অজয়পাড়ের উপকথা
সুদীপ ঘোষাল
ষষ্ঠ পর্ব
সুস্থাবস্থার সময় মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস এই কবিদের চেয়ে অনেক কম পেয়েছেন কবি নজরুল।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কবি নজরুল চলে যান করাচিতে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি করাচির মাটি। তিনি চলে এলেন কলকাতায়, কমরেড মুজাফফর আহমদের সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে এক সঙ্গ বাস করতে থাকেন। ১৯২০ সালে নজরুল ইসলাম ও মুজাফফর আহমদ দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশ করেন। এ কে ফজলুল হক ছিলেন প্রধান পরিচালক। মুজাফফর আহমদ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলে নজরুল সম্পাদিত অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ বের করেন। তারপর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘লাঙল ‘প্রকাশিত হয়। লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বিদ্রোহী কবির সাম্যবাদী চরিত্র প্রকাশিত হয়। তখনই ঘোষিত হলো মানবতার জয়গান।অপরূপা কবির সম্বন্ধে বলে, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত সাম্যবাদী কবিতাগ্রন্থ সমাজতন্ত্রী বাংলা কবিতার দরজা খুলে দিল।
৩০ ও ৪০-এর দশকে সাম্যবাদী কবিতার যে প্রবাহ, তার পথিকৃত কাজী নজরুল ইসলাম। চৌদ্দশো বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল ইসলামই হিন্দু মুসলমান মিলনের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করলে ও সাহিত্যে তা আদৌ যথাযথ ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ব্যক্তি জীবনেও নজরুল তাঁর ব্যবধান রাখেননি। বিয়ে করলেন হিন্দু মেয়ে। তাঁর পুত্রদের নাম রাখলেন হিন্দু মুসলিম ঐতিহ্যকে সমান করে। নজরুল হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের আচার থেকে অন্তর আত্মা অবধি ব্যবহার করেছেন। শুধু কবিতায় নয় গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, গানে সব ক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতার পরিচয় মেলে। পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয় ১৮৯৯ সালের ২৫শে মে। কাজী ফকির আহমেদের ঘরে সেদিন খুশির আলো ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর ঘরে জন্ম নিয়েছে ঘর আলো করা ছেলে। মা জাহিদা খাতুন খুব খুশি।
তাঁরা ছেলের নাম রাখলেন দুখু। দুখুর বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক। তাঁর ভবঘুরে বাল্যকাল আর তাঁর স্কুল শিক্ষা বেশ ভালোই কাটলো। তারপর লেটো দলে গান গাইলেন তিনি। সৈন্যবিভাগেও কাজ করেন। কিন্তু তাঁর অন্তরে তো কবিতার জয়গান বাজে অন্তর জুড়ে। জাতপাতহীন এক সমাজ গঠনের স্বপ্ন ছিলো তাঁর মনে।দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'বল বীর বল উন্নত মম শির,...যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না -বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত!'তাঁর নাম হলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যাঁর গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে।তিনি জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারের দুখু মিয়া হয়ে। আর মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। মাঝে ৭৭ বছর জুড়ে ছিল সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার এক বিশাল ইতিহাস। সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর একটি কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন ছিল - 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।'
অল্প বয়সে স্থানীয় মসজিদে তিনি মুয়াজ্জিনের কাজ করেছিলেন। কৈশোরে ভ্রাম্যমাণ নাটক দলের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে সাহিত্য, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে বাল্যকালে খানসামা ও চায়ের দোকানে রুটি বানানোর কাজ করেছেন।ভক্তি সংগীত ও প্রেম সংগীত যার কথা আগে বলেছি সেগুলো কিছুই স্থায়ী মূল্য আছে সে যাই হোক তাঁর প্রসিদ্ধ কাব্য কবিতা কালক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে যাবার আশংকা থাকলেও একদা ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা আবির্ভাব হয়েছিল এবং সে প্রয়োজনকে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের দ্বারা সার্থক করে তুলেছিলেন তার স্বীকার করতেই হবে বস্তুত রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা কণ্ঠে ধারণ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে। কবি নজরুল ইসলামের শেষ সমাধি বাংলাদেশে শায়িত আছে।কবি নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। অবশ্য তিনি উভয় বাঙালি কবি। শুধু ভৌগোলিক বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ নয় পৃথিবীর যেখানে বাংলাভাষী রূপে যারা বাস করেন তিনি তাদের আত্মার আত্মীয়, পরমাত্মীয় এবং স্মরণীয় কবিরূপে সম্মানীত।
অপরূপার বক্তব্যের পরে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তারপর নরনারায়ণ ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। সভার পাশে রান্না হত খিচুড়ি, তরকারি আর টক। পূর্ববর্ধমান জেলার লোকেরা টক খুব ভালবাসেন।
আমাদের নবগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পটুয়াপাড়া গ্রামে কয়েকঘর পটুয়াশিল্পী বাস করেন।মাথায় ঝাঁকড়া চুলের বীরবাহাদুর বললেন, আমরা, পটুয়ারা অনেকে সঙ্গীত সহযোগে পটচিত্র দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। গানের তালে তালে দর্শক-শ্রোতাদের পটচিত্রের আখ্যানভাগ বুঝিয়ে দিই।রামায়ণ,মহাভারত আর বেদ,উপনিষদের কিছু কাহিনী নিয়ে রচিত আমাদের পটচিত্র। এখন সাময়িক ঘটনার কিছু ছবি আমরা আঁকি।
(ক্রমশ...)
Comments