙ্গলে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল। এতটা যে দেরি হয়ে যাবে, সত্যি বুঝতে পারিনি। আমি, তপেশ, ময়ূখ তিনজনেই জিপের ধকল সামলে যখন গেস্ট-হাউসের গেটের কাছে নামলাম, তখন প্রায় সাতটা বাজে। আড়মোড়া ভেঙে ত্রিলোকনাথের দিকে তাকিয়ে তপেশ বলল, "আভি দারু সারু মিলেগা কী নেহি?" ত্রিলোকনাথ স্বভাবগম্ভীর মুখে বলল, "হা সাব, জরুর। আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন, হামি আভি সব বেওয়াস্থা করছি।"
ভরা জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোয় পুরো জঙ্গলটা ভরে আছে। বারান্দায় আরামকেদারায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সিগারেটে সুখটান লাগালাম। একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক কানের কাছে একনাগাড়ে হয়েই চলেছে। মনে হচ্ছে যেন, আদিম যুগের কোন্ এক গহীন অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে শুধু একা আমি তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছি আর এই কাঠের গেস্ট-হাউসটা সমগ্র জঙ্গলের মধ্যে যেন কালের অস্তিত্ব বহন করে চলেছে। এই আমার একটা স্বভাব, আবার ভালোলাগাও বলা যেতে পারে। ফরেস্ট রেঞ্জের অফিসার হলেও যে কোনো জায়গায় গিয়ে আমার মধ্যেকার স্বভাবকবি হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে আসে। এই ফরেস্টের অফিসার হিসেবে জয়েন করেছি দুদিন আগেই। সব কিছু গোছগাছ করে আজই এলাম এখানে। আপাতত এই সরকারি গেস্ট-হাউসে থাকব। কিছুদিন পরে বাংলোটা পেয়ে যাব। ওটা একটু অপেক্ষাকৃত জনবহুল জায়গায় হবে। এখানে যেমন ত্রিলোকনাথ ছাড়া একদমই লোকবসতি প্রায় নেই বললেই চলে, মাঝে মধ্যে কোনো মানুষের দেখা পাওয়া যায় হয়তো। জঙ্গলের ভিতরের দিকেই গেস্ট-হাউসটা। তাই, এই কয়েকদিন আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমার দুই বন্ধু তপেশ আর ময়ূখ এসেছে। তপেশের আবার একটু পানের নেশা, সে ব্যাটা নিজের কাজে বসে গেছে নিশ্চয়ই!
ত্রিলোকনাথের গম্ভীর কণ্ঠে আদিম অরণ্যের অন্ধকারের তল থেকে উঠে এলাম, "বাবুজী, রাতের খাবার কখন দেব?"
-- নটা নাগাদ এনো।
-- ঠিক হ্যয়। বাবুজী....
ওকে ইতস্তত করতে দেখে আমি অবাক হয়ে বললাম, "কিছু বলবে?"
-- এত দের তক বাইরে বসে থাকবেন না।
-- কেন?! এত সুন্দর চাঁদনী রাতে কী ভালোলাগছে জঙ্গলটা!
-- না মানে...
