পুজোর স্মৃতি
সুব্রত নন্দী মজুমদার
ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি,
মিলনের উৎসবে তাই ফিরায়ে দিও আনি।
সারাটা জীবন আমরা স্মৃতিসুধায় আমাদের পাত্র ভরে রাখি, যা পরবর্তীকালে আমাদের মনে অম্লমধুর অনুভূতির সৃষ্টি করে। স্মৃতি সুখের ও হতে পারে আবার দুঃখের ও হতে পারে। সে রকম এক স্মৃতির কথা আজ শারদীয়া পুজোর আগে আমার মনকে নাড়া দিয়ে গেল।
বাঙ্গালী সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে যে সমস্ত অনুষ্ঠান, তার মধ্যে দুর্গাপূজা অন্যতম। ধনী দরিদ্র, বাল, বৃদ্ধ সব বয়সের নরনারী সারা বছর ধরে ঐ উৎসবের দিন গোনে। এমন কি ভিন্নধর্মীয় বা ভিন্নদেশীয় মানুষ আন্তরিক ভাবে এই উৎসবে অংশ গ্রহণ করে। তাই তো একে বলে মহোৎসব।
বছরের পর বছর এই উৎসবের স্মৃতি প্রতিটি মানুষের মনে বিভিন্ন রকমের অনুভূতির সৃষ্টি করে। কোন কোন স্মৃতি এতটাই মনের গভীরে প্রবেশ করে থাকে যে তা আজীবন মানুষ মনে রাখে। এরকম একটা স্মৃতির কথা আজ বলব যা আমার জীবনে ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে।
আমাদের বংশ জমিদার বংশ। স্বচক্ষে দেখার সুযোগ ঘটেনি, কিনতু বাবা কাকার কাছে শুনেছি আমাদের দেশের বাড়িতে প্রতি বছর ঘটা করে দুর্গাপুজো হত। এরকম ও শুনেছি যে প্রপিতামহদের আমলে কালীপুজোতে মোষ বলি হত। শুনেছি দেশের বাড়ির চন্দিমন্ডপের সামনে এখনো পশুবলির রক্তের দাগ দেখা যায়।
আমার বাবা ,কাকা এবং জ্যেঠা তিন ভাই ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকুরিরত হয়ে আজীবন শহরেই কাটিয়ে দেন। অদ্ভুত এক সমাপতনের ফলে তিনজনেই একই শহরে চাকরি পেয়ে যান। ফলে আমাদের দেশের বাড়িতে যাবার সুযোগ ঘটে নি। তবে বাবারা তিন ভাই মিলে প্রতিবছর দুর্গাপুজো ও কালীপুজো করতেন। ছেলেবেলা থেকেই আমারা সেই উৎসব মহা সমারোহে কাটিয়েছি। বাবারা তিন ভাই একই শহরে থাকার ফলে এবং তিনজনেই কাছাকাছি বাড়ি করেন। তাই আমাদে খুড়তুতো, জ্যেঠতুতো ভাইদের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল।
বাবা, কাকা ও জ্যেঠা তিন ভাই গত হওয়ার পর তিনটি পরিবারেই কি রকম ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কারণ বোনেদের অনেকের বিয়ে হয়ে দূর দেশে চলে যায় আর ভাইয়েরাও পড়াশুনা সাঙ্গ করে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি দেয় চাকরিসূত্রে।
সেই রাম ও নেই, সেই অযোধ্যা ও নেই। প্রথমে চিঠিপত্র মারফত (কারণ সেই সময় মুঠিফোন তো দূরের কথা, সাধারণ ফোন ও সেভাবে চালু হয় নি) কিছুটা যোগাযোগ থাকত, ক্রমশঃ তাও ক্ষীণ হয়ে এল। এমন কি কে কোথায় থাকে তাও ভাল করে জানতাম না। আমি ও কলকাতা এসে যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে সেখানেই স্থায়ী হয়ে গেলাম।
আমার এক খুড়তুতো দাদা, যাকে আমরা ফুলদা বলে ডাকতাম রয়ে গিয়েছিল বাড়িতেই। ফুলদার মারফত মাঝে মাঝে অন্যান্য ভাই বোনদের খবর পেতাম, ঐ ছিল একমাত্র যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম।
আমি বলছি প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। সালটা খুব সম্ভবত ১৯৮০ কি ১৯৮১। এখন আমি আমার স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কলকাতার পুজো উপভোগ করি। সে বছর পুজোর প্রায় ছ’মাস আগে হঠাৎ একদিন ফুলদার একটা চিঠি পেয়ে আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়লাম। ফুলদা লিখেছে, ‘ভাই সোমু (আমার ডাক নাম), বাবারা চলে যাবার পর আমাদের ভাইবোনেদের একসাথে মিলিত হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমার ইচ্ছে অন্তত একবার আমরা সব ভাই বোন মিলে আমাদের বাড়িতে দুর্গা পুজো করি। আমি ঠিকানা জোগাড় করে সবাইকে চিঠি লিখেছি। তোমার ছেলে মেয়েদের ও আমরা কেউ দেখিনি। এই সুযোগে একটা পুনর্মিলন হতে পারে এবং আমাদের ছেলেমেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। আমি নিশ্চিত তুমি সবাইকে নিয়ে আসবে। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় আছি।‘
