আগন্তুক
সুস্মিতা পাল
ও দাদাবাবু কে এয়েছে গো, নাম বলছে দিলীপ মুখার্জী। বোম্বে থেকে আসছে। বীরেন ব্যানার্জী নাকি ওনার আপন মামা, অতএব এটা ওনার মামারবাড়ি। বাড়ির পুরোনো চাকর ঘণ্টা এসে এই খবরটুকু তার দাদাবাবুর কাছে পৌঁছে দিল। খুব উত্তেজিত সে। দাদাবাবু মানে বীরেন ব্যানার্জী তাই শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। ঘন্টাও তাই। "দাদাবাবু, কোনোদিন তো শুনিনি আপনার নিজের কোনো বোন আছে। যা আছে তা তো আপনার জেঠতুতো, খুড়তুতো। তাদের তো আমি দেখেছি। তাদের ছেলেমেয়েদেরও দেখেছি, তা এনাকে তো আগে কোনোদিন দেখিনি। আপনি কি করে এনার আপন মামা হয়ে গেলেন?" ঘন্টা অনর্গল বকে যাচ্ছে। "তা সেই আমার ভাগনা নামের মানুষটিকে কোথায় রেখে এলি? কি জানি আবার কোনো চোর-ডাকাতের পাল্লায় পড়লাম নাকি! বসবার ঘরে বসা, আমি যাচ্ছি, দেখি আবার কোন মূর্তিমান হাজির হল ভাগনা সেজে"।
ঘন্টা দিলীপকে বসবার ঘরে বসিয়ে এসে খবর দিল। বীরেনবাবু চললেন দেখতে ব্যাপারটা কি। পিছন পিছন ঘন্টাও। উনি ঘরে ঢুকতেই আগন্তুক ছেলেটি অর্থাৎ দিলীপ উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে এসে প্রণাম করল। বলল, "আপনিই নিশ্চয়ই আমার মামাবাবু?" "এ্যাঁ, তার মানে তুমি তোমার মামাকে চেনো না? আর বলছ আমি তোমার মামা, এটা তোমার নাকি আপন মামারবাড়ি!" "কি করে চিনব বলুন, সে চেনার সৌভাগ্য আর আমার হল কোথায়? মাত্র আড়াই বছর বয়সেই বাবা-মা মারা গেলে কে আর আমায় মামারবাড়ি চেনাবে বলুন?" "কিন্তু বোম্বেতে তো আমার বড়দিদি থাকতেন, অনেককাল সেখানকার পাট চুকিয়ে চলে এসেছেন, অন্য দিদি বা বোনেরা কেউ তো বোম্বে থাকে না বা থাকত না!" "আমি এটাও জানি, আপনি আমার নিজের মামা নন, আমার মায়ের খুড়তুতো ভাই আপনি। আমার নিজের মামা কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না, তাই মামারবাড়ি বলতে আপনার এই বাড়িই বোঝে আপনার সব ভাগনা-ভাগনিরা। আপনার নিজের মায়ের পেটের কোনো বোন নেই, জেঠতুতো দিদিরা ও বোনেরাই আপনার নিজের বোনের মত"। বীরেনবাবু ভাবেন, সবই তো ঠিক বলছে ছেলেটি কিন্তু বোম্বেতে কে থাকে আমাদের?" এর মধ্যে খবর পেয়ে ওনার স্ত্রী প্রণতিদেবীও পায়ে পায়ে এসে হাজির হয়েছেন বসবার ঘরে।
দিলীপ আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করে, "আমি আপনার মেজদিদির ছেলে, আমার বাবার নাম অশোক মুখার্জী, মায়ের নাম.."। তাকে সবটা বলার সুযোগ না দিয়েই বীরেনবাবু বলেন, "তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে বাবা, অশোক মুখার্জী বলে আমি কাউকে চিনি না"। প্রণতি দেবী এতক্ষণ সব শুনছিলেন, এবার বলে ওঠেন, "দাঁড়াও দাঁড়াও, অশোক মুখার্জী তো আমাদের মানে তোমার মেজোজামাইবাবু। সে তো কবেকার কথা, মারাই গেছেন উনি আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে। দুজনেই একসঙ্গে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলে ওনাদের ছোট্ট ছেলে তখন বোধহয় আড়াই-তিন বছর বয়স, এমনই শুনেছিলাম। তাকে তার কাকা কাকিমা নিজেদের কাছে নিয়ে রেখেছিলেন, তারপর তো আর যোগাযোগও ছিল না, কিন্তু মেজদির নামটা মানে তোমার মায়ের নামটা বল তো"। দিলীপ বলে, "আমার মায়ের নাম সবিতা"। "ঠিক ঠিক, ঠিকই বলেছ", বলেন প্রণতিদেবী। বীরেনবাবু কিছুতেই নিঃসংশয় হতে পারেন না, "দাঁড়াও দাঁড়াও, এতেই হয় না। আজকাল দিনকাল ভালো নয়, এটুকু খবর জোগাড় করে যে কেউ ভাগনা সেজে এসে দাঁড়ালেই মেনে নেবো? প্রমাণ চাই না?" দিলীপের মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে যায়, "কি প্রমাণ দিতে হবে বলুন"। বেচারী মামারবাড়ি একটু আদরযত্ন পাবে এই আশায় কত কি ভাবতে ভাবতে এল ফ্লাইটে। সর্বক্ষণ চিন্তা করল, "মামা শুনেছি খুব ভাল, মামীমা আরো ভাল, কতদিন পর মা-বাবার