-- আরে আমার অভ্যাস আছে। তুমি চিন্তা কোরো না। দশ বছর হয়ে গেল বিভিন্ন জঙ্গলে জঙ্গলে পড়ে রয়েছি, লোকালয়ের মুখ দেখি না, জঙ্গল দেখতে আমার ভালোই লাগে।
-- না বাবুজী, এই জঙ্গলটা চাঁদনী রাতে সুন্দর হলেও খুবই ভয়ানক।
এখানে আসার আগে এরকম কানাঘুষো শুনছিলাম বটে। আগের অফিসারও নাকি ভয়েই ট্রান্সফার নিয়ে নিয়েছে। আমি হেসে বললাম, "ভয়ানক?! সেটা কীরকম?!" স্বভাবগম্ভীর ত্রিলোকনাথকে রীতিমতো ঘামতে দেখলাম! এমন কিছু গরম নয় এখানে বরং এইসময় একটা চাদর গায়ে জড়ালেই আরাম লাগবে। কপালের ঘাম মুছে ত্রিলোকনাথ বলল, "রু... রুদালী!!" কথাটা বলার সাথে সাথে দেখলাম, ওর শরীরটা হাল্কা কাঁপছে, চোখটা সামান্য লাল হয়ে এসেছে! আমি অবাক হয়ে বললাম, "কে রুদালী?! রাজস্থানের রুদালী?!" একটু ঢোঁক গিলে ও বলল, "না, বাবুজী, এই জঙ্গলেই থাকে সে, এক ভয়ঙ্কর আত্মা। কেউ তাকে দেখেনি কিন্তু রাতের বেলা অনেকেই তার ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনেছে, বিশেষ করে এই চাঁদনী রাতে। রাজস্থানের রুদালীদের মতোই তার কান্নাও সেরকম মরা-কান্নার মতো শুনতে লাগে! তাই, তার ওরকম নাম লোকমুখে প্রচলিত হয়েছে।"
-- তোমরা কি কেউ তাকে কখনো দেখেছ?!
-- তাকে যারা দেখেছে, তারা আর জীবিত ফিরে আসেনি, বাবুজী। পরদিন জঙ্গলে তাদের মুণ্ড কাটা লাশটা শুধু পাওয়া গেছে। এ জঙ্গল বড় অভিশপ্ত জঙ্গল আছে, বাবুজী। আগের বাবুজীও এই রুদালীর ভয়েই চলে গেলেন।
-- হুমম্, বুঝতে পেরেছি। এই জঙ্গলে তার মানে চোরা কারবারীদের রমরমা খুব ভালোই রয়েছে। তারাই স্থানীয় লোকেদের ভয় দেখিয়ে এসব করছে। কিন্তু এই অভিজিৎ চৌধুরী থাকতে এসব একদমই হতে দেবে না।
-- না, বাবুজী, আপনি ভুল ভাবছেন। রুদালী সত্যিই আছে। আমার কথা বিশওয়াস করুন। রাতবিরেতে কান্নার আওয়াজ পেলে ভুলেও ঘর থেকে বেরোবেন না। যাই হয়ে যাক্, বাবুজী, নিজের ঘর ছেড়ে একদম কোত্থাও বেরোবেন না। ও ভীষণ ছলনাময়ী আত্মা আছে! আপনাকে ঘর থেকে টেনে বের করার কোশিশ ও জরুর করবে।
ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, "ঠিক আছে। তুমি ভয় পেও না। আমি বেরোব না।"
রাতের নাভালি আরও মায়াময় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। তপেশ আর ময়ূখ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তপেশের নেশাটা বেশ ভালোই হয়েছে বুঝলাম। সামনের গহীন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তপেশ বলল, "চল্, জিপটা নিয়ে একটু ঘুরে আসি। চাঁদনী রাতে জঙ্গলের সৌন্দর্যটাই আলাদা।" কেন জানি না, সায় দিতে পারলাম না। ত্রিলোকনাথের কথায় কি তবে ভয় পেয়ে গেলাম?! নাহ্, ঠিক ভয় নয় কিন্তু অনেক রকম জন্তু-জানোয়ারের উৎপাতও তো রয়েছে। তাছাড়াও জায়গাটাও একেবারে নতুন। