পরকীয়া
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
বাসুলীর থানে কোনওমতে মাথাটা ঠুকে আসতেই হেঁসেলঘরে যে আজ চাল ফুরিয়েছে সেটা মনে পড়ল বলে তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফিরে এল মঙ্গলা। বাপ শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিল 'সর্বমঙ্গলা' সেটাই আর সব কিছুর সাথে ছোট হতে হতে 'মঙ্গলা'য় এসে দাঁড়িয়েছে।
এখন দুপুরবেলার মধ্যে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে দু'এক বাড়ি থেকে যা হোক দু'মুঠো চাল ভিক্ষে করে হলেও ঠিক আনতে হবে তাকে। সে নিজে উপোস করলেও বাচ্চাদুটোকে তো আর না খাইয়ে রাখা যাবেনা। অথচ সংসারের আসল তথাকথিত রোজগেরে একজনের সে ব্যাপারে হুঁশ নেই। এসব কথা ভাবতে বসলেই অভাবের এই সংসারে নিজেকে বড় অসহ্য লাগে আজকাল।
তার বর সুরেন মুনিশ খাটে জোতদারের জমিতে। সে পয়সা যা পায় তার বারো আনাই ভাটিখানায় ঢেলে আসে। সংসারে তাই নিত্যকার অভাব। মঙ্গলা'কে ছাড়াও ঘরে যে আরো দুটি শিশু আছে যার একটির সবে একবছর পেরিয়েছে আর সে এখন হামা টানতে শিখেছে বলে আড়াই বছর বয়সী বড়টির সাথে ক্ষিধে পেলে সেও তুমুল চিৎকার করে কাঁদতে শিখেছে সেসব সুরেন কখনো ভাবতে চায়না। তার ব্যর্থতাগুলোকে একমাত্র ভুলে থাকার উপায় হল দু'পাত্তর গিলে ঝিমাতে বসা।
............
পাড়ার মন্ডলদের বউটার সবে পাঁচ বছর হল বিয়ে হয়েছে। সে দেখতে শুনতে অতটা ভালো না হলেও তার যৌবনটি বেশ উদ্দীপক। আর এমনিতেও চেহারায় সে তেমন হলেও মনের দিক থেকে বেশ দয়ালু।
যদিও গতরখাকী আর বাঁজা মেয়েমানুষ এই দুই বিশেষণে পাড়ায় মুখরুচির উৎস হলেও তার মনের মধ্যে এখনো অমানুষের পরত পড়েনি। তার বর সদরে চাকরি করে বলে সেখানেই বেশীর ভাগ দিন থাকে। মাসান্তে নিজের দেশের বাড়িতে এসে কয়েকটি রাত্রির যন্ত্রণাময় নৈশকালীন রতিবিহার ছাড়া আর তার ঝামেলা বা বাকি অন্য কোনওকিছুতেই তেমন গা নেই।
এই তো গতমাসে সে যখন এসেছিল তখন একবার ধামসা ধামসির পর দাঁতে দাঁত চিবোতে চিবোতে বউকে নিজেই বলছিল,
"ধুসস্ লোকে দু'কথা বলে বলুক!ও তুমি যে বছর বিয়ানী হওনি বলে বেশ ডাঁসা আর ডবকা মেয়েছেলেই আছ সেটাই বা কম কি হে । দীনু কোবরেজ তো সেদিন কতায় কতায় বলছিল একটা কি দুটো বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে গেলে শুনিচি ওসবে নাকি রুচি চলে যায়...হে..হে !"
এই বলে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত দেখিয়ে তাকে তোষকের ওপর আবার একবার শুতে ইশারা করে।
স্বামীটি যদিও একদমই বোঝেনা তার বউটা বাঁজা হলেও কিন্তু তারও যে একটা নিভৃত মন আছে আর সেখানে সহজাত মাতৃত্বের আকুলতা কখনো কখনো এসে ঠিক ফুটে ওঠে।
তাই সেটাই হয়তো পড়শী মঙ্গলার বাচ্চাদের প্রতি ঠিকড়ে বেরিয়ে আসতে চায় বলে ওদের অভাবের সংসারে ভাতের চালটা আর মূলোটা ঠিক যোগাড় হয়ে যায়।
.........
