ধুলোমুঠির গান
অয়ন ঘোষ
৬
"ধরার ধূলিতে যেমন ফাগুন আসে, তেমন করে তুমি আসো না তো"
আচ্ছা কে আসবে, কারোর আসার কথা ছিল কি? বা আমার কোথাও যাবার ছিল কি? মনে তো নেই আমার ওসব মনে তো নেই। দেখেছেন এই এক হয়েছে এখন এই কদিন ফিরতি পথে বেরিয়েই সব যেনো কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই আমার খুব ভুলো স্বভাব।
কোনো কালেই তারিখ মনে রাখতে পারি না। বিয়ের তারিখ জানুয়ারী ২০ না ২১ তা নিয়ে খালি গোল বাঁধে আর গিন্নীর কাছে হেনস্থার এক শেষ। মেয়ের হ্যাপি বার্থ ডে নিয়েও একই অবস্থা, সেখানেও মুখ চুন করা ছাড়া উপায় নেই। নিমন্ত্রণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দিনের আগে বা পরে গিয়েছি, এমন অনেক বার হিয়েছে। আসলে আমি যখন নিমন্ত্রণের কার্ড পড়ি, তারিখ পড়ি না। তাই যারা আমায় চেনেন, নিজেরাই অনেক বার মনে করিয়ে দেন। ট্রেনের টিকিট যে কতবার ভুল দিনে কেটেছি, তার কোনো শেষ নেই। তবুও সংসার সমাজ যে আমাকে মেনে নিয়েছে, এর জন্য আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। আর এখন এই অলীক ট্রেনের যাত্রী হিসেবে এই দেশে এসে কোনটা কি বার জানারও প্রয়োজন পড়ছে না, তাই ওই বার তিথি নিয়ে আপাতত কোনো সমস্যা নেই। দিব্য আছি, রয়ে বসে শুয়ে। কিশলয়ে পড়েছিলাম, থালা ভরে এক রাশি/ ফল কেটে দিল মাসী। তা এখানে মাসির জায়গায় গৃহিণী আছেন। প্রয়োজন মতো জুগিয়ে যাচ্ছেন আর আমি নাকে চশমা এঁটে দু'এক লাইন লিখে বা পড়ে ভাবছি জগৎ উদ্ধার করে দিলাম।
এছাড়া দেওয়াল চিত্রের অফিসে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছি, যতদিন না চিত্রগুপ্ত আমার ফাইল খুলছেন। সেখানে এক রঙিন শুভেচ্ছার পৃথিবী। কতো রকমের হোমটাস্ক, শাড়ি থেকে নেলপালিশ, কান্না থেকে হাসি সবেরই চ্যালেঞ্জ চলছে। আর দেবের সিনেমা দেখার পর থেকে, আমি মাঝে মাঝেই মুখ ফস্কে বলে ফেলি, চ্যালেঞ্জ নিবি না...। তারপর আমার মতো নব্য বা প্রাজ্ঞের কলমচি সেখানে সদা উপস্থিত, বিতরণ যোগ্য জ্ঞানের ভান্ডার নিয়ে, ফলে এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত আর কি নয় তার ওপর আপাতত দুটি এম ফিল গবেষণা পত্রের মতো তথ্য আমার সংগ্রহে। আমিও কিছু ছেড়েছি বাজার বুঝে, কিন্তু নিজে মানছি কি না, সে কথা আর নাই বললাম। আমি তো শ্রী রামকৃষ্ণ নই, যে আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও এর চাপ আছে। বলে দিলাম, মানছি কি না, কে দেখছে। চারিদিকে লাইভ এর ছড়াছড়ি কবিতা থেকে নাটক ( প্রকৃত অর্থে) সবই হচ্ছে, সাথে আউ, ফ্যাবুলাস, ফ্যান্টাবুলাস, আহা থেকে বাহা বিশেষণের পর বিশেষণ, বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে গর্ত করে দিয়েছি দেওয়ালে। সুতরাং ধর্ম, দর্শন, সমাজ রাজনীতি, শিক্ষানীতি কি কঠিন কঠিন বিশ্লেষণ একবারে সিমিনি সেক্টর গোত্রের। কিন্তু ঘড়িকে ১২ টা বাজা থেকে কে কবে বিরত করতে পেরেছে, একমাত্র ব্যাটারি খারাপ হওয়া ছাড়া, সুতরাং বারোটা সে বাজবেই আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মন খারাপের ফন্দি ফিকির।
কিন্তু যে টা বলছিলাম, দাঁড়ান মনে করে নিই। হ্যাঁ মনে পড়েছে কে আসবে? আসলে আমাদের গোটা জীবনটাই তো অপেক্ষার রূপকথা। সারা জীবন ধরে আমরা প্রিয় পায়ের শব্দ মন লাগিয়ে অনুবাদ করি সময়ের সুড়ঙ্গে মুখ ডুবিয়ে। যদিও জানি অনুবাদ খুব কঠিন একটা কাজ বা সবকিছু অনুবাদ সম্ভব নয়। এক ঠোঁটের স্বাদ অন্য ঠোঁট নিলেও তার সব নরম অনুভূতি কি সে পারে অনুবাদ করতে। একটা ভালো আগামীকাল এর জন্য প্রতিদিন আমরা তৃষা ভরে অপেক্ষা করি আর চোখের সামনে ভালোবাসা না পেতে পেতে ঝড়ে যায় আজকের দিনটা। চিরকালই মেছুরের কাছে, যে মাছটা ফস্কে যায় সেটা সবচেয়ে বড় আর যা পাইনা বা হারায় সেটা দামি। সেই অবস্থা আমাদেরও, একটা খুব খেলুড়ে tomorrow আমাদের মাথায় গাধার টুপি পড়িয়ে দিয়েছে আর সেই টুপি পড়ে আমরা অহর্নিশ ছুটে চলেছি। ছুটে ছুটে ক্লান্ত মন, ভেঙে পড়া শরীর তবু মোহ গেলো না। সাধে কি আর Carpe Diem দর্শনের প্রবক্তারা বলেছিলেন gather ye rose buds while you may কিন্তু কে শোনে কার কথা! স্বয়ং রবিবাবু পর্যন্ত বললেন, "আজকের দিনের ঔদার্যের মধ্যে কার্পণ্য আশঙ্কা কেন!" আমরা মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী আজকের দিনটা মাঠে মেরে আগামী ৩০ বছর পরের জন্য সুখী জীবনের গল্প কিনে রাখছি।
(ক্রমশ..)
Comments