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তপেশ বলল, "তুই যাবি না তো? জানি, শালা, তুই এখন খেয়েদেয়ে ঘুম লাগাবি। তুই কি যাবি, ময়ূখ?" বলে ময়ূখের দিকে ঘুরল। ময়ূখ আমার দিকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে বলল, "আমারও খুব ঘুম পাচ্ছে রে।" তপেশ রেগে বলল, "তোরা সব এত ঘুমকাতুরে কেন রে?" আমি বললাম, "শোন্, রাতবিরেতে জঙ্গলে যাওয়াটা কিন্তু বিপজ্জনক।" তপেশ বলল, "তোদের যেতে হবে না। আমি খেয়ে উঠে জিপটা নিয়ে একাই সামনে থেকে একটা চক্কর দিয়ে আসছি। জঙ্গলের বেশি ভিতরে ঢুকব না, গেস্ট-হাউসের আশেপাশেই থাকব।" নাছোড়বান্দা তপেশকে বাধ্য হয়ে বললাম, "আচ্ছা, যা, কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবি।"
পিছনে নাভালির সরকারি গেস্ট-হাউসটা ফেলে জিপ নিয়ে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে তপেশ। জমাট-বাঁধা অন্ধকারে রাতচরা পাখিদের আওয়াজ আর শিয়ালের ডাক ছাড়া কোনো শব্দ আর তেমন কানে আসছে না ওর। হঠাৎ করেই বেশ ঠাণ্ডা লাগছে, আকাশে গোল চাঁদটা মেঘে ঢেকে গেছে, সাথে ঠাণ্ডা হাওয়াও দিচ্ছে। বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা প্রবল। নাহ্, ফেরার রাস্তা ধরাটাই বেটার এবার। জিপটা ঘোরাতে গিয়েই হঠাৎ নরম কাদা মাটিতে পিছনের বাঁ দিকের চাকাটা আটকে যায়। এ তো মহা মুশকিল! জিপ থেকে নেমে পিছন দিকে যেতে গিয়েই চোখ পড়ে, অনতিদূরে একটি জলাশয় রয়েছে আর তার সামনেই একঢাল চুল খুলে দিয়ে একটি মেয়ে বসে আছে! বেশ অবাক হয়ে যায় তপেশ! এত রাতে এখানে একা একটা মেয়ে! এখানে যে জলাশয় ছিল, সেটাও খেয়াল করেনি সে এতক্ষণ! সেজন্যই এখানকার মাটিটাও নরম। হয়তো আশেপাশের গ্ৰামের কোনো মেয়ে জল নিতে এসেছে। সাইড থেকে দেখে বেশ সুন্দরীই মনে হচ্ছে মেয়েটিকে। উপায়ান্তর না দেখে তপেশ মেয়েটিকে ডাকে, "এই যে শুনছেন, আমার গাড়ির চাকাটা কাদায় আটকে গেছে, আমাকে একটু সাহায্য করবেন?" তপেশের ডাকে মেয়েটি পিছনে ঘুরে তাকাল। মেয়েটির চোখধাঁধানো রূপ দেখে চমকে উঠল তপেশ! এই হদ্দ জঙ্গলে শহুরে প্রসাধনীর বাইরে থেকেও এত রূপসী হতে পারে কোনো মেয়ে!? কিন্তু মেয়েটির চোখে জল কেন?! মেয়েটি তপেশের দিকে তাকিয়ে দূরে জলের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। তপেশের মনে হলো, যেন মেয়েটি তাকে ডেকে কিছু দেখাতে চাইছে। মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল সে কিন্তু এ কী?! ও যত মেয়েটির কাছে যেতে চাইছে, ততই যেন মেয়েটি পিছনে সরে যাচ্ছে! সাথে মেয়েটির কান্নার বেগও বেড়ে চলেছে.....