ক'দিন হল বাসুলীর থানে লোকটা আস্তানা গেঁড়েছে। লোকে বলাবলি করছে নিশ্চয়ই ভেক ধরা গুন্ডা-বদমাশ। কিন্তু লোকটা বোবা। যদিও কথা বলতে পারেনা তবু তার দুটো চোখ স্বপ্নের মত এদিকওদিকে আসমানদারী করে কেবল।
এখানে এসে এমনিতে ভিক্ষান্নেই তার দিন কাটে। সে সর্বদাই তার একমাথা ঝাঁকড়া চুল ভর্তি মাথা আর দাড়ি গোঁফের জঙ্গলের ভিতর থেকে মুচকি মুচকি হাসে। যেন জানে, নিজেই আসলে সে যেন এই বাঙ্ময় পৃথিবী একটা অপার বিস্ময়।
............
দুপুরে ভাতের থালায় সামান্য শুক্তো আর ডালভাত চুড়ো করে মেখে নিয়ে মন্ডলদের বৌ'টা ওই লোকটাকে হাতছানি দিয়ে দরজার কাছে ডেকে নেয়। ওর বুড়ী শ্বাশুড়ি এতক্ষণে খাওয়ার পরে একটু ঘুমিয়েছে বলে এখন যেন একটু নিশ্চিন্তি!
লোকটা অস্ফূট আওয়াজে খুশির শব্দ করে গোগ্রাসে খেতে বসে। লোকটার উন্মুক্ত গা'টার দিকে চাইলে সবটা কেমন যেন শিরশির করে ওঠে। ভগমান সবাইকে কি সবটা দেন! ওকে অযথা দেহসৌষ্ঠব দিয়েছেন বলে আবার গলার আওয়াজটা নিজের কাছে জমা রেখে দিয়েছেন। মন্ডলদের বউটা ওর খাওয়া দেখতে দেখতে সবকিছু ভুলে ওকেই যেন একদৃষ্টে দেখতে থাকে আর থেকে থেকে শিউরে শিউরে ওঠে।
বউটা ঠিক বোঝে যে অযত্নের স্নেহদ্রবণের সেই গড়িয়ে আসা আর্দ্রতাটিকে, যা সে এতক্ষণে টের পেয়েছে তার মনের অন্দরমহলে। বড় এক বেআব্রু অপত্য টানের কাঙালপনা যেন।
.........
মঙ্গলা দরজা ঠেলে উঠোনে ঠিক তখনই ঢোকে। তার আজ ভাত জোটেনি। বাচ্চাদের খাইয়ে ওই চালটুকু রাত্তিরের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছে। একটু ঝরতি পড়তি যদি কিছু থাকে তারই খোঁজে সে মন্ডলদের ঘরে আসছিল।
দৃশ্যটার জন্য সে প্রস্তুত ছিলনা। পাড়ার লোকে তাহলে যা বলে মিথ্যে নয়। সদরে বর চাকরী করে বলে সেই সুযোগে ভেতরে ভেতরে তাহলে এই! তার গা ঘেন্নায় রি রি করে ওঠে। সে দেখে বাসুলীর থানের ওই বোবা ভিখিরি ছেলেটা আবেগে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সামনে একটু আগে শেষকরা ভাতে থালাটা অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। আর তার মাথাটা শক্ত করে নিজের বুকে চেপে আছে মন্ডলদের বৌ। আজ যেন তার কাপড়চোপড় যেন একটু বেশি যেন অবিন্যস্ত। আচ্ছা! তাহলে বাঁজা মেয়েছেলে বলে লুকিয়ে লুকিয়ে এত্তসব !
মঙ্গলা এবারে দেখে বউটা এতক্ষণ নিজেরও চোখ বন্ধ করে ঠোঁটদুটো কামড়ে চেপে ধরে আছে। যদিও তার চোখে একইরকম জলের জোয়ারের টান। মঙ্গলা ব্যাপারটা আরো ভাল করে দেখবে বলে আর একটু এগিয়ে এসে লুকিয়ে থাকল।
যদিও পরকীয়া সম্বন্ধের আপাত লোকাচারটি ওর মনে থেকে থেকেই বিবমিষা জাগাচ্ছে যদিও তাও প্রবল কৌতুহলে সে তার থেকে চোখ সরাতে পারছেনা।
কিন্তু সে সবটা এত কাছ থেকে দেখেও জানতেও পারলনা যে ভৈরবীর বানে আজ থেকে দশ বছর আগে যাদের সর্বস্ব ভেসে গিয়েছিল আর তা থেকে মরতে মরতে বাঁচার জন্য সবাই যে যার মত যেদিকে ছিটকে গেছিল তারই শেষাংশটা এতবছর পরে আজ নতুন করে অভিনীত হচ্ছে।
সেদিনের হারিয়ে যাওয়া তার সেই বোবাকালা ভাই'টিকে ঠিক দশবছর পর যে আবার ফিরে পেতে পারে তা আজ ঘরে দুটো সামান্য ভাত নেহাৎ বেশী না চড়লে কেই বা সেটা মন্ডলদের বাঁজা বউটাকে এসে পড়ে এরকম ভাবে জানান দিয়ে যেতে পারত?