চিঠিটা আমার স্ত্রীকে দেখাতে সেও খুব খুশি। সে কলকাতার মেয়ে, বিয়ের পর কুড়ি বছর হয়ে গেল, শ্বশুরের ভিটে দেখে নি। ফুলদাকে জানিয়ে দিলাম যে আমরা অবশ্যই আসব।
ফুলদা জবাবে লিখল, ‘তোমাদের বাড়িতে কেউ থাকেনা বলে অপরিষ্কার হয়ে আছে। আমি পরিষ্কার করিয়ে রাখব যাতে তোমাদের থাকতে অসুবিধা না হয়।‘
সেখানে গিয়ে আমার কলকাতার স্ত্রী আনন্দে অভিভূত হয়ে গেল। তিন সন্তানের মা হয়ে এই প্রথম তার শ্বশুর বাড়িতে পদার্পন। তাই তিন সন্তানের জননী হয়ে ও সে অভ্যর্থনা পেল নতুন বউয়ের মতই। আমাদের তুতো ভাই বোন মিলে সংখ্যা কিছু কিম নয়। তার উপর সকলের ছেলেমেয়ে, বাড়িতে আনন্দের হাট বসে গেল। সবাই মিলে সারাক্ষন হৈ চৈ করছে। বড়রা দাদা, বউদি, দিদি , বোনেরা মহা আনন্দে পুজোর জোগাড়ে ব্যস্ত। চারদিকে আনন্দের ফোয়ারা।
এক সাথে অঞ্জলী দেওয়া, প্রসাদ খাওয়া সে এক বিরাট ব্যাপার। মেয়েরা, বিশেষ করে সব বউরা রান্না করা, সবজি কাটা, মাছ কাটা এই নিয়ে সারাক্ষন ব্যস্ত। সবার উপরে নজর রাখা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দিকে। তাদের চান খাওয়া ঠিক মত হচ্ছে কি না।
ছোটরা দল বেঁধে নিজেরাই গান বাজনার আসর বসিয়েছে, যে যেরকম পারে। চারদিকে আনন্দের ঢেউ। অঞ্জলী দেওয়া, প্রসাদ খাওয়া সে ও মহা উৎসব। দুপুর বেলা পাত পেড়ে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া। রাত্তিরেও তাই। অধিক রাত পর্যন্ত জেগে সবাই মিলে মজা করছে। দেখতে দেখতে পুজোর কটা দিন কেটে গেল। আজ বিজয়া দশমী। ঠাকুর বিসর্জন অনেক দেখেছি, কিন্তু আমার স্ত্রী কেন আমিও প্রত্যক্ষ ভাবে কোনদিন বিসর্জনে অংশ নিই নি। আমার স্ত্রী খুব উত্তেজিত। আমাদের বাড়ি থেকে নদীর দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। লরিতে ঠাকুর বসিয়ে সবাই মিলে হেঁটে চলল বিসর্জন দিতে।
নদীর ঘাত পর্যন্ত নেমে সবাই বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম দল বেঁধে। তারপর কোলাকুলি, প্রণাম, মিষ্টি খাওয়ার ধূম। হাঁড়ি ভর্তি রসগোল্লা আর ঝুড়ি ভর্তি নিমকি নিমেষের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। হঠাৎ ফুল বউদি চিৎকার করে উঠলেন, ‘শমিত কৈ? ফুলদার ছোট ছেলে শমিত। সবাই ব্যস্ত হয়র পড়ল, তাইতো শমিত কোথায়? খোঁজ খোঁজ, সকলে মিলে খুঁজতে লাগল। শমিত কোথাও নেই। হঠাৎ আমার ছেলে চিৎকার করে উঠল, ‘এই যে শমিত।‘ দেখা গেল এই হৈ চৈ এর মধ্যে পাঁচ বছরের শমিত ক্লান্ত হয়ে প্যান্ডেলের মধ্যে এক কোনে ঘুমিয়ে আছে।
পুজো, পুজো ! পুজো শেষ হয়েও হল না। তার ক’দিন বাদেই লক্ষ্মী পুজো। লক্ষ্মী পুজো ও কিছু পরিমান অল্প হলেও বেশ সমারোহের মধ্যে শেষ হল।
ফুলদাকে ধন্যবাদ যে এত সুন্দর করে আমাদের পুনর্মিলন উৎসবটা পরিচালনা করল। এবার আমাদের ফেরার পালা। এতজন ভাইবোন মিলে একসাথে কয়েক দিন কাটান আর কোনদিন হবে না। আজ প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেল, আর হয় ও নি। তবে ঐ ক’টা দিনের সুখ স্মৃতি আমার মনের মনিকোঠায় আজ ও সঞ্চয়িত হয়ে আছে এবং আমৃত্যু থাকবে।
সমাপ্ত।।
Comentários