উঁউঁউউউউউ...! তপেশের মনে হলো, নাহ্, নেশাটা বুঝি আজ বেশিই হয়ে গেছে। ওদিকে না গিয়ে পিছনদিকে ঘুরে এবার সে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু পিছনেও যে সেই একই জলাশয়। কোন্ দিকে যাবে সে?! চারদিকেই সেই জলাশয়! সেই মেয়েটিই বা কোথায়?! পাড়ে উবু হয়ে বসে রয়েছে একটা কালো মতো কোনো জন্তু! ঠাণ্ডা বাতাসের আঁচড়ে এবার ওর বুকের ভিতরেও যেন চাবুক মেরে যেতে লাগল। কোনোদিকে না তাকিয়ে সেই জলের পাড় ধরেই সে ছুটতে শুরু করল। স্পষ্ট শুনতে পারল, পিছনে ধাওয়া করেছে সেই কান্নার আওয়াজ... উঁউঁউউউউউ। নাহ্, আর পারল না..... কালো রোমশ হাতের ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ল জলের মধ্যে। সেই কালো জন্তুটি বা বলা ভালো, কালো অবয়বের মেয়েটি এক টানে ওর মুণ্ডটা ধড় থেকে আলাদা করে দিল। বাতাসে আবার সেই কান্নার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল.... উঁউঁউউউউউ....।
রাতের দিকে গায়ে একটা কম্বল না দিলেই নয়। বাইরে বেশ মেঘ ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, বৃষ্টিও বোধহয় দু-এক ফোঁটা হয়েছে। কম্বলটা গায়ের ওপর ভালো করে টেনে নিয়ে ময়ূখ জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে শুলো। কাচের জানলা দিয়ে বাইরের নিকষ কালো জঙ্গলটা দেখেও কেমন যেন গাটা শিউরে উঠছে। দু-একটা বন্য জন্তুর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে থেকে থেকে কিন্তু কী একটা মিহি সুরের একটানা আওয়াজ যেন ভেসে আসছে, মনে হচ্ছে! ভালো করে কান পাতল ময়ূখ। ঠিক শুনছে কি সে?! এবার আওয়াজটা যেন একটু স্পষ্ট হলো। মনে হচ্ছে, কোনো মেয়ে একটানা ইনিয়ে বিনিয়ে সুর করে কাঁদছে! আশেপাশের কেউ কোনো বিপদে পড়ল নাকি?! এখানে তো কাউকে ডাকলেও পাওয়া যাবে না। আচ্ছা, তপেশ যে সেই বেরিয়েছে, এখনও তো ফেরেনি বোধহয়। বিছানায় পাশে তাকিয়ে অভিজিৎকে অঘোরে ঘুমোতে দেখল সে। তার মানে, তপেশ ফেরেনি এখনও। কান্নার আওয়াজটাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে, স্পষ্ট শুনতে পারছে.... উঁউঁউউউউউ..... উঁউঁউউউউউ.....।
ঘুমন্ত অভিজিৎকে না ডেকে গায়ের চাদরটা জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ময়ূখ। ঠাণ্ডা বাতাস যেন গায়ে ছুরির মতো বিঁধছে। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে জঙ্গলের গাছগুলোর বুকে। অনতিদূরে একটা জলাশয় দেখে চমকে উঠল সে! গেস্ট-হাউসের এত কাছে যে একটা জলাশয় আছে, আগে তো খেয়াল করেনি?! জ্যোৎস্না আলোয় তো চারদিক ভালোই দেখা যাচ্ছিল সন্ধ্যাবেলায়! কান্নার আওয়াজটা ওদিক থেকেই আসছে! জলাশয়ের পাড়ে একটা কালো মতো কী যেন পিছন ঘুরে উবু হয়ে বসে আছে! বারান্দার গেটটা খুলে বেরিয়ে এলো ময়ূখ। সে যেন মোহাবিষ্টের মতো এগিয়ে চলেছে কালো ছায়ামূর্তিটির দিকে, আরও তীব্র হচ্ছে তার কান্নার আওয়াজ..... উঁউঁউউউউউ...... উঁউঁউউউউউ.....। কালো অবয়বটির কাছে পৌঁছতেই ময়ূখের দিকে ঘুরল সে। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল ময়ূখ। কালো একটি নারীমূর্তি উবু হয়ে বসে ছিন্নভিন্ন করছে তপেশের মুণ্ডটা! মুখের শ্বদন্ত আর হাতের নখর বেয়ে নেমে আসছে তাজা রক্তের ধারা। মুহূর্তের মধ্যে কালো রোমশ হাত দিয়ে ময়ূখের মুণ্ডটা ঘুরিয়ে ধড় থেকে আলাদা করে দিল কালো অবয়বটি। বাতাসে তীব্রবেগে ভেসে চলল তার কান্নার আওয়াজ..... উঁউঁউউউউউ..... উঁউঁউউউউউ।