চোখের জলের ভাষা হয়না ঠিকই কিন্তু যে চোখ থেকে সত্যি সত্যি তা ফেলতে পারে সে জানে রক্ত আর চোখের সেই জল দুটোরই স্বাদ আসলে নোনতা।
.................
খুট্ করে কোথায় যেন একটা শব্দ শুনতে পেল মঙ্গলা। আবছা পড়ন্ত বিকেলের আলো ততক্ষণে মরে এসেছে। পুরো ঘরটা জুড়ে হঠাৎ যেন শুনশান্ স্তব্ধতা এনে কে যেন ঢেলে দিয়ে চলে গেছে। মনে হচ্ছে এই পুরো জায়গাটাকেই বাতিল করে দিয়ে সবাই যেন সব পিছুটান ছেড়ে দিয়ে বহু দূরে চলে গেছে। একবার ওর মনে হল হঠাৎ এই অসময়ে মন্ডল বউ এর শ্বাশুড়ী আবার কোথায় গেল? সে মুখরা বুড়ি কি এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে?
আর সেই অবসরে যারা আপ্লূত আবেগের আড়ালে নিজেদেরকে ধরে এতক্ষণ জাপটাজাপটি করছিল ... তারাই বা দু'জনে সব কোথায় গেল?
দরজাটা আলতো হাতে বন্ধ করে উঠোনে যেই পা রাখতে যাবে অমনি ওর মাথায় কি যেন এসে ঠোকা খেয়ে একটু দুলে গেল। ওপরে তাকিয়ে যা দেখল তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। একটা হাড়হিম করা ভয়ে ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। এটা ও কি-ইইইইই দেখছে! সর্বনাশ ! ওই বোবাকালা লোকটাও তো আপনা আপনি কখন কর্পূরের মত সবকিছু থেকে যেন উধাও হয়ে গেছে!
ও নিজে আড়ালে থাকলেও একটু আগে এর সবটাই তো দেখছিল। এবারে ওর সামনে ওর এই একটু আগে দেখা সেইসব দৃশ্যায়ণ যেন কেবল স্বপ্নদৃশ্যের মত এসে সামনে ভাসতে লাগল আর নেচে নেচে দুলতে লাগল।
জ্ঞান হারাবার আগে মঙ্গলা দেখেছিল কড়িকাঠ থেকে আঁচলের ফাঁস গলায় দিয়ে মন্ডল বউ এর নিষ্প্রাণ দেহটা ঝুলে আছে। বউটার কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের শুকনো হয়ে আসা ক্ষীণ ধারাটা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে এটা অন্তত দু- দিনের বাসি মরা!
এরপর সর্বমঙ্গলার দু'চোখে অবশেষে আঁধার ঘনিয়ে আসে। তার মানে এতক্ষণ ধরে যা দেখল তা রক্তমাংসের মানুষের জড়াজড়ি নয়?
জ্ঞান হারাবার আগে পর্যন্ত এই প্রথমবার মন্ডল বৌ'এর জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছুর জন্য খুব ওর কষ্ট হচ্ছিল। মঙ্গলার দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে আসতে ও কিন্তু টের পাচ্ছিল যে ভালবাসার সম্পর্কে খুব জড়িয়ে গেলে বা অহেতুক কাউকে উজাড় করে ভালবাসলে তার প্রতিফলে সেই ভালবাসার জনটির কাউকে বা দু'জনকে বোধহয় শেষমেশ ঠিক মরতেই হয়!
তাও যদি সে জানতো! এই মরণবিচ্ছেদ আর তার আসঙ্গটির কাঙালপনা মরণের পরেও ঠিক জেগে থাকে... মন্ডল বৌ-এর মত একবার হারিয়ে আবার তাকে আবার খুঁজে পাওয়া সেই রক্তের টান হয়ে।
তাই ভাই বোনের মত তা নেহাত নিষ্পাপ সম্পর্ক হলেও অজানা চোখে সেটা সর্বদাই পরকীয়া হয়ে থেকে যায়।
Comments