মত আদর পাবো ওনাদের কাছে। এইসব সুখের কথা ভেবে এসে কিনা এমন জেরার সম্মুখীন!" মামীও এবার মামার তালে তাল মেলান, "ঠিকই তো, দিনকাল ভালো নয়, তুমিই যে সেই আমাদের মেজদির একমাত্র সন্তান, তা আমরা জানব কেমন করে?" দিলীপও ভেবে পায় না কি প্রমাণ দেবে সে নিজের পরিচয়ের সত্যতা প্রমাণ করতে। মামীমা আবার বলেন, "আচ্ছা মেজদির বাড়ি তো কানপুরে ছিল, বোম্বেতে তো নয়। সেখানে শুনেছিলাম জামাইবাবুর বিশাল বড় কাপড়ের দোকান ছিল, জমাটি ব্যবসা, সেসবেরই বা কি হলো, তুমিই বা বোম্বেতে কেন, এগুলো তো ভাবতে হচ্ছে"।
দিলীপ এবার বলতে থাকে, "আমারই বলতে ভুল হয়েছে, বলা উচিত ছিল কানপুর থেকে আসছি, তাহলে হয়তো আপনাদের বুঝতে সুবিধা হতো, আর এতো কনফিউশনও হতো না। আর বোম্বের কথা তো আপনাদের জানার কথাও নয়। বাবা-মা মারা যাবার পর কাকা কাকিমা আমায় কাছে টেনে নেন, সেখানে আমি খুবই আদরযত্নে মানুষ হয়েছি। কাকার কোনো সন্তান ছিল না বলে তাঁরা আমাকে সন্তানতুল্যই দেখতেন। কাকা চাকরি করতেন, তাই ব্যবসা তাঁর পক্ষে নিজের দেখা সম্ভব ছিল না। লোক মারফতই ব্যবসা চলছিল কোনোরকমে। এরমধ্যে বছর দুই বাদে কাকার প্রমোশন হলে বোম্বে ট্রান্সফার হয়ে যান। উনি তখন ব্যবসা বিক্রি করে সেই টাকা আমার নামে ব্যাঙ্কে রেখে দেন। কানপুরের পাট মিটিয়ে আমাদের নিয়ে বোম্বে চলে যান। সেই থেকে আমরা বোম্বেতেই থাকি। কানপুরের পৈতৃক বাড়িটা অবশ্য আছে এখনও। বছরখানেক আগে কাকা মারা যান, কাকিমা এখনো বেঁচে আছেন, কিন্তু তিনি খুবই অসুস্থ। চলচ্ছক্তিহীন, প্রায় শয্যাশায়ীই বলা যায়, আর বেশি দিন হয়তো বাঁচবেনও না। তিনিই আমায় পাঠালেন এখানে। আমার তো আর কেউ নেই, তাই ওনার মৃত্যুর পর যাতে আমি নিজের লোক বলতে অন্তত কাউকে পাই, তাই। আপনাদের যদি কোনো সন্দেহ থাকে আমি ফোনে কাকিমাকে ধরিয়ে দিচ্ছি, ফোনে কথা বলতে পারবেন উনি"। বীরেন বাবু এতক্ষণ সব শুনছিল ভ্রূ কুঁচকে, মনোযোগ দিয়ে। দিলীপ কারো মতামতের অপেক্ষা না করেই কাকিমাকে ফোনে ধরল, বলল, "মামাবাবু তো আমায় চেনেন না, কাকিমা তুমি দেখো চেনাতে পারো কিনা!" কাকিমা বহু পুরনো কথা বললেন যা বীরেনবাবুর স্মৃতিতে ভেসে উঠতে লাগল। এছাড়া কানপুরে ওনার খুড়তুতো ভাই রয়েছেন যিনি অনেকটাই জানেন এসবের আর দিলীপদের পৈতৃক বাড়িটা এখনও আছে যার নিচের তলায় ভাড়া বসানো। বছরে একবার করে কাকা গিয়ে থাকতেন কিছুদিন, দিলীপ খুব কমই গেছে সেখানে। কাকা মারা যাবার পর একদমই যাওয়া হয়নি। জানে সে ওখানেও ওর এক মামা থাকেন। এরপর কাকিমা বীরেনবাবুকে বলেন, "আপনি আপনার কানপুরের ভাই অজিতবাবুকে জিজ্ঞাসা করলে উনিও আপনাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারবেন"।
বীরেনবাবু নিঃসংশয় হবার জন্য ভাই অজিতকে ফোন করে সব জানতে চান। অজিতবাবু যা বললেন দিলীপের কথার সঙ্গে মিলে গেল কিন্তু তিনি বললেন, "দিলীপকে এখন দেখলে আমিও চিনতে পারব না। ওরা বোম্বে চলে যাবার পর আমার সঙ্গে তো আর যোগাযোগ রাখেনি, তবে যা বলেছে সবই ঠিকঠাকই বলেছে"।
এসব কথার মধ্যে ওনারা খেয়াল করেননি কখন বীরেনবাবুর দুই মেয়ে ও দুই ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে বসবার ঘরে এক এক করে। তারাও এতক্ষণ সব শুনেছে। তার মধ্যে ছোটছেলে বলে, "আরে তুমি তো ফেসবুকে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছো, ছোটপিসির ছেলে গৌরদার কমন ফ্রেন্ড দেখে তোমায় অ্যাড করেছিলাম, তুমিই রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলে"। এরপর গৌরকে ফোন করা হোলে সে কনফার্ম করলো, "বড়মামা দিলীপদা ঠিকই বলেছে, ও আমাদের মেজোমাসির একমাত্র ছেলে দিলীপ মুখার্জীই, তুমি নিশ্চিন্ত হতে পারো"। এরপর আর কোনো সংশয় থাকে না। দিলীপ ভাবে, মামারবাড়ির আপ্যায়নটা দারুণ হল, আদর খেতে এসে কি কান্ড!
Comments