ত্রিলোকনাথ এরকমই কিছু ভয় পাচ্ছিল। ঘুমোতে পারছে না সে! ভোর হতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি। আজ আবার রুদালীর কান্নার তীব্রতা বেড়ে গেছে। ও নিশ্চিত, আজ ঐ ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মা নিজের শিকার পেয়েছে। বারবার বাবুজীকে ঘর থেকে বেরোতে বারণ করা সত্ত্বেও কি তবে বাবুজী বেরোল ঘর থেকে?! স্থানীয় বৃদ্ধদের মুখে শুনেছিল, রাজস্থানের একটি দল একবার খেলা দেখাতে এসেছিল পাশের গ্ৰামে। তাদেরই একটা মেয়ে ঘুরতে ঘুরতে জঙ্গলের পথে হারিয়ে গেছিল। হয়তো কোনো বন্য জন্তুর শিকার হয়েছিল সে। খুঁজতে খুঁজতে পরদিন তার মৃতদেহ জঙ্গলের ভিতরে এক জলাশয়ের কাছে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছিল। তারপর থেকেই নাকি এই রুদালীর অত্যাচার শুরু হয়। তার অতৃপ্ত আত্মা রাতের বেলায় সারা জঙ্গল কেঁদে কেঁদে বেড়ায় আর শিকার খোঁজে। বাইরে সাঁইসাঁই করে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে, বৃষ্টিও নেমেছে। জঙ্গলের মৌসম এমনই হয়! যখন-তখন নিজের রূপ পাল্টায়। তার ঘরের থেকে গেস্ট-হাউসটা বেশি দূরে নয় কিন্তু এই ঝড়-জলের মধ্যে সে যাবেই বা কীভাবে?! তাছাড়া রুদালী বাইরে আশেপাশেই কোথাও রয়েছে। বেরোলে আর রক্ষা নেই! কিন্তু কী করবে? কিছু কি উপায় নেই বাবুজীকে বাঁচানোর?! একটা উপায় সে রেখেই এসেছে গেস্ট-হাউসের মধ্যে কিন্তু রুদালীর মায়ায় পড়ে যদি বাবুজী একবার বেরিয়ে যায় সেখান থেকে, তাহলে আর কিছু করার থাকবে না। আজ এত তীব্র কেন রুদালীর কান্নার আওয়াজ?! হে ভগবান! রক্ষা কোরো ওদের। মনে মনে হনুমান চালিশা আওড়াতে থাকে ত্রিলোকনাথ।
আচমকা ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম আমি! অনেক দূর থেকে ময়ূখের গলার আওয়াজ পেলাম, মনে হলো! পাশে তাকিয়ে দেখি, ময়ূখ আর তপেশ কেউই নেই। তার মানে তপেশ এখনও ফেরেনি কিন্তু ময়ূখ কোথায়?! বাইরের সোঁ সোঁ হাওয়া তখন কাচের জানলায় আছড়ে পড়ছে। জঙ্গলের মধ্যে এরকম ঝড় উঠতে আমি আমার দশ বছরের কেরিয়ারে দেখিনি! ঝড়ের আওয়াজের মধ্যেই ভেসে আসছে একটানা মহিলা-কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ! ত্রিলোকনাথের কথাগুলো মনে পড়ল। নাহ্, ওরা দুজন কোনো বিপদে পড়েনি তো?! কিন্তু এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কোথায় খুঁজব ওদের!? তবে কি রুদালীর খপ্পরে পড়েছে ওরা?! ভাবতে ভাবতেই কাচের জানলাটার দিকে চোখ পড়ল, স্পষ্ট দেখলাম, একটি কালো নারী অবয়ব ভাঁটার মতো চোখ দিয়ে আমাকে মাপছে, তার দু দিকের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে টাটকা, কালচে রক্তের ধারা। ঝড়ের সাথে সাথে যেন এই জানলা থেকে ঐ জানলা সেই কালো শরীরটা উড়ে বেড়াচ্ছে আর সাথে সাথে বাড়ছে তার কান্নার তীব্রতা..... উঁউঁউউউউউ..... উঁউঁউউউউউ। জানলার কাচ, কাঠের দরজায় আছড়ে পড়ছে সেই কান্নার আওয়াজ। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমশীতল স্রোত নেমে গেল, অন্ধকারে হাতড়ে বালিশের তলা থেকে নিজের রিভলবারটা বের করলাম। জানি, এই অপার্থিব শক্তির সাথে যুঝতে পারব না, তবুও শেষ রক্ষা করতেই হবে। একবার ভাবলাম, বাইরে বেরিয়ে দেখি কিন্তু ত্রিলোকনাথের সাবধান-বাণী কানে বাজতে লাগল। লক্ষ করলাম, জানলা-দরজা ভেদ করে সেই কালো অবয়ব কিছুতেই ভিতরে প্রবেশ করতে পারছে না। বাইরে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে যেন পুরো বাড়িটাকেই উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছে কিন্তু বিফল হয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে, এই অভিশপ্ত জঙ্গলের চারদিকে যেন আর কেউ নেই, শুধু আমি এই আদিম অরণ্যের গহীন অন্ধকারে একা বসে এই অপার্থিব শক্তির তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করছি! এই ভয়ঙ্কর রাতও বোধহয় আর শেষ হওয়ার নয়! আর ক্রমশ তার কান্নার তীব্রতায় ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে আমার কান..... উঁউঁউউউউউ.... উঁউঁউউউউউ.....।
বাইরে ঝড়টা থেমে গেছে অনেকক্ষণে, রুদালীর আওয়াজও থেমে গেছে। পুব দিকের আকাশটা একটু ফর্সা হতেই ত্রিলোকনাথ দু-তিনজন লোক নিয়ে গেস্ট-হাউসের দিকে এলো। বাড়ির চারদিকের লণ্ডভণ্ড অবস্থা দেখেই ত্রিলোকনাথ বুঝল, বাড়ির ভিতর ঢুকতে পারেনি সেই প্রেতাত্মা। কাল রাতের খাবার বাবুজীদের দিয়ে ঘরে যাওয়ার সময়ে ভূতেশ্বর বাবার মন্ত্রপড়া জল দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল বাড়িটাকে। রুদালীর হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় তারা পায়নি ঠিকই কিন্তু এই মন্ত্রপড়া জলের বন্ধনের মধ্যে থাকলে সাময়িকভাবে তার থেকে বাঁচা যায়। এইভাবেই তো তারা, আশপাশের গ্ৰামের লোকেরা এই আত্মার সাথে লড়াই করেই কাটাচ্ছে রাতগুলো। আর রুদালীর মোহে পা দিয়ে যে এই বন্ধন ছেড়ে বেরিয়েছে, তাকেই বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়েছে। স্থানীয় এই তান্ত্রিকের জল পড়ার ভরসায়ই এখানকার লোকগুলো প্রাণ হাতে করে বেঁচে রয়েছে।
জ্ঞান আসতেই দেখলাম, সামনে ত্রিলোকনাথ সহ আরও দু-তিনজন স্থানীয় মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের মুখেই শুনলাম, তপেশ আর ময়ূখের মুণ্ডহীন ধড়টা তারা জঙ্গলের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছে। তল্পিতল্পা গুছিয়ে ট্রেন ধরে সেদিনই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম কিন্তু এখনও ঘুমের মধ্যে শুনি সেই আওয়াজ..... উঁউঁউউউউউ..... উঁউঁউউউউউ...... উঁউঁউউউউউ।
(সমাপ্ত)
Comments